Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

ডেবে গেছে প্রাচ্যের চাকা বিষণ্ন আজ যৈবতী কন্যার মন তবুও পুত্র ধাবমান স্বর্ণবোয়াল পানে

Written by হাসান শাহরিয়ার.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

স ম্পা দ কী য়

আমাদের সবার, হয়তো-বা সবার না, সবার হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, কারণ ব্যাপারটি শোকের এবং শোকের আয়ু বেশিদিন থাকার কথা না, এবং তাই, আমাদের সবার না- কারো কারো চিন্তায় বা ভাবনায়, ক’দিন আগের ১৪ জানুয়ারির কথা মনে পড়ে, এবং আমাদের মনে থাকে যে, সেটা ২০০৮ সাল, এবং মনে পড়ে, সেদিন আমরা এক প্রধান নাট্যকারের প্রয়াণ দেখেছিলাম।

এ-প্রয়াণ সবার মাঝে আকস্মিকভাবে হাজির হয়, এবং তাই সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, এবং তখন সবাই ভাবে যে- সেলিম আল দীন তো এমন ছিলেন না। সেলিম আল দীন এমন ছিলেন না, কারণ তিনি প্রচার-বিমুখ ছিলেন না, তিনি তাঁর যে-কোনো সৃষ্টির ভ্রুণাবস্থা থেকেই আপ্লুত হতে থাকতেন এবং একটি বা বলা যেতে পারে আরেকটি শিল্পকর্ম অচিরেই পৃথিবীর আলো দেখবে বলে জানান দিতে থাকতেন, এবং এ-ও জানান দিতে থাকতেন যে, শীঘ্র-আসা শিল্পকর্মটি একেবারে নতুন- তা আঙ্গিকগতই হোক আর কনটেন্টগতই হোক। এমত চারিত্র্য লক্ষণের শিল্পীর তো এভাবে আকস্মিক প্রয়াণ হওয়ার কথা না- তাই, এই প্রয়াণে ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে কারো উপায় থাকে না।

যিনি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেন, অনেককে, হয়তো-বা সবাইকে, তিনি তাঁর সৃষ্টি দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ানো শুরু করেছিলেন বেশ আগেই এবং তাই অনেকের ১৯৭২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্যপ্রতিযোগিতার কথা মনে পড়ে এবং জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন নাটকটির কথাও মনে পড়ে এবং মনে পড়ে যে নাটকটি এ্যাবসার্ডধর্মী ছিল- যদিও বাংলানাট্যের এ্যাবসার্ড নাট্যকার সাঈদ আহমদের বিবেচনা অনুযায়ী এটা এ্যাবসার্ড নাটক না- এ্যাবসার্ড-প্রবণ নাটক, তখন আমরা অন্তত বুঝতে পারি যে, এটা নিরীক্ষাধর্মী নাটক ছিল- নিরীক্ষা কেবল কনটেন্টেই না, নামেও এবং আমরা অনেকেই স্মরণ করতে পারি যে, স্বাধীনতার পর পর হয়ে যাওয়া ঐ উৎসবটি নাগরিক নাট্যচর্চার দ্বার উন্মোচন করেছিল এবং সেই সাথে আগাম জানান দিয়েছিল যে, স্বাধীন দেশে নিয়মিত নাট্যচর্চা হবে এবং এতে নেতৃত্বে থাকবে আমাদেরই নাট্যকারেরা এবং ১৪ জানুয়ারি এদের অনেকেরই মনে পড়ে যে, সেলিম আল দীন সেই সব নাট্যকারদের মধ্যে প্রধান একজন হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রধান নাট্যকার জীবদ্দশায় প্রতিটি বাঁকে বাঁকে দর্শক-সমালোচককে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়েছেন এবং কোনো না কোনো ফর্মে বা কনটেন্টে দর্শক-সমালোচক স্থির হওয়ার আগেই নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় নেচেছেন এবং তাই, অনেকে স্মরণ করে যে, কোনো নাটকের প্রশংসার পর সেই সমালোচকের দ্বারাই পরের নাটক প্রায় খারিজ হওয়ার উপক্রম হয় এবং এটা লক্ষ্য করে সেলিম আল দীন তাঁর স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলেছিলেন যে- শকুন্তলা দেখার পর রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকেই বেশ আপ্লুত হলো, কিন্তু কিত্তনখোলা দেখার পরই বললো সেলিম ভাই এটা কী করলেন আপনি! কোনো নায়ক নাই, মেইন কোনো ক্যারেক্টর নাই, কিছুই বোঝা যায় না। কেউ কেউ বললেন এটা নাটক না উপন্যাস? আমার বয়োজ্যেষ্ঠ এক নাট্যকার বললেন- সেলিম তুমি এটা আবার লেখ, একটু পরিবর্তন করো। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে- আমি যা-ই লিখে থাকি না কেন, আমি আলাদা কিছু লিখেছি।- এবং এভাবে বলাটাকে আমাদের অনেকের কাছে ঐদ্ধত্বপূর্ণ মনে হলো কিন্তু তারপরও আমাদের বলার কিছু থাকছিল না, কারণ, তারপর সেলিম আল দীন আমাদের সামনে যৈবতী কন্যার মন আর হাত হদাই আর চাকা নিয়ে হাজির হন এবং শিল্পের নতুনত্বে আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেতেই থাকি। আমাদের অনেকের তখন সেলিম আল দীনের আরেকটি উক্তির কথা স্মরণ হয় এবং উক্তিটি আমাদের ঠোঁটে ফুটে ওঠে- এবং এ-ও বুঝলাম নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং ঢাকা থিয়েটার যদি আমার পাশে থাকে আমার পথ চলায় আর কোনো বাধা আসবে না।- এবং আমাদের স্মরণ হয় যে, তাঁর এই উক্তিটি সাম্প্রতিককালে করা, এবং সাম্প্রতিককালে করার ফলে উনি একজনের নাম উল্লেখ করতে ভুলে যান বা সেই নাম উল্লেখ করার আর প্রয়োজনও পড়ে না, কারণ, ততদিনে সেলিম আল দীন-নাসির উদ্দীন ইউসুফ-ঢাকা থিয়েটার প্রায় একটি মাত্র শব্দ হয়ে ওঠে। উনি একটি নাম ভুলে যান এবং এই নামটি আমরা প্রায় সবাই স্মরণ করতে পারি এবং আমরা বলাবলি করি যে, সৈয়দ জামিল আহমেদ চাকা নির্দেশনা দেয়ার পর যদি আরও বেশি সেলিম আল দীন-প্রিয় হতেন বা সেলিম আল দীন যদি সৈয়দ জামিল আহমেদ-প্রিয় হতেন তাহলে ঢাকার মঞ্চটা আরও বেশি করেই ফুলে ফেঁপে উঠতো। কিন্তু আমরা চাইলেই সেলিম আল দীন তা করতে বাধ্য নন, কারণ, ৭০ দশকের পর থেকেই তিনি তাঁর কাজের ‘রোড ম্যাপ’ এঁকে ফেলেছেন এবং তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যে, বাঙলা নাটকের মুক্তি দিতে হলে নিজস্ব নাট্য-আঙ্গিক নির্মাণ করতে হবে এবং এধরনের মৌলিক চিন্তাভাবনার জন্য নিজস্ব ও স্থায়ী প্লাটফর্ম দরকার এবং তা কেবল একটি নাট্য-সংগঠন দিয়ে সম্ভব না, তখন আমাদের অনেকের স্মরণ হয় যে, নিজস্ব নাট্য-আঙ্গিক নির্মাণকল্পে প্রয়োজনীয় গবেষণার জন্য সেলিম আল দীন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ চালু করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ চালু হওয়ার পর তাঁর তথাকথিত ‘ৗদ্ধত্ব’ আমরা আরো বেশি করে উপলব্ধি করি এবং আমরা দেখতে পাই যে, নাট্যতত্ত্ব বিভাগটি আসলে তাঁর একটি গবেষণাগারে পরিণত হয়। এবং আমরা লক্ষ্য করি, এই গবেষণাগার থেকেই  যৈবতী কন্যার মন, হাত হাদাই, চাকা, হরগজ নাটক লিখিত হয়, কিন্তু বিভাগ থেকে যে নতুন ‘সেলিম আল দীন-দের’ জন্ম নেয়ার কথা ছিল, সেই পথটি রুদ্ধ হয়। এবং তখন অনেকেরই স্মরণ হয় যে, ঐ বিভাগের কামালউদ্দিন কবির বা সাজেদুর রহমান চঞ্চল- যারা কিনা বিভাগের  কৃতি ছাত্র ছিল এবং যারা কিনা ম্যালা কাজ করেছে স্নাতকোত্তর পাশের পরেও, এবং দুজনার মধ্যে শেষজন এখন সেলিম আল দীনের মতোই নামের আগে ‘ড.’ লিখে মফস্বল শহরে নাটক নির্মাণ করে চলেছে এবং প্রথমজন ‘ড.’ লেখার জন্য ধাবমান এবং ইতোমধ্যেই সে আরেক প্রধান নাট্যকার, যদিও বয়স মাপলে অনেককে ‘প্রধান’ বলাটা গর্হিত, তবুও কাজের সাথে পরিচিতজনেরা তাকে ‘প্রধান’ বলতেই চান- সেই বদরুজ্জামান আলমগীরের নাটক নিয়ে বেশ কাজ করে চলেছে- তাদের প্রতিভার মূল্যায়ণের এক বিরাট বাধা হয়েই দাঁড়িয়ে যায় এই নাট্যতত্ত্ব বিভাগটি। এবং তখন, অনেকের স্মরণ হয় যে, সেলিম আল দীন শেষ দিনগুলোতে এসব নিয়ে বেশ আক্ষেপ করতেন, কিন্তু নিজের হাতে খোদাই করা এই গর্তে তাঁর আক্ষেপ করা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না।  

এই আক্ষেপ ছাড়া আর কিছু করতে না পারাটা প্রায় সবাই ভিন্ন চোখে দেখে, কিন্তু তখনই তাদের অনেকের বোধে আসে যে, প্রকৃত শিল্পীর আসলে অনেক দোষ-ত্রুটি থাকে- এবং তারা সবাই ভাবে যে সেলিম আল দীনেরও দোষ-ত্র“টি থাকতে পারে এবং সেগুলো তাঁর ছিল-ও। এবং তখন তাদের কাছে সেলিম আল দীনের প্রকৃত শিল্পকর্মগুলো নাড়াচাড়া দিতে থাকে এবং তাদের করোটিতে ধরা দেয় যে, তিনি হরগজ, প্রাচ্য আর নিমজ্জন লিখেছেন, এবং এদের মধ্যে অনেকেই বলে যে-  হরগজ- শালা তো একটা ‘গোয়ের্ণিকা’, এবং নিমজ্জন- শালা তো আরেকটা ‘গোয়ের্ণিকা’।

এই যে পাবলিক বলে এগুলা শালা গোয়ের্ণিকা, এতে কোনো অসুবিধা নাই, কিন্তু সবার প্রায় একই সাথে মনে পড়ে যে, সেলিম আল দীন বা তাঁর সহযাত্রীরা- যাঁদের অনেককেই কেউ কেউ ‘সহযাত্রী’ না বলে ‘সাঙ্গপাঙ্গ’ বলা শুরু করেছে, তারা বলে যে- এগুলা তো ‘গোয়ের্ণিকা’ না ‘গোয়ের্ণিকা’র চায়া বড় কিছু এবং তখন আমাদের মধ্যে কারো কারো সরদার ফজলুল করিমের একটি কথা মনে পড়ে এবং আমাদের মনে পড়ে যে এই কথাটি তিনি বলেছিলেন তখনকার সদ্যপ্রয়াত হুমায়ুন আজাদ প্রসঙ্গে। এক পণ্ডিত সম্পর্কে এক দার্শনিকের মন্তব্য হওয়ায় আমাদের এই কথাটি বিশ্বাস করতে মন চায় এবং আমরা বুঝতে পারি যে, এই কথাটি আসলে কেবল ‘কথা’ না, এটি হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিমের মূল্যায়ণ। আমাদের উচিত হুমাযুন আজাদকে নিয়ে এখন কিছু ভাবা- এই বলে যখন তিনি থামলেন তখন আমাদের, হয়তো-বা উপস্থিত সবার না, কারো কারো, একটু দ্বিধা হয়, আসলে তিনি কী বলতে চান? জীবিত হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে কি আমরা ভাবি নাই কিছুই? মারা যাওয়ার পর ভাবতে হবে?- এমন একটা প্রশ্ন কারো কারো মনে জাগে কিন্তু কী কারণে যেন মুখে আটকে থাকে, ফলে প্রশ্নটা শব্দ আকারে বের হয় না, কিন্তু এতে সরদার সাহেবের কোনো সমস্যা হয় না, কারণ তিনি বোধহয় জানতেন যে এই কথার পর আমাদের ভেতর এই প্রশ্ন জাগবে এবং তারপর প্রশ্নটার এই জবাব দিতে হবে- জীবিত হুমায়ুন আজাদের জন্য কারো ভাবতে হয় নাই, উনি নিজেই নিজের জন্য এত ভাবা ভাবছেন যে কেউ কাছে ঘেষতে পারে নাই। নিজের পণ্ডিতি নিয়ে এত পণ্ডিতি বোধ করি আর কেউ করে নাই।- তারপর যখন আমাদের সম্প্রতি-দিনের ১৪ জানুয়ারির কথা মনে পড়ে, এবং আমরা দেখি যে, সেলিম আল দীনের মধ্যেও নিজের সৃষ্টি নিয়ে আপ্লুত হওয়ার ব্যাপার ছিল এবং কেবল নিজেরটা নিয়ে আপ্লুত হওয়ার ব্যাপার না, রবীন্দ্রনাথের পর আর কোনো বাঙালি যে দু-কলম লিখতে-পড়তে পেরেছে সেটাও নাকচ করে দেয়ার প্রবণতা ছিল, তখন আমাদের মধ্যে যাদের ১৪ জানুয়ারির কথা মনে পড়ে তাদের অনেকে স্বস্তি পায় যে, যেহেতু সেলিম আল দীন এখন আর নেই, তাই তাঁকে এবার প্রাণ খুলে মূল্যায়ণ করবে।

প্রাণ খুলে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে কেউ কেউ আবার ভ্যাবাচ্যাকা খায়, কারণ তারা দেখে যে সেলিম আল দীন আবার তাঁর বাঁক বদল করেছেন এবং এবার এসব বাঁক বদলের কেন্দ্র বিন্দু হলো কনটেন্ট এবং তারা দেখে যে সেলিম আল দীন বাংলা সাহিত্য বা কম করে হলেও বাংলা নাট্যসাহিত্য খুঁড়ে খুড়ে দেখেছেন যে, সেখানে নাটক আছে মানুষ আছে কিন্তু কোনো প্রকৃতি নেই এবং সেলিম আল দীন এবার এই প্রকৃতি নিয়ে নেমেছেন এবং তখন আমাদের মধ্যে কারো কারো তাঁর কিছু কথা স্মরণে আসে, যে কথাগুলোতে আবার হয়ত-বা কেউ কেউ ‘ঐদ্ধত্ব’ খুঁজে পায় কিন্তু এবারও তাদের সেই ‘ঐদ্ধত্ব’ হজম করা ছাড়া গতি থাকে না।- হ্যাঁ, আমি দেখলাম আমাদের সাহিত্যে পশু-পাখি নিয়ে কোনো কিছু নাই। কেরামত মঙ্গল-এ একটা ষাঁড়ের গল্প আছে, যেখানে মানুষের সাম্প্রদায়িকতার পাপের বিরুদ্ধে যেনবা একটা ষাঁড় বিদ্রোহ করে বসে। ষাঁড় তো ওখানে সত্যের সিম্বল। হাজার হাজার বছর ধরে সে মানুষের পরিশ্রমের সঙ্গী। মানুষের শ্রমকে লাঘব করার সঙ্গী, কোনো দেবদূত নয়, একটা চারপায়ী পশু, সহস্র সহস্র বছর ধরে ঘাম, রক্ত ঝরিয়েছে, হাড্ডি, শিং দিয়েছে, মাংস, দুধ দিয়েছে ... অথচ একটা গল্পও তাদেরকে নিয়ে নাই। তাই আমি ধাবমান রচনা করলাম। ওটা সোহরাব নামে এক মোষ- সেই মোষের গল্প। আমি অদ্ভূতভাবে লিখলাম, একটা জায়গায় আছে মোষের মা হামেলাপাহাড়ী গয়াল দ্বারা গর্ভবতী হয়েছে। সুতরাং গারোরা ভাবছে যে, বাঙ্গালিদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যে বোঝাপড়া সেটা সমাধানের জন্য সোহরাবের আগমন ঘটেছে, যাকে তারা পূজা করে। যখন মোষটাকে লিল্লাহর মোষ হিসেবে কসাইরা জবাই করতে এসেছে, তখন মোষটা বিদ্রোহ করলো। বিদ্রোহ করে পালাতে শুরু করলো, কয়েকটা মানুষ মেরে ফেললো। নদী পার হলো সীমান্ত অতিক্রম করার সাথে সাথে বি.এস.এফ গুলি করে, একটা গুলি লেগে গেছে, শেষ পর্যন্ত ব্যাক করেছে রক্ত ঝরিয়ে। মোষটা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পন করে। আমি শেষে বৌদ্ধের বানী দিয়ে ধাবমান শেষ করেছি।- তখন আমাদের অনেকের মনে হয় যে, সাহিত্যে গরু মানে এতদিন যে গফুরের মহেষের নাম স্মরণে আসতো, এখন থেকে বোধহয সোহরাবের কথাও মনে হবে, এবং তখন আমরা দেখতে পাই যে জীবনের শেষ সময়গুলোতে সেলিম আল দীন সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন এবং তখন তাঁর মাথা থেকে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বা ঢাকা থিয়েটারও বিলুপ্ত হয়ে যায়, কারণ, অনেকের মনে হয় যে এই যে ধাবমান এটা পড়ার জন্য দেখার জন্য না, এবং তখন আমাদের আরেকটি রচনার কথা মনে পড়ে এবং আমরা দেখি যে সেটি কেবলই একটা মাছের গল্প বা হয়তো কেবলই মাছের গল্প না এবং এর নাম হয় স্বর্ণবোয়াল, এবং এই স্বর্ণবোয়াল নিয়েও সেলিম আল দীনের একটা কথা অনেকের স্মরণে আসে এবং সেটি হলো- স্বর্ণবোয়াল একটু উরভভবৎবহঃ, তা এই অর্থে যে, ডবংঃবৎহ জয়-পরাজয়ের কনসেপ্টের যে জায়গাটা, সেখানে এ নাট্যে আমি প্রাচ্যকে প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি মনে রেখেছি যে, মেলভিলের লেখা ঞযব ডযরঃব ডযধষব-তে বিশাল মাছ শিকারের গল্প বা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো মহান লেখক বিশেষ করে তাঁর ঞযব ঙষফ গধহ ধহফ ঞযব ঝবধ'র মতো লেখা পৃথিবীতে থাকার পরও আমি কেন স্বর্ণবোয়াল লিখেছি। আমার মনে হয় যে, তাদের লেখাকে শ্রদ্ধা জানিয়েই তাদের থেকে ভিন্ন মত পোষণ করি জীবনের নান্দনিক ও দার্শনিক ক্ষেত্রে। কাজেই মাছের গল্প হলেই যেমন একটা মাছ থাকে না, তেমনি স্বর্ণবোয়াল’র গল্প একটি মাছের গল্প মাত্র নয়। এটার সাথে অদ্ভুত মিল আছে চাকা’র।- এবং এই কথাগুলো যাদের সামনে তিনি বলেছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আরও পরিষ্কার হওয়ার জন্য প্রশ্ন করে- ওয়েস্ট থেকে কীভাবে ভিন্ন এটা যদি একটু বলতেন- এবং তিনি যেন প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলেন যে এর উত্তর দিতে হবে এবং তিনি বলেন যে- আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখায় মানুষের সাকসেস এবং ফেইলিওর দুটোই এসেছে প্রচণ্ড মানবিক প্রণোদনায়। সেটা পাশ্চাত্য দর্শন সম্ভূত। আমার এখানে সাকসেসই সবকিছু নয়। আমার এখানে স্বর্ণবোয়ালটা ধরা যায় না। এর সঙ্গে ওদের জীবন-জীবিকার চিত্রতো আছেই এবং মাছের সাথে বিরল লড়াইয়ের কথাও আছে। হেমিংওয়ের গল্পে আছে কয়েকদিনের, আমার এখানে আছে একদিন একরাত্রির। কিন্তু কতটা ভিন্ন যে, বাবা মারা গেছে, বাবার শিয়রে এসে বলছে যে- বাবা তোমার বড়শিটা ঠিক আছে, সুতাও ছিঁড়ে নি, তবে বোয়াল মাছটা আমি তুলতে পারি নি। ... এটা কিন্তু মৃত বাবাকে শোনাচ্ছে। অর্থাৎ ইতিহাস এবং প্রেরণাটা ঠিকই রয়ে গেছে, কিন্তু সফলতা আসে নি। আমি মনে করি সাকসেসটা সবকিছু না।- এবং এই স্বর্ণবোয়াল নিয়েও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মন্তব্য উপস্থাপন করে এবং তারা বলে যে- স্বর্ণবোয়াল আসলে পড়ার জিনিস, দেখার জিনিস না। তখন তারা আরও একটা কেবল ‘পড়ার জিনিস’ আবিষ্কার করে এবং দেখে যে তাদের সামনে পুত্র বলে একটা রচনা উপস্থিত হয় এবং এটিও প্রকৃতি নিয়ে এবং তারা দেখে যে এটিতে পিতা-মাতা তাদের ফাঁসিতে মরে যাওয়া পুত্রের সংস্পর্শ খোঁজে সেই ফাঁসি দেয়া গাছের শেকড়ের সাথে। এবং তখন অনেকের মনে পড়ে যে, সেলিম আল দীনের শেষ রচনাগুলো- ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল, পুত্র এগুলো তাদের পড়া হয় নাই এবং আসলে এগুলো যে সেলিম আল দীন লিখে গেছেন সেটাও তাদের ছিল না এবং তাই এগুলো তারা পড়তে পারে নাই এবং তখন তাদের স্মরণ হয় যে আসলে সেলিম আল দীনের কোনো রচনাই তারা পড়ে নাই এবং না পড়েও সেলিম আল দীনকে তারা চিনতে পেরেছে কারণ ওগুলো তারা মঞ্চে দেখেছে এবং তাদের হঠাৎ করেই মনে হয় প্রকৃতঅর্থে জীবিতকালেও তারা কখনো সেলিম আল দীনের সৃষ্টির সাথে পরিচিত হয় নাই তারা আসলে সেলিম আল দীনকে কেটেকুটে নাসির উদ্দীন ইউসুফের তৈরি শিল্পকর্ম দেখেছে এবং তাই তাদের মনে হয় যে কোনটা কেবল পড়ার জন্য লেখা আর কোনটা কেবল দেখার জন্য লেখা সেগুলো নিয়ে তাদের কথা বলা উচিত না, কারণ তাদের স্মরণ হয় যে কিত্তনখোলা থেকে শুরু হয়ে চাকা বা হরগজ-কেও কেউ কেউ বলতো এগুলো পড়ার জিনিস দেখার জিনিস না, কিন্তু পরে যেহেতু এগুলো দেখার জিনিস হয়েছিল, তখন তাদের মনে হতে থাকে যে তাহলে হয়তো ধাবমান, স্বর্ণবোয়াল, পুত্র-ও দেখার জিনিস হতে পারে। এবং তখন আমরা কেউ আর সেলিম আল দীনের জন্য শোক করি না, আমরা অপেক্ষায় থাকি সেলিম আল দীনের সৃষ্টির ভবিষ্যৎ দেখার জন্য এবং আমাদের এমত মনে হয় যে- খুব শীঘ্রই আরও বেশি করে সেলিম আল দীন জীবন্ত হয়ে বাংলার মঞ্চ সমৃদ্ধ করবে।


ইতি
হাসান শাহরিয়ার
০৬ জুন ২০০৮
তল্লাবাগ, সোবহানবাগ, ঢাকা