Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গ্রুপ থিয়েটারের উড়ো পায়রা

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

॥ এক ॥

‘দারুণ খবর! যাত্রায় চানস পেয়েছি। মাস গেলে বাইশ শো টাকা! মোটাসোটা ডেইলি অ্যালাওয়ানস! ট্যাকসি অথবা প্রাইভেট কার! কাল থেকে আর তোদের সঙ্গে দেখা হবে না!’ শৃঙ্গবিজয়ী পর্বতারোহীর উত্তেজনায় আত্মহারা শুভ্র একদমে কথাগুলো বলেই দুর্লভ সিগারেটের দুর্মূল্য প্যাকেট ছুঁড়ে দিল তার থিয়েটার দলের বন্ধুদের দিকে- বিনিময়ে ওদের বিপুল অভিনন্দন প্রত্যাশা করে।

অন্ধকার গলির ভেতর সাইকেল মেরামতি দোকানের লাগোয়া আট-বাই-ষোল চুনবালিঝরা, ইঁটের দাঁত বার করা ঘরখানায় তখন মোমবাতির নৃত্যরত আলোছায়া কাড়াকাড়ি করে জনাকুড়ি ঘর্মাক্ত যুবক নিবিষ্ট মনে এমন সব সন্দেহজনক কাজে মেতে আছে, বাইরের কারোর চোখে হঠাৎ মনে হবে, বুঝিবা এটা এই শহরের সমাজবিরোধীদের একটা আখড়া। যে জানে সেই কেবল জানে, এখানে চলে নাটক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এখানেই নিরন্তর শিল্প বুদ্ধি আর সমাজবোধের লৌহচক্রে শান দিয়ে থিয়েটার নামক অভিনয় মাধ্যমটিকে বানানো হয় একটি সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর অস্ত্র ... যে ভীষণভাবে ঝলমলিয়ে উঠতে পারে এই সময়ের যতো নোংরামি ভণ্ডামি অবিচার আর অনাচারের মাথার ওপর। লড়তে পারে মানুষের চৈতন্যের কলুষমুক্তির জন্যে। ... রাত পোহালে দলের নতুন নাটক নামবে। ঘর জুড়ে চলছে তারই আয়োজন।

অরণ্য, শ্যাম, শক্তি, মানব, চারজনে মিলে নিজেদের মধ্যে লোফালুফি করে যে যার ডায়ালগ ধরাছাড়া সড়গড় করছিল ... শুভ্রর কথায় ক্যাচ-ফসকানো ক্রিকেটারের মতো বোকা চোখে এ ওর মুখের দিকে চাইল। ‘যাত্রায় যাবি মানে?’ গা ঝাড়া দিয়ে উঠল অরণ্য- ‘তোর অতো বড় রোলটা এখন শেষ মুহূর্তে করবে কে! ডুবিয়ে দিয়ে যাবি নাকি?’

ওদের পাশেই লিস্ট মিলিয়ে নাটকের রিকুইজিশান গোছাচ্ছিল জয়ন্ত আর শিবেন। হাসতে হাসতেই আগুনটা খুঁচিয়ে দিল জয়ন্ত ... বাইশ শো টাকা মাইনে ছেড়ে তোর সঙ্গে নাচবে নাকি? শুভ’র পেছনে বসে সস্তায় কেনা পরচুলটা স্পিরিট দিয়ে পরিষ্কার করছিল শংকর। থেমে গেল। ... ‘এটা তো শুভ্র’র মাথার মাপে কেনা। আর কি এটা পরিষ্কার করার দরকার আছে কোনো?’

সন্দেহ অতিদ্রুত ঘরের মধ্যে জাঁকিয়ে বসল। সত্যি যদি শুভ্র যাত্রাদলে নাম লিখিয়ে এসে থাকে, তবে তো এ নাটকের এখানেই ইতি। শুভ্র’র গানের গলা অসাধারণ! ওকে মাথায় রেখেই এই গান-প্রধান নাটকটা বাছা হয়েছে। এখন চট করে ওর জায়গায় একজন সুগায়ক অভিনেতা খুঁজে বার করা ... বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটারের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। সৌমেন, বাবলি, নোটক, মাথায় হাত দিয়ে বসেছে। এক রাশ টাকা খরচ হয়ে গেছে নাটকটার পেছনে। গাদা গাদা কাঠ কিনতে হয়েছে সেট বানানোর জন্যে, পোশাকপত্তর বানানো হয়েছে, শিক্ষক এনে নাচ তোলানো হয়েছে, বাদ্যযন্ত্রী, আলোকশিল্পী, মহিলা শিল্পী, সকলকেই কিছু কিছু অগ্রিম দেওয়া হয়েছে ... মনে হচ্ছে সব জলে গেল! পাঁচ মাসের এতো আয়োজন সবই যে পণ্ডশ্রম। রাগে শুভ্র’র দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসল নোটন।

ঘরে জায়গা হয় না। রাস্তায় ফেলে কাঠ চেরাই করছিল অজয়, অধীর, সমুদ্র, দুলাল। অফিস কামাই করে চারদিন ধরে চলছে এই সেট বানানোর কাজ। সেই কাজটাই এখন কোনো কাজে লাগছে না শুনে, অজয় এমন বিশ্রীভাবে শুভ্র’র দিকে ঘুরে দাঁড়াল, মনে হল পারলে হাতের ঐ করাতি দিয়ে এখুনি শুভ্রকেই না চিরে ফেলে!

‘অপরচুনিস্ট! কেরিয়ারিস্ট!’ সোজাসুজি আক্রমণ করল লোকনাথ, ‘... এসব উড়ো পায়রাদের নিয়ে থিয়েটার করা যায় না ... আন্দোলন করা যায় না।’ সবাই জানে লোকনাথ তার বিশ্বাসের ব্যাপারে কট্টর এবং প্রখর। তবে তার আজকের জ্বালাটা অন্যখানে। সম্প্রতি কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, দেশের সিগারেট কোম্পানিগুলো হঠাৎ শহরের গ্রুপ থিয়েটারের মস্ত পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছে। বহুদলের পাবলিসিটির ভার নিচ্ছে তারা। লোকনাথও এমনি একটা কোম্পানিকে ভাজিয়ে একরাশ পোস্টার ছাপিয়ে এনেছে। এখন নাটক যদি সত্যিই বন্ধ হয়ে যায়, অনুগ্রহদাতার কাছে মুখ রাখা কঠিন হবে তার।

বাতিগুলোর মোম বেশ খানিকটা ঝরে গেছে। সম্রাট কণিষ্কের কবন্ধের মতো দেখাচ্ছে আধপোড়া মোমের ধড়গুলোকে। সবাই যে যার কাজের হাত গুটিয়ে নিয়ে গুম হয়ে বসে আছে। দারুণ খবরটা শুনিয়ে গোটা দলটাকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে দিয়েছে শুভ্র।

শুধু অসিতকেই দেখা যাচ্ছে অচঞ্চল। খুব ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। যতো যাই কিছু হোক, সেক্রেটারির কর্তব্য সে কখনো ভোলে না। হাত বাড়িয়ে প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট তুলে নিল, নাকের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তামাকের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বলে- ‘তিন মাসের চাঁদা আর গত বছরের টিকিট ‘পুশে’র একশো আট টাকা তোর কাছে পাওনা আছে শুভ্র। যাত্রা’য় যাবার আগে সব মিটিয়ে দিয়ে যা ভাই। এ মাসের ঘর ভাড়া দিতে হবে।’
রাগে দুঃখে ঘৃণায় তখন কেঁপে উঠল শুভ্র।

॥ দুই ॥

কী ভাবছ শুভ্র, আমরা খুব ছোট লোক, তাই না? বন্ধুর সাফল্যে কনগ্রাচুলেট করি না, সুদখোর মহাজনের মতো বকেয়া পাওনাগণ্ডার তাগাদা সারি। ভাবছ বোধহয় আমরা তোমার সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত, অথবা যাত্রা নামক অভিনয় শিল্পমাধ্যমটির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। দেখ শুভ্র, অন্যের বেষ্পতির দশায় বুকের ভেতরটা যে টনটন করবে না, এমন মহাপুরুষ আমরা কেউ না। তবে কিনা যাত্রায় না গিয়ে তুমি যদি বড় একটা চাকরি নিয়ে বিদেশ যাত্রা করতে, তখনো আমাদের মুখগুলো এমন কালো হয়ে উঠত। তোমার মনে আছে বেকার দীপক যেদিন চাকরি পেল, সেদিনও আমরা এমনি জবুথবু হয়ে পড়ে ছিলাম, দীপকের ফুলটাইম সার্ভিস থেকে দল এবার বঞ্চিত হতে চলেছে দেখে। রতন যেদিন বিয়ের কার্ড এনে দেখাল, আমরা আতঙ্কিত হয়েছিলাম ... বুঝতে পেরেছিলাম দীপক এবার দলে আসা-যাওয়া কমিযে দেবে নির্ঘাত। সত্যি কথা হলে- এই গ্রুপ থিয়েটার বড় স্বার্থপর। সে শুধু তার নিজের দিকটা দেখে। সামাজিকতা কী লৌকিকতা পালনের ফুরসত নেই তার। অহরহ অনটনের সঙ্গে লড়াই করে, অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। সিনেমা যাত্রা কী বাঁধা মঞ্চের মালিকী থিয়েটারের মতো বুকে পাউডার মেখে থিয়েটার করা যায় না এখানে। সরকারি বেসরকারি দান অনুদানেব ব্যবস্থা নগণ্য। কব্জির ঘাম ঠোঁটে মুছে থিয়েটার করে চলেছি আমরা। কেউ আমরা নিছক শিল্পী নই, সবাই আমরা একাধারে কর্মী-সংগঠক। জিদ আর আকাক্সক্ষাই আমাদের সম্বল। সংগঠনই আমাদের শক্তি। এক এক জন ছেলে এই সংগঠনের এক একটি স্তম্ভ। তাই কেউ যখন চলে যায়, সাড়ম্বরে বিদায় সম্ভাষণ জানাবার বিলাসিতা আমাদের আসে না ভাই।

শুভ্র তুমি জানো, এই শহরের বুকে এই মুহূর্তে অন্তত তিনরকমের থিয়েটার চলছে। একরকম আছে পাড়ার বা অফিসক্লাবের শখের থিয়েটার। নিছক শখ মেটাতে যে থিয়েটার সংঘটিত হয় পাড়ার দুর্গোৎসব কমিটি, অ্যাথলেটিক ক্লাব বা অফিস রিক্রিয়েশান ক্লাব দ্বারা। নিছক হৈ হুল্লোড়ের খেলা। অনেক রকম শখ এক যোগে কাজ করছে সে সব জায়গায়। রঙ মেখে অনেকের সামনে নিজেকে হাজির করার শখ, লোকের বাহবা কুড়োনোর শখ, এক রাত্রির জন্যে নিজেদের শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বগোত্রীয় ভাবার অদম্য শখ। মানুষের ভেতর অভিনয় করার যে সহজাত প্রবৃত্তি রয়েছে, তারই তাড়নার নির্ভেজাল প্রকাশ দেখতে পাবে সেখানে। কলকাতার দ্বিতীয় থিয়েটার হ’ল ... মালিক চালিত স্টার রঙমহল বিশ্বরূপার বাণিজ্যিক কারবার। যার সার্থকতা একমাত্র অর্থোপার্জনে। মালিক তাই মনে করেন, শিল্পীরা যা ... কর্মীরাও তা-ই। তৃতীয় থিয়েটার এই গ্রুপ থিয়েটার, শখেরও নয়, ব্যবসারও নয়। চল্লিশবছর আগে বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’-র মধ্য দিয়ে যে গণনাট্যের সূত্রপাত ঘটে, গ্রুপ থিয়েটার তারই উত্তর সাধক। দুর্ভিক্ষ মহামারী মুনাফাবাজি শোষণ দু-দুটো মহাযুদ্ধ যে ক’টা রাক্ষুসে সন্তান প্রসব করেছে, তাদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে এর জন্ম। করেও চলেছে। গ্রুপ থিয়েটার দায়বদ্ধথিয়েটার- সময়ের কাছে, সমাজের কাছে, মানুষের কাছে। বিশ্বাসের দিক দিয়ে, লক্ষ্যের দিক দিয়ে, সংগঠনের দিক দিয়ে তিন থিয়েটারে আসমান জমিন ফারাক। তাই কেউ যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায়, আমরা বুঝি সে আমাদের আদর্শে আস্থা হারাচ্ছে, আমাদের তুচ্ছ করছে, ব্যক্তিগত উন্নতির দৃষ্টান্ত খাড়া করে আমাদের ভেতর সংশয় ঢোকাচ্ছে ... আমাদের দুর্বল করছে। যত তাড়াতাড়ি পারি পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে আমরা তাকে খরচের খাতায় তুলি শুভ্র। বাদশার হারেমের মতো। হারেমে যদি কোনো বেগমের মন উড়ু উড়ু হয়, বাদশা তৎক্ষনাৎ তাকে খরচের খাতায় পাঠাতেন। অন্য বিবিদের গায়ে যেন উড়ো বাতাস না লাগে! প্রতিষেধক ব্যবস্থা।

॥ তিন ॥

ভেবো না শুভ্র, তুমি ছেড়ে যাচ্ছ বলে আমরা জন্মের মতো ভেঙে পড়েছি। আমরা মচকাই শুভ্র, ভাঙি না। আর কিছু না থাক, ভূপাতিত সহযোদ্ধার দেহ ডিঙিয়ে সামনে অগ্রসর হবার শিক্ষা আমাদের আছে। একটু পরেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসব। কালই তোমাকে আমরা ভুলে যাবো। উড়ো পায়রাদের ভুলতে হয়। আমাদের দলের বয়েস মাত্র দশ বছর। তা এইটুকু সময়ের মধ্যে অন্তত সাড়ে সাত শো উড়ো পায়রা দেখেছি আমরা, যারা হঠাৎ উড়ে এসেছে, দাঁড়ে বসে দোল খেয়েছে, তারপর একদিন ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেছে।

উড়ো পায়রারা অন্তত দশ রকমের আছে শুভ্র। একদল আছে যারা এখানে আসে, সন্ধ্যেবেলা আর কোনো কাজ নেই বলে। পুরো বেকার কিংবা আংশিক বেকার পায়রারা তাদের বেতো ডানার অবসাদ ঝাড়তেই আসে। এসেই হৈ চৈ শুরু করে দেয়। এমন ভাব দেখায় যেন থিয়েটার ছাড়া জীবনে আর কিছু বোঝে না। পারলে গোটা দলটাকে একাই কাঁধে নিয়ে ছোটে! দলও বোকার মতো এদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারপর যেই এদের সন্ধ্যেবেলার কাজ জুটে যায়, অমনি পালায়। রাস্তাঘাটে দেখা হলে, ভীড়ের মধ্যে গা ঢাকা দেয়। আবার তোমার দলের উড়ো পায়রাদের ঝাঁকটি এখন বেশ বড়সড়। সিনেমা বা যাত্রায়, নিদেন টি.ভি কী রেডিয়োয় চানস পাবার জন্যেই যারা গ্রুপ থিয়েটারে ঠেক নেয়। প্রথমদিনই ঘোষণা করে, নাটক শিখতে এসেছি। তখনি সন্দেহ করা উচিত, নিশ্চয় অর্জিত শিক্ষা অন্যত্র কাজে লাগাবার ধান্ধায় আছে। যদ্দিন থাকে সেই চেষ্টাই করে এরা। দুপুরবেলা টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো কী চিৎপুরের গদিতে কী রেডিয়ো স্টেশনের দরজায় এইসব লক্কা পায়রাদের ধর্ণা দিতে দেখা যায়। যেই বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, অমনি পালায়। যদি না ছেঁড়ে, হতাশ হয়ে পালায়। মোটকথা এরা পালাবেই। তৃতীয় দলের পায়রা বড় চটুল আর চঞ্চল প্রকৃতির। থিয়েটার কী, কেন, খায় না মাথায় দেয় ... কোনো খবরই রাখে না। হঠাৎ উড়ে এসে বসে, হঠাৎই চলে যায়। চার পাঁচ বছর পর কোনো শো-এর দিন হয়ত নতুন বৌকে নিয়ে হাজির হবে। সগর্বে বৌকে জানাবে, এই দলটা সেই তৈরি করে গেছে। সত্যি, গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যোগাযোগ আজ অনেকের সাংস্কৃতিক জীবনের মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এলো, কেন গেলো, কোনো উত্তরই রেখে যায় না এরা। চতুর্থ দলে সেয়ানা পায়রা। ঘরে ঢোকার পর এদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হয়, দলে গণতন্ত্র কতোখানি আছে সেটাই খতিয়ে দেখা। গণতন্ত্র রক্ষার জন্যে দলের মধ্যে দল পাকায় এরা। যেদিন যায়, একা যায় না ... সঙ্গে আরো গোটাকয় নিয়ে যায়। আর এক রকম আছে ভীতু পায়রা। দল যতদিন টিমটেমে থাকে, এদের মতো নিষ্ঠাবানকর্মী আর কেউ নয়। দল যেই বড় হয়, থিয়েটারের কাজকর্ম বাড়ে, অমনি এরা ভয় পেতে থাকে। শঙ্কিত হয়, এইবার থিয়েটার বুঝি ওদের গ্রাস করবে। ওদের সময়-স্বাস্থ্য-সংসার সব ধ্বংস করে দেবে। আতঙ্কে ছেড়েছুড়ে ছুটে পালায় এরা। আতঙ্ক অকারণও নয়। শিল্প সাহিত্য কখনোই তোমার এক টুকরো মনোযোগ নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না শুভ্র। ক্রমশ সে তোমার সকাল দুপুর সন্ধ্যে, তোমার নিদ্রা জাগরণ সব দখল করে নেবে। আমাদের সময়কার অনেক ছেলেই, প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও, এই ভয়েই বহু বৃহৎ কাজ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে।

বিচিত্র এই পায়রা-চরিত্র বর্ণনা করে আর লাভ কী শুভ্র, বরং বুঝতে চেষ্টা করো, এই সব আপাত নিরীহ যাযাবর পাখিরা আমাদের থিয়েটারের কতো সর্বনাশ করে যায়। সংগঠনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। এদের হঠাৎ হঠাৎ অন্তর্ধানে কতো টাকা মাটি হয়, কতো পরিকল্পনা ধ্বসে যায়। কতো অভিনয় পণ্ড হয়, উপযুক্ত মানে পৌঁছুতে পারে না। গ্রুপ থিয়েটারের চারপাশে অজস্র সমস্যা, কোনোটাই কিছু ছোট নয়। আবার এই দলত্যাগ সমস্যাটাও কোনোটার চেয়ে ন্যূন নয়। একটি দলের পরমায়ূ দু’চার বছর কমিয়ে দিয়ে যেতে পারে এক একটি দলছুট। সিনেমা যাত্রা বা বাণিজ্যিক থিয়েটারে এটা নেই। টাকা দিয়ে ওরা শিল্পী কলাকুশলী কর্মী সবাইকে পোষে। কেউ চলে গেলে টাকা ফেলে রাতারাতি ওরা যোগ্যতর প্রতিভা কিনে আনতে পারে। সত্যি কথা বলতে কী, ওদের ছেড়ে কেউ বড় একটা যায়ও না। নেহাত সিনেমা বা যাত্রা কাউকে ঠেলে বার করে না দেওয়া পর্যন্ত সবাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। গ্রুপ থিয়েটারের চেহারাটা আলাদা। প্রতিদিন চলছে এই যাওয়া আসার খেলা। এখানে পাখি পড়ান পড়িয়ে বোবাদের মুখর করা হয়। হায়,  খোকার মুখে কথা ফুটলে, সে সর্বাগ্রেই বলে, বিদায়। অনেকটা সেই কাকের বাসায় কোকিলছানা প্রতিপালিত হওয়ার মতো।  

॥ চার ॥

রাগ করো না শুভ্র। তোমাকে সামনে পেয়েই এতো কথা বললাম। নইলে, সত্যি, ভেবে দেখলে তোমারইবা দোষ কতটুকু! আজ বাইশ’শ টাকার টোপটা গেলা ছাড়া তোমারইবা কী করার আছে? তোমার বাড়ির অবস্থা জানি। তোমার বাবা রিটায়ার করেছেন, তোমার দাদা বাহাত্তর সালে একটা ভাঙা বাড়ির পাঁচিল টপকাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা পড়ে, ছোটো দু’টি ভাই স্কুল কলেজ ছেড়ে দিয়ে কী সব গুপ্ত ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে, তোমার মা সন্ধ্যেবেলায় তোলা উনুনে ফুঁ দিতে দিতে ছেঁড়া আঁচলে চোখ মোছেন। শুভ্র, তোমার আমার পশ্চিম বাংলার হাজার হাজার গ্রুপ থিয়েটারকর্মীর বাড়ির অবস্থা একই রকম। আমাদের মতো মাঝারি নিম্ন মাঝারি অভাবের ঘরে বাইাশ’শ টাকা তো দু’কোটি টাকার লটারি পাওয়ার মতো। আমাদের থিয়েটারের যদি তোমাকে বাইশটে পয়সা দেবারও ক্ষমতা থাকত, নিশ্চয় আজ সদলবলে তোমার দরজা আটকে দাঁড়াতাম। কিছুতে যেতে দিতাম না তোমাকে। কিন্তু কেউ না জানুক, তুমি জানো ভাই, মাথা ফাটাফাটি করলেও তোমাকে সাহায্য করার মতো একটা আধলাও বেরুবে না আমাদের ক্যাশবাক্স থেকে। টাকার অভাবেই আমরা থিয়েটারের সবচেয়ে প্রয়োজনীয়কর্মীটিকে ধরে রাখতে পারি না। 

টাকাকড়ির হিসেব দিতে গেলে রাত পুইয়ে যাবে, শুধু বলি এক বিচিত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে শ্বাস টানছে আমাদের থিয়েটার। ব্যবস্থাটা বিচিত্র এই কারণে যে, থিয়েটার দল যারা করে, তারা শুধু করেই যাবে, থিয়েটার থেকে কিছু পাবে না। ... অন্যদিকে বাইরের একদল এই থিয়েটার থেকে জীবিকা অর্জন করবেন। মহিলা শিল্পী টাকা পাবেন, আলোক শিল্পী টাকা পাবেন, পাবেন টেপরেকর্ডার মাইক্রোফোনের মালিক, হল-মালিক পাবেন, তাঁর কর্মচারীরাও টিপস পাবেন, কর্পোরেশন টিপস পাবে ট্যাকসও পাবে, মাল টানার জন্যে ঠেলা-চালকও পাবেন। শুধু তুমি থিয়েটারের ছেলে যদি কাঁধে মাল বয়ে নিয়ে যাও, তুমি কিছু পাবে না। তা বলে ভেবো না শুভ্র, যাঁরা পাচ্ছেন তাঁদের না পাওয়ার পক্ষে সুপারিশ করছি আমরা। না, তেমন বোকা নই। কথা হচ্ছে, সবাই যদি পাবে, যারা হোতা তারা শুধু বঞ্চিত হবে কোন অপরাধে? থিয়েটার করার দায়টা কি শুধু আমাদেরই, আর কারো নয়? পেশাদার আর অপেশাদারের এমন হৃদ্যতাপূর্ণ সহাবস্থান তুমি কি দুনিয়ার আর কোথাও দেখতে পাও?

অথচ বাইরে তুমি শুনতে পাবে, ‘গ্রুপ থিয়েটারে’র টাকা আছে। আজকাল কল’শো বেড়েছে, কল’শো-এর রেটও বেড়েছে, কাজেই এক একটা দল এক একটা ছোটোখাটো পুঁজিপতি হয়ে উঠেছে। খবর রাখি না, কে পুঁজিপতি কে লাখোপতি হল, আমরা শুধু জানি কল’শো-এর রেট বাড়িয়েও আমাদের পেট কিছু ভরেনি। আমাদের অবস্থা সেই ভূতে পাওয়া নন্দরানীর মতো। গপ্পোটা বলি শোন। নন্দরানীকে ভূতে ধরেছে। নন্দরানী শুধু খাচ্ছে, যা সামনে পাচ্ছে গবগব করে গিলছে। সাত গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়েছে, নন্দরানীর অভূতপূর্ব ভোজনপর্ব দেখতে। সন্ধ্যেবেলায় ওঝামশাই ঘোষণা করলেন, আসলে নন্দরানী খাচ্ছে না, খাচ্ছে ওর কাঁধের ভূত। প্রমাণও পাওয়া গেল। দশ মিনিট পরে ওঝা যখন নন্দরানীর ঘাড়ের ভূত নামিয়ে দিলেন, নন্দরানী সকলকে অবাক করে আবার খেতে চাইল। মানে এবার সে নিজে খাবে। তাই বলছি, রেট যা বাড়ানো হয় সে ঐ পেশাদারদের দাবি মেটাতেই বাড়াতে হয়। নন্দরানীর অবস্থা তাতে কিছু পাল্টায় না।

আমরা সেই শো-এর শেষে অভুক্ত শরীরে কাঁধে কাঠের প্লাটফরম পোশাকের ট্রাঙ্ক নিয়ে পথে নামি। পথের ভিখারীও যখন ঘুমোয়, গ্রুপ থিয়েটারের ছেলেরা শক্ত ঘাড়ে বোঝা বয়। একটু আগে যারা ছিল মঞ্চের রাজা উজির, তারাই এখন মুটে মজুর। অর্ধেক রাতে বাড়ি ফিরে দ্যাখে, ভাত ঠাণ্ডা, বিছানা ঠাণ্ডা, মায়ের চোখ ঠাণ্ডা। উত্তাপ শুধু জন্মদাতা পিতার গলায়- ‘শিশির ভাদুড়িকে বলো, কাল থেকে হোটেলে বন্দোবস্ত করে নিতে।’ ... সত্যিই তো, এই কাজের বদলে খাদ্যের সংসারে এমন অকাজ আর কে করছে!

বাড়িতে আমরা কেঁচো, অফিসে আমরা চোর। মাসের মধ্যে দশদিন থিয়েটারের জন্যে ছুটি নিতে হয়, দলের কাজের জন্যে বিকেল চারটেয় অফিস থেকে চুরি করে বেরিয়ে পড়তে হয়, ফাঁকিবাজ চোর ছাড়া কী বলা যায় আমাদের? চানস পেলেই কর্তৃপক্ষকে তেল দিতে হয়। যত অবিচার ঘটুক না আমার পাশের টেবিলের সহকর্মীর ওপর, আমাকে মুখ বুঁজে থাকতেই হবে ... ঐ বাড়তি সুবিধাটুকু নেবার জন্যে। বোঝো শুভ্র বোঝো ... যে থিয়েটার আমাদের প্রতিবাদের ভাষা যোগায়, সেই থিয়েটারের জন্যেই জীবনের অন্য ক্ষেত্রে আমরা অপদার্থ আপোষী সুবিধাভোগী এবং দালাল। আয়রনি, মস্তবড় আয়রনি! শুভ্র, সরকারি বেসরকারি সব অফিসেই খেলোয়াড়রা বাড়তি অনেক সুযোগ পেয়ে থাকেন। তাঁদের কাজকর্ম তাঁদের মর্জিমাফিক। দু’টোর সময় বেরিয়ে ময়দানে গিয়ে তাঁরা ‘বোঝাপড়ার খেলা’ খেলতে পারেন। কিন্তু থিয়েটার এমনই এক ফালতু ব্যাপার যে তার জন্যে দু-দশ মিনিট আগে বেরুতে চাইলে, কর্তারা এমন মুখ করেন, যেন আমরা গণিকালয়ে যাচ্ছি।

বিদায় শুভ্র। যেখানে যাচ্ছ যাও। শুধু একটা কথা, তুমিও যেন ওদের মতো ভুলেও ভেবো না, আমাদের পরিশ্রম, আমাদের আত্মহনন রক্তক্ষরণ সবই অকারণ কিংবা ব্যর্থ। আজ বাংলা থিয়েটারের যেটুকু যা মান, সম্মান, গর্ব, সে যে এই গ্রুপ থিয়েটারের দৌলতে নিশ্চয় তোমাকে বলে বোঝাতে হবে না, কিংবা দৃষ্টান্তসহ প্রমাণও করতে হবে না।

মনোজ মিত্র : অধ্যাপক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ভারত

[লেখকের ‘অলীক সুনাট্য রঙ্গে’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত- সম্পাদক]