Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সফদর হাশমীর সাক্ষাৎকার

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

অনুবাদ : আনু মুহাম্মদ

[অনুবাদকের কথা : আমরা সম্মিলিতভাবে সক্রিয় স্বপ্ন দেখি ও তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করি একজন অসাধারণ সংগ্রাামী মানুষ, মার্কসবাদী ও নাট্যকর্মী, কবি, চিত্রশিল্পী, রাজনৈতিককর্মী, সংগঠক সফদর হাশমীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১২ এপ্রিল দিল্লীতে। ১৯৭৫ এ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন এবং পরে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশনে (গণনাট্য সংঘ) যোগ দেন। ১৯৭৩ এ তিনি আরও ক’জনের সঙ্গে মিলে গঠন করেন জননাট্য মঞ্চ (জনম)। পরে যুক্ত হন সি.পি.এম এর সঙ্গে।

দিল্লীতে শিক্ষালাভের পর কিছু সময় দিল্লীর জাকির হোসেন কলেজ এবং শ্রীনগর, গারওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রেস ইনফর্মেশন অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকার পর ১৯৮৩ সালে তিনি পূর্ণসময় থিয়েটারে ও রাজনৈতিককর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

জননাট্য মঞ্চের মাধ্যমে সফদর নাটকের ক্ষেত্রে এক নতুন ও বলিষ্ঠ ধারা নির্মাণ করেন। কীভাবে, কাদের জন্য এবং কম সময়ে ও কম খরচে কার্যকরভাবে জনগণের বিভিন্ন সমস্যা ও সংগ্রামে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য এবং তাদের সংগ্রাম এগিয়ে নেবার, তাদের সংগঠিত করবার কাজের সহযোগী হিসেবে পথ নাটককে এগিয়ে নিতে হয়-সফদর হাশমী তা তাঁর স্বল্প সময়ের জীবনে সার্থকভাবেই দেখাতে পেরেছিলেন। তাঁর সঙ্গে সকল রাজনৈতিক কৌশল ও কর্ম পদ্ধতিতে সবার মতের মিল না হতে পারে। কিন্তু তার সৃষ্টিশীলতা, অঙ্গীকার, বিপ্লবী স্বপ্নকে সবার মধ্যে জাগিয়ে তোলার অদম্য কর্মস্পৃহা আমাদের জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন সামাজিক অঙ্গীকারাবদ্ধ নাট্যকর্মী বলতে কী বোঝায়।

জননাট্য মঞ্চ জন্মের পর থেকে শ্রমিক কৃষক ছাত্র কর্মচারী ও মেহনতি মানুষের মধ্যে বিভিন্ন নাটকের প্রায় ৪৩০০ প্রদর্শনী করেছে। জনমের অধিকাংশ নাটকই সফদর-এর লেখা। এছাড়াও তিনি লিখতেন গান, চিত্রনাট্য। আঁকতেন ছবি, মুখোশ বানাতেন, পোস্টার লিখতেন, শিশুদের জন্য লিখতেন। এবং তাঁর সব কাজই ছিল সমাজ পরিবর্তনের বিশাল আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত। খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ও ক্ষমতা অনেক উজ্জ্বল থাকা সত্ত্বেও তিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করার মত অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন ঝুঁকিপূর্ণ কষ্টসাধ্য এবং দীর্ঘ সংগ্রামের জীবনে।

নাটকের মাধ্যমে তিনি জনগণকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ ও আলোড়িত, আন্দোলিত ও সংগঠিত করছিলেন ঠিক তেমনি ক্রুদ্ধ ও বৈরী করে তুলছিলেন শাসকশ্রেণীকে। তারই ফলাফল তাঁর হত্যাকা-। ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি দিল্লীর কাছে শহীদাবাদে শ্রমিক এলাকায় ‘হল্লাবোল’ নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে তিনি কংগ্রেস (আই) এর গুণ্ডাবাহিনীর হাতে গুরুতর জখম হন। নিহত হন একজন শ্রমিক। ২ জানুয়ারি সফদরেরও মৃত্যু হয়।

তাঁর সংগঠন জনম থেমে থাকে নি। তাঁর মৃত্যুর পর জনম সেই অসমাপ্ত নাটক সমাপ্ত করেছে। শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভের যে ধারা সফদর শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, যার অপরাধে তাঁকে খুন করা হয়, তাঁর খুন সে ধারাকে বরঞ্চ আরও শক্তিশালী করে।

সফদরের এই মৃত্যু নাটকের, রাজনৈতিক থিয়েটারের শক্তিই প্রমাণ করে। সফদরের এই মৃত্যু আমাদের সামনে নির্মাণ করে রাজনৈতিক অঙ্গীকারে উজ্জ্বল একজন সাংস্কৃতিককর্মীর অসাধারণ প্রতিকৃতি।

১৯৮৮ সালের এপ্রিল মে মাসে উট্রেক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটারকর্মী Eugene van Erven এর কাছে দেয়া সফদর হাশমীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের অনুবাদ করেছি (এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ ছাপানো হলো-সম্পাদক)।  এতে নাটক, রাজনীতি ও সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে সফদরের চিন্তা ও স্বপ্নের সন্ধান পাওয়া যাবে। এটি সংকলিত হয়েছে সফদর হাশমী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট প্রকাশিত ‘দ্য রাইট টু পারফর্ম : সিলেক্টেড রাইটিংস অব সফদর হাশমী’ গ্রন্থে]

Eugene van Erven
সফদর আপনি ভারতের সংগঠিত গণনাট্য আন্দোলন সম্পর্কে প্রথমে কিছু বলুন।

সফদর হাশমী
আমাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় ৪টি রাজ্যের মধ্যে ৩টিতে-অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক এবং কেরালায় সংগঠিত গণনাট্য আন্দোলন আছে যা সংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন- আরও স্পষ্ট করে বললে সংগঠিত বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তামিলনাড়ু–তে কি ঘটছে তা আমি অতটা ভালো জানি না। অন্ধ্র প্রদেশের সংগঠনের নাম অন্ধ্র প্রজা নাট্য মণ্ডিলি, কর্ণাটকে এর নাম সমুদয়া এবং কেরালায় নাম কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ। ৮ মাস আগে অন্ধ্র প্রদেশে রাজ্যপর্যায়ে সম্মেলন হয়েছে সেখানে জানা গেছে যে, তাঁদের ৬০ টিরও বেশি সক্রিয় ইউনিট রয়েছে। এর সবগুলোই গ্রামভিত্তিক-উত্তর ভারতে যেমন শহর বা নগরভিত্তিক হয়ে থাকে তেমনি নয়। অন্ধ্র প্রদেশে তাঁরা কাজ করেন কৃষি শ্রমিক, চাষী এবং তাদের শিশুদের সঙ্গে। তরুণী এবং মহিলাদের সেখানে বড় ধরনের অংশগ্রহণ রয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে তারা একটি বড় কাজ করেছেন যা আমার কাছে দারুণ মনে হয়েছে। মার্কসবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে উত্তর ভারতে কিংবা এদেশের আর কোথাও এরকম কোন ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। অন্ধ্রপ্রদেশের কোনো এক গ্রামে তাঁরা সপ্তাহব্যাপী একটি ওয়ার্কশপ করেছেন। সেখানে প্রায় ৭০০ গণনাট্য শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন। এ গ্রামে পাশাপাশি ৮০টি ওয়ার্কশপ চলেছে এবং তার থেকে ডজন ডজন গান, নাটক এবং নৃত্য তৈরি হয়েছে। এর পরই অনুষ্ঠিত হয়েছে ১০ দিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসব। রাজ্যের সকল জেলা থেকে উৎসবে অংশীদারীত্ব ছিল। তাঁরা বাড়িতে ফিরেছেন এক বিরাট অভিজ্ঞতা এবং অধিকতর সংগঠিত সংগঠন নিয়ে। আরও ভালো ব্যাপার হল সেখানে স্থানীয় জনগণ এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিলেন।

তাঁদের আরও আছে রাজ্য কমিটি এবং জেলা কমিটি। আর প্রতিবছরই তাঁদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের কাঠামো গণতান্ত্রিক এবং কর্মকর্তারা নির্বাচিত। তাঁরা নিয়মিত প্রকাশনা করেন এবং বই ধার নিয়ে পড়ার মতো গ্রন্থাগারও আছে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় তাঁদের কিছু কাজ দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।

তাঁদের গান এবং নাচ খুব দৃঢ়ভাবে ঐতিহ্যভিত্তিক কিন্তু পরিষ্কারভাবে ঐতিহ্যগত থিয়েটারের অবস্থান থেকে মুক্ত। আমি মনে করি আমরা সবাই এই কঠিন কাজটির মুখোমুখি হচ্ছি। যে ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি আমাদের সমগ্র দেশ দখল করেছে এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে তার থেকে নিজেদের মুক্ত করবার প্রয়োজন আমরা সবাই অনুভব করি। আমরা সবাই এমন আঙ্গিকে কাজ করতে চাই যার সঙ্গে জনগণ পরিচিত এবং যা জনগণ শতশত বছর ধরে নিজেদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি যদি ঐতিহ্যবাহী আঙ্গিক ব্যবহার করতে যাই সেই আঙ্গিকের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা, সামন্ত কাঠামো, এমনকি প্রাক সামন্ত কাঠামোর চিন্তাভাবনা সম্বলিত বিষয়বস্তুও চলে আসে। ঐতিহ্যবাহী ফর্মকে কাঁচি চালিয়ে তার বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে গ্রহণ করা যায় না। কেননা এ দু’টি অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক গণনাট্য শিল্পী একাজ অনেকখানি সাফল্যের সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের থিয়েটারে আমরাও অনেক গান ব্যবহার করি যেগুলো ঐতিহ্যগত ভঙ্গি বা সুরসমৃদ্ধ। কিন্তু তারপরও আমি দাবি করতে পারি না যে তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক দিক থেকে এই প্রশ্নটির সমাধান হয়েছে। আরও উল্লেখ করবার মত বিষয় হচ্ছে যে,সরকারি আধা সরকারি এবং বিদেশী তহবিলপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যাপক আকারে আমাদের ঐতিহ্যগত লোক ও পাহাড়ী শিল্পধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে। এসব জিনিস যখন নতুন করে বিকশিত হচ্ছে তখন এবই সঙ্গে হাজাররকম পশ্চাৎপদ চিন্তাও তাঁর সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে।

Eugene van Erven
সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সম্পর্কে আপনি নেতিবাচকভাবেই বলে থাকেন। এরা কী লক্ষ্যে কাজ করছে এবং তাদর কৌশল কী?  

সফদর হাশমী
এসব কিছু নির্ভর করছে শাসকশ্রেণী কারা এ সম্পর্কিত উপলব্ধির ওপর। উপরে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও ভারত মূলত শাসিত পুঁজিপতি এবং সামন্তপ্রভূদের মোর্চার দ্বারা। জনগণকে পশ্চাৎপদ রাখা তাদের ক্ষমতার অন্যতম হাতিয়ার। সারা দেশে জনগণের বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠা ঠেকানো এবং একই সঙ্গে শ্রমিক আন্দেলন, কৃষক আন্দোলন, কৃষিমজুর আন্দোলন, ছাত্র, যুব এবং নারী আন্দোলন ও জনগণের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের যে বিক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে এই শাসকশ্রেণী সকল পশ্চাৎপদ কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাচেতনা বিকশিত করবার কৌশল প্রণয়ন করেছে। এর একটি উপায় হিসেবে তারা আমাদের থিয়েটারে ভারতীয়করণকে উৎসাহ দেবার নামে ঐতিহ্যিক শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে।

আমাদের আধুনিক নাটকের ইতিহাস খুব স্বল্পকার। ১০০ বছরের বেশি নয়। বাংলার কিছু অঞ্চল, কলকাতা এবং মহারাষ্ট্র ছাড়া আমাদের দেশে আর কোথাও নাগরিক থিয়েটারের শেকড় নেই। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে আছে একটি সমৃদ্ধ লোক থিয়েটারের ঐতিহ্য। জনগণের সাংস্কৃকিত আন্দোলনে বিকাশের ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবেও থিয়েটার গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।

স্বাধীনতার পর থেকেই ঐতিহ্যবাহী থিয়েটারের সমস্যা ছিল-সমস্যা ছিল প্রকৃত ভারতীয় একটি ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার।

বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যে, ভারতীয় ভাব মানে হচ্ছে দেবদেবী, অগ্নি বা বুদ্ধ উপাসনা, তীরধনুক ইত্যাদি। কিন্তু আরও অনেকের সঙ্গে আমিও মনে করি যে, এসব জিনিস থিয়েটারকে ভারতীয় চরিত্র দান করবার চাইতে বেশি করে তাকে আরও পশ্চাৎপদতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। থিয়েটারকে এ থেকে মুক্ত করা জরুরি। এর মানে এটা নয় যে, আমরা ঐতিহ্যিক শিল্প মাধ্যমগুলো বর্জনের কথা বলছি। দু’ধারার ঐতিহ্য আছে বলে আমরা মনে করি। আসলে ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের একটি সমালোচনামূলক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

সব সরকারি ও এসব সংস্থা চায় যে আমরা ঐতিহ্যের প্রতি প্রাণহীন আনুগত্য প্রকাশ করি। এ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আমাদের আন্দোলনের মধ্যেও গৃহীত হয় নি। আমি একজন নাগরিক সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে ঐতিহ্যগত স্টাইলে অভ্যস্ত নই। এটা হচ্ছে একজন কৃষক বা পাহাড়ী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ, তাঁরা সঙ্গীত করেন নাচেন তাঁদের নিজস্ব ভঙ্গিতে। আমি সেভাবে পারবো না। কিন্তু যখন আমি সে রকম করতে চেষ্টা করবো, কিছুমাত্রায় হলেও সেখানে ঐ ফর্মটি নষ্ট হবে, বিকৃত হবে এবং তার সঙ্গে সম্পর্কহীন বা বিচ্ছিন্ন কিছু উপাদান তাতে আরোপিতও হবে।
 
লোক এবং পাহাড়ী শিল্পমাধ্যমের অনেকগুলো খুবই সমৃদ্ধ। সেগুলো যেমন উপভোগ্য, তেমনি দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে আবেদনও ব্যাপক। আমরা এগুলো জানা বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু তার হুবহু অনুকরণ বা তাকে অন্য বিষয়বস্তুতে ব্যবহারের কোনো ফলাফল দাঁড়ায় না। একটা উদাহরণ দেই। পাহাড়ীদের মধ্যে শিকার নৃত্য আছে-বিভিন্ন গোষ্ঠী এটা বিভিন্নভাবে পরিবেশন করেন। কোনো কোনো নৃত্যশিল্পী নিজে ভাল্লুক বা সিংহ বা মোষের অভিনয় করেন, অন্যরা হন শিকারী। তারা গোল হয়ে ঘুরতে থাকেন, নাচতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত কেন্দ্রবিন্দুতে এসে শিকারকে বধ না করেন। বর্তমান জীবনের সঙ্গে এটি সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও এটা তাদের পূর্ব পুরুষদের থেকে চলে আসছে। এই ফর্মটাই যদি আমরা ব্যবহার করতে চাই অন্যকিছু বলার জন্য, যেমন ধরুন ১৯৭৭ এ আধাফ্যাসিস্ট কংগ্রেস (আই)-কে পরাজিত করবার জন্য ভারতীয় জনগণের জাগরণ। আমি মনে করি না যে, একমাত্রিকভাবে এটি সেভাবে তুলে ধরা সম্ভব। আমি যদি কংগ্রেস (আই)-কে ষাঁড় বা সিংহে নামিয়ে আনি তাহলে এটা শুধুমাত্র সংকোচনবাদে পরিণত হবে। এর মধ্য দিয়ে আমি সমসাময়িক রাজনীতির জটিল অবস্থা জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারবো না, জনগণের সংগ্রামকেও সরলীকরণ করা হবে। অনেকেই এরকম করেছেন, করা সহজও। আসলে জনগণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যতই ক্রমে ঘনিষ্ট এবং মৌলিক হতে থাকবে, ততই গণনাট্য চর্চার মাত্রাও বাড়বে। বিষয়বস্তু যত সমৃদ্ধ হবে নতুন নতুন আঙ্গিকও ততই বেরিয়ে আসবে।

আমি বিশ্বাস করি যে, যদি ঐতিহ্য জীবন্ত হয়, যদি এটা আমার মধ্যে থেকে থাকে তাহলে এটা আমার সৃষ্টিশীল প্রকাশের মধ্যে একটা স্থান করে নেবেই। কিন্তু এরকম হতে পারে না যে, আমি কথাকলি গুরুর পায়ের কাছে ৬ মাসের জন্য বসে থাকলাম এবং ফিরে এসে কথাকলি স্টাইলে আধুনিক নাটক করলাম। কিংবা চৌধুরী-এর কিছু জিনিস শিখে তাকে আধুনিক নাটকের আঙ্গিকে ভরে দিলাম। এভাবে কাজ হয় না।

আমার নিজের কথা বলতে পারি। আমি ছোটবেলা গান শিখেছি সামন্ত গ্রাম সমাজে, লোক-ঐতিহ্য থেকে। এসব গান আমার সত্ত্বার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। এখন কোনো নাটকের সঙ্গে গান লিখতে গিয়ে আমি ভিন্ন কোনো ধরনের গান লিখতে পারবো না, যা আমার পরিচিত, যা আমার ভেতরে আছে সেটাই কোনো না কোনোভাবে বেরিয়ে আসবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তর মধ্য প্রদেশের অংশ এবং রাজস্থানে এক ধরনের গান প্রচলিত আছে যাকে বলা হয় ‘আলাহ’ এটা হচ্ছে আলাহ এবং উদেল এই দুই ভাইয়ের কাহিনী, সাহসী দু’জন। এই গানের মধ্যে নির্দিষ্ট দ্বন্দ্ব আছে। লম্বা লম্বা বাক্যে বর্ণনামূলক ভঙ্গিতে গান গাওয়া হয়। এই গানের ছন্দ সুর এবং বর্ণনামূলক ভঙ্গিটি আমার নিজেরও অঙ্গ হয়ে গেছে। আমি যখন বর্ণনামূলক ভঙ্গিতে মে দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো গান লিখতে বসি তখন আমার মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐ আঙ্গিকটির মধ্যেই চলে যায়। কাজেই আমার মধ্যে যাই থাক, ঐতিহ্যগত বা পশ্চিমা সেটা তার স্বাভাবিক প্রকাশ খুঁজে নেবেই। সংকীর্ণ, সহজ বা সংক্ষিপ্ত পথে একে হজম করার বা ব্যবহারের সুযোগ নেই।

Eugene van Erven
অনেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা অর্জনে এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনেও ঐতিহ্যকে ব্যবহার করে থাকেন। আমি ভাবছি হাবিব তানভীরের মত ব্যক্তিদের কথা এবং তাঁর ‘চরণ দাস চোর’ ...

সফদর হাশমী
হাবিব তানভীর সম্পর্কে মতামতের ক্ষেত্রে বহুরকম মতভেদ আছে। তিনি অনেক কাজ করছেন এবং আমি যদ্দুর জানি ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি ছতিশগড়ী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। আমি তাঁর কাজ যতটা দেখেছি- তিনি ওঁদের স্টাইল, নাচ গানের ধরন কিংবা উপস্থাপন ভঙ্গি কোনোটাই পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা করেন নি। ভদ্রলোক আসলেই এই কাজকে অনেক গভীরভাবে নিয়েছেন। গ্রুপের অধিকাংশ ব্যক্তিই নিরক্ষর সেকারণে তাদেরক কোনো লিখিত স্ক্রিপ্ট বা এ জাতীয় কিছু দেয়া হয় নি। তাদেরকে নিয়ে হাবিব বেশ কয়েকটি ব্রেশটীয় নাটকও করেছেন। যেমন ধরুন তিনি করেছেন ‘এ গুড পারসন অব সেচুয়ান’। প্রথমে তিনি বারবার এই গল্পটি তাদের বলেছেন। এভাবে যখন এই গল্পটি শিল্পীদের জীবনও ধারণার অঙ্গে পরিণত হয়েছে তখন তাঁরা নিজেরাই এই গল্পকে ভিত্তি করে নাটকটি দাঁড় করিয়েছেন। ওয়ার্কশপের মত পরিবেশ তিনি তৈরি করছেন, পাহাড়ী স্টাইলের গানগুলো অনুবাদ করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাজ খুবই পছন্দ করি। জানি যে তিনি বাইরে গেছেন এবং এডিনবার্গ উৎসবে পুরস্কারও লাভ করেছেন।

এসব কাজে নেমে প্রথম দিকে তিনি এমন কিছু করেছিলেন যার ব্যাপারে আমাদের তীব্র আপত্তি ছিল এবং আমরা তাঁর খোলাখুলি সমালোচনাও করেছি। যেমন ধরুন, ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস যখন ভাঙলো তখন তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থনে রাস্তার নাটক করলেন। আমরা এটাকে কংগ্রেস (আই) এর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ হিসেবেই গ্রহণ করেছি। এটা এমন সব শক্তির সঙ্গে আঁতাত যাদের বিরুদ্ধে সমগ্র জনগণের নাট্যআন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। পরে তিনি এরই পুরস্কার হিসেবে পার্লামেন্টের উপ পরিষদে মনোনয়ন লাভ করেন। ৬ বছর তিনি এম.পি ছিলেন। কিন্তু গত ৭/৮ বছর তার কাজের মধ্যে আমি পরিবর্তন দেখছি। এটি আরও মৌলচরিত্র নিচ্ছে। হাবিব তানভীর একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিকের ব্যাপারে যেভাবে তাঁর সমগ্র জীবন ব্যয় করছেন, সে ব্যাপারে মূল্যায়নের জন্য আমি নিজেকে যথেষ্ট যোগ্য মনে করি না। ছতিশগড়ী উপজাতীয় থিয়েটার নিয়ে তিনি কোনো ফাজলামি করছেন না। এই উপজাতির বাস রায়পুরের কাছাকাছি মধ্যপ্রদেশের একটি স্থানে। তিনি রায়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ মেয়েকে দেখাশুনার জন্য বরোদায় থাকেন। তাঁর কাজের ব্যাপারে গভীর শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁর বেশকিছু নাটকের ব্যাপারে আমার একইরকম আপত্তি আছে। সর্বশেষ যে নাটক তিনি করেন, ‘ইমমরটাল টেল অব হিরমা’- তাতে এমন কিছু উপাদান আছে- যা কুসংস্কারকে দৃঢ় করে এবং উপজাতীয় জনগণের সমগ্র অভিজ্ঞতাকে উপকথায় পরিণত করে। এ ব্যাপারে আমি তাঁর সঙ্গে কথাও বলেছি। আপনি অন্যদের সঙ্গেও তাঁর ব্যাপারে কথা বলতে পারেন। এরকম মহান শিল্পীর সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য আমি কেউ নই। দুর্ভাগ্যবশত ‘চরণ দাস চোর’-ছাড়া অন্য কোনোটিতে তিনি জনপ্রিয় হন নি। শ্রীরাম সেন্টারে তিনি  যখন ‘ইমমরটাল টেল অব হিরমা’ করেন তখন মিলনায়তনে দর্শক ছিলেন মাত্র ৩০/৪০ জন। পশ্চিমে অবশ্য তিনি খুবই সমাদৃত এবং পিটার ব্রুক তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দেন।

যাহোক, এটা সত্য যে অনেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য ঐতিহ্য ব্যবহার করেন। কেউ কেউ ঐতিহ্যের ধর্মগুরুতে পরিণত হয়েছেন। এদের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছি। কিন্তু কাজটা কঠিন হচ্ছে একারণে যে, থিয়েটার পেশাগতভাবে সংগঠিত হচ্ছে না। দিল্লী এবং উত্তর ভারতে নিয়মিত থিয়েটার শিল্পী বলে কেউ দাঁড়াচ্ছেন না। টিভি নাটক অনেক থিয়েটার শিল্পীকে শুষে নিচ্ছে- মঞ্চ নাটকে তাঁদের আমরা সেভাবে পাচ্ছি না। টেলিভিশন শিল্পী পরিচালকদের রুটি মাখন দিচ্ছে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত করছে মঞ্চ নাটককে। পেশাগতভাবে না দাঁড়ানোর ফলে এখানে প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক বিতর্কগুলোও হচ্ছে না। আমি গত কিছুদিনে ৩/৪ টি প্রবন্ধ লিখেছি বিভিন্ন পত্রিকায় (দ্য ইকনমিক টাইমস, এ সানডে পেপার) ইচ্ছে করেই উষ্কানিমূলকভাবে। যাতে কিছু বিতর্কের সূত্রপাত হয়। কিন্তু কিছুই হয় নি, একেবারেই কিছু না। নাট্য সমালোচনাও ফালতু- আলোকসম্পাত ভালো, অমুকে ভালো করেছে অমুকে নয় ইত্যাদি।

Eugene van Erven
যাঁরা জনপ্রিয় থিয়েটারে কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে বাদল সরকার এবং তৃতীয় থিয়েটার এর খুব নাম শোনা যাচ্ছে। তাঁর কাজের ব্যাপারে আমার নন্দনতাত্ত্বিক এবং মতাদর্শিক উভয় আপত্তিই রয়েছে। আপনি এ ব্যাপারে কী মনে করেন?

সফদর হাশমী
আপনার কতটা আপত্তি আছে জানি না, তবে বাদল সরকার সম্পর্কে একজনের যতটা আপত্তি থাকা সম্ভব আমার তা আছে। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো। প্রথমত তিনি ৪/৫ টি উল্লেখযোগ্য নাটক লিখে বাংলা নাটকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু যখন থেকে তিনি তৃতীয় থিয়েটার শুরু করলেন, তখন থেকেই গণনাট্য আন্দোলনের তিনি অনেক ক্ষতি করেছেন। তিনি কী বলছেন তার চাইতে তাঁর কাজ, ওয়ার্কশপ, গ্রুপ শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ইত্যাদি থেকে দেখা যাবে তিনি নাটকের বিষয়বস্তুকে ক্রমেই গৌণ করে তুলেছেন। আঙ্গিককেই আনছেন সামনে- যেন সেটাই নাটক। এগুলো শুধুমাত্র কায়দাকানুনের দক্ষতা, আর কিছু নয়। দর্শকরা বলবে ‘আ! চমৎকার! ওরা শরীর দিয়ে কামান বানিয়েছে’। বিষয়বস্তু দেখলে এখানে নৈরাজ্যিক কিছু বক্তব্য পাওয়া যাবে কিংবা পাওয়া যাবে সিনিসিজম। এরকম বিপ্লবীর অনেক সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি যারা সর্বোচ্চ কণ্ঠে চিৎকার করে বলে প্রত্যেকেই হচ্ছে জারজ এবং সকলেই দূর্নীতিবাজ। এই অবস্থান গ্রহণ করা সবচাইতে সহজ কেননা এর জন্য আপনার কোনোক্ষেত্রে অঙ্গীকার প্রয়োজন হয় না।

তাঁর একটি নাটক আছে ‘মিছিল’ নামে। সারাদেশ জুড়ে এটি দারুণ খ্যাতি অর্জন করছে। এটা হচ্ছে সিনিসিজমের চূড়ান্ত। এক নিঃশ্বাসে তিনি মার্কস. এঙ্গেলস, ফ্রয়েড থেকে লেনিন, হিটলার, বরিস বেকার পর্যন্ত সবার নাম বলে যাচ্ছেন। সবাই এখানে সমান। তিনি বরাবর এরকম কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর সমগ্র চিন্তাই নৈরাজ্যিক। আমি মনে করি এটা সুপরিকল্পিত। তাঁর নাটক যখন চলে তখন বেশ জমজমাট, শেষ হলে পুরো কনফিউজড।

বাদল সরকার একটা ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। তিনি সবসময়ই নিজের ত্যাগকে মহিমান্বিত করতে চান, যা আমার কাছে অরুচিকর মনে হয়। আমার মনে হয় তার এসব কাজ উদ্দেশ্যমূলক। তিনি সবসময়ই দারিদ্র্যের মধ্যে কীভাবে থাকেন. কীভাবে তিনি হাঁটেন, চিনি ছাড়া চা খান, এসব কথাই বলেন। তিনি নিজেকে ঘিরে একটা ব্যক্তিগত উপকথা তৈরি করেছেন। বাদল সরকার বাংলায় কাজ করেন বাম ফ্রন্টের বিরুদ্ধে। বাংলা বিহারের গ্রামে তিনি বিভিন্ন চার্চ সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে কাজ করেন। বুর্জোয়া প্রেস তাকে খুব প্রচার দেয় এবং এরকম একটি ধারণা দিয়ে থাকে যে, তিনি নাটকে বিপ্লব করছেন এবং ভারতে পথনাটক তাঁরই আবিষ্কার। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমাদের নিজেদের কথা বলতে পারি- আমরা যখন আমাদের পথনাটক শুরু করি তখন আমরা তাঁর কোনো নাটক দেখি নি, এমনকি নামও শুনি নি। এটা বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। অন্য আরও অনেক গ্রুপের জন্য একথা সত্য। শরীর চর্চার কিছু কৌশল আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আছে যা কারিগরি ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর। কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ঐতিহ্যের সঙ্গে একটা সমালোচনামূলক সম্পর্কে যাওয়া। বাদল সরকারের সাথে যারা কাজ করেন তারা এরকম কোনো সম্পর্কে যেতে পারেন না। তাদেরকে ব্যক্তিক প্রভাব দ্বারা আপ্লুত থাকতে হয়। আমি তাঁকে সরাসরিও এসব কথা বলেছি।

Eugene van Erven
তিনি কী উত্তর দিলেন?

সফদর হাশমী
 (হাসি) তিনি হাস্যময় বুদ্ধে পরিণত হলেন।

Eugene van Erven
সামগ্রিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য উৎপল দত্তের মত ব্যক্তিরা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তিনি তো এখন রাস্তায় খুব কমই যান, তাই না? তাছাড়া বোম্বের আজেবাজে ছবিতে তার অংশগ্রহণ- এটাই বা কী ব্যাপার?

সফদর হাশমী
স্বাধীনতার পর উৎপল দত্তই প্রথম পথনাটক শুরু করেন। তিনি গ্রামে গ্রামে গেছেন, গেছেন দূরবর্তী জেলাগুলোতে। সর্বত্র তাঁর নাটক হয়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। উৎপলের বাস্তববাদী নাটক এক সময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। দীর্ঘ কাব্যময় কথন নাড়া দিত জনগণের আবেগকে। একই সময় তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের বেদনাদায়ক অধ্যায়ের উপর শক্তিশালী নাটক লিখেছেন। ১৯১৯ সালে অমৃতসরে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর ব্রিটিশ সরকার গুলি করে ৩০০ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছিল। তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। উৎপল এ বিষয়ের ওপর যাত্রার ভঙ্গিতে বেশ উঁচু মাত্রার নাটক লিখেছিলেন। আমি শুধুমাত্র এ কারণে এ নাটকটি বারবার করতে চাই যে, অমৃতসরের এ ঘটনাটি আমি জনগণকে জানাতে চাই এবং এর উপর আর কোনো ভালো নাটক নেই। এটি তাদেরকে অনেক কিছু ভাবতে শেখায়, উদ্বুদ্ধ করে। সাধারণভাবে আমি এমন ধরনের নাটক, চলচ্চিত্র বা চিত্রকলার বিরোধী যা মানুষকে আবেগে উদ্বেলিত করে। এটা অনেকটা আপনার মত গ্রহণ না করা পর্যন্ত একজনের কলার ধরে ঝাঁকানোর মত। সে অর্থে আমি ব্রেশটিয়ানের চাইতেও বেশি, আমি বরঞ্চ মানুষের যুক্তির কাছে যেতে চাই এবং বোঝাতে চাই বাস্তবে কী হচ্ছে। এরপরও বলবো ভারতের গণনাট্য আন্দোলনে উৎপল দত্তের অবদান অনেক-অনেক। সে তুলনায় বাদল সরকারের প্রভাব বরঞ্চ নেতিবাচক। এ ব্যাপারে আমি খুবই নিশ্চিত।

Eugene van Erven
আপনি বলেছেন যে আপনি আগে সিপিআই (এম) এর সঙ্গে কাজ করেছেন। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভেতরে কি শিল্পসংস্কৃতি নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে?

সফদর হাশমী
এ দেশের কোনো কমিউনিস্ট পার্টিই সারাদেশ জুড়ে সাংস্কৃতিকভাবে নিজেদের সংগঠিত করে নি। কোনো কোনো রাজ্য ব্যতিক্রম। পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ) এখনও টিকে আছে। এটি স্বাধীনতা পূর্বকালের সংগঠন, সেসময় এটি সর্বভারতীয় সংগঠন ছিল। এটি গঠিত হয় ১৯৪৩ সালে। ভেঙে যায় ১৯৫৮ সালে। পুনর্গঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। আবারো ভেঙে যায় এবং ১৯৭৭ থেকে এটি আবার নতুন করে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই তাদের দু’টি সক্রিয় শাখা আছে যেগুলো থিয়েটার গণসঙ্গীত এবং পাপেট নাটক করছে।

পশ্চিমবঙ্গে গণনাট্য সংঘ ভেঙে যায় ১৯৪৮ সালে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্যও এ সময়টি ছিল খুব সংকটজনক। আর সে সময় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের জন্ম হয়। বর্তমানে বাংলায় এটিই মূলধারার নাট্য আন্দোলন। ১৯৭৭ সাল থেকে গণনাট্য সংঘ শহরে নয় গ্রামাঞ্চলে সক্রিয়। কিন্তু এটা বলা ভুল হবে যে সিপিআই (এম)- এর রাজ্য কমিটির কোনো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সম্পর্কিত নীতি আছে।

Eugene van Erven
নির্দিষ্টভাবে আপনার ক্ষেত্রে তারা কি আপনার কাজে সহযোগিতামূলক ভূতিকা পালন করে?

সফদর হাশমী
পশ্চিমবঙ্গে গণনাট্য সংঘ এবং সিপিআই (এম)-এর মধ্যে খুবই জীবন্ত সম্পর্ক রয়েছে। এবই অবস্থা কর্নাটক, অন্ধ্র প্রদেশ এবং কেরালায়। যদিও সবগুলো সিপিআই (এম) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। বিহারে রাজ্য পর্যায়ে দুটো সংগঠন আছে। একটির নাম ‘রেভ্যুলুশনারী কালচারাল ফ্রন্ট’, এটি সম্প্রতি বিহারে রাজ্য পর্যায়ে সিপিআই (এম)-এর সহযোগিতায় গণনাট্য সংঘ সংগঠিত হচ্ছে। দিল্লীতে আমাদের কথা যদি বলি তাহলে আমরা নির্দিষ্টভাবে কোনো সংগঠন নই, একট ট্রুপ। প্রসেনিয়াম থিয়েটার দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। প্রদর্শনী এবং স্ক্রিপ্টের সংখ্যা বিবেচনা করলে আমরা প্রচুর কাজ করেছি, স্ক্রিপ্ট সারা দেশে বিতরণ করেছি-সম্ভবত যেকোনো সংগঠিত আন্দোলনের চাইতে আমাদের কাজ বেশি। এবছর ১৫ অক্টোবর আমাদের পথনাটক কার্যক্রমের ১০ বছর পূর্তি হবে। এর মধ্যে আমরা ৪ হাজারেরও বেশি প্রদর্শনী করেছি এবং ২০টিরও বেশি নাটক করেছি। ১১টি নাটক ভারতের প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নারী, মূল্যবৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা, শিল্পায়ন বিল ইত্যাদির উপর রচিত নাটক তামিল, কানাড়া, তেলেগু, মালয়ালা, বাংলা এবং পাঞ্জাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। আদি হিন্দুস্তানী আঙ্গিকে এগুলো উত্তর ভারতের সর্বত্র প্রদর্শিত হয়েছে। আমাদের হিসাবের বাইরেও এগুলোর হাজার হাজার প্রদর্শনী হয়েছে। আমরা মাত্র ১৪ জনের একটি ট্রুপ এবং সিপিআই (এম)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এরকম- সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আসবার আগেই আমরা কেউ কেউ সিপিআই (এম) এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম। যেমন ১৯৭০ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি সেসময় আমি সিপিআই (এম) এর ছাত্রফ্রন্টে কাজ করতে থাকি। ছাত্র-রাজনৈতিককর্মী হিসেবে আমি ভালো করতে পারি নি। সে সময় ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশন একটি সাংস্কৃতিক ইউনিটের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকি। সাংস্কৃতিক ইউনিট যখন করা হল তখন আমি তাতেই যোগ দিলাম যদিও শিল্পসাহিত্যে আমার তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এই ইউনিটে আমরা প্রথম ভিয়েতনামের উপর একটি নাটক করি বাংলা থেকে অনুবাদ করে। এরপর আমরা বিহারে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের উপর আরেকটি নাটক করি। বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্রকর্মী সাংস্কৃতিক ইউনিটে অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠেন। আমরা যখন গান আর নাটক শুরু করলাম তখর আরো বেশি বেশি করে তাতে জড়িত হয়ে পড়ছিলাম এবং উপলব্ধি করলাম যে, যেহেতু আমাদের কাজের ক্ষেত্র অনেক বেড়ে গেছে সুতরাং ছাত্র ফেডারেশনে শৃঙ্খলার মধ্যে আমাদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের যাবার দরকার হচ্ছে শ্রমিক, কৃষক, যুব নারী সকলের মধ্যে। কাজেই আমরা আলাদাভাবে একটি সাংস্কৃতিক ট্রুপ গঠন করলাম এবং গৌরবময় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এর নাম দিলাম আইপিটিএ (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশন-গণনাট্য সংঘ)। দিল্লীতেও আগে আইপিটিএ ছিল কিন্তু ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সময়ের মধ্যে এটি দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি শেষের দিকে বছরে একদিন দেখাসাক্ষাতের মত একটি ক্লাবে পরিণত হয়েছিল। কনট প্লেসে তাদের একটি অফিস ছিল। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন সম্পাদক সংগঠনের প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায় অফিসটি ব্যক্তিগতভাব দখল করেন এবং একে আমদানী রপ্তানী ব্যবসার একটি অফিকে পরিণত করেন। এই অফিস সম্পর্কে খোঁজ পেয়ে আমরা সেখানে যাই এবং অফিসটি ছেড়ে দিতে বলি। তারা রাজী হয় নি। আমরা সবাই ছিলাম তরুণ, ১৬/১৭ জন। কাজেই শেষ পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করেই কাজটা করতে হলো। ঐ ভদ্রলোক এবং তার জিনিসপত্র তুলে এনে বাইরে ফেলে দিলাম।

এই অফিসে আমরা প্রায় দেড়বছর কাজ করি। এ সময় আমরা পথনাটক শুরু করি নি, প্রসেনিয়াম থিয়েটারই করতাম। আমাদের একটি গানের দলও ছিল যা নিয়ে আমরা কারখানা গেটে, ধর্মঘট-কালীন অন্যান্য আন্দোলনের সময়, মে দিবস, অক্টোবর বিপ্লব ও অন্যান্য সময়ে আমরা গান করতাম। এখানে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনও তখন ছিল খুব প্রাথমিক অবস্থায়। ১৯৭৩ এর আগ পর্যন্ত এখানে সিপিআই (এম) হয়ই নি যদিও ১৯৬৫ সালেই এটি সর্বভারতীয় পর্যায়ে সংগঠিত হয়। কাজেই আমাদের সংগঠনের সঙ্গে সিপিআই (এম)-এর কোনো সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় নি।

Eugene van Erven
কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলো কখন? এটা কি মস্কো এবং পিকিং বিরোধের ফলাফল নয়?

সফদর হাশমী
ভাগ হলো ১৯৬৪ সালে। উল্লম্ব ভাগ, সব গণসংগঠনই ভাগ হলো। না, মস্কো এবং পিকিংকে কেন্দ্র করে এ বিরোধ ছিল না। জানি এভাবেই পশ্চিমা বিশ্বে বিষয়টিকে দেখা হয়, এটা ঠিক নয়। ১৯৫১ সাল থেকেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে স্বাধীনতা উত্তর ভারতের পরিস্থিতি ও করণীয় সম্পর্কে গুরুতর মতভেদ ছিল। একটি অংশ মনে করতেন স্বাধীনতার পর ক্ষমতা সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী বুর্জোয়াদের হাতে গেছে। তাদের লাইন ছিল শাসক বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রতিনিধি ভারতীয় কংগ্রেসকে সহযোগিতা দান করা। অন্য অংশটি মনে করতেন, স্বাধীনতার পর ক্ষমতা গেছে একচেটিয়া বুর্জোয়া এবং সামন্ত জোতদারদের অশুভ আঁতাতের কাছে। তাদের শ্লোগান ছিল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লদের। তারা কংগ্রেসের প্রবল বিরোধী ছিলেন। ৫১ থেকে সমস্যা থাকলেও তারা একইসঙ্গে কাজ করতেন। কিন্তু ১৯৬৪ নাগাদ তা তীব্র আকার ধারণ করে এবং ভেঙে যায়।

Eugene van Erven
আপনাদের জননাট্য মঞ্চ সম্পর্কে বলুন ...

সফদর হাশমী
১৯৭৩ সালের এপ্রিলে এটি গঠিত হয়। জননাট্য মঞ্চ সংক্ষেপে ‘জনম’। জনম থেকে আমরা প্রথম যে নাটক করি সেটি হচ্ছে উৎপল দত্তের লেখা। এটা আরউইনশ’-র লেখা ‘বিউরি দ্য ডেড’ নাটক অবলম্বনে লেখা ‘মরণের পরে’। প্রথম নাটক করে কিছু তহবিল সংগঠিত হল তা দিয়ে সংগঠনকে ভালো গোছানোর কাজে গুরুত্ব দিলাম। খুব শীগগীরই ৫০-৬০ জন হয়ে গেলাম। দিল্লীর ক‘জন খুব সম্মানিত ব্যক্তিত্ব আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। একজন তরুণ নাট্যকারের লেখা ‘দ্য আর্কিটেক্ট অব ইন্ডিয়া’, ‘ডেসটিনি’ ছিল পরবর্তী নাটক, জাতীয় সঙ্গীত থেকে শিরোনামটি নেয়া হয়েছিল। ৩ ঘন্টার নাটক। ব্রেশটীয় স্টাইলে করা। নাটকটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এটাকে এ বছর আমরা পার্ক কলেজচত্বর এবং শ্রমিক এলাকায় নিয়ে যেতে শুরু করলাম।

কোনো কোনো জায়গায় বিপুল দর্শক শ্রোতা পাওয়া গেল। উত্তর প্রদেশের পশ্চিম দিকে আমরোহা নামে এক শহরে প্রদর্শনী করলাম। প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘাঁটি। ১ লাখ জনসংখ্যার এ শহরে প্রথম রাতে হল ১০ হাজার, দ্বিতীয় রাতে ৩৫,০০০। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ-এর লেখা গান এবং এই নাটক সারারাত চলেছিল।

Eugene van Erven
নাটকের কাহিনী কী ছিল?

সফদর হাশমী
একটি ছোট গ্রাম। নির্বাচন, দুই পার্টির দু’জন প্রার্থী এদের একজন পুঁজিপতি, অন্যজন বড় জোতদার। ব্যাপক নির্বাচনী প্রচার চলছে কথ্য অকথ্য সব পদ্ধতি ও উপায়ে। শ্রমিক মেহনতি মানুষেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কাকে ভোট দেবেন কেননা দু’জন প্রার্থীই তাদের শত্রু। এক পর্যায়ে তারা নিজেদের একজন প্রার্থী দাঁড় করালেনÑএকজন নাপিত। সবচাইতে ‘নিচু’ জাতের ‘হরিজন’- অস্পৃশ্য। জনগণ তাকে গ্রহণ করতে থাকলো। অন্য দু’জন প্রার্থী বিপদ দেখে ঐক্যবদ্ধ হল এবং ভাড়াটে খুনীর মাধ্যমে গরীব প্রার্থীকে খুন করলো। এখানেই কাহিনী শেষ কিন্তু নাটক শেষ হয় দু’জন কথকের কথা ও গানের মধ্য দিয়ে। সেখানে শত্রু চিহ্নিত করার ও সংগ্রাম অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে সামনে আনা হয়।

Eugene van Erven
কথকদের ভূমিকা কী থাকে?

সফদর হাশমী
আমাদের ঐতিহ্যগত লোকনাট্যে নট বা নটি নামের কথকের একটা ভূমিকা থাকে। সংস্কৃত থিয়েটারে একে বলে সূত্রধর। নট নাটকের সব দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে এবং কাহিনীর সূত্রগুলো জনগণকে ধরিয়ে দেন। সে সময়ে বিপরীত নট দর্শকদের মধ্যে থেকে উঠে এসে প্রশ্ন করেন ‘কী হয়েছে মানুষকে এটা বললেই চলবে না, কেন হয়েছে এটাও বলতে হবে’। গান ও কথার মধ্য দিয়েই কথকের এই কাজ।

Eugene van Erven
এরপর অন্যান্য ...

সফদর হাশমী
এর পরপরই আমরা ‘বকরি’ নামে অন্য একটি নাটক করি। আপনারা জানেন মহাত্মা গান্ধী বকরি ভালোবাসতেন। নাটকটি সঙ্গীত নির্ভর। আঙ্গিকটা নেয়া হয়েছে উত্তর প্রদেশ এবং হরিয়ানার লোকথিয়েটার থেকে- নওটাঙ্কি।

এখানে আছেন নট ও নটি, বহুমানুষ এখানে গান করনে, নাচেন। এ নাটকটিও বিপুল মনোযোগ ও প্রশংসা আকর্ষণ করে। এটা আমরা ঘরে করেছি, বাইরে-কলেজে, শ্রমিক এলাকায়, গ্রামেও করেছি। ৫০টি প্রদর্শনী করেছি এ পর্যন্ত। জরুরি অবস্থা জারীর পূর্ব পর্যন্ত এটি আমরা করেছি।

১৯৭২ সালে আমরা যে নাটকটি প্রথম পথে করেছিলাম তা এখানে উল্লেখ করতে হয়। সেটি ছিল ভিয়েতনামের উপর। ‘নিক্সন-কিসিঞ্জার সংলাপ’। এই সংলাপের মধ্য দিয়েই ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের লেজে-গোবরে অবস্থা, জনগণের সংগ্রামের বিশাল শক্তির বিষয় আনা হয়েছে। সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে গান, নাচ। এটা আমরা করছি দিল্লীর ইউসিস অফিসের সামনে।

১৯৭৫ এর ১২ জুন আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটা ঘটনা ঘটলো। এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দিল যে, ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে বিজয়ের জন্য অসদুপায় অবলম্বন করেছেন, তাকে লোকসভার আসন ছেড়ে দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদও ছাড়তে হবে। ইন্দিরা এ রায় মানলেন না, সুপ্রীাম কোর্টে গেলেন ১৩ দিন পর সুপ্রীম কোর্ট রায় দিল যে, তিনি কোনো অসদুপায় অবলম্বন করেন নি। পরদিনই তিনি দেশে জরুরি অবস্থা জারী করলেন। সকল বিরোধী নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করলেন। ১৮ মাস ভয়াবহ নির্যাতন ও দমনপীড়ন চললো। তিনি পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানানোর পরই আমরা একট পথ নাটক লিখলাম ‘কুরসি কুরসি কুরসি’। একজন রাজার সঙ্গে গদির বৃত্তান্ত। তিনি যেখানে যাচ্ছেন, গদিও সেখানেই নিয়ে যাচ্ছেন, হাজার চেষ্টা করেও দুটোকে আলাদা করা যাচ্ছে না। অফিস এলাকায়, শ্রমিক এলাকায় এটা বিপুল সাড়া সৃষ্টি করে। দর্শকরাও আমাদের পরামর্শ দেন- আরও কী কী সংলাপ যোগ করা যায় সে সম্পর্কে। জরুরি অবস্থা জারীর পর আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এই ১৮ মাস আর প্রায় কোনো কাজই হয় নি- হওয়া উচিত ছিল।

১৯৭৭ এর ডিসেম্বরে দিল্লীতে আবার গ্রুপ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেই। জরুরি অবস্থার উপর উৎপল দত্তের একটা নাটক বাংলা থেকে অনুবাদ করে ‘নাউ ইজ দ্য কিংস’স টার্ন টু প্লে’ নামে করা হয়। এটা অনেকটা যাত্রা ঢঙে করা। খুবই ব্যঙ্গাত্মক ও আক্রমণাত্মক নাটক এটি।

Eugene van Erven
উৎপল দত্ত কি এটা জরুরি অবস্থার সময়েই লিখেছিলেন?

সফদর হাশমী
আমার তাই ধারণা। বাংলার পরিস্থিতি এখানকার চাইতে অনেক খারাপ হয়েছিল। আমরা যে পরিস্থিতি ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত দেখেছি, বাংলার জনগণ তা ১৯৭২ থেকেই দেখে আসছিল। কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর সেখানে নির্মম নিপীড়ন চলে। শুধুমাত্র সিপিআই (এম)-এরই ১২০০ কর্মী নিহত হন। জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসে। একই শ্রেণীর প্রতিনিধি। শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা আরেকটি পথনাটক করতে উদ্যোগী হই। দিল্লীর বাইরে একটি রাসায়নিক কারখানার শ্রমিকেরা খুব সামান্য একটি দাবী জানিয়েছিলেন। দাবীটি হল যেহেতু শ্রমিকেরা ১৫/২০ মাইল দূর থেকে আসেন সুতরাং সাইকেল রাখার একটি জায়গা দিতে হবে এবং ফ্যাক্টরির মধ্যে একটি ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে তারা চা খেতে পারেন। নিজেদের খাবার গরম করতে পারেন। ম্যানেজমেন্ট এটাতেও রাজী নন। শ্রমিকেরা এ দাবীতে ধর্মঘটে গেলেন। জনতা পার্টির পুলিশ তাদের উপর হামলা চালালো। গুলিতে নিহত হলেন ৬ জন শ্রমিক।

শ্রমিক এলাকায়, কৃষক অঞ্চলে আমরা যাতে নাটক নিয়ে যেতে পারি সেজন্য এমন নাটক করতে উদ্যোগী হলাম যা (ক) কম ব্যয়বহুল (খ) পরিবহনযোগ্য ও স্থানান্তরযোগ্য এবং (গ) কার্যকর। ভিয়েতনামের উপর নাটক ও ইমার্জেন্সীর আগের নাটকের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা নতুনভাবে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে উদ্যোগী হলাম। সে সময়ই জনতা সরকার শ্রমিকরিরোধী নতুন শিল্প সম্পর্ক বিল জারীর উদ্যোগ নিয়েছিল- প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার ঠিক এরকম আইনই আবার পাশ করতে উদ্যোগী হল। বিলের মোদ্দা কথা হল এই যে- ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দমন করবার জন্য স্থানীয় সরকারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হবে, সতর্কতামূলক আটকের অধিকারও থাকবে। আলোচনা দরকষাকষির সুযোগ সীমিত থাকবে। শ্রমিকদের অনেক গণতান্ত্রিক অধিকারও কেড়ে নেয়ার ব্যবস্থা হল। আমরা ক্যান্টিনের ঐ ঘটনা ও এই বিল সম্পর্কিত করবার চেষ্টা নিলাম।

আমরা ৬ জন ৩ দিনে স্ক্রিপ্ট দাঁড় করলাম। আমাদের শরীর দিয়ে আমরা বানালাম মেশিন। ৫ জন (৩জন শ্রমিক ১ জন পাহারাদার এবং মালিক) এসে ঐ মেশিন চালু করবে, নানা রকম শব্দ করে বোঝাবে। কথক কথা বলবে। হঠাৎ করে মেশিন বন্ধ হবে। কথক প্রশ্ন করবে- ‘কী হল? মেশিন বন্ধ হল কেন? কেউ একজন কিছু বল!’ তখন মেশিনের একটি যন্ত্রাংশ এসে বলে ‘আমি বন্ধ করেছি। আর সহ্য হচ্ছে না’। ১ জন শ্রমিক তখন তার সঙ্গে মেশিনের শোষণমূলক সম্পর্কের কথা বলতে থাকে। তিনি মেশিনের জন্য- মালিকের জন্য- পুঁজির জন্য কাজ করেন কিন্ত বিনিময়ে পান পাহারাদারের কাছ থেকে নিপীড়ন। এরপর মালিক- পাহারাদার আসে- তাদের কথা বলে। কথক এরপর কথা বলতে চায়- কিন্তু যন্ত্রের মধ্যে বিস্ফোরণ হয়। শ্রমিকরা দাবী জানাতে থাকে। পাহারাদার গুলি করে হত্যা করে। কথকের কথা এবং এরপর শ্রমিকদের উত্থানের বিভিন্ন ঘটনা ও ভঙ্গি দিয়ে নাটকের শেষ হয়।

‘মেশিন’ এই নাটকটি ১৯৭৮-এ ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৭,০০০ ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সম্মেলন উত্তর ১৬০,০০০ শ্রমিক সমাবেশে অত্যন্ত সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়। এটি হয় স্টেডিয়ামে। অন্যান্য অঞ্চলেও এটি মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি স্বল্পস্থায়ী ছিল, এজন্য এর সঙ্গে আরেকটি নাটক যোগ করলাম। এটির বিষয়বস্তু গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া কৃষক। নাম ‘ফ্রম দ্য ভিলেজ টু দ্য সিটি’ এর মধ্যে অনেক গান আছে। ৭৮ এবং ৭৯ সালে আমরা এর ১৫০টি প্রদর্শনী করি। দুটো নাটক মিলিয়ে ৪০ মিনিটের অনুষ্ঠান।

১৯৭৮-এ আমরা আরেকটি নাটক করি সাম্প্রদায়িকতার ওপর, আলিগড়ে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। দিল্লী থেকে ৯০ মাইল দূরে আলিগড়ে একটি ছোট শহর। হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯৭৮ সালে সংঘটিত দাঙ্গা আগেরগুলো থেকে ভিন্ন। জানেন যে, আলিগড় তালা তৈরির জন্য খ্যাত। এখনও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আলিগড় তালা-কারিগরদের তালাই ব্যবহৃত হয়। এখানে মুসলিম এবং হিন্দু কারিগররা সম্পূর্ণভাবে পরস্পর- নির্ভরশীল। কিছু কিছু কাজ ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুরা করে থাকেন, কিন্তু কাজ করেন মুসলমানেরা। জানা কথা কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে এই তালা শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। যদি মুসলিম-হিন্দুরা এক সঙ্গে কাজ করতে না পারেন তাহলে তালাও বানানো বন্ধ হয়ে যাবে। জানা গেছে, গত দু’বছরে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানের অধীনে আলিগড়ে দুটো বৃহৎ তালা কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা আরও বৃহৎ আকারে ঐতিহ্যগত তালা উৎপাদন করে। ঐতিহ্যগত তালা শিল্পগুলো ধ্বংস করবার জন্য দাঙ্গা লাগানো এবং কারিগরদের বৃহৎতালা শিল্পে মজুর হিসেবে নিয়োগ করবার জন্য দাঙ্গা লাগানো তাদের স্বার্থেই দরকার। এই বিষয়ের ওপরই পরবর্তী নাটক তৈরী করেছি। নাম ‘খুনি’ (কিলারস)। এই নাটকটিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এবং উত্তর ভারতে অনেকেই এই নাটকটি করেছেন।

এতে তেমন কোন কাহিনী নেই। প্রথমে তালা বানানো এবং বহু হাত ঘুরে তার পণ্য হয়ে উঠার প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। কীভাবে দু’টো ধর্মীয় সম্প্রদায় পরস্পর মিশে আছে, পরস্পরের উৎসবে যাচ্ছে, খেলছে, গান গাইছে তা-ও দেখানো হয়েছে। এরপর দেখিয়েছি এদের মধ্যে ৩ জন হীনমতলববাজ ঘুরছে। একজন প্রশাসক, একজন শিল্পপতি এবং একজন ভাড়াটে দাঙ্গাবাজ। দাঙ্গা শুরুর পর কারিগরেরা প্রথম গেলেন প্রশাসকের কাছে, তারপর মালিকের কাছে, তারপর ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। কাজ হল না, সকলেই দাঙ্গায় নিহত হলেন। মৃতদের তথ্য থেকে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন; ‘সবকিছু তো দেখলেন, এখন আপনাদের দায়িত্ব চোখ খোলা রাখা এবং আসল যারা শত্রু তাদের খুঁজে বের করা।’ এর জন্য আমি দু’তিনটি গানও লিখেছি।

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা প্রথমবারের মত সত্যিকার অর্থে নাটক যেভাবে করা উচিত সেভাবে করলাম। একটা ঘটনা ঘটলো যার পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমরা নাটক তৈরি করলাম এবং পুরো শহরে সেটা নিয়ে ঘুরলাম। যেখানেই আমরা এটা করলাম সেখানে একে কেন্দ্রবিন্দু করেই জনগণের ব্যাপক সমাবেশ হল এবং সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টির অবস্থা তৈরি হল। ঘটনাটি বলি। নির্দিষ্ট তারিখ মনে নেই। পরপর ৩ দিন বন্ধ ছিল। শুক্র, শনি, ও রবিবার। বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লী ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন বাস ভাড়া প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধির ঘোষণা দিল। তাদের ধারণা ছিল সবচাইতে সংগঠিত শক্তি হচ্ছে ২ লাখ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। ৩ দিনের ছুটিতে তারা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং কোনো প্রতিরোধ হবে না। আসলেও অনেক বিক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও শক্তিশালী সংগঠিত প্রতিরোধের অভাবে লোকজন নতুন ভাড়া দেয়া শুরু করেছিলেন।

বিকেল ৪ টায় অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভার খবর জানিয়ে ছাত্র ফেডারেশনের এক নেতা আমাকে এ বিষয়ে নাটক করবার অনুরোধ জানালেন যখন; তখন বাজে সকাল সাড়ে ১০টা। ভাবি নি, কিছু করতে পারবো, তবুও দু’টোয় সবাইকে নিয়ে বসলাম। গান তৈরি করলাম, সুর দিলেন আরেকজন। এবং দু’ঘন্টার মধ্যে একটি কাঠামোও দাঁড় করালাম। প্রথমে এটি করলাম সুপার বাজারে, তারপর কনট প্লেস এলাকাতেই করলাম আরও একটি। বাসস্ট্যান্ডে করলাম কয়েকটি। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হল। নাটকটি ছিল এরকম- দিল্লী ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের (ডিটিসি) বাস থামানোর একটি চিহ্ন আছে। ওটি দিয়েই আমাদের নাটক শুরু। এরপর শিল্পীর বাস ধরার জন্য লাইন ধরে ঠেলাঠেলি করছেন। একজন বললেন, এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছি, এখনও বাস নেই। তারপর একটি বাস এলো, এরকম ধরে নিয়ে ঠেলাঠেলি। তারপর আর একটি চলে গেলো- না থেমে। তারপর আরেকটি, উঠার চেষ্টা, ব্যর্থ। একজন বৃদ্ধা চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গেলেন রাস্তায়। বিক্ষুদ্ধ যাত্রীরা মিছিল নিয়ে গেলেন কর্পোরেশন অফিসে, বিক্ষোভের মুখে ম্যানেজার এসে বললেন, সার্ভিস ভালো করবার জন্য আমরা ভাড়া বাড়াতে যাচ্ছি। তারপর বিক্ষুদ্ধ যাত্রীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ, বিক্ষোভ। এখানেই ফ্রিজ এবং সেইসঙ্গে গান। গানের কথা হচ্ছে- মুখ খুললেই মারে পুলিশ, বুলেট আসে/আসুন তবে হাত ধরি আর যুদ্ধ করি একসাথে।

প্রথম দিন ৪টি শো’ করলাম। তারপর তার আরও কিছু উন্নতি করে পরবর্তী ৪ দিনে শো’ হল ৪৮টি। এক একটা শো’ করার জন্য আমরা যখন সরে যাই, তখন আগের দর্শকের অনেকে আমাদের সঙ্গে যেতে থাকেন। এভাবে দেখা যায় কয়েকটি শো’র পর এটি বিরাট এক জনসভার রূপ নেয়।

Eugene van Erven
এরপর কোনটি?       
 
সফদর হাশমী
এরপরের নাটক বলতে হয়- এখন পর্যন্ত সবচাইতে সফল নাটক আমরা দাঁড় করাই ঐ বছরেই পরের মাসে, মার্চে। নাটকের নাম ছিল ‘আওরত’। ১৯৭৯ সালের ২৫ মার্চ ‘নর্থ ইন্ডিয়ান ওয়ার্কিং ওমেনস কমিটি’ গঠন উপলক্ষে এটি রচিত হয়। এরপর আমরা আরেকটি নাটক তৈরি করি, নাম ‘৩ কোটি’। এটি দেশের শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে লেখা। এই সংখ্যা এখন আরও বেড়েছে। এই নাটকের উপলক্ষ্য ছিল ৩ দফা দাবীতে দিল্লীতে ‘সর্বভারতীয় ছাত্র-যুব সভা’। ৩ দফা দাবী ছিল- বেকার ভাতা প্রদান, শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা এবং ভোটাধিকারের বয়স ১৮ তে নামিয়ে আনা।

১৯৮০ সালের মার্চে আরেকটি নাটক করলাম, নাম ‘দামবৃদ্ধি’। এ নাটকের জন্য আমরা দিল্লীর রাস্তায় রাস্তায় পরিচিত যাদুকর ও তার বালকের আঙ্গিকটি ব্যবহার করেছি। যাদুকরেরা একটি কালো কাপড় দিয়ে বালকটিকে ঢেকে ফেলে এবং তাকে দিয়ে যাদুবিদ্যার কারিগরি প্রদর্শন করে। আমাদের নাটক এভাবেই শুরু হয়। বালকটি কাল চাদর গায়ে দিয়ে ভিন্ন একটি মাত্রা লাভ করে এবং সব কিছুর ভেতরের খবর সে জানতে পারে। যাদুকর তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এতসব মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে কেন?’ বালক বলে ‘তাঁরা ক্ষুধার্ত, তারা এখানে এসেছে যদি কিছু রুটি পাওয়া যায় সেই আশায়’। আসল যাদুকরদের খেলায় বালক যা খুশি তাই করতে পারে। কিন্তু এখানে যাদুকর তাকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি তাদের জন্য রুটি জোগার করতে পার?’ বালক উত্তর দেয়, ‘মনে হয় না’। যাদুকর তবুও তাকে চেষ্টা করতে বলে। বালক তারপর ঘুরতে ঘুরতে একস্থানে গিয়ে দেখে এক ব্যবসায়ী সব রুটি মজুত করে রেখেছে। বালক সেগুলো নিতে চেষ্টা করে ব্যবসায়ী বাধা দেয়। তারপর ব্যবসায়ীকে পরাজিত করে বালক রুটিগুলোকে নিয়ে আসে। রুটিগুলোর সঙ্গে একজন অভিনেতা ছিলেন, তিনি এরপর নিজের জীবন কাহিনী নিয়ে একটি গান পরিবেশন করেন। জমিতে তার জন্ম হয় ‘কৃষক তাকে যত্ন-শ্রম দিয়ে বড় করেছেন, কেটেছেন, তারপর রুটি হিসেবে বাজারে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী তাকে করে রেখেছে বন্দী। রুটির শেষ কথা- যারা তাকে এত কষ্ট করে উৎপাদন করেছে, সে তার কাছেই যাবে। এরপর যাদুকর জনগণকে বলে, আপনাদের রুটি আপনাদের জন্য মুক্ত করেছি। এখন আপনারা বাকিটা দেখুন। সে তারপর চলে যায়। কিন্তু ব্যবসায়ী এসে আবার রুটিকে ধরে বেঁধে নিয়ে যায়। যাদুকর ও বালক আবার চেষ্টা করে রুটিকে মুক্ত করতে। এই সময় যাদুকর ও বালক মন্ত্রীর কাছে যায় এবং বলে যে, রুটি আটক আর জনগণ ক্ষুধার্ত। এ অবস্থার অবসান করতে হবে। ঝগড়া চলতে থাকে। এর মধ্য দিয়ে মন্ত্রীর আসল চেহারা বের হয়ে। মন্ত্রীকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়- ‘তাহলে মন্ত্রী হয়েছেন কেন?’ মন্ত্রী বললো- ‘নিজেকে ধনী করবার জন্য’। যাদুকর- ‘তাহলে গত নির্বাচনের সময় কেন মানুষের পায়ে ধরেছেন?’ মন্ত্রী- ‘দরকার হলে গাধার পাও ধরতে হয়’। যাদুকর- ‘নির্বাচনে জিতেছেন কীভাবে?’ মন্ত্রী- ‘শিল্পপতিদের দেয়া টাকার জোরে’। যাদুকর- ‘মন্ত্রী হয়েছেন কেন?’ মন্ত্রী- ‘জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির জন্য এবং জোতদারদের সেবা করবার জন্য’। এরপর আরও কিছু বক্তব্য এবং গান। শেষে যাদুকরের কথা- এগুলো কোনো যাদু নয়। গত ৪০ বছরের কাহিনী। আপনারা কি শুধু তালি দেবেন, না আর কিছু করবেন?

অর্ভিনয়ের পরই আমরা নাটকের স্থান ত্যাগ করি না। সাধারণত আমরা এসব স্থানে বসি এবং কথা বলি। অনেক গ্রুপ দেখি এসব নাটক করতে গিয়ে দর্শকদের অংশগ্রহণের নামে তাদের কাউকে কাউকে টেনে তাকে হাস্যস্পদ বানায়। এটা জনগণের প্রতি এক ধরনের অশ্রদ্ধা, যার আমরা চরম বিরোধী।

১৯৮১ সালের মার্চে আমরা নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত একটি ঘটনার ওপর নাটক করি। সাম্প্রদায়িকতা এবং সা¤্রাজ্যবাদ নিয়েও নাটক করা হয়।

১৯৮৭ তে আমরা করি শিশুনীতির বিরুদ্ধে শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে একটি নাটক। এ সময়ের মধ্যে অবশ্য আরও নাটক করা হয়। গত সাড়ে ৯ বছরে আমরা ২২টি নাটক করি।

Eugene van Erven
আপনাদের সংগঠনের সদস্যদের পেশা কী?

সফদর হাশমী
আমার স্ত্রী স্কুল শিক্ষক। একজন সরকারি কর্মকর্তা। আরেকজন পত্রিকা অফিসে অনুবাদের কাজ করেন। একজন প্রিন্টিং প্রেস চালায়। আমি ফ্রিল্যান্সার। আমাদের সবার গড়পড়তা বয়স মধ্য ত্রিশ। সবচাইতে বয়ষ্ক সদস্যের বয়স ৪৮। আমরা সবাই একটা অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছি। এই কাজই আমাদের জীবনের প্রধান দিক।

Eugene van Erven
খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কি আপনার কোনো আগ্রহ নেই?

সফদর হাশমী
আমরা সবাই এরকম অনেক সুযোগ পেয়েছি। প্রত্যাখ্যান করেছি। অর্থনৈতিক সমস্যা আমাদের বিরাট। কোনো স্পন্সর নেই। রাজনৈতিক দল, গণ-শ্রেণী সংগঠনেরও আর্থিক অবস্থা খারাপ। পেশাভিত্তিক কাজ না করলে খুব অসুবিধা কিন্তু এখনও কাজ করতে পারছি। আমাদের আরও অনেক পরিকল্পনা আছে, অর্থাভাব সেখানে বড় সমস্যা। একটা ইন্সটিটিউট করা খুব দরকার। গণমুখি প্রগতিশীল থিয়েটারের নাট্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, সফর, সংগ্রহ, গবেষণা সবই থাকা দরকার। এখনও এটা আমাদের স্বপ্ন পর্যায়ে আছে। কিন্তু খুব সক্রিয় স্বপ্ন।

এখন দিল্লীতে আমাদের মতই আরও গ্রুপ করবার চেষ্টা করছি। এছাড়া কাজের বিকাশের সম্ভাবনা নেই। যদি আমরা একটি গ্রুপ হিসেবেই থাকি, তাহলে তা ভেঙে যাবার সম্ভাবনা থাকেই। কিন্তু যদি একটা আন্দোলনের মধ্যে থাকি তাহলে তা বিকশিত হবে।

Eugene van Erven
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারণা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কিছু বলুন।

সফদর হাশমী
সাংস্কৃতিক বিপ্লব গড়ে তোলে একটি পার্টি। একটা সাংস্কৃতিক ট্রুপের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্যে অনেক কাজ অন্তর্ভুক্ত- ব্যাপক গণশিক্ষা প্রচলন, সাহিত্যের গোপন সম্ভার উন্মুক্ত করা, চলচ্চিত্র ও থিয়েটারের নতুন ধারা নির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করা, নতুন সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিস্তার।

চার্চ এবং চার্চভিত্তিক বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এ দেশে অনেক ক্ষতিকর কাজ করছে। এদের অনেকে সংগঠিতভাবে বাম আন্দোলনের বিরুদ্ধে কাজ করছে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্তরে আমরা নেই। আমরা এখন একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদনের জন্য শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করবার কাজটিকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এটাই আমাদের কাজ। গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল গল্পকার, কবি, সঙ্গীত দল তারাও একাজ করছেন।

কদ্দিন লাগবে জানি না, তবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হবার পরই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আসল কাজ শুরু হবে। এখন যা ব্যক্তিগত স্বপ্ন, তখন তা-ই হবে কাজের প্রধান ধারা। আমি জানি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাংস্কৃতিককর্মীদের মধ্যেও এরকম স্বপ্ন আছে। আমরা সবাই বস্তুত- সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি।

আনু মুহাম্মদ :  সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।