Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

একটি নাট্যবোধিনী পুঁথির রিপ্রিন্ট

Written by মামুন হুসাইন.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

‘পৃথিবী আমার পকেটে’ নামে একটি সাধরণ-জ্ঞানের বই দেয়া হয়েছিল আমাদের ছোট-ক্লাসে। শোনা গেল, প্রধান শিক্ষক ‘মূল্যের ঘরে’ অতিরিক্ত টাকা লিখে ছাত্রদেরকে এই বই কিনতে বাধ্য করেছেন। একদা অগ্নিগর্ভ আত্রাই থেকে অভিবাসন নেয়া, জনৈক তরুণ শিক্ষক, যিনি পরে আমার এক খালাকে বিয়ে করেন, তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে, প্রতিবাদ হিসেবে প্রধান শিক্ষককে পুরো জামাসহ চেয়ারের অনেকখানি ওপরে তুলে, ভদ্রলোকের নাকে-চোয়ালে সামান্য ক্ষত করে, জামার গুটিকতক বোতাম চিরকালের মত নিখোঁজ করে দেন। এতকাল পর, ভদ্দরলোক প্রমাণের জন্য, খ্যাতিমান বন্ধুদের ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে থাকা রিডার্স ডাইজেস্ট উল্টানোর সময় দেখতে পাই, পত্রিকার গা ঘেঁষে লেখা- ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন ইওর পকেট’- নাকি বাংলায় বলবো, ‘পৃথিবী তোমার পকেটে’!

পৃথিবী কেনা-বেচার পথ-ঘাট মাড়িয়ে আমার এই মেসো মশাই, সর্ব প্রথম উদ্যোগী হয়ে, এখন পাড়ার যে মাঠে চাঁদমারী খেলা হয়, সেখানে নাটকের উদ্যোগ নেন। চাঁদমারীর নীচে সিএ্যান্ডবি’র কয়লা এবং বিটুমিনের স্তুপ। হাতে-হাতে ময়লা মাটি সরানোর পর, পাড়ার ভদ্রমহিলারা শাড়ি দান করলে স্টেজ বানানো গেল। সন্ধ্যা হতেই সারা মাঠ লোকে-লোকারণ্য। নাটকের শুরুতে গৌরাঙ্গ নামক কে একজন নিখোঁজ-সংখ্যালঘু মিছেমিছি ঠোঁট নাড়লো, আর শাড়ির আড়াল থেকে ভেসে আসা গানের সঙ্গে গলা মেলালো। মেসো মশাই এবং পাড়ার পুরনো মুদি দোকানী পূণ্যবাবু, জেলে আটক কয়েদী হয়ে- নাটকের ভেতর মজা ছড়ালে, সারা মাঠ হ্যা-হ্যা করে হাসলো। সে-ই ছিল আমাদের প্রথম নাট্যশালা, নাটমঞ্চ অথবা নাটমন্দির। দ্বিতীয় এবং শেষ আর একবার নাটক হয় ঐ খোলা-এবড়ো থ্যাবড়ো মাঠেই; পুরো মনে নেই- ঢাকা থেকে সিনেমার একজন ভিলেন এলেন, কোনো প্রকার মহলা ছাড়াই তিনি তার তীব্র অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিলেন- আবছা অন্ধকারে কেউ ঘরে এসে লোকটিকে হত্যা করবে। মঞ্চের আলো হত্যাকারীর হাতে এবং ছুরিতে; ছুরি আমূল বুক ফুঁড়ে গেলে- শক্তিমান অভিনেতা পুরো মঞ্চ দাপিয়ে, ব্যথা এবং শোক প্রকাশের দায় প্রকাশের অভিপ্রায়ে কাঠ-বিছানো মঞ্চ অনেকখানি দূর্বল করে ফেলেন। অভিনেতার বুকে-গলায় তীব্র লাল রক্ত দেখতে দেখতে আমরা সেদিন ভীত এবং উত্তেজনা বোধ করি।

ঐ উত্তেজনার আভা মিলিয়ে গেলে, রাষ্ট্রীয় নাটের গুরুদের বিশেষ ইচ্ছায় পাড়ায় পাড়ায় এবার নূরানী-সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ইতোমধ্যে দুটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা ফলবান হয় এবং মদিনা ফেরত মানুষ নাটক এবং গানবাজনাকে শুকনো গড়াইয়ের অবশিষ্ট স্রোতে ডুবিয়ে, ধূ-ধূ চরে আতর সুরমা মিশিয়ে বেহেশতী-ফলমূলের চাষাবাদ শুরু করেন। দলছুট কিশোরদের কেউ বারান্দা আড়াল করে পাঠ্যপুস্তকের ‘একাঙ্কিকা’ করার আয়োজন নিলে ভৎর্সনার স্বীকার হয়। এবার সুবোধ-গোবৎসের মতো আমরা পরীক্ষা পাশের পুলসিরাতে বিশিষ্ট এ্যাক্রোবেট হওয়ার মহলা শুরু করি। ঈশ্বর আমাদের মনোবাঞ্ছনা পূরণ করেন! পরীক্ষা পাশের কল্যাণে বড় স্কুলের বারান্দা, মাঠ এবং ঘাস-পাতার ভেতর হাঁটাহাঁটির হুকুম মেলে। দেখি, অনেক ক’জন যুবক, যাদের কেউ কেউ অধুনা ঢাকা শহরের নাট্য-অধিপতি, তারা এই বরেন্দ্র শহরের রুখো ঘাস-মাটি কামড়ে বড় হয়েছিলেন একদা। নাটক ক্ষুরধার হচ্ছে, নাটক বদলে দিচ্ছে সমাজকে, বন্ধুদের এই সব শক্ত-প্রতিজ্ঞা আমাদের সংক্রামিত করে। আবার কতিপয় মাস্টার মশাই নাটক করছেন, আলাদা দল করেছেন- তা দেখে নাটকের জন্য আরো খানিকটা মায়া বৃদ্ধি হয়। হয়ত নাটকের সময় হাজির হয়েছি- লাগাতার মহলা দেখছি, নাটক যখন করছে, তখন বন্ধুর ক্যামেরায় সার্টার টিপে দিয়েছি, বন্ধুর নাট্য-অভিমুখী বান্ধবীর নাম শুনছি, শো’র সময় বন্ধুর ঘড়ি-টাকা নিজের পকেটে পাহারা করছি, বন্ধুদের ঝগড়া-খুঁনসুটি দেখছি, অথবা নেহায়াৎ-ই নাটক পড়া- নাট্যকার বন্ধুর স্ক্রিপ্ট, গলা দিয়ে সারা বিকাল-সন্ধ্যা কেবল পড়ে শুনালাম। হয়ত সেই সন্ধ্যাতেই, থার্ড থিয়েটার, পথনাটক, বাদল সরকার, প্রসেনিয়াম, ইউরোপ, উৎপল, লিভিং থিয়েটার, ওয়েস্কার, মোহিত চাটুয্যে, হাশমি, আরণ্যক, সেলিম আল দীন, হল্লাবোল, থিয়েটারে পেশাদারিত্ব এবং অন্তরঙ্গ নাটক নিয়ে ঝড় তোলা হলো- ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া অতি দুধ-চিনি মেশানো চায়ের কাপে। সেই সব চায়ের দাগ লেগে থাকা জামা-কাপড় মলিন হতে হতে কবে ক্যাম্পাসের বুড়ো ছাত্রে রূপান্তরিত হয়েছি বুঝতে পারি নি। একদিন আবিষ্কার হয়- নাটক পড়ার দিন অজান্তে হত্যা হয়ে গেছে, আর আমরা চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। এবার চাকুরিহীন ঢাকা শহরের অবসাদ এড়াতে, টানা বছর-তিন, বন্ধুদের কেউ কেউ নাটকপাড়ায় নিয়ে যান- দেশের ক্ষমতাবান দলগুলোর প্রযোজনা দেখতে পাচ্ছি সেই প্রথম। এরপর দীর্ঘ যোগাযোগহীনতা। চাকুরি করতে সবে নেমেছি দক্ষিণবঙ্গের এক অজ-পাড়া গাঁয়ে। হিরণ গমেজ নামক এক সত্তরোর্ধ মানুষ ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলার ফাঁকে, কেবলই কোলকাতার থিয়েটার নিয়ে গল্প-গাছা শুরু করেন- আমি তুলসী লাহিড়ী অথবা শিশির ভাদুড়ীকে দেখতে পাই যেন। অহীন্দ্র মহাশয় হেঁটে আসছেন। মনে হচ্ছে শ্যামবাজারে দাঁড়িয়ে আছি। এই জায়গায় ছিল পাঞ্জাবি হোটেল। এটি স্টার। এটি মিনার্ভা থিয়েটার। আর ঘুরে ফিরে আবারও শিশির ভাদুড়ী, বিশ্বরূপা, লিন্ডসে স্ট্রিট এবং কোনো একদিন আমিনা হোটেলের সুরম্য রুটি কাবাব। বৃদ্ধ হিরণ গমেজের সঙ্গে চা খেতে খেতে অনুভব হয়- শ্রীমন্ত নদীর জল ভাটায় দ্রুত নেমে যাচ্ছে। বড়দিন উপলক্ষে ক্যাথলিক পল্লীতে নাটক হবে, লেখক রঞ্জন দেবনাথ, তার মহলা চলছে ফাদার বাড়িতে। পুরনো চুন-সুড়কি ভেদ করে নাটকের শব্দ আসে, অথবা খানিকটা নৈঃশব্দ এলে, কেবল শ্রীমন্তের জল গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। এই শব্দ মাথায় অথবা শরীরের কোথাও জল-ছাপ এঁকে দেয়। আবিষ্কার করি, আমার জন্মস্থানের নাম কুষ্টে। ‘নাটুকে গ্রাম’ নামে আমাদের এই জেলায় অনেকগুলো স্থান একদিন চিহ্নিত করা হয়েছিল- চুয়া, খোকশা, ভেড়ামারা, বাড়াদী, হরিনারায়ণপুর, হাটশ হরিপুর, গোস্বামী দূর্গাপুর ইত্যাদি; এখানকার মানুষ নাকি নাটক নিয়ে বেজায় ব্যস্ত থাকতো। শহরের বড় রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে ১৯১৫ সালে তৈরি ‘পরিমল থিয়েটার’এর দালান দেখি। মোহিনী মিল প্রাঙ্গণেও একটি মঞ্চ হয়েছিল, সেটি ১৯৩২-৩৩ এর কথা। এই সব থিয়েটারে মানুষ কী পদ্ধতিতে থিয়েটার করতেন এখন আর জানার উপায় নেই।

নাট্য-বিষয়ক এই সব এ্যানিকডৌটস্ নিয়ে আলোচনা হলে, আমাদের জনৈক বন্ধু চাটমোহরের এক নাট্যদলের সন্ধান জানান- নিভৃত গ্রামে ওরা দিন শেষে বিবিধ পেশার প্রান্তিক মানুষ নিয়ে নাটক করে, বাঁশবন-মন্দিরের চাতালে মহড়া চলে; আর নৌকায় ভেসে, সাইকেল চেপে, উঠানে-ময়দানে নাটক করে চলেছেন এই ঘোরতর বিপর্যয়ের কালেও।

চাটমোহর-বোথড়ের চড়ক মেলায়, এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। চাটমোহরের নাট্যজন দয়ার্দ্রচিত্তে বই পুস্তক পড়তে দেয়, নাটক দেখার নির্দেশ পাঠায়, চড়কে বড়শি বেঁধা মানুষের ঘূর্ণন দেখায়, খাদ্য দান করে- আর ধীরে ধীরে আমার অপুষ্ট মস্তিষ্কে নাট্য-সেন্স প্রবিষ্ট করে। নাটক নিয়ে যে জ্ঞান-গম্যি আমাকে এক্ষনি প্রকাশ করতে হবে- এ-সব আমার সেই সব টগবগে বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া সুদমুক্ত ঋণের প্রতিশ্র“তি। খবর আসে কোলকাতা-থিয়েটারের সুবাস নিয়ে বেড়ে ওঠা আমার প্রবীণ বন্ধু হিরণ গমেজ ইতোমধ্যে গ্রেভইয়ার্ডে। অথচ কেমন অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখতে পাই- শ্রীমন্ত নদীতে জোয়ার-ভাটা চলছে, চড়কের বর্শি বেঁধা মানুষটি জিহ্বা ছিদ্র করে মৌসুমের কাঁচা আম ঝুলিয়েছে ধারালো শলার দুই মাথায় এইমাত্র, আর হিরণ গমেজের কবর জুড়ে অল সোলস্ ডে’র হাজার হাজার মোমের আলো।

আরম্ভের আরম্ভ আছে বলে যে ধারণাটির সন্ধান পাই- এতক্ষণ সেই ঘটনাটিই ঘটেছে। অথবা বলা যায়, শিবকে তুষ্ট করে কেবল ধান ভানতে বসেছি। তবে এতটুকু অগ্রিম আন্দাজ দেয়া যায়- নাটকের সঙ্গে আমার যে যৎকিঞ্চিৎ দেখাশোনা তাতে করে ‘আমি ও আমার থিয়েটার’, ‘আমাদের নাট্য-আন্দোলনের ভবিষ্যৎ’, ‘বিবর্তনের ধারায় বাংলা নাটক’, কিংবা ‘সাহিত্য-নাটক-সমাজ’- শিরোনামে গুরুত্বপূর্ণ আত্মকথা বা গবেষণাগ্রন্থ রচনার জন্য উপযুক্ত লোক আমি নই। তবে অন্যমানুষের নাম বদল করে, তাদের টিকা-ভাষ্য সেবন করে, মাঝে-মধ্যে যেভাবে আমরা সত্য-মিথ্যে গল্প বানাই- সে-রকম একটি ভঙ্গী করে কাউকে কাউকে ভড়কে দেয়া অনেকটা সহজ বটে! শেষ পর্যন্ত এই আয়োজনটা তা-ই হয়।

লেখার প্রপস্ যোগাড়ের জন্য কৃতি বন্ধুদের সঙ্গে কথা হলে, ওরা লেবেদেফের নাম শোনায়। লেবেদেফের পুরো নাম আরো দীর্ঘ শব্দের, আমি মনে রাখতে পারি না। রডনি নামক জাহাজে চড়ে লেবেদেফ মাদ্রাজ এলেন, মাদ্রাজ থেকে কোলকাতা। তারপর নাটক, প্রতিপক্ষের আক্রমণ, মামলা-মকদ্দমা, গ্রেপ্তার এবং চিরকালের মতো কোলকাতা ত্যাগ। লেবেদেফের সঠিক ছবি নিয়ে তর্ক হয়েছিল কার সঙ্গে? চটজলদি জবাব দিতে পারি না। অর্বাচীনতা এড়ানোর জন্য, যেন বা আমি নাটকের খুব বিশিষ্ট কেউকেটা, এই ভঙ্গীতে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে এবার বক্তৃতা বানাই। ... বন্ধুরা বিশ্বাস করুন আমি ছেলেবেলায় কোনোদিন অভিনয় করি নি। কেবলমাত্র নাটক শুনতাম, রেডিও-তে, ঘন্টার পর ঘন্টা। খেলাধূলা করতে পারতাম না। চাকরি করার সময় রিহার্সেল ক্লাব খুলে বসলাম। সাহেবদের দেশে গেলাম টাউনপ্ল্যানিং পড়তে। ফিরে এসে সাগিনা মাহাতো এবং বল্লভপুরের রূপকথা। গ্রোটস্কির সঙ্গে পরিচয় হয় পোল্যান্ডে। তারপর কেবলই নাটক নিয়ে ভেবেছিÑথার্ড থিয়েটার, থিয়েটার ফর অপ্রেসড, স্টেট থিয়েটার নাকি স্ট্রিট থিয়েটার? একদিন অনুভব হয়- নাটকের দল-বল কেমন ফিকে হয়ে আসছে। ফিল্ম কি থিয়েটারকে ম্লান করে দিচ্ছে? কেউ ধমকে তাকায়। ভদ্রলোক বললেন, আমি কবিতা থেকে তারপর নাটকে এসেছি। একজন কবি কবিতা থেকে অনেক লার্জার, অনেক ওয়াইডার, অনেক বিগার। একটু পিছিয়ে গেলে দেখুন কবি ও নাট্যকার একাকার হয়ে গেছেন- কালিদাস, শেক্সপীয়র, সোফোক্লিস, ইউরোপেদিস। আসলে থিয়েটার একটি যৌথশিল্প- ভাষ্কর্য, চিত্রকলা, নৃত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য, সমস্ত জায়গা থেকেই নির্যাস এসে পৌঁছেছে। তবে এই যে নাটকটি আপনারা দেখলেন, এটি এ্যাবসোলিউটলি কনভেনশনাল, বাট ওয়েলমেড থিয়েটার। আবার এমন নাটক আছে- যেটি একেবারেই ইনডিভিজ্যুয়াল ব্যাপার, কেউ আগে এরকমটি করেন নি। অর্থাৎ কেউ এভাবে করতে চাইলে হবে অনুকরণ। আমি ঠিক এজন্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে নাটক বানাই নি। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শংকর, সুনীল- অনেকের লেখা থেকেই নাটক দাঁড়িয়েছে, কিন্তু মানিকের উপন্যাসে আমি হাত দিতে পারি নি। ... একবার হলো কী শাঁওলী মিত্র ডাকঘর পাঠ করছিল। ভালো লাগছিল না। কথাটা নিন্দে ভাববেন না। সফিস্টদের একটা প্রশ্ন ছিল সক্রেটিসেরে কাছে যে, আমি ভালো কাজ করবো, তাতে কোনো গ্যারান্টি আছে যে আমার ভালো হবে? থিয়েটারের ছেলেদেরও একই প্রশ্ন- থিয়েটার যে করবো, আমার ভালো হবে কি? গোটা পরিস্থিতিটাই গোলমেলে। ধরুণ, দলের ছেলেকে বললাম সাতটা-সাড়ে সাতটায় রিহার্সেলে আসতে। সে একটা টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করছে। সেখানে সে পাঁচটার সময় ছুটি চেয়েছে। বলেছে রিহার্সেল আছে। প্রযোজক তাকে ধমকে বলেছেন, সারাক্ষণ নাটক নাটক করো। ছেলেটি মুখ চুন করে রাত ন’টায় এসেছে। তাকে আমি কী বলবো? চাকরি করে না, সারাদিন সিরিয়াল করে, তিনশো-চারশো টাকা পাচ্ছে। সিরিয়ালওয়ালারা জানে গ্র“প থিয়েটার থেকে শিল্পী নেয়া সুবিধাজনক। এদের মুখভঙ্গী সহজ এবং সহজে জিভের আড় ভেঙে কথা বলে। ছেলেটি সুটিং-এর জন্য সমুদ্রে যাচ্ছে। আমরা চুক্তি করছি- পরশু সন্ধ্যায় কল-শো, তুমি পারবে তো? এদেরকে আমি সমাধান দেব কীভাবে? টাকা-পয়সা নিশ্চয়ই জরুরি, আবার টাকা পয়সা জমিয়েই শিল্পী নাটক করেছে। রক্তকরবী করার সময় আমরা চার আনা-আট আনা জমিয়ে পঁচাত্তর টাকার একটি ঝাঁজ কিনেছিলাম। ভালো বাল্বের নামে, একবার না-বুঝে খারাপ বাল্ব কিনলাম। আলো-ছায়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ভেবে মন খারাপ হচ্ছিল। ধীরে ধীরে ডিমার হলো, ক্লাউড প্রজেক্টর হলো, তারপর রেজিসটেন্স ডিমার ..., তবে কি মিথ্যে-মিথ্যে আলোর গিমিকই সবটুকু নয়!

অন্য এক গভীর আলোর সন্ধানে আমরা একদা বৃক্ষমূল পুঁতেছিলাম গ্রাম থিয়েটারের নামে। গ্রাম থিয়েটার কথাটার অর্থ হলো বাংলাদেশের জনপদের গ্রামীণ অংশে আধুনিককালের শিল্প মনষ্কতায় নাট্য। নাটক শেষে সারারাত জেগে শীতরাত্রির সাড়ে তিনটায় বাসে চেপে ফিরছি। অর্ধতন্দ্রার ভেতর হঠাৎ আকাশে নূপুরধ্বনি। বুঝতে পারি বালিহাঁসের ঝাঁক যাচ্ছে অজানা হ্রদের উদ্দেশ্যে। আমরা সামনে এগুতে থাকি। শুরুতে আমরা গ্রাম থিয়েটারের তত্ত্ব নিয়ে গ্রামে যাই নি। গিয়েছি সরল হৃদয়ে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কাছে তাদের শিক্ষা দিতে নয়, নিজেদের দীক্ষা নিতে। কেউ কেউ ভেবেছিল এ-ও আরেক নতুন চমক। কেউ জানে না আমি রাত জেগে মাটি কেটে ঐ কলেজ প্রাঙ্গণে চৌকোণ খোলা মঞ্চটি বানিয়েছিলাম। বালু-কণাকে সাক্ষী রেখে বলেছিলাম- হে মৃত নদী, তোমাকে বিমূর্ত স্রোতে বয়ে নিয়ে যাব একদিন পৃথিবীর ফোরাত ভোলগা রাইন ও টেমসের তীরে। জানবে তুমি ও তোমার প্রেমিক পুরুষেরা বিশ্বমানবের পথে ছুটে চলেছে। কিন্তু সে শপথ কি পূরণ হবে এক জীবনে। গ্রাম থিয়েটারের কর্মী এই শপথের পথ ধরে আপনারাও এগিয়ে চলুন।

আশির শেষ সময় পর্যন্ত, নাট্যজনেরা এই রকম তীব্র প্রতিজ্ঞা, জিদ এবং শপথের বাক্যমালা গেঁথে- শহর এবং গাঁ ঘিরে ফেলেছেন। গাছ চাপা-পড়া মানুষটি ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে, আর আমরা সেক্রেটারিয়েটে ফাইল নিয়ে দৌড়–চ্ছি, কোন মন্ত্রণালয় লোকটিকে বাঁচাবে? থিয়েটারের অন্তরঙ্গতা বোঝানোর জন্য আমরা গল্পটি ফের বলি- ভিড়ের ভেতর থেকে একজন ভাঙাচোরা মানুষ চিৎকার করে ওঠে- চাপা-পড়া লোকটির কী হবে ভাই? বাঁচবে তো? এর জবাব নাটকের মানুষেরা তক্ষণি দিতে পারেন নি। কারণ ওরা তখন মঞ্চে বোমা আক্রান্ত অপর নাট্যশিল্পীর হাত পা, মাংস, চশমা এবং ঠিকরে পড়া চোখ পলিথিনে গুছিয়ে নিচ্ছিল। ... উৎপল দত্ত বলতেন, মেঘনাদবধ কাব্য মুখস্ত না থাকলে মঞ্চে নেমো না বাপু! আমি পুরো মুখস্ত করতে পারি নি। একটা প্রশ্ন জিজ্ঞিস করবো- পিরানদেল্লা মুসেলিনীকে সমর্থন করেছিলেন এবং আর্নল্ড ওয়েস্কার ছিলেন কমিউনিস্ট বিরোধী। সবাই বললো, এরা শক্তিশালী নাট্যকার, আমরা এজন্যই কি এদের নাটক মঞ্চস্থ করবো? ঢাকা-নাটকের রাস্তার দু’পাশে মাশরুমের মতো বেড়ে ওঠা উপকারী চঞ্চল খাদ্য বনাম জামদানী- এই রিহার্সেল দেখতে দেখতে, কেউ ফুচকার টক-জল মুখে নিয়ে, হেঁটে-বেড়ানো নাট্য-প্রতিভাদের নাম শেখায়- ইনি হলেনগা হায়দার, ইনি মজুমদার, ইনি হক সাহেব, ইনি মমতাজউদ্দীন, ইনি রশীদ, ইনি সোলায়মান, ইনি ইউসুফ, ইনি সেলিম, ইনি সাঈদ সাহেব ... , আর ঝলমল শব্দে যারা হেঁটে চলেছে, এরা সব বিশিষ্ট নাট্যকুশলী ওরফে কমুনিকেশান সেলের ক্রিয়েটিভ এক্সজিকিউটিভ। বরেন্দ্র শহর থেকে কিছুকাল আগে একটি মেয়ে, জনৈক নটরাজের পত্রিকায় কাজ করতে যায়- মেয়েটি কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিল না, এর অর্থ øানের জায়গারও অভাব হচ্ছিল; শো’র দিন চুপ করে আগে-ভাগে অডিটোরিয়ামের বাথরুমে øান করে, আবার হাসি হাসি মুখে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতো চাকরিদাতার উদ্দেশ্যে। মেয়েটি যেহেতু নাটকের কেউ নয়- অতঃপর চাকরিহীন হয়ে বড় শহরে নিখোঁজ হয়ে যায়। নাটকের পত্রিকার কথা মনে হলে, মেয়েটি কেন বারবার এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বুঝতে পারি না। সেদিন সবার মতো আমিও মেয়েটিকে আশ্রয় দিই নি, অথবা ভাবি নি আদৌ।

মেয়েটির হারিয়ে যাওয়া গল্প শেষ হলে, ঝলমলে নাট্যকুশলীদের সঙ্গে আবার একদিন মোড়ে দেখা হয়। কে একজন বিশিষ্ট থার্ড থিয়েটার-কন্যা লিভার ব্রাদার্সের একগুচ্ছ সাবান নিয়ে আমাদের ডোর বেল বাজায়। মুগ্ধ হয়ে আমার মেয়ে তারকা-শিল্পীর অটোগ্রাফ নেয়। দু-দশদিন বাদে, খ্যাতিমান আর একজন এসে আমাদের বাথরুম টয়লেট ঘষে দিল। মেয়ে খুশি হয়- ওর অটোগ্রাফ খাতা বাড়িতে বসেই দ্রুত ভর্তি করতে পারলো। মেয়ের আনন্দিত মুখ দেখতে দেখতে- একদা ১৫ জুন ২০০৪, আমাদের ও দিকটায় ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ফাউন্ডেশন’ তৈরি হলে,নাটকের কয়েকজন কুশলী এবং পরিচালককে আবার বড় চঞ্চল দেখায়। মঞ্চ আলো করে রোকিয়া এ রহমান, সেলিনা হোসেন, মালেকা বেগম এবং সুফিয়া আহমেদ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা মঞ্চের সৌন্দর্য পড়ি: প্রিয় শ্রোতৃবর্গ, লিভারের দর্শন হচ্ছে, একজন ব্যক্তি হিসেবে নারীর ভেতরের সৌন্দর্য আর আত্মবিশ্বাস বের করে আনা। বড় প্রজেকশনে তখন নাট্যকারের তৈরি ছবি ঘুরছিল- মেয়েটি কীভাবে বাবাকে সুখি করছে! বাবা আক্ষেপ করছে ছেলে নাই বলে। ত্বক অনুজ্জ্বল বলে মেয়েটি ভালো চাকরি জোগাড় করতে পারছিল না, এমন কি বিয়েও হচ্ছিল না। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী এসে ত্বক উজ্জ্বল করলো আর তাকে আকাশে উড়িয়ে দিল।

মেয়েটি আকাশে ওড়ে, অথবা ইকারুসের আকাশ দেখা স্বপ্নে তোলপাড় হয়। সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যের সংবেদনশীলতায়, আকাশে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একদা-আত্মজার জন্য চোখে জল খুঁজে পান। কিন্তু হই হই ভিড়ে জল হারিয়ে গেলে, প্যান্টিন শ্যাম্পু নিয়ে হাজির হন ব্রেশট এবং ইবসেন বিশেষজ্ঞ- তার নাটকের নাম, ‘প্যান্টিন ইউ গট দ্য লুক’। অপরূপ আলো ছড়িয়ে পত্রিকার মাননীয় উপ-সম্পাদক, গতিশীল-প্রফেসর এমিরেটাস, বাদল সরকারের ভাবশিষ্য, আর আন্তিগোনে করেছিল (চিনতে পারছো?), সেই ভদ্র মহিলা, ... ঐ যে ‘সুখ’ সম্পর্কে চেঁচিয়ে বলছিল- এরা সব মঞ্চ জুড়ে। মঞ্চের আলো এবং সৌন্দর্য পান করে আমরা যখন ঘরে ফেরার আয়োজন করছি- তখন বাংলা লিঙ্কের ‘লেডিস প্যাকেজ’ বিজ্ঞাপন বানিয়ে সদ্য-পুরস্কৃত, একদা উৎপল দত্ত কাম পিরানদেল্লা ভক্ত, মিস ওয়ার্ল্ড হওয়ার বিশিষ্ট রেসিপি পড়ে শোনাচ্ছিলেন শ্র“তি-নাটকের মতো: কী তোমাকে মানায় সেটা মেক-আপ আর্টিস্টকে বলতে যেও না। উনি একজন পেশাজীবী। কেঁদে-কেটে একশেষ হতে হবে তোমাকে। আর তোমাকে এমন কি থাপ্পড়ও খেতে হতে পারে। আর তুমি যদি না-ও জেতো, তবু তুমি কিছু পাচ্ছ, সুতরাং এটা কোনো অকাজের জিনিস না। এতো এতো যোগাযোগ ঘটছে তোমার, এটা শেষ হতে হতে তোমার হাতে পনরটা আলাদা আলাদা বিকল্প থাকছে। সিরিয়াল, র‌্যাম্প, যে-কোনো কিছু। আমি তোমাকে দশটা করে মাল্টি-ভিটামিন দিচ্ছি, কিন্তু এখনও তোমাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে না। আমার ভয় হচ্ছে, এর একমাত্র সমাধান আরও আরও খাওয়া। প্রত্যেকে তোমাকে দেখছে। প্লিজ মাইকটা তোমার বুকের উচ্চতায় ধরো। নিশ্চিত কর যে, এটা তোমার আত্ম-সত্ত্বারই একটা বিস্তার। ঐভাবে তোমাকে সেক্সি শোনাবে, ভালোই মানিয়ে নিয়েছ। সত্যি কথা বলতে কী, দর্শককে তোমার সেক্স-আপ করতে হবে। প্রত্যেকে তোমাকে দেখতে থাকবে, কাজেই প্রফুল্ল, সুখি আর স্থির হও।

সুখি হওয়ার এইসব করণ-কৌশল, এখন প্রায়শ আমাদের খ্যাতিমান নাটক এবং সাহিত্য বিশেষজ্ঞদের কলম থেকে, ‘নক্ষত্র’ হয়ে খসে পড়ে। ফলে কেউ আর সহসা ‘আকাশ-গঙ্গা’ খুঁজতে বেরোয় না। আমরা দেখি, নাটকের তারকাবৃন্দ-ই সংবাদপত্র, টিভি এবং সংস্কৃতি ইন্ডাস্ট্রির মূল নক্ষত্রপুঞ্জ অথবা কর্পোরেট মিডিয়ার প্রধান সেনাপতি। কবে পথনাটকের সুগন্ধে একবার দেখা হয়েছিল বোঁথড় খেয়াঘাটে, সেই সূত্র ধরে রিটায়ার্ড নাট্য-নির্দেশকের শীতাতপ কক্ষে ঢুকলে, তিনি মিষ্টি কণ্ঠে ম্যাকলুহাল-ম্যাকচেজনি পড়াতে শুরু করেন, যেন আজ সন্ধ্যাতেই প্রথম শো- খেয়াল করলেই দেখবে, কর্পোরেট মিডিয়া জনগণের ওপরে, তারা পছন্দ করুক বা না-করুক, বিজ্ঞাপন ও বাণিজ্যায়নের কার্পেট বোমা ফেলছে। তুমি কি বুঝতে পার টেলিভিশন প্রোগ্রামের প্রবাহ বাণিজ্য পথের সঙ্গে কেবল সমান্তরাল নয়, এটা কার্যত বাণিজ্যপথের অংশ, এর সঙ্গে একান্তভাবে যুক্ত। ... গ্লোবাল ভিলেজ বলছ কেন? বলো দে আর লুকিং ফর গ্লোবাল সুপার মার্কেট। টিভির খবর কীভাবে কুর্ণিশ করে বিজ্ঞাপনকে সিংহাসন ছেড়ে দেয়, ডু ইউ নো ইট? এক একবার সংবাদে প্রায় আট থেকে দশ মিনিটের দুবার বিরতিতে অর্থাৎ ফার্স্ট মিড ব্রেক এবং সেকেন্ড মিড ব্রেকে বিজ্ঞাপন দেয়ার খরচ একুশ এবং ষোল হাজার টাকা। ... লোকটি হাসে, আর কবে দ্য থ্রি পেনি অপেরা করেছিল, তা থেকে মজা ছড়ায়- ‘বুঝিছো তো, অন্ধকার আর ভীষণ ঠাণ্ডার এই উপত্যকা জুড়ে শুধু দুঃখ-কষ্ট প্রতিধ্বনিত।’

শীতাতপ ঘরের ভেতর দুঃখ কষ্টের সুঘ্রাণ গড়িয়ে পড়লে কেউ আমাদেরকে বুদ বুদ ওঠা ইউরো লেমন খেতে দেয়।- এইটার এ্যাড আমাদের হাউজ থেকে। ছোট টেলিভিশন জুড়ে নেসলে, ফ্রেশ মিল্ক, হরলিক্স, গেরিলাযুদ্ধ, বাংলা লিঙ্ক আর স্যামসাং ফ্রিজ কেনার উদাত্ত আহ্বান। ইউরো লেমন চুমুক দিতে দিতে সারা যাকেরের ‘মাদার্স ডে’ উদযাপন দেখছি, স্কুলের দরজায়। এদিকে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’র সৌজন্যে ‘স্বপ্নপূরণ’ গল্পের পুরস্কার বিতরণী চলছিল- স্বপ্নজয়ী নারীদের ছবি দেখতে দেখতে কে যেন আবার থ্রি পেনি অপেরা আওড়ায়- ‘বুঝিছো তো, অন্ধকার আর ভীষণ ঠাণ্ডার এই উপত্যকা জুড়ে শুধু দুঃখ-কষ্ট প্রতিধ্বনিত!’

নাটক নিয়ে একটি বাক্যও গুছিয়ে বলতে পারলাম না- এই ভেবে মন সত্যিই এবার দুঃখ-কষ্টে টলমল হয়। কোনোদিন বড় একটি নাট্যসংখ্যা বেরুবে কোথাও, আর আমি গুরুত্বপূর্ণ লেখার ভিড়ে  দু’এক  ছত্র স্ক্র্যাপ গুঁজে দিয়ে পলাতক হতে পারবো; ভেবে-ভেবে একগুচ্ছ শিরোনাম টুকে রাখি- রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়ন,  নাট্যচর্চার ইতিবৃত্ত, নাটকের গান, আমাদের মঞ্চে বিদেশী নাটক,নাট্য-আন্দোলনের সমস্যা, নাকি থিয়েটারের বিষয়-আঙ্গিক নিয়ে ঢাক গুড়-গুড় এক প্রবন্ধ! অথবা অনেক রকমের নোট্স নিয়ে হয়ত নাটকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি নিয়ে একটি ভারি গবেষণাকর্ম হাতে নেয়া যায়। নাটক তখন ধরা যাক ‘প্রমোদ’ নামক একটি ফিনিস্ড প্রোডাক্ট বাজারে লঞ্চ করছে। প্রথমত সে নানান দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে, আর দ্বিতীয়ত প্রতিযোগিতা করছে বাজারের অন্য প্রমোদ-উপকরণের সঙ্গে। পশ্চিম বঙ্গের রুদ্র প্রসাদ ১৯৯৫ সালে নাটক করার খরচ দেখিয়েছিলেন এক লাখ বাইশ হাজার ঊনআশি টাকা সাতানব্বই পয়সা। নাটকের সঙ্গে এখানে যারা সরাসরি যুক্ত, তারা একটি হিসাব করে দেখতে পারেন। বস্তুত এই খরচ-পত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিপুল এক মিডিয়া বাজার। বিদ্দৎজনেরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী মিডিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ৮টি বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশন। সামির আমিন, বিশ্বব্যবস্থায় ধনী দেশগুলো যে ৫টি ক্ষেত্রে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দাবী করে, তা চিহ্নিত করেন এইভাবে- প্রযুক্তি, অর্থবাজার, প্রাকৃতিক সম্পদ, মিডিয়া এবং গণ-বিধ্বংশী অস্ত্রশস্ত্র। এই ধারাবাহিকতায়, মেক্সিকোর টেলিভিশন কোম্পানীর কর্ণধার এমিলিও মন্তব্য করেন- মেক্সিকো হলো বিনয়ী, কিন্তু চরম নির্যাতিতের দেশ এবং তারা আজীবন নির্যাতিত হবে। টেলিভিশনের দায়িত্ব এদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং দুঃখজনক বাস্তবতা এবং দুরূহ ভবিষ্যৎ থেকে তাদের সরিয়ে আনা।

বোঝা যায়, ভবিষ্যৎ তৈরির তীব্র দায়বদ্ধতা নিয়ে আমাদের টেলিভিশন ভায়েরা এই কাজটি সক্ষমভাবে করতে পারলেও নাট্যবিলাসী বন্ধুদের পর্যাপ্ত খতিয়ান আমার হাতে এক্ষুণি নেই। অনেক বছর আগে বাংলাদেশের ৫টি নাট্যদলকে কেউ প্রশ্ন করেছিলেন- কোন ধরনের নাটক প্রযোজনায় আপনাদের আগ্রহ বেশি? কারণ বলুন। এই প্রশ্নের জবাবে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়র বক্তব্য: নাটক প্রযোজনায় আমরা বিচিত্রতায় বিশ্বাসী। বিশেষ কোনো মতবাদ বা দর্শনে আমরা বিশ্বাসী নই বলে বিশেষ ধরনের নাটকে আমাদের আগ্রহ শূন্য। ... যেন আমাদের নাটক হয় জীবন থেকে অবিচ্ছিন্ন, অবশ্য সে জীবনের স্বরূপ ও ব্যাখ্যা আমাদের নিজেদের, অন্যের ধারণা বা ব্যাখ্যার সঙ্গে তা না-ও মিলতে পারে। ঢাকা থিয়েটারের বক্তব্য- আমরা জীবনঘনিষ্ট হবার জন্য নাটক করি। আমরা নিজস্ব সৃজনশীলতাকে সর্বাগ্রাধিকার দিই। কারণ শুধু নাটক নয়, আমরা যে উদ্দেশ্যে নাটক করছি, সে উদ্দেশ্য মাত্র আমাদের লেখকরাই অনুধাবন করতে পারেন। বহুবচনের বক্তব্য- নিরীক্ষাধর্মী প্রচলিত নাট্য-আঙ্গিকের সাথে নাটকের আনুসঙ্গিক দিকগুলোর কলা-কৌশলের ওপর নিরীক্ষা। মঞ্চের কনভেনশনাল কনসেপশনের পরিবর্তন ঘটানো যায় কিনা, সেই সাথে আধুনিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাম্প্রতিক নাট্য আন্দোলনের ধারাকে দেশীয় রীতির মিশ্রণে নতুন রূপ দেয়া যায় কিনা, বহুবচন এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে আগ্রহী। কারণ বহুবচন শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য বা দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য একান্ত অনুগত নাটক করায় বিশ্বাসী নয়। আমরা নাট্য-আন্দোলনের জন্য মূলত নাটক করছি। অভ্যস্ত চৈতন্যের দর্শককে নতুনভাবে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার ইন্ধন জোগাতে। থিয়েটার’৭৩, চট্টগ্রামের বক্তব্য: ... সময় ও সুযোগ মতো বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিক নাটকগুলো মঞ্চস্থ করার ইচ্ছা আমাদের আছে। আধুনিক কলাকৌশল ও আঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্বলিত নাটক নিয়ে আমরা সযতেœ চিন্তা-ভাবনা করছি। থিয়েটারের বক্তব্য- যে ধরনের নাটকে সমসাময়িক জীবন আছে, জীবনের আধুনিক বিশ্লেষণ আছে, কিন্তু মধ্যযুগীয় দার্শনিক তত্ত্বের উৎপাত নেই, আমরা সে-ধরনের নাটক প্রযোজনায় আগ্রহী। কেননা আমরা বিশ্বাস করি আমাদের চারপাশের আবহ সব সময়ই নাটকীয় উপাদানে সমৃদ্ধ এবং এদের বাদ দিয়ে যত্রতত্র নাটকের অনুসন্ধান করা অযথা সময় ও শক্তির অপচয়।

এই অরাজনৈতিক-রাজনৈতিক ধ্যান নিয়ে আমরা নাটককে একদা সশ্রস্ত করেছিলাম। নাটকের সেইসব অস্ত্রসমূহ এখন কোথায় ভূ-গর্ভস্ত জীবন যাপন করছে, তা উদ্ঘাটনে সরকারের কর্মক্ষম সৈন্যদল বরাবর সাহায্য প্রার্থনা করা যায় একবার। ১৯৭২ সালে এ দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র দুই জন। এখন কোটিপতির সংখ্যা কতদূর পৌঁছেছে, খোদ সরকার বাহাদুরও জানেন না। নিন্দুকেরা বলেন এই কোটিপতি ক্লাবের অনেক সদস্য এসেছেন নাট্যপাড়া থেকে; নাকি ভুল হলো? একদা নাটকের মানুষগুলো কমুনিকেশন হাইওয়ে হয়ে, বিজ্ঞাপন হয়ে, অচিরেই ছোট-ছোট মিডিয়া মোগলে রূপান্তরিত হয়েছেন প্রবল বশীকরণের প্রতিভা ছড়িয়ে। দেখা গেল- নাটকের মানুষ নাট্য-রূপান্তরের সৃজনশীলতায় অতি দ্রুত আদিবাসী প্রজেক্ট ডিরেক্টরকে ডেভেলপমেন্ট থিয়েটারের নির্মাণ-বিনির্মাণের তত্ত্বে অবশ করে, নাটক এবং ফিল্ম মেকিং-এর ওয়ার্ক-অর্ডার হাতে নিয়ে, তবে এসেছেন দলের সান্ধ্যকালীন রিহার্সেলে।

রিহার্সেল শেষে, রাতে মেসে ফিরে গরীব নাট্যকর্মী জীবনানন্দের ‘জীবন প্রণালী’ দেখে- ‘আচ্ছা এই যে নাটক লিখে যারা থিয়েটারে দেয়, তারা পয়সা পায় না? যদি সে নাটক অভিনীত হয়? কত টাকা পায়? আমি ঠিক বলতে পারি না। তবে তুমি একখানা নাটক লিখলে পারো।’ সফদর বললেন- তিনি খসড়া করেন, লিখেন কর্মীরা। ব্রেশট নাটক লেখার কথা বলেন না- নাটক করা, আসলে কীভাবে বাঁচবো, তা বোঝানোর জন্য। নিঃসঙ্গ নাট্যকর্মী সারারাত তোলপাড় হয়- নাটক তাহলে বাঁচায়? আপনারা বললেন বটে, নাটক ভালো কাজ, তা শেষ পর্যন্ত আমাদের নিজেদের ভালো হবে তো? মানে আমাদের সুখ, আমাদের আনন্দ, আমাদের আনন্দময় বেঁচে থাকা? রাত জেগে ছেলেটি নতুন নাটকের পাঠ মুখস্ত করে-

‘আন্তিগোনে    সুখ কাকে বলে ক্রেয়ন?
ক্রেয়ন    সুখ? তুমি হিমনকে বিয়ে করবে। তোমার সংসার হবে, সন্তান হবে। হিমন সিংহাসনে বসবে। তুমি জীবনটাকে যন্ত্রের মতো চালাতে শিখবে।
আন্তিগোনে    ব্যাস! এই এতটুকু! আমি বিয়ে করবো, আমার সন্তান হবে, সংসার হবে- এই এতটুকু?
ক্রেয়ন    এ-সব কি তুচ্ছ?
আন্তিগোনে    তুচ্ছ নয়? এরই জন্য তোমার অন্যায় প্রভুত্ব আমায় মেনে নিতে হবে? আমার দাদার মৃতদেহ শকুনে কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে, জেনেও আমাকে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে যেতে হবে! এই সুখের লোভে?
ক্রেয়ন    চুপ করো।
আন্তিগোনে    কেন চুপ করবো? তুমি কি ভাবছ তোমার ভয় তোমার লজ্জা এসব বুঝি না আমি? আমি যা বলছি তা তো সত্যি। আর তাকে থামাতে হলে তোমাকে চিৎকার করতে হবে, গর্জন করতে হবে। ঐ হাড়ের টুকরোটা যার নাম দিয়েছ ‘সুখ’ সেটাকে রক্ষা করতে হবে। সেটাকে জিভ দিয়ে চাটতে হবে।
ক্রেয়ন    আন্তিগোনে শান্ত হও।
আন্তিগোনে    আমি তো শুধু জানতে চাইছি কোন সুখের জন্য আমাকে কতটুকু মূল্য দিতে হবে। তবে তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছ কেন?
ক্রেয়ন    ঠিক আছে। তুমি হিমনকে ভালোবাস তো?
আন্তিগোনে    হ্যাঁ, ভালোবাসি। সে তো আমার জন্য সব করতে পারে। কিন্তু সে-ও যদি সব ব্যাপারে হিসাব কষতে শেখে, সে-ও যদি তোমার মতো সুবিধাবাদী হয়ে যায়, তাহলে সেই বুড়ো বিশ্রী হিমনকে আমি চাই না।
ক্রেয়ন    কী উন্মাদের মতো প্রলাপ বকছ!
আন্তিগোনে    আমি ঠিক বলছি। তোমাদের সুখে আমি থুতু ফেলি। তোমার ঐ মহামূল্যবান জীবনে আমি থুতু ফেলি। তোমরা সবাই জন্তুদের মতো, যা শুঁকছো, তা লকলকে জিভ দিয়ে চাটছো। একটা নির্বোধ একঘেয়েমিকে, কতগুলো ছোট-ছোট সুবিধাকে তোমরা বলো ‘সুখ’। আর সেটাই সারা পৃথিবীর লোককে গেলাতে চেষ্টা করো। ঐ টুকরো সুখ, খণ্ড সুখ, ক্ষুদ্র সুখ আমি চাই না। আমি জীবনকে সম্পূর্ণভাবে পেতে চাই। আর তা যদি না পাই, তাহলে মরতেই চাই।’

ছেলেটি মনে মনে নাটক লেখে- না, মৃত্যুর অনুবাদটি ঠিক এইভাবে আমি করতে চাই না! তারপর কলম চিবুতে চিবুতে ভাবে, শেষ পর্যন্ত আর কি লেখা যায়? কাগজের খবর নিয়ে মাথার ভেতর নাটকের গল্প জমা হচ্ছে যেন: বরেন্দ্রের এই অঞ্চলে, যেখানে খাপরা ওয়ার্ড বর্তমান, সেই উঁচু লাল দালানে একজন নাট্যকর্মী সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে গাছ, ফুল ও মাটির যতœ নিচ্ছেন! বহুকাল আগে, ফাদার সিয়ের্গী পুরোহিত-তন্ত্র থেকে বেরিয়ে একজন নামহীন গোত্রহীন মানুষ হওয়ার চেষ্টা নিয়েছিলেন মাটি ও ঘাস-পাতার যতœ নিতে নিতে। হয়ত বেঁচে থাকার ঐ-টিই ছিল তার শেষ কৌশল! আমাদের বাজার, আমাদের ক্যান্টনমেন্ট, আমাদের সম্পদ, আমাদের ক্ষমতাবদল, আমাদের জ্ঞানবৃক্ষ এবং আমাদের ভায়োলেন্স নিয়ে- নাটকের যুবকটি ভাবে, আমাদের বাঁচাটা হয়তো নাট্যতত্ত্বের আর এক ভয়ঙ্কর-সুন্দর অধ্যায়। হয়তো রক্তে আরো তীব্র আগুন-ছাই ছড়িয়ে, বনের মোষ-তাড়ানোর দ্রোহ এবং প্রতিভা নিয়েই নাটক করার জার্সি গায়ে চাপানো দরকার। অন্যথায় বিপুল-ক্ষমতাবান বাজারের সকাল-বিকেল দেখতে-দেখতেই, আমি হয়ে পড়ি নিতান্ত একটি ক্লীব জীব! নাটকের জীবন, নাট্যকারের জীবন, তাই সেই ম্যাটাডোরের মতো- আহত হয়ে, রক্তে ডুব-সাঁতার দিয়ে আবার রাষ্ট্রের গোঁয়ার-শিং-কে করতলগত করা। এই প্রতিজ্ঞা ছড়িয়ে পড়লে, তখন আন্তর্জাতিক নাটমন্দির থেকে একটি দুটি বুলেট হাশমী বা প্রবীর গুহের জন্য বরাদ্দ হয়। একটি দুটি দুর্বল নাটমন্দির গোপন-আগুনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর নাটকের মানুষ কাঁধে-গলায়-বুকে রক্তাক্ত আগুন, পোড়া-মাংসের সুঘ্রাণ এবং গুলিবিদ্ধ চশমা-সহ হাঁটতে হাঁটতে আবার খানিকটা দম নেয়; খানিকটা ঘুমের মতো হয়, খানিকটা দ্রবিভূত হয় বাতাসে, আর তীব্র মেটামরফোসিসের প্রক্রিয়া শেষ করে, ঐ ভাঙা মঞ্চের ছাই-পাশ সরিয়ে, এবার নাটক লেখেন মাটিতে চারকোল ঘষে ঘষে।

মামুন হুসাইন : গল্পকার