Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

কালের কথক : সেলিম আল দীন

Written by সাজেদুল আউয়াল.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

হাসান শাহরিয়ার
সম্পাদকেষু,
সেলিম আল দীন সম্পর্কে কিছু লিখতে বলায় কৃতার্থ বোধ করছি। সেলিম আল দীন, দীর্ঘ এক দমকা হাওয়ার নাম, আমার কাছে। একসঙ্গে হেঁটেছি দীর্ঘ ৩৫ বছর। তবু স্বীকার করে বলছি তাঁকে বুঝতে পারি নি, বুঝতে চাইও নি। বুঝতে চেয়েছি তাঁর ভাব, রচনা-কৌশল ও রচনা-কর্মে স্থিত প্রকরণ-পরিচর্যা এবং অর্থগুচ্ছ। একদা তাই লিখেছিলাম ‘কালের কথক: সেলিম আল দীন’ শীর্ষক রচনা, ছাপা হয়েছিল তাঁরই সম্পাদিত জার্নাল ‘থিয়েটার স্টাডিজ’-এ। পত্রসঙ্গে তা পাঠালাম, প্রয়োজন মনে করলে পুনর্মূদ্রণ করতে পারেন। বলেছিলেন নোতুন রচনা দেয়ার জন্য। চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লিখতে পারি নি। একটি লাইন লেখার পর দ্বিতীয় লাইনেই মৃত সেলিম আল দীন জীবিত হয়ে ওঠেন! ভয় ধরে বুকে- লেখা আর এগোয় না। এমনই হয়েছে বারবার- এস এম সুলতান, আহমদ ছফা, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মোনাজাতউদ্দিন, এস এম সোলায়মান, নাসরীন হক চলে যাওয়ার পরও তাই কিছু লেখা হয়ে ওঠে নি। তাতে মনে হয়েছে, ওঁরা আছে, দেখা হয় না, হবে কোথাও, যেমনটা হয়েছে বেঁচে থাকতে দীর্ঘ বিরতির পর।

তবে সত্য এই যে, সেলিম আল দীন নেই- এমন কি তাঁর অনুপস্থিতিও নেই। তাঁর চলে যাওয়ার খবর ১৪ জানুয়ারি দুপুরে আপনিই তো এসএমএস করে জানালেন। তখন ক্লাস নিচ্ছিলাম- সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস বাতিল করে ছুট দিই ল্যাব এইডে। এরও আগে, ১২ জানুয়ারি আপনার এসএমএস পেয়েই জানতে পারি তিনি অসুস্থ হয়ে ল্যাব এইডে ভর্তি হয়েছেন- সেদিনও ছিল দুপুর, বংশী নদীর ওপারে ‘কালি ও কলম’ আয়োজিত লেখক-শিল্পীদের মিলনমেলায় ছিলাম, প্রকৃতি বেষ্টিত। দ্রুত নদী পার হয়ে চলে আসি ঢাকায়।

লিখতে বলেছেন, অবশ্যই লিখবো। এরকম একজন বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন মানুষকে বুঝতে চাওয়া মানে তো নিজের জ্ঞানগত-কাঠামোকে ঋদ্ধ করা। শুধু সম্পাদক সেলিম আল দীনকে জানার চেষ্টা থেকে তথা তাঁর সম্পাদিত ১৪ টি ‘থিয়েটার স্টাডিজ’ পাঠ করার প্রচেষ্টা থেকে জানা যাবে নাটক ও অন্যান্য শিল্প আঙ্গিকের রূপ-রূপান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর ও অন্যদের ধারণা; জানা যাবে তাঁর শিল্পভাষ্যের  নৈয়ায়িক ভাবনা। তাঁর রচিত প্রবন্ধসমূহ, যাতে রয়েছে তাঁর শিল্পতত্ত্ব সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা, সেগুলোর পুনর্পাঠ থেকে অবশ্যই জেগে ওঠবে নব শিল্পবোধ- সেই বোধকে অবশ্যই ধারণ করার চেষ্টা করবো কোনো রচনায়। তাঁর নিমজ্জন, স্বর্ণবোয়াল, পুত্র এবং অন্যান্য নাট্য-উপাখ্যান বীক্ষণপূর্বক যে অভিজ্ঞান সঞ্চিত হবে তা ধারণ করে যে পাঠ রচনা করার ইচ্ছে আছে, তা, কথা দিচ্ছি আপনার ‘থিয়েটারওয়ালা’-য় পত্রস্থ করার জন্য পাঠাবো। তাঁর দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব বা একাঙ্গীকরণতত্ত্ব পাঠে আমার এমত প্রতীতি জন্মেছে যে, তিনি বস্তুত বাঙালির নিজস্ব নন্দনতাত্ত্বিক পরিকাঠামোর ঢিলেঢালা ভাবকে পোক্ত পাটাতনের ওপর স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। শিল্পকর্ম সম্পাদনের পাশাপাশি শিল্পসৃষ্টির করণ-কৌশল নিয়ে ভাবা সহজ কথা নয়; সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার অধিকারী না হলে কাজটি করা সম্ভব নয়। এই দূরূহ কাজটি সেলিম আল দীন করে গেছেন। বেঁচে থাকলে এই অকর্ষিত উষর ক্ষেত্রটি আরো ফলবান হতো, সন্দেহ নেই।

একদিন হেঁটেছি জীবিত সেলিম আল দীনের পেছনে, সে-দিন হাঁটলাম তাঁর শববাহী শকটের পেছনে। বড় বেদনার দিন ছিল সেই ১৬ জানুয়ারি। নিম ফলের মতোন তেতো ছিল মন। হাতে ছিল একটি মাত্র ঝরা শিউলী। জাতীয় যাদুঘরের কম্পাউন্ড থেকে কুড়িয়ে পাওয়া। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে ধাবমান শকটের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় তাঁর কফিনের উপর ছিটিয়ে দিই ফুলটি- অবচেতনের গহন থেকে একটা অব্যক্ত বেদনা সারা দেহমন জুড়ে বয়ে যায়। খুবই নির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্টরূপে উদ্ভাসিত হয় তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিনক্ষণ, কথোপকথন- সেই ’৭৩-এর পুরানা পল্টন, ‘একতা বিতান’-এর মহড়া কক্ষ যেখানে ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর মহড়া হতো, এখানেই সেলিম আল দীন ১৯৭২-এ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এসে থাকতেন, বড় একটা টেবিলে বসে লিখতেন। এই বাড়িটিতেই তাঁর সাথে প্রথম দেখা।

প্রথম দিনই কতকগুলো বইয়ের নাম লিখে দেন। তারপর থেকে তো এত বছর বইয়ের ভেতরেই থেকে গেলাম! ১৯৮০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর যে-দিন মৎ রচিত ফণীমনসা প্রথম মঞ্চস্থ হয়, সে-দিন সেলিম আল দীনই আমার হয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর দর্শকদের দিয়েছিলেন। খুবই একটা মনোহর, কখনোই ম্লান না-হওয়া সম্পর্ক ছিল তাঁর সঙ্গে। স্নেহ তো করতেনই, কেন জানি পাশে পেলে ছাড়তেই চাইতেন না। আমার নিজেরও পছন্দের মানুষ ছিলেন এই সদা-চঞ্চল ও অস্থির সুস্থিতির অধিকারী মানুষটি। তাই আমার
পি-এইচ.ডি. পর্যায়ের গবেষণা-অভিসন্দর্ভের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাঁকেই বেছে নিই। বলেছিলেন- আমি শুধু ভাষাটা দেখে দেবো, ভেতরটার দায়িত্ব তোর। আমার ওপর আস্থার ঘরটা এতটাই প্রশস্থ ছিল তাঁর। বলেছিলেন বটে, কিন্তু ভেতরটাও বারবার উল্টে-পাল্টে ঠিক করে দিয়েছিলেন তিনিই।

সেই তাঁকে নিয়ে শববাহী গাড়িটি চলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, পেছনে রইস ভাইয়ের গাড়িতে আমি, টিপু ভাই। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ-এর দিকে চলছে গাড়িটি, দু’দিকে দাঁড়ানো শিক্ষার্থী ও গুণগ্রাহীবৃন্দ। অপসৃয়মান শীতের শেষ বিকেলে পাতা ঝরছে, লালচে পাতা, হলুদ পাতা। উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে এই পাতা ঝরার পালা দেখে মনে হলো আজ ক্যাম্পাসের সব পাতা ঝরবে সেলিম আল দীনের শোকে।

সন্ধ্যায়, লালচে আলোয় তাঁকে সমাহিত করার পর কয়েক মুঠ মাটি দিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি নিজেকে। নিজেরই অজান্তে দেহ ভেঙে পড়ে কান্নায়, অদূরে দাঁড়ানো তখন বাচ্চু ভাই, আফসার ভাই, বেবী ভাই, রইস ভাই, আরো কত-শতজন। আরো দূরে ছিন্ন-শুকনো কাঠাল পাতা ঝরছে, নীরবে।

১৪ মার্চ ২০০৮, খুব ভোরে বাচ্চু ভাই, আফসার ভাই, সানি ভাই, হারুণ ভাই, হিমুসহ আমাদের গাড়ি চলেছে সেলিম আল দীনের গাঁয়ের বাড়ি সেনেরখিলের দিকে। আজ তাঁর চেহলাম ও স্মরণসভা। ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭-এ তিনি এই গাঁয়ে ছিলেন, ঢাকা থেকে ফোন করাতে বলেছিলেন- চলে আয় তোর থিসিস নিয়ে, সবগুলো কপিতে কাঁচা সই করে দিবো। যাওয়া হয় নি। যে-দিন গেলাম সে-দিন তিনি আর নেই। দোতলায় তাঁর শোবার ঘরের লোহার আলনায় ঝুলানো তাঁর শার্ট, খয়েরী রঙের। এই শার্ট গায়ে তাঁকে বহুবার দেখেছি। বাথরুমে পড়ে আছে তাঁর ব্যবহৃত টুথব্রাশ, পেস্ট আর চিরুনী। বাচ্চু ভাই রুমে ঢুকেই তাঁর খাটে বসে থাকেন অনেক্ষণ, কোনো কথা না বলেই।

শেষের দিকে সেলিম আল দীন খুব ঘন ঘন যেতেন তাঁর জন্ম-ভিটায়। শতবর্ষের পুরোনো চৌচালা পৈত্রিক ঘরের পাশেই নির্মাণ করেন পাকা বাড়ি। দোতলার ছাদে বসার জায়গা রেখেছিলেন, নিচে রান্নাঘরের পাশেও অর্ধবৃত্তাকারে তৈরি করেছিলেন বসার স্থান। ছাদে ওঠার জন্য বসিয়েছেন জাহাজের লোহার সিঁড়ি। বাসার সামনে পুকুর কাটার কাজ শুরু করেছিলেন, বর্ষার পানিতে ভেসে আসা তাজা দেশি মাছ খাবেন বলে। কোথায় ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি? কেন এই সমুদ্র সংলগ্ন গাঁয়ে এমন আয়োজন? শিকড়ের সন্ধানে নাকি অন্য কোনো কিছু ক্রিয়াশীল ছিল এই আয়োজনের পেছনে?

প্রিয় হাসান শাহরিয়ার, সকল প্রশ্নের উত্তর মেলে না। সকল ইচ্ছেও পূর্ণতা পায় না। যেমন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারি নি আপনার অনুরোধ মতো সেলিম আল দীন সম্পর্কে কিছু লিখতে। আমার এই অক্ষমতাকে ক্ষমা করবেন।

ইতি
সেলিম আল দীনের ‘চিরস্নেহভাজন’
সাজেদুল আউয়াল
২১ মার্চ, ২০০৮।

[বিঃদ্রঃ সাজেদুল আউয়াল রচিত ‘কালের কথক : সেলিম আল দীন’ প্রবন্ধটি সেলিম আল দীন সম্পাদিত থিয়েটার স্টাডিজ, সংখ্যা- ৮, আষাঢ় ১৪০৮, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা-য় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখকের অনুমতি নিয়ে থিয়েটারওয়ালার পাঠকদের জন্য তা’ পুনর্মূদ্রণ করা হলো এই বিশেষ সংখ্যায়। ]

কালের কথক : সেলিম আল দীন

সেলিম আল দীন, বিবেচনা করি, কেবল নাটককার নন, পুরোদস্তুর একজন লেখক। তিনি ‘পাঠ’ রচনা করেন- শুধু ‘নাটক’ নয়। এই পাঠ-এ স্থিত হয় মানুষ ও তার কাহিনী- তাদের সময়, গান, পরিসর, সামাজিক চিহ্নসমূহ, কথকতা, কাব্য, নৃত্য, বাদ্য, মিথকথা, স্থানীয় ভাষা, ভাবধারা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং নাট্যগুণ সম্পন্ন কৃত্য। পাঠ-এ স্থিত নাট্য সম্ভাবনাকে যখন মঞ্চে প্রয়োগ করা হয় তখন তা হয়ে ওঠে নাটক। অর্থাৎ যখন তাঁর পাঠ দর্শনের তখন তা নাটক ও নাট্য, যখন তা পঠনের- তখন তা পাঠ (text) উপাখ্যান এবং আরো কিছু। তাই দর্শক ও পাঠক- এই দুই তাঁর রচনার অংশ। এ দুই ছাড়া তাঁর রচনা প্রাণ পায় না।

আমাদের সংস্কৃতি-অঙ্গনের এ-এক আনন্দঘন উন্মাদনা যে তিনি শুধু জীবিতই নন, তিনি ক্রমাগত পাঠ রচনা করে চলেছেন, একের পর এক। অতিক্রম করে চলেছেন নিজেরই পূর্বতন ধারণা তথা পাঠকৃতির (textualities) কলা-কৌশল, শিল্পরূপ ও রীতিকে। সময়ের সাংস্কৃতিক প্রতিবেদন রচনা করাই যেন তাঁর আরাধ্য কর্ম-কৃত্য। তিনি কৃত্যবাদী লেখক। সমকালীন বাঙলা নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি বান্ধবহীন এবং স্ব-সৃষ্ট শিল্প-ভুবনের নিঃসঙ্গ বাসিন্দা। তাঁর কৃত্যসমূহ তথা তাঁর রচিত পাঠ বা নাটকসমূহকে বাঙলা নাটক রচনার পটভূমিতে স্থাপিত করতে হলে তাদের কয়েকটি পর্ব বা কালে বিভক্ত করে দেখা দরকার। এতে করে একদিকে যেমন লেখক হিসেবে তাঁর শিল্প-ভাবনার বিভিন্ন পর্যায়সমূহ অনুধাবন করা সহজ হবে অন্যদিকে তাঁর রচনাসমূহের প্রধান প্রধান প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যসমূহও পরিস্ফুট হবে।

রচনা-বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং প্রযোজনা-কাল বিবেচনা করে তাঁর রচনাসমূহকে আমরা তিনটি পর্বে পৃথক করতে পারি-

প্রস্তুতি পর্ব : ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত রচিত বিভিন্ন নাটক এই পর্বের অন্তর্গত। সর্প বিষয়ক গল্প (১৯৭২), জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭২), এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা (১৯৭৩), করিম বাওয়ালীর শত্র“ অথবা মূল মুখ দেখা (১৯৭৩), সংবাদ কার্টুন (১৯৭৩), মুনতাসীর (১৯৭৬)১, চরকাঁকড়ার ডক্যুমেন্টারী (১৯৭৭), শকুন্তলা (১৯৭৭) ও আতর আলীদের নীলাভ পাট (১৯৭৯) এই পর্বের রচনা।

অন্বেষণ-পর্ব : ১৯৮১ থেকে ১৯৯৪ অবধি রচিত রচনাসমূহ এখানে স্থান পেতে পারে। কিত্তনখোলা (১৯৮১), কেরামতমঙ্গল (১৯৮৫), হাত হদাই (১৯৮৯), চাকা (১৯৯১), যৈবতী কন্যার মন (১৯৯৩) ও একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৩) এই পর্বের প্রণিধানযোগ্য কাজ২।

উত্থান-পর্ব : ১৯৯৮-২০০০। বনপাংশুল (১৯৯৮) ও প্রাচ্য (২০০০) মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে এই পর্বের সূচনা।


প্রস্তুতি-পর্বে ৩ লেখক কেশর দোলানো অদম্য সিংহ। মঞ্চে তাঁর একচ্ছত্র রাজত্ব। একের পর এক মঞ্চসফল নাটক লিখেছেন। এই পর্বে পাঠ দাঁড় করানো বা প্রচলিত ধারণায় নাটক রচনার ক্ষেত্রে লেখকের মধ্যে নানামুখী প্রবণতা দৃষ্ট হয়। লেখক যখন তাঁর ভুবনদৃষ্টি (world-view) প্রস্তুত করছেন, তখন বাংলাদেশে নব উদ্যমে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসর বিষয় হয়ে এসেছে লেখকের কাজে। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে দেখা যায়। ১৯৭৩ সাল থেকে লেখকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তাঁর নাটক ও নাট্যভাবনার গতি প্রকৃতি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার।৪ স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস সুখপাট্য নয়। তাই এই পর্বে রচিত সেলিম আল দীনের নাটক সুখপাঠ্য হলেও নাটকে বিধৃত সমাজ, সময় ও মানুষের চিত্র ভঙ্গুর, অস্থির ও সমস্যা জর্জরিত। নাটকের বিষয়বস্তু সর্বদাই সমসাময়িক ঘটনা-নির্ভর। একমাত্র ব্যতিক্রম শকুন্তলা। এই পর্বে রচিত জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন, এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা, সংবাদ কার্টুন ও মুনতাসীর- সব ক’টি নাটকই তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থির সময়ের বয়ান। লেখক মাত্রই সমসাময়িক নিজ বাসভূমির অবক্ষয়িত সমাজ-বাস্তবতা দ্বারা তাড়িত হয়ে থাকেন। সেলিম আল দীনও হয়েছেন, চিত্রিত করেছেন সেই সময়কার রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের চালচিত্র।

এই পর্বের কাজে শুধু শহর নয়, গ্রাম এলাকার চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। করিম বাওয়ালীর শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা, চরকাঁকড়ার ডক্যুমেন্টারী ও আতর আলীদের নীলাভ পাট নাটকসমূহে গ্রামীণ পটভূমির মধ্যে সংগঠিত নানা অসংগতির খতিয়ান ধরা পড়েছে। এই ধারা বা gener-এর রচনাসমগ্রের ধারাবাহিকতায় রচিত হয়েছে কিত্তনখোলা ও পরবর্তী রচনাসমূহ। লেখক এই পর্বে নানা দিকে হাত বাড়িয়েছেন- খুঁজে বেড়িয়েছেন আঙ্গিক-কাঠামো। মনে পড়ে, ১৯৭৪-এর দিকে পুরানা পল্টনের ‘একতা বিতান’-এ থাকার সময় লেখক ‘নয়নাট’ নামে একটি নাটক রচনা-কৌশলের কথা ভেবেছিলেন। সম্ভবত নাটকের শরীরে নয়টি ভাগ আনার কথা তখন তিনি ভেবেছিলেন। তাঁর এই ভাবনা তখনকার কোনো কাজে প্রতিফলিত না হলেও পরবর্তী পর্যায়ে রচিত কেরামতমঙ্গল-এ এই ভাগ করার প্রবণতার বাস্তবরূপ পেতে দেখি, খণ্ড ও বৃত্ত পরিকল্পনায়। এই পর্বে লেখক যখন রাস্তায় রাস্তায় অভিনয় করার জন্যে চরকাঁকড়ার ডক্যুমেন্টরী লিখছেন, তখন ‘নাচাও রাস্তা নাচাও’ নামে একটি নাট্য প্রচেষ্টার ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি এমনই। যখন যে কাজ করেছেন, তাকে একটি কৃত্য করে তুলতে চেয়েছেন- কোনো না কোনো অভিধা-অলঙ্কার তাঁর কাজের শরীরে পরিয়ে দিতে চেয়েছেন। পরবর্তী পর্বের কাজের ক্ষেত্রেও তাঁর এই প্রবণতা ক্রিয়াশীল। কিত্তনখোলা লেখার পর গ্রামে মেলা পত্তনের ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট হন। ‘চলো চলো গ্রামে চলো’ তখন হয়ে ওঠে তাঁর প্রিয় স্লে­াগান।

এই পর্ব তাঁর পরীক্ষা-নীরিক্ষারও পর্ব। আঙ্গিক খোঁজার পর্ব। এই আঙ্গিক খোঁজার পথে তিনি অনুকরণ করেন নি তাঁর পূর্বতন কোনো লেখককে। বরং নাকচ করে এগিয়ে গেছেন বাস্তবধর্মী নাটক রচনার ধারাকে।৫ জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, সংবাদ কার্টুন ও মুনতাসীর- এগুলো নাচ-গানসমৃদ্ধ কৌতুকপূর্ণ রচনা, যা এমন আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে, যে আঙ্গিক এর আগে চর্চিত হতে দেখা যায় না। এই আঙ্গিক মিউজিক্যাল কমেডির আদলে নির্মিত। মনে পড়ে মুনতাসীর ফ্যান্টাসী লেখার পূর্বে সেলিম আল দীনের হাতে আমেরিকার বিখ্যাত মিউজিক্যাল কমেডি Hello Dolly দেখেছিলাম। হয়তো ঐ নাটকের গঠন-প্রকৃতির ছাপ তাঁর মুনতাসীর- এ পড়ে থাকবে। শকুন্তলা লেখার সময়ও তাঁর টেবিলে বাণভট্টের কাদম্বরী দেখেছিলাম- সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের কোনো কোনো শব্দ লেখককে গ্রাস করেছিল হয়তো।

সেলিম আল দীনের ‘প্রস্তুতি পর্ব’ শুরু হয় সত্তর দশকের শুরুতে এবং শেষ হয় আশি দশকের শুরুতে। এই এক দশকে রচিত তাঁর নাটকে নানামূখী প্রবণতার চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। এই সময়ে রচিত নাটকের বিষয়, শুধু শকুন্তলা বাদে, সবগুলোই বাস্তব থেকে আহরিত। তবে আঙ্গিকের দিক থেকে দেখলে এ-সব রচনায় আঙ্গিকের ধারাবাহিকতা নেই বললেই চলে। সম্ভবত গ্রুপ থিয়েটার-এর যে কনসেপ্ট, সেই কনসেপ্টের দিকে লক্ষ্য রেখে লেখক এই পর্বে নাটক রচনা করে গেছেন বলে এমনটা ঘটেছে। সর্বদাই মঞ্চের কথা, দলীয় সামর্থ তথা দলের অভিনয়শিল্পীদের ক্ষমতা ইত্যাদি মাথায় রেখে তিনি নাটক রচনা করেছেন। গ্রুপ থিয়েটার হিসেবে ঢাকা থিয়েটার-এর নাট্যভাবনা তথা দর্শনও প্রভাব ফেলে থাকবে হয়তো। এই দল মানুষের সংগ্রামী জীবনের চিত্র মঞ্চে উপস্থিত করার ব্যাপারে শুরু থেকেই সজাগ ছিলো।৬ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সেই দর্শনই ক্রিয়াশীল। এই দর্শনের প্রভাব সেলিম আল দীনের নাটক রচনা তথা পাঠ নির্মিতির মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত।

এই পর্ব তাঁর মানস-গঠনের পর্ব। আর এই মানস-গঠনের ব্যাপারে তাঁর সকল নাটকের নির্দেশক (শুধু চাকা বাদে) নাসির উদ্দীন ইউসুফ৭-এর এক বিরাট ভূমিকা আছে বলে আমার ধারণা। লেখক-নির্দেশকের এমন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পৃথিবীতে বিরল। প্রায় তিন যুগ ধরে এঁরা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নাটক ও নাট্যক্রিয়ার ধারাসমূহ সম্পর্কে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ সবিশেষে জ্ঞাত থাকায় তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো তাঁর বন্ধুকে প্রাণীত করা, দিক নির্দেশনা দেয়া।

সেলিম আল দীনের এই পর্বের কাজে পাশ্চাত্যের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। তবে পরবর্তী পর্বের কাজে এই প্রভাব অনুপস্থিত। দেশজ নাট্যবুদ্ধির অন্বেষণে নিরত তখন লেখক।


অন্বেষণ-পর্বে লেখক অনেক সুস্থির। প্রস্তুতি-পর্বের মতোন আর ছুটোছুটি করতে দেখা যায় না। আঙ্গিক-সর্বস্বতা ত্যাগ করেছেন, পুরাণের পিছনেও ছুটছেন না, পাশ্চাত্য থিয়েটারের দীক্ষা পরিত্যাগ করেছেন- বাঙালির নিজস্ব নাট্যবুদ্ধির সন্ধান তাঁর তখন আরাধ্য অঙ্গন। প্রস্তুতি-পর্বে যে-সব প্রাধান্যবিস্তারকারী (dominant) শিল্প-আঙ্গিক তাঁকে গ্রাস করেছিলো, সে-সবকে অন্বেষণ-পর্বে লেখক নাকচ করে দেন। এই পর্বে লেখক শিকড়ের সন্ধান শুরু করেন। নিজস্ব নাট্যতত্ত্ব ও নন্দনতত্ত্ব তাঁর অন্বেষণের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিত্তনখোলা রচনার মাধ্যমে এই অন্বেষণের পর্ব শুরু হয়। শেষ হয় যৈবতী কন্যার মন রচনার মাধ্যমে। মাঝে রচিত হয় কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, চাকা ও হরগজ-এর মতন অমর পাঠ। এই পর্বে লেখক পাঠ বা নাটক রচনার জন্যে রীতির সন্ধানে ব্যস্ত। কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল ও হাত হদাই রচিত হয় বর্ণনাত্মক রীতিতে। চাকা, যৈবতী কন্যার মন ও হরগজ কথানাট্য নামে এক বিশেষ শিল্পরীতির আশ্রয়ে রচিত।

এই পর্বে লেখক ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী’ অর্থাৎ পাঠ রচনার ক্ষেত্রে লেখক নাটকের বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে আসতে তৎপর। তাঁর এমত প্রতীতি জন্মায় যে, একটি মহৎ পাঠে সব শিল্প-আঙ্গিকের অবস্থান সম্ভবপর করে তোলা যায়। তাই এই পর্বে তাঁর কাছে নাটক আর নাটক নেই- তা হয়ে ওঠে কথা, কাহিনী, উপাখ্যান, নৃত্য, গীত, নাট্য, রাগরাগিনী ইত্যাদির বিচিত্র সমাহার।৮ চাকা নাটকের ভূমিকায় আমাদের সাহিত্যভুবনের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক যে কথা সেলিম আল দীন ও তাঁর কাজ সম্পর্কে লেখেন, তা আলোচনা এগিয়ে দেয়ার কাজে সহায়ক বলে উল্লেখ করছি-

বাংলা নাটকের এক প্রধান পুরুষ; সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ, নতুন কিন্তু বাংলা ভাষার সৃষ্টি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই। বাংলায় তিনি লেখেন কারণ বাংলার অস্তিত্ব এবং জগৎ-বোধ, যাপিত জীবনের স্বপ্ন ও যন্ত্রণা তাঁর বিষয়- অপিচ তা বিশ্বের সকল মানুষেরই মানচিত্র হয়ে ওঠে বটে। মানুষ প্রসঙ্গে আমাদের বিস্ময় যেমন অফুরান, মানুষের কথা বলবার মাধ্যমও তেমনি বিচিত্র ও সহস্র। বাংলার ধূলিতে ও কাদার পটে অনবরত দাগ কেটে যাওয়া চাকার প্রতীকে সেলিম আল দীন মানুষের জীবনের যে মৌল কথাটিকে দেখতে পান, সেই কথা প্রকাশের জন্য তাঁকে সন্ধান করতে হয় কথা বিন্যাসের নতুন এক চেতনা- সংলাপ নির্ভর নাটক তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে হয় না, আবার কেবল দেহছন্দ-নাচ-অভিনয় সকল কিছু তাকে এটে উঠতে পারে না, উপন্যাসের ধারা বর্ণনাও তার নিকট বলে মনে হয় না, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এবং ব্যক্তি-সমাজ সংগ্রাম তাঁকে অবিরাম দুলিয়ে দিতে থাকে ভূত-ভবিষ্যতে, এমত মুহূর্তে আমাদের এই নাট্যকার এক নতুন সাহিত্য মাধ্যম আবিস্কার করে ফেলেন- কথানাট্য- যা নাটক, কবিতা, নাচ, গীত, উপন্যাস, উপকথা ও কথকথার সমাহার।৯

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি থেকে এ-কথা প্রতীয়মান হয় যে, এই পর্বে লেখক এমন একটি রচনা-রীতির সন্ধান লাভ করেছেন, যা লেখকের বিবেচনায় ‘সকল দ্বৈত শিল্পরীতিভেদ অস্বীকার পূর্বক রচনার কাঠামো, ভঙ্গি ও সর্বোপরি শিল্পের নানা উপাদানের একটি স্বতঃস্ফূর্ত মিশ্রণ যা সর্বাংশে মৌলিক এবং নানা রীতির সংযোগ সত্ত্বেও অভেদাত্ম।’১০


প্রস্তুতি-পর্বের নানামুখী প্রবণতা এই পর্বে উধাও। এই পর্বের কাজে রচনা-রীতির সন্ধান ও সেই রীতির মধ্যে স্থিত শিল্পের নানা উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে দেখা যায় লেখককে। কিত্তনখোলা থেকে হরগজ পর্যন্ত নাটক রচনার ক্ষেত্রে লেখকের যে প্রবণতা ক্রিয়াশীল ছিলো তা তাঁর জবানীতে এই রকম-

কিত্তনখোলা থেকে হরগজ পর্যন্ত আমি সজ্ঞানে বাঙলা নাটকের চিরাচরিত রুগ্নবাস্তবতার রীতি পরিহার করতে চেয়েছি। জীবন, জগত ও মানবিক বোধের যে সকল নতুন স্পর্শে বাঙলা গান, কবিতা, উপন্যাস দুই শতবর্ষে ব্যাপ্তি ও বিস্তারলাভ করেছে, তার তুলনায় ক্লিশে সমাজ চিন্তনের অতিগুরুভার বহন করতে গিয়ে বাংলা নাটক বহুক্ষেত্রে শিল্পপথ বিচ্যুত হয়েছে। পাশ্চাত্যে প্রায় পরিত্যক্ত বিস্মৃত উনিশশতকীয় রিয়ালিজমের প্রভাব বাংলা নাটক বা উপন্যাসে এখনও যাকে বলে দোর্দণ্ড বা মধ্যাহ্নের মার্তণ্ড প্রতাপে বিদ্যমান। কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল ও হাত হদাই এই ত্রয়ী নাটকের অনুপ্রেরণার স্থল চিরায়ত এপিক ও ধর্ম- বিশেষত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জীবন চেতনা এমন কি- আঙ্গিক পর্যন্ত সে সকল কাব্যে, এপিক বা মহাকাব্যে প্রায় এক বিন্দুতে মিশে গেছে। এপিক বা প্রাচ্য ধর্মদর্শন আমাকে ঐ ত্রয়ীতে অনুপ্রাণিত করেছে, এ কালের জীবনের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেখার প্রেরণা দিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, বৌদ্ধ জাতকের গল্প, ওভিদের মেটামরফসিস পাপ ও কর্মফলের শ্লাঘ্য শিল্প-লেখা, কোরান, ডিভাইন কমেডিয়া ও মহাভারতের নরক কল্পনাকে একালের সঙ্গে মেলানো যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওডিসি, ইলিয়াড, সিন্দবাদের সমুদ্র ভ্রমণ কোথাও অদ্বৈতের টঙ্কার দেয় অন্তরে। এই ত্রয়ী রচনা শেষে এও মনে হয়েছে বাস্তবতা আমার লক্ষ্য নয়, এমন কি বর্তমানও অবলম্বন মাত্র। আমি বরং কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই-এর মধ্যে চিরায়ত বাঙালি তথা প্রাচ্য মানবের আকার অঙ্কনে প্রয়াসী ছিলাম।১১

এই পর্বে রীতি হিসেবে ‘কথানাট্য’ প্রাধান্য পায়- সৈয়দ হক যাকে ‘আবিষ্কার’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং যাকে তাঁর কাছে ‘এক নতুন সাহিত্য মাধ্যম’ বলে মনে হয়েছে। সেলিম আল দীনের কথাতেও দেখি যে তিনি ‘চিরাচরিত রুগ্নবাস্তবতার রীতি পরিহার করতে’ চেয়েছেন এই পর্বে। ‘উনিশশতকীয় রিয়ালিজম’ তাঁর কাছে গ্রহণীয় বলে মনে হয় নি। এপিকধর্মী কাজের মধ্যে তিনি নাটক রচনার কাঠামো বা রীতির অন্বেষণ শুরু করেন। উপর্যুক্ত নাতিদীর্ঘ উদ্ধৃতিটিতে তার বিস্তারিত বিবরণও পাওয়া যায়। বাস্তবতার যে চিত্র আমরা এই পর্বের কাজে পাই, তা লেখকের মতে ‘মহাকাব্যিক বা ধ্র“পদী বাস্তবতাবাদ’। দ্বৈতাদ্বৈতবাদীতায় উপনীত হবার ইচ্ছা এই পর্বে পূর্ণতা পায়- চাকা বা যৈবতী কন্যার মন-এর পাঠ বিশ্লেষণ করলে তার প্রমাণ মিলবে। কোনো একটি আঙ্গিক প্রাধান্য পায় নি এই পর্বের কাজে বরং আঙ্গিকসমূহ একটি অন্যটির গায়ে হেলে পড়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে, শিল্প-শৃঙ্খলা মেনে নিয়েই। একটি আঙ্গিক লোপ পেয়েছে সমান্তরাল বা অগ্রবর্তী অন্য একটি শিল্প-আঙ্গিকের কাছে। এক মোলায়েম দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ভিতর দিয়ে নাটকস্থ সমস্ত আঙ্গিক তথা সংলাপ গান, গল্প-কাহিনী, নাচ, কথকতা, উপকথা, মিথকথা, কৃত্য, কাব্য, বর্ণনা ইত্যাদি বিবাহিত হয়ে নিঃশেষ হয়েছে নাটকের অন্তে, অবশিষ্টহীনভাবে। প্রশ্ন জাগে অধম এই কাঙালের মনে : সব কিছুর ঐকত্রিক রূপ কী এই ‘কথানাট্য’ বা ‘বর্ণনাত্মকরীতি’? সব কিছু মিলে যে রূপ ও রীতির জন্ম হয় তার স্বরূপ কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে, যিনি এই রূপ ও রীতির স্রষ্টা, তিনি জানান: ‘আঙ্গিকের ভেতরেই আঙ্গিক বিনাশী শক্তি আছে। তাকে চিনতে গেলেই দেখা যায় সর্বত্র সে অবিনীত দৃঢ় মূর্তি। শিল্পের নিয়মে তার জন্ম অথচ সে শিল্প সংহারী।১২ বহুকাল ধরে শিল্পের সংসারে ঘর করা মানুষের পক্ষেই সম্ভব এমত অনুধাবন। তাই এই পর্বের কাজে লক্ষ্য করি, সব আঙ্গিক একে অন্যেতে লোপ পেয়ে যে বৃহত্তর আঙ্গিকের জন্ম দেয়, তাকেও লেখক কোনো নামেই ডেকে তৃপ্তি পান না- কেবলই থেকে থেকে নাম পাল্টান। তাঁর খোঁজ যেন শেষ হয় না।

এই পর্যায়ের কাজে লেখক লেখার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভাটি বাংলার বৃহত্তর লোক সমাজের জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম তথা দলিত মানুষদের জীবন-চর্যার নানাদিক। তাঁদের জীবনচক্রে যে নিরন্তর রূপান্তর সাধিত হয় তার চিত্র পাওয়া যায় এই পর্বের কাজে। নাট্যকলাবিদ আফসার আহমদ কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল ও হাত হদাই নিয়ে ‘মঞ্চের ট্রিলজী’ শীর্ষক যে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন, তা এই বাংলায় প্রথম সেলিম আল দীনের পাঠ বিশ্লেষণের আন্তরিক প্রয়াস। আফসার আহমদ-এর বিবেচনায় ‘কিত্তনখোলা নাটকের বিষয়বস্তুর বিন্যাসে এর রচয়িতার চেতনায় এদেশের লোক ঐতিহ্য সংস্থিত এবং সাম্প্রতিক জীবন ভাবনা নাটকটির বিষয়বস্তুর বিন্যাসে এর রচয়িতার চেতনায় এদেশের লোক ঐতিহ্য সংস্থিত এবং সাম্প্রতিক জীবন ভাবনা নাটকটির আদ্যন্ত বিস্তৃৃত।’১৩ কেরামতমঙ্গল নাটক সম্পর্কে আফসার আহমদ-এর বিবেচনা হচ্ছে যে, ‘এ নাটকে যোগ হয়েছে লোকজ জীবনের বিপুল জীবনভাষ্য। হিন্দু-মুসলমান, গারো-হাজং, ক্যাথলিক-খ্রিস্টান, মুনি-ঋষি, হিজড়া, জমিদার, জেলে, মাঝি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর অবক্ষয় প্রভৃতি অজস্র জাতি, প্রজাতি, ধর্ম, মানুষ ও প্রসঙ্গ নিয়ে গড়ে ওঠেছে নাটকটির বিশাল আখ্যানভাগ। এর সঙ্গে লোকজ উপাখ্যান, উপকথা, কিংবদন্তীর সার্থক সমন্বয় ঘটেছে।১৪ হাত হদাই নাটকের বিষয়ও সমুদ্রোপকূলীয় স্থানীয় মানুষের জীবন থেকে নেয়া। এই সব তথ্য উত্থাপনের মাধ্যমে এই সত্যে উপনীত হওয়া যায় যে, এই পর্বে লেখক লোকজীবনবর্তী। লোকজীবনের মধ্যে চর্চিত নানা আঙ্গিকের সাংস্কৃতিক উপাদান (culture-gene) তাঁকে আপন পথ নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে।

এই পর্বে পথ কেটে অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে লেখককে আরো যে বিষয়টি সাহায্য করেছে সেটি হচ্ছে ‘ঢাকা থিয়েটার’ কর্তৃক পরিচালিত ‘গ্রাম থিয়েটার’ আন্দোলন। ১৯৮১ সালে গ্রামে গ্রামে থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই আন্দোলন দানা বাঁধে। এই আন্দোলনের সূত্রে লেখককে গ্রামে গ্রামে যেতে হয় এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হতে হয়। গ্রামীণ সংস্কৃতির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান তাঁর কাজে প্রভাব ফেলেছে প্রবলভাবে। তিনি দলিত সাহিত্য-চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন সচেতনভাবেই এই পর্বে। এই আন্দোলনের অধীনে ১৯৮৬ সালে ‘লোকনাট্য গবেষণা প্রকল্প’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার আওতায়ই সেলিম আল দীন সংগ্রহ করেন বেহুলা লক্ষিন্দরের হাস্তর’ শীর্ষক পালা মানিকগঞ্জের তালুকনগর থেকে।

এই সময় আরো একটি নাট্যভাবনা লেখকের মননে প্রাধান্য পায়- তা হলো ‘জাতীয় নাট্য আঙ্গিক’ নির্মাণের ভাবনা। মৌলিক নাটক রচনার মাধ্যমে এই আঙ্গিক অর্জনের কথা ভাবা হয়। এতে করে লেখক আরো বেশি স্থানীয় সংস্কৃতির (indigenous culture) দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্রস্তুতি-পর্বে মঞ্চের কথা মাথায় রেখে নাটক রচনার যে তাগিদ দেখা যায়, এই পর্বে এসে সেই ভাবনা তিরোহিত- কাহিনীর প্রয়োজনে চরিত্র-সংখ্যা নির্ধারিত হচ্ছে, তাই কেরামতমঙ্গল-এ দেখা যায় চরিত্র-সংখ্যা ষাট ছাড়িয়ে যেতে। অর্থাৎ এই পর্বে এসে সেলিম আল দীন নাটক আর শুধু মঞ্চায়নের জন্যে রচনা করেছেন না- পাঠের জন্যেও সে-সব রচিত হচ্ছে। তিনি যেন শুধু রচক নন- কথক হয়ে ওঠারও চেষ্টা করেছেন। নিজের লেখক সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের আর্তি থেকেই তিনি প্রকৃতপক্ষে ক্রমাগত আত্মপ্রকাশের রীতি বা কাঠামোর অন্বেষণ করেছেন এই পর্বে।

প্রস্তুতি পর্বের দৃশ্য বিভাজনরীতি আর এই পর্বে অনুসৃত হয় নি। যেমন চাকা-য় লম্বক ও তরঙ্গ বিভাজনরীতি অনুসৃত হয়েছে। কিত্তনখোলা-তে সর্গ বিভাজন প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে। কেরামতমঙ্গল খণ্ড ও বৃত্ত পরিকল্পনায় রচিত। হাত হদাই-এর অঙ্ক বিভাজন একেবারেই অন্যরকমÑ উপকূলবাসীর জীবন যাত্রার বয়ান বলে জোয়ার ভাটার অনুকরণে নাট্যপর্ব বিভাজিত হয়েছে। মোট ষোল পর্বে এই নাটক বিভক্ত। এই পর্বের কাজের আরো একটি বিশেষত্ব হচ্ছে যে, প্রস্তুতি পর্বের নাটকের মতন এই পর্বের নাটকে ঘটনার তুঙ্গ নেই- ইউরোপীয় নাটকের ধাঁচ থেকে লেখক সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে স্থানীয় নাট্যরীতির অন্বেষণে ব্যস্ত।

এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হচ্ছে। সেটি হলো সেলিম আল দীনের অন্বেষণ পর্ব (১৯৮১) শুরুর আগে মৎ প্রণীত ফণীমনসা নাটকের পাঠ প্রণয়ন (১৯৭৮-’৭৯) ও মঞ্চায়ন (১৯৮০)। সেলিম আল দীনের মতন এই অধমও ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর সাংগঠনিক কাঠামো থেকে উচ্ছ্রিত। আমাকেও নিজের জীবনের প্রথম ও শেষ নাটক রচনা করতে গিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির সন্ধান করতে হয়েছে। তবে আমার এ সন্ধান কোনো সচেতন প্রয়াস ছিল না- তিতাসপারের ছেলে বলে এমনটা হয়েছে। তিতাসকে ছেড়ে এলেও তিতাস আমাকে ছাড়ে নি- আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে মালোপাড়ার আখ্যান, কাব্যনাটক ফণীমনসা। তিতাসপারে সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ অনায়াসে উঠে এসেছে লেখাতে। ১৯৭৮ সালে ফণীমনসা রচনাকালে আমার বয়স বিশ এবং তখনো আমার স্মৃতিতে ফেলে আসা তিতাসপারের স্মৃতি জাগ্রত। ঐ স্মৃতিরই বি-নির্মাণ বলা যায় এই আখ্যান। বিশিষ্ট নাট্যতত্ত্ববিদ শান্তনু কায়সার-এর মতে-

ফনীমনসা মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে ‘ঢাকা থিয়েটার’ বাঙলা নাটক ও নাট্যরীতিকে খুঁজে বেড়ানোর যে প্রকৃত যাত্রা শুরু করেছিল তা তথ্য হিসেবেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর মধ্যে দিয়ে নাট্যকার ও নাট্যদলটির অভিপ্রায় ও নাট্যদর্শন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। আঙ্গিক ভাঙা আঙ্গিকের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় ফণীমনসা-য়। তিতাস পারের নানা সাংস্কৃতিক উপাদান- তাদের আঙ্গিকসহ লীন হয়ে গেছে নাট্যকার নির্মিত আঙ্গিকের মধ্যে। অঙ্গ বিলীন হয়ে গেছে অঙ্গে। আবার প্রতিটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠিত স্ব-মহিমায়- কথকতা, স্থানীয় গান (সারিগান, কীর্তন), নৃত্য, কাব্য, গল্প- সব আলাদা আবার সব কিছুর ঐকত্রিক রূপ এই আখ্যান। আর আঙ্গিকে স্থিত বিষয় পেয়েছে এমনই বিস্তার যার ফলে সকল পরাজয় ও মৃত্যুর পরেও আখ্যানটি দাঁড়িয়ে যায় প্রাণ-প্রবাহের পক্ষে।১৫

ফণীমনসা সম্পর্কে সেলিম আল দীনের মন্তব্য: ফণীমনসা-য়ও বাঙলা থিয়েটারের মেজাজ অকপট রূপে বিদ্যমান।১৬ মনে পড়ে- প্রথম মঞ্চায়নের (২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮০) সন্ধ্যায় আমি আর সেলিম আল দীন এই নাটক মহিলা সমিতির অডিটরিয়ামের পেছনের সারির পেছনে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করি- তাঁকে বেশ উত্তেজিত হতে দেখেছি। পরে, উপস্থিত দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে সেলিম আল দীন ও আমি একসঙ্গে মঞ্চে উঠি- অনেক প্রশ্নের উত্তর সেদিন উনি নিজেই দিয়েছিলেন। পুরো নাট্যষজ্ঞটির সাথে উনি বেশ একাত্ম হয়েছিলেন। ফণনীমনসা যদি তাঁর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার প্রকোষ্ঠে একটুখানি আন্দোলন তুলে থাকে অথবা যদি তাঁকে একবারের জন্যে হলেও তিতাসের পারে নিয়ে গিয়ে থাকে- এই কাঙাল তবে নিজেকে ধন্য মনে করে। জানি না এমনটা ঘটেছে কিনা। তবে লক্ষণদৃষ্টে অনুমান করি এমনটা ঘটলেও ঘটতে পারে। লক্ষণীয় যে কিত্তনখোলা-ও একটি নদীর নাম। ফণীমনসা-ও একটি নদীর নাম। ফণীমনসা-য় সম্মিলিতভাবে একটি সম্প্রদায় (মালো) ভূমি পাবার জন্যে লড়াই করে। কিত্তনখোলা-য় সোনাই চরিত্রটি তার জমি রক্ষার জন্যে একা জোতদারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাছাড়া ফণীমনসা-য় যে কাব্যময়তা, কথকতা, স্থানীয় কাহিনী, ভাষা, উপমা, বাগ্ধারা, শব্দ, নৃত্য, গীত, উপকথা ইত্যাদির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়- কিত্তনখোলা-তেও এ-সবের কিছু কিছু উপস্থিতি লক্ষণীয়। সংকোচ ও লজ্জার সঙ্গেই বলছি যে, যে আমি এই একটি আখ্যান রচনা করেই থেমে আছি, সেই আমি যদি তাঁর অন্বেষণ-পর্বে তাঁকে একটুখানি হলেও ভাবনার খোরাক যুগিয়ে থাকি, তবে তিতাসের পারে জন্ম নেয়াটাকে সার্থক বলে ধরে নেব।


অন্বেষণ-পর্বে ‘কথক’ হয়ে ওঠার যে প্রবণতা লক্ষ্য করি, উত্থান-পর্বে এসে তা পূর্ণতা অর্জন করে। বনপাংশুল ও প্রাচ্য-তে লেখক পরিপূর্ণভাবে কথক হয়ে উঠেছেন- কালের কথক। তাঁর নাটকে সংলাপের বাইরে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা আছে বলে বা চরিত্ররা নিজেদের উদ্দেশ্য করে কথা বলেন বলে বা পাঠের মধ্যে কোথাও দৃশ্য পরিসরের বর্ণনা আছে বলেই তিনি কথক নন- তিনি কথক, কারণ তিনি তাঁর জনপদের মানুষদের (শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, উপজাতি নির্বিশেষে) আখ্যানে প্রবেশ করে সেই আখ্যানের ইন্টারপ্রিটেশন দাঁড় করান বলে। বনপাংশুল-এ তিনি বাংলাদেশের এক লঘু নৃ-গোষ্ঠীর (মান্দাই) কথা বর্ণনা করেছেন। প্রাচ্য-তে সমতটের মানুষদের জীবন, পরিসর, সাংস্কৃতিক মনোভাব ও দর্শন তুলে ধরেছেন। এ পর্বে তিনি দু’টি ভিন্ন সম্প্রদায়ের দু’টি ভিন্ন কালের কথক। দু’টি আখ্যানেই যে সম্প্রদায়ের মানুষের কথা বলা হয়েছে- তাঁদের জীবনযাত্রা বহুকাল ধরেই প্রবহমান। লেখক তাঁদের সেই প্রবহমানতার মধ্যে প্রবেশ করে নতুন কালের কাহিনী বলেছেন। ভিন্ন বাচন (explanation) দাঁড় করিয়েছেন তাঁদের জীবন-চর্যার নানা দিক। ঠিক যেভাবে আমাদের গায়েনরা পাঁচালি বা পালাসমূহে করে থাকেন।

পাঁচালি বা পালায় যেমন কথক কাহিনীকে বিভিন্ন স্তরে বাহিত করে কাহিনীর ভিন্ন বাচন দাঁড় করান- বনপাংশুল-এও লেখক ঠিক সেই কাজটিই করেছেন। এপিকধর্মী যে কোনো কাজেই এই স্তর বিভাজনরীতি লক্ষ্য করা যায়। ঋত্বিক ঘটকের সকল কাজে, বিশেষ করে সুবর্ণরেখা-য় তো এই স্তর বিন্যাসের নজির প্রবলভাবে উপস্থিত। বনপাংশুল-এ আমরা প্রধানত তিনটি স্তরের উপস্থিতি লক্ষ্য করি: বাস্তবের তন্নিষ্ট স্তর, মিথের জগৎ এবং মম্ময় জগৎ। নাটকটি দর্শনের পরই এই তিনটি স্তরের উপস্থিতি আমাকে গ্রাস করে। তিনটি স্তরের ক্রিয়াশীলতা তদন্ত করে ঐ রাতেই পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও হুমায়ুন কবিরকে তার ব্যাখ্যা শোনাই। পরদিন ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর জন্মদিনেও স্তরসমূহের ব্যাখ্যা পুনর্ব্যক্ত করি সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী-র কাছে। বাস্তবের তন্নিষ্ট স্তরে বাঙালি পুঁজির আগ্রাসনের কাছে মান্দাইরা হার মানে। কেউ বাস্তব থেকে পালাতে চায়- কেউ থেকে যেতে চায় এই অরাজক বাস্তবতাতেই। মিথের জগতে দেখা যায় চরিত্ররা ধর্ম-দেবতা-লোকাচার ইত্যাদির বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে আসতে তৎপর। মম্ময় জগৎ তৈরি হয় অভিনয় স্থলে, মঞ্চে। বাস্তব ও মিথের অভিকর্ষণে এই জগৎ তৈরি হয় চরিত্রসমূহের অভিনয়ের মাধ্যমে। এই অভিনয়রীতি মিশ্ররীতির- সংলাপাত্মক ও বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির সংমিশ্রণে মূর্ত হয় এই মিশ্ররীতির অভিনয়-কৌশল। এই জগৎ চরিত্রসমূহের একান্ত ব্যক্তিগত জগৎ। এই জগতে চরিত্রসমূহের যে উপলব্ধি হয়, তা তাঁদের নিজস্ব উপলব্ধি- যেমন সুকিকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের দ্বন্দ্বে ‘ব্যক্তি’ হয়ে উঠতে দেখি। সুকির শরীর তাঁর নিজের ভোগের জন্যে, শিবের জন্যে নয়- এই ভাবনা তার মনে স্থান পায়। সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় বিধানের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে ‘ব্যক্তি’ হয়ে ওঠতে চায় সুকি। পূর্বতন বিশ্বাস, প্রথা, প্রতিষ্ঠান, আচার ইত্যাদি ভেঙে তার শরীর তার নিজের করে পেতে চায়, তার যৌনতাকে তার নিজের ভোগের জন্যে পেতে চায়। কিন্তু পায় না। প্রকৃতপক্ষে সুকির যৌন অবদমনই তাঁকে পুরাণবিমুখ করে তোলে। তাই সে শুধু নিরাকার শিবের প্রতি নয়, সাকার গুণীনের প্রতিও বিমুখ হয়ে ওঠে।

বনপাংশুল-এ এই রকম বিভিন্ন স্তরের উপস্থিতি লক্ষ্য করে লেখক হিসেবে সেলিম আল দীনের এপিক-উত্থান সম্পর্কে আমার ধারণা বদ্ধমূল হয়। লেখক যেন আর শুধু নাটককার নন, আমাদের এপিক ট্র্যাডিশনের পাঁচালিকারদের মতন কথক হয়ে উঠতে চেয়েছেন এবং হয়েছেনও তা। পাঁচালিকার হয়েছেন। পাঁচালি মৌখিক রীতির সৃষ্টি। লেখ্যরীতির চেয়ে এই পর্বে সেলিম আল দীন মৌখিক রীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন- কথক বা গায়েন হয়ে ওঠার এ-এক অমল ধবল প্রয়াস। আমাদের প্রাচীন ও মধ্যযুগের পালাকার বা গায়েনরা এই মৌখিক রীতিকেই প্রাধান্য দিতেন। সেলিম আল দীন তাঁর স্ব-সংস্কৃতির অঙ্গণে বিচরণের সময় এঁদের দেখা পেয়েছেন- গ্রামে গ্রামে ও পুরনো কালের রচনায়। প্রভাব যদি পড়ে থাকে তো এদেরই প্রভাব পড়েছে বেশি তাঁর সৃষ্টিকর্মে। লেখক স্বয়ং তাই বনপাংশুল-এর রচনারীতি নির্ধারণ করতে গিয়ে একে ‘নব্যকালের পাঁচালি’ বলে অভিহিত করেছেন।

বাঙলা পাঁচালিরীতির স্বরূপ তিনি সন্ধান করেছেন তার ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ শীর্ষক পি-এইচ.ডি. পর্যায়ের গবেষণাকর্মে। এই গবেষণা-কর্মটি তাঁর লেখক সত্তার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বলা চলে তাঁর মূল প্রবণতার বিমোক্ষণও ঘটেছে এই গ্রন্থ রচনার মাধ্যমেই। শিকড় সন্ধানের যে যাত্রা অন্বেষণ-পর্বে শুরু হয়েছিল, তার পরিসমাপ্তি ঘটে মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যরীতি অনুসন্ধানের মাধ্যমে- তাত্ত্বিক ও মৌলিক পাঠ প্রণয়ন- উভয় দিক থেকেই। পাঁচালিরীতির সন্ধান তিনি গবেষণা করতে গিয়েই পেয়েছেন। পাঁচালি সম্পর্কে সেলিম আল দীনের অভিমত-

পাঁচালি, মধ্যযুগের আখ্যান পরিবেশনার বিশিষ্ট রীতি। নাট্য-উপাদানের বিচারে, পাঁচালি হচ্ছে মূলত পালাভিনয়। এদেশে ‘দৃশ্যকাব্য’ মাত্রই ‘সঙ্গীতাত্মক’- পাঁচালি এই ধারারই পূর্বসূরী। এজন্য বিশেষজ্ঞদের মতে তা কেবল ‘গীত নয়’ একই সঙ্গে ‘গীতাভিনয়’। অন্যদিকে গায়েন দোহারের যৌথ পরিবেশনা দৃষ্টে পাঁচালি ‘সম্প্রদা’ বা ‘সম্প্রদায়ের অভিনয়’ রূপেও আখ্যাত।১৭

বনপাংশুল-এ আমরা প্রকৃতপক্ষে একটি সম্প্রদায়ের, তথা লুপ্তপ্রায় মান্দাই কোচদের অভিনয়ই প্রত্যক্ষ করি- যদিও ‘এ নাটকের অভিনেতারা কেউ কোচ সম্প্রদায়ের নন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে দিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে পৌঁছাতে পারি ছায়া মান্দাইদের ভুবনে।’১৮ লক্ষণীয় যে এই পর্বে লেখক ‘সম্প্রদায়ের কথক’ হয়ে ওঠেছেন এবং এই কৃত্যে পাঁচালিরীতিই তাঁর কাছে অধিক যুৎসই বলে বিবেচিত। বনপাংশুল-এ পাঁচালির গড়ন ব্যবহারের পক্ষে লেখকের অভিমত-

বনপাংশুল-এ পাঁচালির গড়ন নির্বাচনের পশ্চাতে এই নন্দনভাবনা কাজ করেছে যে, বাঙলা উপাখ্যানের মডেলেই আধুনিকতা, সমকালীনতা, জীবন ও জগতের নানা স্তরের আন্তঃসম্পর্কের জটিল আবর্তসমূহের ধৃতি সম্ভব কিনা। উপরন্তু সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য নাট্য নির্মাণ কৌশলের অভিজ্ঞতায় পাঁচালির উপস্থাপনাকে নাট্যের অনিবার্যস্থলে ন্যাস করা সম্ভব কিনা- তাও বুঝে নেয়া। বনপাংশুল তাই নিরীক্ষানুধর্মী নয়, একান্ত বিশ্বাসে বাঙলা শিল্প মডেলের অস্তিত্ব খুঁজে দেখা। ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণা ভাসমান ফেনাপুঞ্জ নয়। নিরীক্ষা নয় এ মূল বৃক্ষের বীজাঙ্কুর। অভ্রান্ত নিশ্চিত তার শেকড়-বাকড়। এই উপাখ্যানবর্তী নাট্যে, আদি পাঁচালি (দাশরথি রায়ের নব্য পাঁচালি ব্যতিরেকে) নির্মাণ ও পরিবেশনা কৌশলের অদ্বৈত ব্যবহারের মধ্যে কোন পিছুটান বা নিছক ঐতিহ্য প্রীতি কাজ করে নি। বরং কোনো সুবি¯তৃত পরিভাষাসমূহ উপাখ্যানে, ঐ সকল পরিভাষাকে নির্মাণের নানা স্তরে শীর্ষনাম রূপে ব্যবহারপূর্বক আমার গল্প বুনন রীতিটাকে অধিকতর নিশ্চিতরূপে প্রকাশ করা যাবে এরকম বিশ্বাস ছিল। কথানাট্যের শুরুতে, সংস্কৃত ‘কথাসরিৎসাগর’-এর গল্প বিভাজন থেকে মঙ্গলাচরণ বা উমাপতি বন্দনার ধাঁচ এবং লম্বক, তরঙ্গ প্রভৃতি পরিভাষা গৃহীত হয়েছিল। পরে পড়নের ক্ষেত্রে একটা নিশ্চয়তা মিলে ছিল বলে যৈবতী কন্যার মন ও হরগজ-এ তা পরিত্যাগ হয়। অবশ্য পাঁচালির দিশা, বোলাম, নাচাড়ি, শিকলি, পদ, কথা, প্রভৃতি পরিভাষা বনপাংশুল পরবর্তী রচনা প্রাচ্য-তেও অনুসৃত হয়েছে। ভবিষ্যতে নির্মাণ কৌশলগত এই শব্দগুলির পরিচয় সুলভ হলে কাহিনীর শরীর থেকে তা পরিত্যক্ত হতে পারে।১৯

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিটি থেকে লেখকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে সঞ্চরণশীল মনোভাবের পরিচয় মেলে। পাঠ-এ স্থিত গল্প তিনি কোন আঙ্গিকে বুনন করবেন, প্রধানত এটিই তার ভাবনা হলেও তিনি কোনো অর্থেই আঙ্গিক সর্বস্ব শিল্পী নন। আঙ্গিক সর্বস্বতা বিষয়ের দৈন্য থেকে দেখা দেয়। সেলিম আল দীনের রচনায় আর যাই থাক, বিষয়ের দৈন্য আছে, এ কথা তাঁর কঠোর সমালোচকরাও বলতে পারবেন না। তিনি যে আঙ্গিক-নির্ভর লেখক নন, একথা উপরের উদ্ধৃতিতেই আছে, যেখানে তিনি প্রয়োজনে কাহিনীর শরীর থেকে সাম্প্রতিককালে ব্যবহৃত পরিভাষাসমূহ যথা দিশা, বোলাম, নাচাড়ি, শিকলি, পদ, কথা২০ প্রভৃতি যা পাঁচালির বুনন রীতিতে অপরিহার্য, ভবিষ্যতে তাও পরিত্যাক্ত হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করছেন।

বস্তুত গ্রহণ-বর্জনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সেলিম আল দীন আঙ্গিকের অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন। লেখক প্রথম জীবনে নানা আঙ্গিকে কাজ করেছেন, পরে কিছুটা স্থিত হয়েছিলেন বর্ণনাত্মক রীতি ও কথানাট্য নামক আঙ্গিকের কাছে, আরো পরে উল্লিখিত পাঁচালি রীতি অনুসৃত হয়েছে তাঁর কাজে। হয়তো এর পরের পর্বে তিনি হয়ে উঠবেন ‘আঙ্গিকজয়ী’ লেখক। সম্ভাব্য সব ধরনের আঙ্গিক নিয়ে কাজ করার ফলে হয়তো নব ধারার আঙ্গিকের জন্ম দেবেন, নতুবা আঙ্গিকের ধারণাই লুপ্ত হয়ে পড়বে তাঁর কাজ থেকে- কারণ তিনি পাঠ রচনার ক্ষেত্রে অদ্বৈতবাদী। তাঁর পক্ষেই বলা সম্ভব: ‘লেখক জীবনের প্রথম দিকে আঙ্গিকাতঙ্ক থাকে, পরে লেখক আঙ্গিকাবদ্ধ হন, আর কোনো এক প্রবল জীবনের আহবানে তিনি হয়ে উঠেন অদ্বৈতবাদী ও আঙ্গিকজয়ী লেখক।’২১

উত্থান-পর্বে রচিত বনপাংশুল ও প্রাচ্য- অনুমান করি- প্যাসটিশধর্মী (pastiche) কাজ। উল্লিখিত দু’টি নাটকই বাঙলা পাঁচলিরীতির অনুসরণে রচিত বলে আমার এমত ধারণা জন্মেছে। প্যাসটিশধর্মী কাজে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহীত শিল্প উপকরণ সন্নিবেশিত থাকে। সেলিম আল দীন প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাঁচালি নির্মাণ ও পরিবেশনার কৌশল থেকে শিল্প-উপকরণ সংগ্রহ করেছেন- আমি মনে করি এটি তাঁর জন্ম-অধিকার। নিজের ঐতিহ্যের মধ্যে নিজেকে প্রবিষ্ট না করতে পারলে কোনো লেখকেরই সাহিত্য-কর্ম করার অধিকার জন্মায় না। সেলিম আল দীন যতই বলুক যে, বনপাংশুল ও প্রাচ্য-তে ‘অদ্বৈত পরিভাষাসমূহ ব্যবহারের মধ্যে কোনো পিছুটান বা নিছক ঐতিহ্য প্রীতি কাজ করে নি’, প্রকৃতপ্রস্তাবে এই ঐতিহ্যপ্রীতিই তাঁর লেখক সত্তাকে ভিন্ন ভিন্ন অভিমুখ গ্রহণ করতে প্রাণিত করেছে। এই প্রীতি সব বড় মাপের শিল্পী-লেখকের মধ্যেই জন্মায়- তালিকা না বাড়িয়ে শুধু অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ঋত্বিক ঘটক, ক্রিস্টফ কিসলওস্কি (চলচ্চিত্রকর) ও ওলে সোয়িস্কার নাম উল্লেখ করবো- এঁরা সবাই স্ব-ঐতিহ্য থেকে শিল্প-উপকরণ সংগ্রহ করেই এঁদের কাজকে সমৃদ্ধ করেছেন।২২ শিকড়ের সন্ধান তাঁদের সবাইকে করতে হয়েছে শিল্প-কর্ম সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়ে। কিসলওস্কির মতে- ‘কোনো কিছুর শিকড়ে পৌঁছাবার যে প্রক্রিয়া তার প্রতি বরাবর আমার আকর্ষণ দুর্নিবার। সৃষ্টি-ধর্মী কাজের এই প্রক্রিয়াকে আমি এক কথায় বলব সেরিব্রাল।’২৩ সেলিম আল দীনের কাজেও এই সেরিব্রালবর্তীতা তথা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রণোদনা কাজ করেছে। তাঁর কাজ নিছক আবেগনির্ভর নয় বরং বুদ্ধিভিত্তিক ও ঐতিহ্যলগ্ন। ঐতিহ্যলগ্ন বলেই এই পর্বের দু’টি কাজেই প্রাচ্যের নিজস্ব গল্প বলার ঢং তথা লিনিয়ারবর্তীতা অনুসৃত।২৪

লিনিয়ারবর্তী তথা টানা গল্প বলার কাজে এর স্রষ্টাই গল্পের মূল কথক। বনপাংশুল ও প্রাচ্য দুটি কাজেই এর পাঠ রচয়িতা এর কথক। যেমন রামায়ণ, মহাভারত, পাঁচালি, পালা- সবখানেই এঁদের স্রষ্টারাই কথক। সেলিম আল দীন সেই ধারাবাহিকতায় নিজেকে  প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই পর্বে। আমার মতে, এখানেই তাঁর উত্থানের মূলধারা নিহিত। এই উত্থান-পর্বে তিনি তাঁর লেখক সত্তাকে হত্যা করেছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাঁচালি ধারার ন্যারেটিভসমূহের কথক সত্তাকে, নিজের মধ্যে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কথকরা যে ন্যারেটিভসমূহ বর্ণনা করতেন, এই বর্ণনা-প্রদান (performance) মূলত বাঙলা নাট্যরীতিরই একটি ধারা। এই ধারার কথকদের কাজের প্রশংসা করা হলেও এঁদের সাহিত্যিক প্রতিভা মূল্যায়িত হয় নি। কারণ, তখনও ‘লেখক’ (author) এর ধারণাটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। লেখক-এর ধারণাটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত প্রসার লাভ করে। লেখক-এর ধারণা নিতান্তই আধুনিক (?) যুগের সৃষ্টি। সেলিম আল দীন আধুনিক যুগের সৃষ্ট এই লেখক সত্তাকে হত্যা করে নিজের মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের কথকদেরই।


অন্তে বলা চলে, সেলিম আল দীন শিকড়ে পৌঁছবার যে ‘প্রক্রিয়া’- সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে প্রবিষ্ট করে রেখেছেন। মৌলিক অথবা স্বভূমিজ শিল্পরীতির আশ্রয়ে রচিত নাট্যধারা২৫ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার ভিতরে আছেন তিনি। তাঁর কাজের রূপ-রূপান্তর বিচার পূর্বক এ-কথা চলে যে, তিনি ১. উত্তর ঔপনিবেশিক শিল্পরীতিকে বর্জনযোগ্য বলে মনে করেন; ২. সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্বের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পক্ষপাতি; ৩. স্বদেশীয় প্রাক-পূঁজিবাদী শিকড়বিহীন শিল্পরুচিকে পরিত্যাজ্য মনে করেন এবং ৪. স্থানীয় শিল্পরীতির বিশিষ্টতা প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

সহস্র বছরের শিল্প-কর্মের যে স্থানীয় ধারাবাহিকতা, সেই ধারাবাহিকাতায় লেখক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তবে, লেখক এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ যাতে এ যাত্রা কোনো ‘পুনরাবর্তনের প্রয়াস হয়ে না ওঠে অথবা তা হয়ে না ওঠে নিছক পুনরুজ্জীবনের কৃত্রিম প্রয়াস ... যার নাম, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ।’২৬ লেখকের দার্শনিক অবস্থান বিচারপূর্বক বলা চলে যে, তিনি শিল্পরীতির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার যান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বা পরম্পরায় বিশ্বাসী নন। আজ যা গ্রহণীয়, কাল তা পরিত্যাজ্য হতে পারে।

তাই, সেলিম আল দীনের কাজের মূল্যায়ণ প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পবিচারের তত্ত্বসমূহ দিয়ে করতে যাওয়া বিপদজ্জনক। এতে করে তাঁর কাজের অবমূল্যায়ন হতে পারে। তাঁর কাজে যেহেতু বাঙালির নিজস্ব নাট্যবুদ্ধির প্রতিফলন ঘটেছে, তাই তাঁর কাজ বাঙালির নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তার ঘেরাটোপের মাধ্যমেই করা সঙ্গত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাঙালির নিজস্ব নন্দনতাত্তিক পরিকাঠামোর কোনো সূত্রবদ্ধ গ্রন্থ নেই। ধারণা করি, সেলিম আল দীন যে ধারায় কাজ করছেন এবং আরো যাঁরা করে গেছেন এবং এখন করছেন- তাঁদের কাজ সংশ্লেষণপূর্বক সেই অভাব মোচন হতে পারে অর্থাৎ বাঙালির নন্দনভাবনার শোলকসন্ধান সম্ভব হতে পারে। আলোচ্য লেখক স্বয়ং সেই কাজে তৎপর। তাঁর ‘বাঙলা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের পূর্বাপর’ শীর্ষক প্রবন্ধ তার প্রমাণ। প্রত্যেক সমাজই কোনো-না-কোনো প্রাধান্য-বিস্তারকারী শিল্পরীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে- সেলিম আল দীনের সমকালীন সমাজও তার ব্যতিক্রম নয়। তাঁর বৈশিষ্ট্য, তিনি এই প্রাধান্যবিস্তারকারী উন্মুল শিকড়হীন পাতিবুর্জোয়া শিল্পধারার কাছে নতি স্বীকার করেন নি, বরং এর বিপরীতে স্থানীয় ধারা নির্মাণে ব্রতী। এ যাবৎকাল ধরে আমরা যে ইউরোপীয় একক নন্দনভাবনার আওতায় ছিলাম, তিনি তার মধ্যে নিজেকে বিলীন করেন নি, তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা ও যৌথ অবচেতনার জগৎকে বিনির্মাণ করে চলেছেন তাঁর কাজে, তাঁর পাঠকৃতিতে। এবং এই সূত্রে তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে শুধু পুনর্নির্মাণই করছেন না, তাকে উন্নীতও করছেন। তাঁর কাজে যে স্ট্রাকচারাল এপিকের লক্ষণ দৃষ্ট হয়, তা তাঁকে আজ ভিন্ন বাচনে তুলে ধরতে বাধ্য করে। তার পঞ্চাশতম জন্মজয়ন্তীর নান্দীপাঠে তাই উচ্চারিত হয়-

বাংলা নাটকে শেকড়সন্ধানী অভিযাত্রিক নাট্যকার সেলিম আল দীন পা রেখেছেন পঞ্চাশে। তাঁকে অভিনন্দন। তাঁর ৫০তম জন্মজয়ন্তীতে এ কথা আজ মোটেও অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর হাতেই রবীন্দ্রোত্তর বাংলা নাটকের রূপ ও রীতি বাঙালি জাতির সহস্র বছরের নাট্যধারার সঙ্গে অভেদাত্মœক হয়ে উঠেছে। এই ভূখণ্ড ও মানুষের আত্মার ক্রন্দনধ্বনিটি তাই বড় অন্তরঙ্গ হয়ে বাজে সেলিম আল দীনের শিল্পবীণার তারে। তাঁর নাটকে এই ভূখণ্ডে বসবাসরত জাতি ও নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অন্তগর্ত রূপটি ও আঙ্গিকের দ্বৈতনিখিলে তিনি সবসময়েই দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পস্রষ্টা। সেলিম আল দীনের নাটকের একটির সঙ্গে অন্যটির তাই স্বানুকৃতির মৃতচ্ছায়ার চিহ্ন লেগে নেই। নিজের তৈরি বৃত্ত থেকে স্বচ্ছন্দে ঘটে তাঁর অন্য আর এক নতুন শিল্পরীতির বৃত্তমুখে অভিগমন। ফলে তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে বাংলা নাটকের নব আঙ্গিক রচনার প্রত্যয়ী এবং ধ্যানমগ্ন অভিযাত্রা। বিশ্বনাট্যের ধারায় একালের শিল্পরুচির মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা নাটকের একটি স্বতন্ত্র রূপ প্রতিষ্ঠার সাধনায় ব্রতী নাট্যকার সেলিম আল দীন। বিশ্ববীণার তারে যত ক্ষুদ্রই হোক না তিনি এই একটি নিক্কন তুলেছেন।২৭

উপর্যুক্ত নান্দীপাঠে আমরা এক ভিন্ন আঙ্গিকে বৃত সেলিম আল দীনকে পাই। এ-সত্যও উচ্চারিত হয় যে, তিনি ‘নতুন শিল্পরীতির বৃত্তমুখে অভিগমন’-এর জন্যে নিজের সৃষ্ট রচনাকেই গিলে খেয়ে ফেলেন, জন্ম দেন নিজেরই উদর থেকে শিল্পভুক পাঠ- যে পাঠ-এ ‘স্বানুকৃতির মৃতচ্ছায়ার চিহ্ন লেগে নেই।’ এই যে নিজেকেই নিজে সৃষ্টি করে ভেঙে ফেলা, নিজের সৃষ্ট পাঠ-কে গিলে ফেলা- এই আত্মপ্রত্যাখ্যানের উৎস কোথায়? ‘নিজেরই তৈরি বিশ্বাস ও অভ্যাসকে বার বার পেরিয়ে যাওয়ার গতি ও প্রেরণা নিজের ভেতর জাগ্রত রাখা’২৮-র যে ইতিহাস আমরা তাঁর পাঠ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম- তার পিছনেই-বা লেখকের কী প্রকার শিল্প ও জীবনদর্শন ক্রিয়াশীল? উত্তরে বলবো, পাঠ নির্মিতির ক্ষেত্রে ঐতিহ্যলগ্ন হওয়া এবং তাকে নিজস্ব ভুবনদৃষ্টির মাধ্যমে উন্নীত করার আকাক্সক্ষা যেমন সেলিম আল দীনের মধ্যে ক্রিয়াশীল, তেমনি লোকসমাজের মধ্যে যে মানবিক, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক উপাদানসমূহ আছে, তাদের নিজ রচনায় ধৃত করার চেষ্টাও ক্রিয়াশীল তাঁর শিল্প ও জীবন-ভাবনায়।

এই ক্রিয়াশীলতার মধ্য থেকেই তাঁর রচনায় স্থান করে নিয়েছে বাঙলার লোকায়ত দর্শনের মানবিক দিকসমূহ। এই মানবিক দিকের সন্ধান মেলে বনপাংশুল ও প্রাচ্য- উভয় রচনায়। অতীতের কথকবৃন্দ যেভাবে তাঁদের ন্যারেটিভসমূহে কাহিনীর পাশাপাশি লোকায়ত দর্শনের চর্চা করতেন, সেলিম আল দীনও এর বাইরে যেতে পারেন নি। তাই বনপাংশল এ দেখি লেখক মানবিকতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ভ্রুণ হত্যার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যান- ‘সুকির গর্ভে ধর্ষণের ভ্রুণ পাপ পূণ্যের ধার ধারে না মোটেই। মানবিক নিয়মে সে বেড়ে ওঠে। সুকির গর্ভেই কালো মেঘের কাজল পরে নেয় আরেক বনপাংশুল- সে আসবে।’২৯ এই উদার মানবিক পটভূমিতে শেষ হয় বনপাংশুল। প্রাচ্য-তেও লেখক কাহিনীর ছলে প্রাচ্য দেশীয় এক মধুর-মনোরম-মানবীয় দর্শনকে তুলে ধরেন। আর তা হচ্ছে ক্ষমার দর্শন। এই নাটকের নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ-এর মতে ‘সেলিম আল দীনের নাটক প্রাচ্য-র দর্শন হলো প্রাচ্য জনপদের হাজার বছরের জীবন দর্শনের একটি প্রতিফলন। ক্ষমার শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতেই হয়তো সেলিম এরকম একটি মর্মান্তিক গল্পের আশ্রয় নিয়েছে।’৩০

প্রাচ্য নাটকে সয়ফর যে তার নবপরিণীতা বধূকে ডঙ্কাকারী সাপটিকে ক্ষমা করে- তার  একটি সামাজিক কারণ বিদ্যমান। ধারণা করি আমাদের বৃহত্তর লোকসমাজে বৌদ্ধদর্শনজাত ‘সর্বপ্রাণবাদ’-এর যে প্রভাব আছে, সেই প্রভাবের বলেই সয়ফর সাপটিকে ক্ষমা করে। এই নাটকের সয়ফর স্বয়ং সেলিম আল দীন, কারণ তিনিই এ-আখ্যানের কথক। তাঁর জীবনদর্শনই প্রতিফলিত প্রাচ্য নাটকে। সম্ভবত ‘বৌদ্ধজাতক’-এর প্রভাব পড়ে থাকবে লেখকের মননে। ‘বৌদ্ধজাতক’-এর গল্পের প্রভাব এড়ানো সম্ভব হয় নি রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও- সেলিম আল দীনের কাজেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। বৌদ্ধদর্শনে উদার মানবিকতা ও সর্বপ্রাণবাদী ধারণা তথা জীবকে বধ না করার ধারণা বিদ্যমান।

বাঙালি মানসের মধ্যে স্তরীভূত সেই ধারণারই প্রকাশ ঘটেছে প্রাচ্য নাটকে। পাশ্চাত্য ক্ষমা করতে জানে না- ক্রিশ্চিয়ান ও মুসলিম ইডিয়লজিতে ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ নয়। অথবা জীব হত্যাও মহাপাপ নয়। ওখানে দাঁতের বললে দাঁত- প্রাণের বদলে প্রাণ। তাই আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে রচিত Old Man And the Sea-তে দেখি তিমির কঙ্কালটাকে তীরে তুলে আনা হয়। অন্যদিকে সাপটিকে হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও সয়ফর ক্ষমা করে। আসলে কথকভেদে একই ধাঁচের কাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন দর্শনের প্রলেপ পড়ে।

আলোচ্য কথক সেলিম আল দীন সব দিক থেকেই ভিন্ন। এহেন ভিন্ন কথকের জন্য শেষ বলে কিছু নেই- যে প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন, সেই প্রক্রিয়াই সব। তিনি সামগ্রিকভাবে একজন কথক হিসেবে যা- তাই তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক বা বিষয়- তিনি নিজেই একটি মহৎ পাঠ। এই ধরনের সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার অধিকারী কথক নিজের রচনার চাইতেও বড়। নিজের মতন করে বেড়ে ওঠা ও আত্মপ্রকাশের তাগিদই কৃত্যবাদী লেখক সেলিম আল দীন-কে নব নব শিল্পরীতির অন্বেষণে অস্থির করে রেখেছে।

তথ্য নির্দেশিকা ও টীকা
১.    মঞ্চস্থ হবার সময় নাটকটির নাম ছিল মুনতাসীর ফ্যান্টাসী। পরে লেখক ফ্যান্টাসী শব্দটি বাদ দিয়েছেন। যতদূর মনে পড়ে চরকাঁকড়ার ডক্যুমন্টোরী নাটকের নাম থেকে ডক্যুমেন্টরী শব্দটিও বাদ দেবার কথা ভেবেছিলেন। এ-তথ্য এ জন্যে গুরুত্বপূর্ণ যে, লেখক যে ক্রমাগত নিজের ঐতিহ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন তা এই পুনঃনামকরণের মধ্য থেকেই বোঝা যায়। উল্লেখ্য যে, মুনতাসীর ফ্্যান্টাসী নাটকে আমি প্রপ্স মাস্টার হিসেবে টানা দুই-আড়াই বছর মঞ্চের পিছনে কাজ করেছি। এই পর্বে তিনি জুলান ও শালনা নামে একটি নাটক লিখেছেন। জুলান মেসোপোটিমিয়ার একটি স্থানের নাম আর শালনা বাংলাদেশের- দুই পর্বে বিন্যস্ত নাটকটিতে লেখক দুই জায়গায় মানুষের মধ্যে দূরত্ব ও কালের ব্যবধান সত্বেও মানবিক গুণাবলীর মধ্যকার ঐক্য অন্বেষণ করেছিলেন। পুরানা পল্টনের মহিলা কলেজে ১৯৭৪ (?) এর দিকে মহড়া হতো। আমি সেই নাটক হাতে কপি করেছিলাম- তখন ফটোকপি করার প্রচলন ছিল না । মনে পড়ে নাটকের মহড়া ছয়টায় শুরু হবার কথা থাকলেও আমি চারটার মধ্যেই দশ-বারোটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে কলেজের ক্লাশরুমে বসে বসে পাঠ্য বই পড়তাম। নটরডেম কলেজের ছাত্র ছিলাম বলে প্রতি সপ্তাহেই কুইজ পরীক্ষা দিতে হতো। তাই কলেজ থেকে বাসায় ফিরে, খেয়ে দেয়ে আবার এই মহিলা কলেজের ক্লাশরুমেই কুইজের পড়া তৈরি করতাম। পড়তে পড়তে প্রায়দিনই পাণ্ডুলিপি মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। কারো খোঁচায় হয়তো ঘুম ভাঙতো। নাটকটি কেন মঞ্চস্থ হয় নি, সে-কথা আজ আর মনে নেই।
২.    এই পর্বে স্থান পাবে হরগজ নামক কথানাট্য। হরগজ রচিত হয় ১৯৯২ সালে। বাসন, আততায়ী, সয়ফলমুল্লুক বদিউজ্জমান এই পর্বে রচিত নাটক।
৩.    প্রস্তুতি পর্বেরও পূর্বে লেখক ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা করেন। বিপরীত তমসায়, ঘুম নেই, রক্তের আঙ্গুরলতা, নীল নীল যন্ত্রণা এই সময়ে রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক।
৪.    ১৯৭৩ সালেরর শেষের দিকে ‘ঢাকা থিয়েটার’-এ একজন মঞ্চকর্মী হিসেবে যোগদান করি। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার পর রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি। থাকি ৩৫/বি নয়া পল্টনে। একদিন পুরানা পল্টনের গলিতে হাঁটছি- ‘একতা বিতান’ নামে যে ক্লাবটি ছিল- ওখানে দেখলাম নাটকের মহড়া চলছে- দুই টাকার বাদাম কিনে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে নাটক করার ইচ্ছা জানাতেই তিনি কাজে লেগে যেতে বললেন।  সেই থেকে ঐ দলের কর্মী।
৫.    বাস্তবধর্মী নাটক রচনার ধারাটিই চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই বাংলায় প্রবল ছিলো। সিকান্দার আবু জাফর, ওবায়দুল হক, আলী মনসুর, আনিস চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, রজিয়া খান, কল্যাণ মিত্র, আসকার ইবনে শাইখ, নুরুল মোমেন, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, সাঈদ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ- এঁরা সবাই উল্লিখিত দশকের প্রতিষ্ঠিত নাটককার। এঁদের কারো কারো রচনা বাস্তবধর্মীতা অতিক্রম করে অন্য মাত্রাও অর্জন করে। উদাহরণ হিসেবে নূরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সাঈদ আহমদ ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-এর কথা বলা যায়। নূরুল মোমেনের নেমিসিস (১৯৪৮) মন্বন্তর নিয়ে লেখা। চল্লিশ দশকের শুরুতে বাংলায় যে মন্বন্তর দেখা দেয় তা নাটকের পটভূমি। নাটকে একক চরিত্রের অবস্থান, কাহিনীর প্রচণ্ড গতি ও ঘটনার বহুমাত্রিক সংস্থান নাটকটিকে বাস্তবধর্মী নাটক থেকে পৃথক করে। শওকত ওসমান তাঁর নাটকে তৎকালীন প্রাক-পূঁজিবাদী সমাজ বাস্তবধর্মীতার  দুষ্টক্ষতগুলোকে প্রহসনাকারে উপস্থিত করে। তবে বাস্তবধর্মীতা পুরোপুরি পরিহার করে নাটক রচনার উদাহরণ আমরা পাই মুনীর চৌধুরীর কবর (১৯৫৩) নাটকে। এটি একটি একাংক নাটক। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) এই নাটকের পটভূমি। বাস্তবধর্মীতা ত্যাগ করে নাটককার এক্সপ্রেশনিস্টিক টেকনিক ব্যবহার করেছেন এই নাটকের রচনা শৈলীতে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহিপীর, উজানে মৃত্যু এবং সাঈদ আহমদের কালবেলা নাটকে বাস্তবধর্মীতা পরিত্যাগ করা হয়- তিনটি নাটকই নীরিক্ষাধর্মী (এ্যাবসার্ড) নাটকের পর্যায়ে পড়ে। সত্তর দশকে এসে বাংলাদেশে নাটক রচনার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে। গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট পুরোপুরি দানা বাঁধে এবং এই সূত্রে বিভিন্ন নাট্যদল যেমন ‘পারাপার’ (১৯৭০), ‘আরণ্যক নাট্যদল’ (১৯৭১), ‘থিয়েটার’ (১৯৭২), ‘ঢাকা থিয়েটার’ (১৯৭৩) প্রভৃতি নাট্যদল সংগঠিত হয়। ‘নাগরিক নাট্যদল’ অবশ্য ১৯৬৫ সালেই প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রুপ থিয়েটারগুলোর প্রয়োজনেই নতুন ধারার নাটক রচনার তাগিদ অনুভূত হয়। বাস্তবধর্মী নাটক বর্জিত হয়- শুরু হয় পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর্ব। সেলিম আল দীনের জন্যে যে পর্ব ‘প্রস্তুতি পর্ব’ বলে চিহ্নিত করা চলে।
৬.    ‘ঢাকা থিয়েটার’ তাদের ঘোষণা পত্রে শুরু থেকেই এ কথা বলে আসছে যে: বাংলাদেশ একটি সংগ্রামক্ষুব্ধ অকুতোভয় জনপদের নাম। যুদ্ধ, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে এই জনপদ সমুন্নত জীবনের আকাক্সক্ষাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে তার সামুদ্রিক দুই চোখে। এই দেশ, তার ইতিহাস, সংগ্রাম, সংস্কৃতি তার সব কিছুকে আমরা সম্মান করি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, ধরলার কূলে কূলে নামহীন-গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবন আমাদের নাটকের বিষয়বস্তু।
৭.    নাসির উদ্দীন ইউসুফের জন্ম ১৯৫০ সালে। অসাধারণ তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি। উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী এমত নির্দেশক এই বাংলায় নেই বললেই চলে। তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়ার প্রায় সূচনা-লগ্ন থেকেই তাঁর কাজ দেখার ভাগ্য হয়েছে। সেই সূত্রে লক্ষ্য করেছি যে, কী অপার সৃষ্টিশীলতার তৃষ্ণা নিয়ে তিনি একেকটি নাটকের মঞ্চরূপ দিতে সচেষ্ট হন। মৎ প্রণীত একমাত্র নাটক ফণীমনসা-রও তিনি নির্দেশক ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ড্রামা সার্কেল’-এর পুরোধা ব্যক্তিত্ব বজলুল করিম-এর সংস্পর্শে থাকায় তাঁর মধ্যে নব্যকালের থিয়েটার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা জন্মেছিলো, যে ধারণা তিনি সঞ্চারিত করে থাকবেন তাঁর কাজে, তাঁর সৃষ্টিশীলতায়।
৮.    বিস্তারিত তথ্যের জন্যে এবং লেখকের দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পী সত্তার স্বরূপ জানার জন্যে দেখুন ‘বাঙলা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বের পূর্বাপর’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। এটি ছাপা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘থিয়েটার স্টাডিত’ জুন ১৯৯৫-এর তৃতীয় সংখ্যায়।
৯.    সৈয়দ শামসুল হক, ‘গ্রন্থমুখ’, চাকা, গ্রন্থিক, ১৯৯২, ঢাকা, পৃ. ৬৮
১০.    সেলিম আল দীন, পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৯, পৃ. ৯
১১.    সেলিম আল দীন, ‘কথাপুচ্ছ’, যৈবতী কন্যার মন, গ্রন্থিক, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ১৪১-৪২
১২.    পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪২
১৩.    আফসার আহমদ, ‘মঞ্চের ট্রিলোজী’, মঞ্চের ট্রিলোজী ও অন্যান্য প্রবন্ধ, গ্রন্থিক, ১৯৯২, ঢাকা, পৃ. ৭৫
১৪.    পূর্বেক্ত, পৃ. ৮৮
১৫.    শান্তনু কায়সার, ‘জল ও মৃত্তিকার আখ্যান’, ফণীমনসা, পাঠক সমাবেশ, ২০০১, পৃ. ৯
১৬.    সেলিম আল দীন, ‘বাঙলা নাট্য নির্দেশনা শিল্পরীতি: নাসির উদ্দীন ইউসুফ’, থিয়েটার স্টাডিজ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জা.বি. সংখ্যা-৭, জুন ২০০০, পৃ. ১৫
১৭.    সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃ. ৭৭
১৮.    ঢাকা থিয়েটার কর্তৃক প্রকাশিত বনপাংশুল নাটকের প্রচার পুস্তিকা।
১৯.    সেলিম আল দীন, ‘সমকালে পাঁচালির আঙ্গিক ভাবনা : প্রসঙ্গ ‘বনপাংশুল’, ১২-১২-২০০০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধ, পৃ. ৩-৪
২০.    বনপাংশুল-এ ব্যবহৃত পাঁচালির পরিভাষাসমূহ:
        ১. পদ- আধুনিক কবিতার আঙ্গিকে রচিত রাগ শূন্য অথবা সরাগ। মধ্যযুগে পদ পয়ার ছন্দে রচিত হতো।
        ২. বোলাম- পাত্র-পাত্রীর সংলাপ।
        ৩. কথা- গদ্যে বর্ণনা-ব্যাখ্যা। চরিত্রের সংলাপ। রাগ ভিত্তিক।
        ৪. দিশা- লৌকিক গানের সাধারণ ধূয়া।
        ৫. নাচাড়ি- আধুনিক কবিতার আঙ্গিকে রচিত। রাগভিত্তিক নৃত্য ও অভিনয় সহযোগে পরিবেশনীয়।
        ৬. নাটগীত- নাট্যমধ্যে পরিবেশিত কোন নাট্যাংশ যা চরিত্ররূপে পরিবেশনকারী গায়েন কর্র্তৃক উপস্থাপিত।
        ৭. অন্তিম ভটিমা- শেষ প্রশান্তি বচন বা উপসংহার।
        (সূত্র: শৈলী (ঈদ সংখ্যা, ১৯৯৮)- তে প্রকাশিত বনপাংশুল-এর অন্তে লেখক কর্র্তৃক দেয়া পরিভাষাসমূহের ব্যাখ্যা।)
২১    সেলিম আল দীন, পুর্বোক্ত, পদটীকা নং ৯, পৃ ৩৭
২২.    ঋত্বিক ঘটক যে ৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তার সব ক’টিতে আমাদের ঐতিহ্যের নানা সাংস্কৃতিক উপাদান দ্যোতিত। Cinema and  ও গ্রন্থে ও ‘মানব সমাজ, আমাদের ঐতিহ্য, ছবি-করা  ও আমাদের প্রচেষ্টা’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি তাঁর ঐতিহ্য সংলগ্নতার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর প্রায় সব লেখাতেই স্থানীয় সংস্কৃতির নানা শিল্প-উপকরণ ব্যবহারের পটভূমি বিধৃত আছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণও তাঁর অমর উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম রচনার পূর্বে তিতাসের পাড়ে ঘুরে ঘুরে স্থানীয় গান সংগ্রহ করেছেন। পরবর্তী সময়ে এই সব গান তিনি উপন্যাসে ব্যবহারও করেছেন। ২০-২২ বছরের অদ্বৈত কী গভীর নিষ্ঠার সাথে স্থানীয় সংস্কৃতির গভীরে পৌঁছবার চেষ্টা করেছেন তা তাঁর ‘বারমাসী গান ও অন্যান্য’ গ্রন্থে পরিদৃষ্ট। অদ্বৈতের কাজও সেরিব্রালধর্মী। সোয়িঙ্কাও এই ঘরানার লেখক। তাঁর Myth, Literature and the African World-ও স্ব-জাতির শিল্প-ভাবনার শিকড় সন্ধানের খতিয়ান। গবেষণাধর্মী এই গ্রন্থের প্রভাব সোয়িঙ্কার কাজে বিদ্যমান। সেলিম আল দীনের গবেষণা-কর্ম ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’-ও তাঁর কাজকে প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে।
২৩.    স্বপনকুমার ঘোষ, ‘ক্রিস্তফ কিসলওস্কির সঙ্গে কথোপকথন: ওয়ারশ-র দিনরাত্রি’, সানন্দা,২৮ এপ্রিল, ১৯৯৫, কলকাতা পৃ. ১১২। কিসলওস্কি পোল্যান্ডের চলচ্চিত্রকর। থ্রি কালারস রেড, থ্রি কালারস ব্লু ও থ্রি কালারস হোয়াইট তাঁর বিখ্যাত ট্রিলোজি।
২৪.    লিনিয়ারবর্তী গল্প-কথনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে রামায়ণ ও মহাভারত- এপিকধর্মী এই দুটি কাজেই লিনিয়ার বা এক রৈখিক গল্প বলার প্রবণতার পাশাপাশি সমান্তরাল রেখায় অন্য গল্প প্রবাহেরও নজির উপস্থিত। দুই রেখার গল্প যে কোথাও গিয়ে এক বিন্দুতে মিলেছে এমনও নয়। সেলিম আল দীনের
কেরামতমঙ্গল-এ এই এপিকধর্মীতার চিহ্ন স্পষ্ট।
২৫.    বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সেলিম আল দীন রচিত প্রবন্ধ ‘বিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক : রূপরূপান্তর’, ভোরের কাগজ (সাময়িকী) ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯, পৃ. ১৫। এই প্রবন্ধে লেখক বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের তিনটি ধারা লক্ষ্য করেছেন: ১. মৌলিক অথবা স্বভূমিজ শিল্পরীতির আশ্রয়ে রচিত নাট্যধারা. ২ অনুবাদ, ভাবানুবাদ ও রূপান্তরের ধারা এবং ৩.  মিশ্রধারা।
২৬.     সেলিম আল দীন পূর্বোক্ত পাদটীকা নং ৯, পৃ. ২
২৭.     সেলিম আল দীনের পঞ্চাশতম জন্মজয়ন্তীতে ঢাকা থিয়েটার কর্র্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা।
২৮.    তপোধীর ভট্টাচার্য, ‘রোলা বার্ত, পাঠকৃতি ও পাঠক’, অমৃতলোক সাহিত্য পরিষদ, ১৯৯৮, কলিকাতা.
পৃ. ৮৬
২৯.      সেলিম আল দীন, বনংপাংশুল, শৈলী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ২৭৭
৩০.    নাসির উদ্দীন ইউসুফ, নির্দেশকের কথা, প্রাচ্য নাটকের প্রথম প্রদর্শনীতে ঢাকা থিয়েটার কর্র্তৃক প্রকাশিত প্রচার পুস্তিকা।

সাজেদুল আউয়াল : নাট্যকার, সদস্য- ঢাকা থিয়েটার