Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : এবার কি নটেগাছটি মুড়োল?

Written by অংশুমান ভৌমিক.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[থিয়েটারওয়ালা’র ২০ বছর পূর্তিতে সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার আমার কাছে একটা লেখা চাইলেন। বিষয় ধরিয়ে দিলেন ‘গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার’। আমার মনে হলো, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গে যত নাটক হয়েছে, সেসব নিয়ে খণ্ডিত-মাঝারি-বিস্তারিত অনেকে অনেক কিছু লিখবেন। আমি আর সে-পথ মাড়ালাম না। বরং বেছে নিলাম ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ ভারতের মুম্বই শহরে হয়ে যাওয়া ৮ম থিয়েটার ওলিম্পিকসের একটা সেমিনারের অভিজ্ঞতাকে। এই অভিজ্ঞতার সাথে পাঠককে সঙ্গী করতে পারলেই তারা বুঝে যাবেন, গত দুই দশকে কেবল আমাদের না, বিশ্বের তাবৎ থিয়েটারেরই কেমন রূপবদল হয়েছে এবং ক্রমাগত হয়ে চলেছে।- লেখক।]

‘হু শ্রিংকস মাই থিয়েটার?’ এর বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘অ্যাই, কে রে? কে মুড়িয়ে দিচ্ছিস আমার নটেগাছ?’ এরকম একটা উদ্বেগজনক ব্যাপার নিয়ে মগজধোলাই করার জন্য, আর চাট্টি কথা বলার জন্য ডাক পড়েছিল মুম্বইতে। থিয়েটার ওলিম্পিকসের ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারে।

খবরের খাতিরে লিখে রাখা ভালো যে, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’র (এনএসডি) আয়োজনে অষ্টম থিয়েটার ওলিম্পিকসের রাজসূয় যজ্ঞ লাগাতার দু’মাস (১৭ ফেব্রুয়ারি-৮ এপ্রিল ২০১৮) ধরে ভারতের ১৭টি রাজ্য জুড়ে চলেছিল। তার পালা সাঙ্গ হয় আরব দরিয়ার তীরে মুম্বইতে। মুম্বইতে রোজ দু’টো করে নাটক হচ্ছিল। দু’জায়গায়। প্রভাদেবী এলাকায় ‘রবীন্দ্র নাট্য মন্দির’ নামে যে খানদানি সংস্কৃতিকেন্দ্র আছে সেখানে বিকেল ৪টে থেকে শুরু। সেখানকার পালা ফুরোতেই আর একটু দূরে, ওরলি মহল্লায় নেহেরু সেন্টারে সন্ধে সাড়ে ৭টায় থার্ড বেল বেজে উঠছিল। মুম্বই এমনিতে কসমোপলিট্যান। বহুভাষিক বহু সাংস্কৃতিক মহানগর। বাছাই করে আনা মরাঠি, হিন্দি আর গুজরাতি নাটক দেখতে উপচে পরা ভীড় হবে এ তো জানা কথা। তা বলে বাংলা বা ফরাসি নাটকেও লোক ভালো হচ্ছিল। কলকাতা থেকে সোহাগ সেন গেছিলেন ইংরিজি নাটক ‘সোনাটা নিয়ে। হাউসফুল! সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় গেলেন নাটক ‘ঘটক বিদায়’ নিয়ে। হাউসফুল! তাছাড়া শুধুতো নাটক নয়। নাটক ফুরোলে সেখানেই সেন্টারস্টেজে চেয়ার টেবল সাজিয়ে মিট দ্য ডিরেক্টরের পালা ছিল। কমবেশি ঘন্টা খানেকের মামলা এমনিতে সব শোতে উপুড় চুপুড় ভিড়। শো-র পরেও শ দু’য়েক দর্শক থেকে যাচ্ছিলেন নির্দেশকের কথা শোনার জন্য। দু’টি সংশয়ের নিরসনের জন্য।

এসব দেখে তো আয়োজকদের আহ্লাদে আটখানা হবার কথা। তা সত্ত্বেও উৎসব কর্তৃপক্ষ যে ২৭-২৮ মার্চের আন্তর্জাতিক স্তরের আলোচনার জন্য এমন উদ্বেগজনক ব্যাপারকে সামনে এনে ফেললেন তার মূল সঙ্গত কিছু কারণ ছিল।

একটা কারণ তো কলকাতা থেকে উড়ান ধরে মুম্বই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পর থেকেই টের পাচ্ছিলাম। এত বড়মাপের একটা নাটকীয় ঘটনা যে মুম্বইয়ের মাটিতে হচ্ছে সেটা চট করে বুঝবার উপায় নেই। ঢাউস ঢাউস সব হোর্ডিং ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানীর আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। যেন বিকিকিনির হাট বসেছে ত্রিভুবন জুড়ে। কোথাও থিয়েটার ওলিম্পিকসের নাম-গন্ধ নেই। পারেল মহল্লায় আইসিটি গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল নামে এক রইস হোটেলে আমাদের তোলা হয়। রিসেপশন থেকে খবরের কাগজ চেয়ে নিলাম। ২৬ মার্চের ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’। ৩০ পাতার ব্রডশিটের ভাঁজে ৩৪ পাতার একটা ট্যাবলয়েড যার নাম ‘মুম্বই মিরার’। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ঐ ৬৪ পাতার মধ্যে থিয়েটার ওলিম্পিকস তো নয়ই, থিয়েটার বলে কোনো চিজ যে সারা জমানায় আছে তাই ঠাহর হলো না। অথচ যে মরাঠি যুবক আমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে এসেছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে, সব শো হাউজফুল যাচ্ছে। কাতারে কাতারে নাট্যমোদী প্রবেশপত্রের জন্য হাপিত্যেশ করছেন। তার মানে প্রচারের একেবারে হদ্দমুদ্দ না হলেও খবরটা ছড়িয়েছে। হাজার হাজার লোক রোজ যেখানে যাচ্ছেন, দেশবিদেশের বাছাই করা সব নাটক যেখানে দেখানো হচ্ছে, নামীদামী নটনটীরা এসে মঞ্চে দাপাচ্ছেন, সেখানকার কোনো খবর কাগজে বেরুবে না! সিনেমার জন্য পাতার পর পাতা। থিয়েটারের ভাগে খোলামকুচিও নেই। মন খারাপ হলো। অবিশ্যি অতটা খারাপ না হলেও চলতো। কারণ, মাসখানেক আগে কলকাতাতেও পালা পড়েছিল থিয়েটার ওলিম্পিকসের। মিডিয়া কভারেজ তো হয়ই নি। উপরন্তু নগন্য সংখ্যক দর্শকের সামনে মঞ্চস্থ হয়েছে বেশিরভাগ নাটক। মুম্বই কলকাতার কথা হলো। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার খাস তালুক দিল্লিতেও নাটকের টানে উজিয়ে আসা জনসমাগম মোটেই আশানুরূপ হয় নি। কলকাতা বা ঢাকার দল যারাই কামানি অডিটোরিয়াম, শ্রীরাম সেন্টার, এলটিজি অডিটোরিয়াম বা অভিমঞ্চে নাটক করে গেছেন, সবাই শূন্য দর্শকাসনের পানে চেয়ে হাহাকার করেছেন। স্যোসাল মিডিয়ার দৌলতে সেসব রাষ্ট্র হতে দেরি হয় নি। এতে করে আয়োজকদের মাথা কাটা যাওয়ার দাখিল হচ্ছিল।

কাজেই কিসের জন্য থিয়েটারের বাড়াভাতে ছাই পড়ে যাচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি ছিল বৈকি!

বক্তাদের আটআনা ভারতের নানান এলাকা থেকে এলেন। বাকিরা এলেন ইতালি, জার্মানি, রাশিয়া থেকে। ২৭ মার্চ বিশ্বনাট্য দিবসের সকাল থেকে ভাবুকদের জমায়েত হলো রবীন্দ্র নাট্যমন্দিরের চারতলায় মিনি অডিটোরিয়ামে। কতক অ্যারেনা স্টেজের মাপের এই মিনি প্রেক্ষাগৃহ পি এল দেশপান্ডের নামে উৎসর্গীকৃত। প্রয়াত এই নাট্যবিদের কলকাতা শান্তিনিকেতনে হামেশাই যাতায়াত ছিল। দেখে স্বস্তি বোধ হলো। কমলাকর সোনতাক্কে এখন মরাঠি নাট্যবিদদের প্রমুখ। আরও অনেক গুণীজনের মধ্যমণি হয়ে তাঁকে প্রথম সারিতে বসে থাকতে দেখে আশ্বস্ত হওয়া গেলো। নাটককার শাফাত খান আমাদের চেনাজানা। তাঁকেও দেখলাম মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।

কলকাতার নাট্যকার শান্তনু বসু এখন এনএসডি’র ডিন অফ অ্যাকাডেমিক অ্যাফেয়ার্স। তাঁর পৌরোহিত্যে শুরু হয়ে গেলো আলোচনাসভার কাজ। এনএসডি’র বর্তমান অধ্যক্ষ বামন কেন্দ্রে ক’দিন ধরে মুম্বইকে ঘাঁটি করে আছেন। এ মহানগরের সংস্কৃতিজগৎ তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। উদ্বোধনী ভাষণ তিনিই দিলেন।

নিজেদের, মানে নাটুয়াদের দিকে আঙ্গুল তুলে আলোচনা শুরু করলেন বামন। তাঁর চাঁদমারিতে এলেন সেইসব নাট্যকার যারা নিজেদের ভেতরের তাগিদে নাটক করেন বলে বুক বাজান। কে কী বললো, লোকে দেখলো কী দেখলো না, তার পরোয়া করেন না। বামনের সাফ কথা হলো নাটক আদতে বিনোদনের মাধ্যম। ঘরে বসে কবিতা লেখা বা ছবি আঁকার সঙ্গে তার ঢের তফাৎ আছে। যিনি নাটক করছেন আর যারা নাটক দেখতে আসছেন, তারা একে অপরকে খাতির না করলে রস জমবে কীকরে? লেনদেন চাই। আদানপ্রদান চাই। নাট্যকার যত ইচ্ছে মৌলিক হোন। যত ইচ্ছে পরীক্ষানিরীক্ষা করুন। ফর্ম নিয়ে কনটেন্ট নিয়ে যত ইচ্ছে ভাঙচুর করুন। সবকিছুই সকলের ভালো লাগবে এমন কোনো দিব্যি কেউ দিচ্ছে না। তা বলে আমি যেটা ভালো বুঝি সেটাই নাটক, নইলে নয়, এমন জেদ ধরলে খুব মুশকিল। নাট্যকার যেন নাট্যরসিকের নাড়ি ছুঁতে পারেন, তাঁর মনে দাগ কাটতে পারেন। নইলে নাটক মাটি। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় বামন যখন মুম্বইতে পা রেখেছিলেন তখন পরীক্ষামূলক নাট্যচর্চার ঘাঁটি ছিল দাদার মহল্লার ‘ছবিলদাস হল’। বামুনের মনে আছে ‘ছবিলদাসে’র ১৫০-২০০ দর্শকাসন ভরে গেলে ওখানকার নাটুয়াদের কপালে ভাঁজ পড়তো। বেশি লোক হচ্ছে মানে নাটক ভালো হচ্ছে না- এটাই ছিল মোদ্দাকথা। আবার কোনো নাটক দেখতে মোটে দু’টো লোক এলে তাদের ফূর্তি বাগ মানতো না। এনএসডি থেকে বেরিয়ে ফোক থিয়েটার আর রিচুয়ালিস্টিক থিয়েটার নিয়ে গবেষণা করছিলেন বামন। সেখানে হাজার লোক লাখো লোক চোখ বড় বড় করে নাটক দেখছেন। অথচ ছবিলদাসে লোক না এলেই যেন বর্তে যান কর্তারা! গোলমালটা কোথায়? বামুনের মাথায় ঢুকতো না। পরে বুঝেছিলেন যে, ছবিলদাসের নাটুয়া চাইছেন দর্শক আরো তৈরি হয়ে আসুন। একবারে মাথায় না ঢুকলে আচ্ছা সে লেখাপড়া করে ফের আসুন। ব্যাপার-স্যাপার দেখে বামুনের মনে হয়েছিল, ‘থিয়েটার তো ল্যাবরেটরি নয়। একতরফা চলা ইন্টেলেকচুয়াল ডিস্কোর্সও নয়। কাজেই ওই গোঁড়ামির মধ্যেই গলদ আছে।’ অচিরেই ছবিলদাস হল উঠে গেল। যারা ওখানে আনাগোনা করতেন তারা দাদার মহল্লার রমরমিয়ে চলা থিয়েটার শিবাজী মন্দিরে নাড়া বাঁধলেন বা বাণিজ্যবান্ধব মরাঠি-গুজরাতি-হিন্দি নাটকের লাইনে দাঁড়াতে শুরু করলেন।

তাহলে নটেগাছটি কে মুড়োল? বামনের কথায় স্পষ্ট হলো যে, নাক-উঁচু নাটুয়ার দল নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারলেন। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললেন। তারপরই এলো গ্লোবালাইজেশন। শুরু হলো মার্কেট ইকোনমির মারকাটারি খেল। এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির খোলনলচে বদলে গেল। সিনেমা-টেলিভিশনের দোসর হয়ে হাতের মুঠোয় চলে এলো মোবাইল এন্টারটেইনমেন্টের সাড়ে বত্রিশ ভাজা। ব্যাস! নাটকের বরাতে যেটুকু জায়গা বরাদ্দ ছিল, সেটুকুও জবরদখল হয়ে গেল। তখন স্বখাত সলিলে ডুবে মরাই নাটকের ভবিতব্য হলো।

অন্যদিকে বাজারের খুঁটে নাটককে বাঁধতে গিয়ে দিশেহারা হলেন অনেক নাটুয়া। চাহিদা আর যোগানের সরল সমীকরণে এমন বুঁদ হয়ে গেলেন যে, হাটের ব্যাপারীর সাথে তার ফারাক কখন ঘুঁচে গেল ঠাহরই হলো না। এখানে দু’টো কথা লিখে রাখা ভালো। আমরা বাঙালিরা অনেকেই জানি না যে, মহারাষ্ট্রে নাটকের বাজার খুব চাঙ্গা। হিন্দির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে মরাঠী ও গুজরাতি নাটক। আজো। হামেশাই ২০-৩০ লাখ টাকা লগ্নি করে নাটক নামে। লক্ষ্য থাকে প্রযোজককে দ্বিগুণ টাকা ফেরত দেওয়া। ২৭ মার্চ বিকেলে ঐ রবীন্দ্র নাট্য মন্দিরেই ‘কোড মন্ত্র’ নামে একটা গুজরাতি নাটক হচ্ছিল। হলিউড সিনেমা ‘এ ফিউ গুড মেন’-এর ছাঁচে ঢালা চড়া দাগের নাটক। আর্মি কোর্ট মার্শালের আড়ালে রকমারি রহস্যের পর্দা ফাঁস। সবকিছুতে তুখোড় পেশাদারিত্ব। দু’বছরের মধ্যে ২১১টা শো হয়ে গেছে নাটকটার। লোকে ২০০-৩০০-৫০০ টাকার টিকিট কিনে হইহই করে দেখতে আসছে। শিগগিরই হিন্দি ভার্সনও নামবে। এর পাশাপাশি আছে সিনেমা করে নামডাক পাওয়া লোকদের বেশি পয়সা দিয়ে নাটক করানোর প্রবণতা। একেবারে মোটাদাগের এসব নাটকের টিকিটের দাম শুরুই হয় হাজার টাকা থেকে। ৫ হাজারেও বিক্রি হয় এমন নাটকের টিকিট। বামনের আক্ষেপ যে নাটক এখানে আড়াল মাত্র। তারকাদর্শনই এইসব কা-কারখানার মূলে। একে গণমাধ্যমের ক্ষীর খেয়ে যাচ্ছে সিনেমা ক্রিকেট আর ফুটবল। তার উপর এইসব তারকাচিহ্নিত নাটক নিয়েই মেইনস্ট্রিম মিডিয়া নাচানাচি করছে। ‘ভালো নাটক’কে একরকম বয়কটই করছে তারা। আর এর দরুন এনএসডি’র মতো প্রতিষ্ঠানে শিখে এসে, পড়ে এসে যারা নতুন নাটকের রাস্তা কাটতে চাইছেন, তাদের পথে পথে পাথর বিছোনো থাকছে।

এসবের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে গলা তুলতে পারতেন না নাটুয়ারা? পারতেন। বামন মনে করেন যে, তাঁদের জোট বাঁধা উচিত ছিল। জোরের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দরকার ছিল। কিন্তু থিয়েটার কমিউনিটির কব্জির জোর যে ঠিক কতখানি আজ পর্যন্ত তা টের পাওয়া যায় নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ‘সিস্টেম’ নাটককে একেবারে অপাংক্তেয় করে দিয়েছে। শুধু ভারতে নয়, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো কিছু ব্যতিক্রমী দেশকে বাদ দিলে সারা দুনিয়া জুড়েই এমন ধারা ব্যাপার চলছে।

আরও একটা জরুরি দিকে আলো ফেললেন বামন। মানুষ কি আদৌ নাটক দেখতে চাইছে? নাটকের মধ্যে নিজেকে খুঁজতে চাইছে? নাটক কি সমাজের কাছে জরুরি হয়ে উঠতে পারছে? নাটকের দরকার যদি অন্য কোনো না কোনো মাধ্যম দিয়ে পুষিয়ে যায়, তবে নাটক করে হবেটা কী? নাকি নাট্যকার তাঁর পেট চালানোর দায় থেকে নাটক করে চলেছেন? বামন বলছেন, জনসংখ্যার কত শতাংশ নাটক দেখতে আসছেন এটা বের করতে মহারাষ্ট্র জুড়ে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে, জনসংখ্যার এক নগণ্য অংশ নাটক দেখতে চান। মুখে বলছি যে, মরাঠিরা নাটকপাগল জাত। অথচ মহারাষ্ট্রের মেরেকেটে ৩% মানুষ অডিটোরিয়ামে এসে টিকিট কেটে নাটক দেখেন। বাকিদের এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই। ফোক এবং ট্রাইবাল থিয়েটারকে এই হিসাবে ধরা না হলেও জনজীবনে নাটকের জায়গাটা কীভাবে কমে এসেছে সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকছে না। পশ্চিমবঙ্গ আর মহারাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি নাটক হয়। সেখানেই যদি এমন হাঁড়ির হাল হয়, তবে দেশের বাদবাকি অংশের কথা তো কহতব্য নয়। বামন বলছিলেন, উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী এলাকার ১% মানুষ যদি নাটক দেখতে আসেন তাহলে নাটকের স্বর্ণযুগ এসে যাবে। সেটা হচ্ছে না।

তবে কি সরকারি মদদ ছাড়া নাটকের বরাতে কানাকড়িও নেই? কেউ কেউ ভাবেন নাটুয়াদের পিঠ চাপড়ানোর জন্য এককালে রাজা-বাদশারা ছিলেন। লাটসাহেব জমিদারের নজরানাতে যে নাটুয়াদের দিনগুজরান হতো, এ তো নিজেদের চোখে দেখা। বামন এই অতিকথার বেলুন ফাঁসিয়ে দিয়ে বলছিলেন যে, গাইয়ে বাজিয়ে নাচিয়েদের দানাপানি দিয়ে পুষেছেন, এমন রাজা-বাদশার নাম ইতিহাসে ভুরি ভুরি মিলবে। কিন্তু নাটুয়াদের মাথায় তুলে রাখার ইতিহাস কোটিতে গোটিক! ‘নাটুয়ারাতো রাজা-বাদশাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। শাসকের দিকে আঙ্গুল তোলেন। তাঁদের দর্প চূর্ণ করে দেন। রাজসভায় বিদূষক বা ক্লাউনদের তো কাজই হচ্ছে জনসমক্ষে শাসকদের কাপড় খুলে দেওয়া। আম-আমির মনের কথা আড়েঠারে শাসকদের কানে তোলাই তো এইসব নাটুয়াদের কাজ ছিল। এতে করে একঘর লোকের সামনে মজা পাবার ভাব দেখালেও, আসলে ভেতরে ভেতরে হাড়ে হাড়ে চটে যেতেন শাসককুল।’ কাজেই রাজা-বাদশাহদের সঙ্গে নাটুয়াদের সম্বন্ধ কোনোদিন গভীর হয় নি। শাসক নাটুয়াদের সন্দেহের চোখে দেখেন। ফেলতে পারেন না, তা বলে চোখের মণি করে রাখেন এমনও নয়। ফলে আকবরই যদি না থাকেন বীরবল তবে যাবেন কোথায়? ‘হামারে পাস আকবরই নেহি! হামারে পাস বীরবল হি বীরবল হ্যায়!’ আকবর বিহনে বীরবলের খেল খতম হয়ে গেছে, এমনটাই মনে হচ্ছে বামুনের।

কেউ বলতে পারেন, ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক তো নাটুয়াদের পেছনে বছরে কোটি কোটি টাকা খরচা করেন। তার বেলা? বামন বললেন, ‘সরকারি খাজাঞ্চিখানা থেকে আসা পয়সায় জান-প্রাণ লাগিয়ে নাটক করা যায় না। সরকার সেটা চায়ও না। সরকার আসলে চায় নাটুয়াদের চুপ করিয়ে রাখতে। নাটুয়াদের আওয়াজ বন্ধ করে দিতে।’ বোঝার উপর শাঁকের আঁটি হয়ে এসেছে কী করণীয় আর কী করণীয় নয়, তার লম্বা-চওড়া ফর্দ। নাটুয়াদের ঘরোয়া আলোচনাতে এবার কোন নাটক করা যায় তাই নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছেন সবাই। সবাই এমন নাটক খুঁজছেন যাতে কেউ চটে না যান। এদিকে মিঠেকড়া নিয়েই তো নাটকের সংসার। কেবল মিঠে দিয়ে নাটক হয় না। কড়ার ভাবে কম পড়লে মিঠের স্বাদও কম পড়ে। যে ক্রিয়েটিভ ফ্রিডমের ডঙ্কা বাজিয়ে নাটুয়ারা ঝড় তুলতেন, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানান রকমের চাপে পড়ে তা কি উবে যাবার জোগাড় হয়েছে? এই গ্যাঁড়াকলে পড়ে নাটুয়ারা নিজেরাই নটেগাছের বারোটা বাজাচ্ছেন কিনা এই কথাটাও ভেবে দেখতে বললেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার অধ্যক্ষ। এহেন পদমর্যাদার লোকের মুখে এহেন মন কি বাত শুনে তাজ্জবই হলাম আমরা। খুশিও হলাম।

বামন আরো কিছু কূট প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলছিলেন যে, আমাদের জীবনযাত্রা হু হু করে পাল্টে যাচ্ছে। রাস্তার ধারের সব্জিওয়ালার চাইতে শপিংমলের দোকানদারকে মনে ধরছে বেশি। ছিটের জামার চাইতে ব্র্যান্ডেড গার্মেন্টের দিকে নজর যাচ্ছে বেশি। কালচারাল আইডেন্টিটির এই সংকট কুরে কুরে খাচ্ছে মানুষকে। দুনিয়াদারীর বেগ এমন বেড়ে গেছে যে, একটা খবর দু’মিনিটেই বাসি হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল একটা পোস্টের একবেলাতেই মেয়াদ ফুরোচ্ছে। একটা কিছু হলে সেটাকে এদিক থেকে সেদিক থেকে এমনভাবে তুলে ধরছে গণমাধ্যম যে, নাটুয়ারা মাথা গলানোর ফুসরত পাচ্ছেন না। সেনা জওয়ান শহিদ হবার খবর ফলাও হতেই বুম হাতে রিপোর্টার পৌঁছে যাচ্ছেন তার শোকার্ত মায়ের কাছে। শুধোচ্ছেন, ‘কেমন লাগছে আপনার?’ ভাবা যায়! অথচ যাচ্ছে। মিডিয়ার এই মিডিয়োক্রিটি আর সুপারফিসিয়ালিটি এখন কোয়ালিটির মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে কল্পনার কোনো অবকাশই থাকছে না। নাটককারের হাত থেকে নাটক বেরোনোর আগেই বিষয় তামাদি হয়ে যাচ্ছে। নাট্যকার বেচারী এখন কার পায়ে মাথা কুটবেন? আগে শিল্পীরা জমিয়ে আড্ডা দিতেন। যিনি ছবি আঁকেন তিনি সিনেমাওয়ালাদের সঙ্গে মিশতেন। নাটুয়াদের সঙ্গে কবিদের জম্পেশ বৈঠক হতো। কথায় কথা বাড়তো। নাটকীয় সংলাপে তার প্রতিফলন দেখা যেত। সেই ব্যাপারটাও একরকম উঠেই গেছে। সবাই একা হয়ে গেছেন। নাটক তো তিলোত্তমা শিল্প। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে চেনা জানা না থাকলে সে চলবে কী করে?

জ্যান্ত জীবনের আয়না

উদ্বেগ ছাপিয়ে আশঙ্কার যে মেঘ কালো হয়ে ঘন হয়ে জমতে শুরু করেছিল, তার থেকে খানিক রেহাই মিলল জার্মান নাট্যবিদ ইনা রস-এর ভাষণে। ইদানিং আর্টস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে নাট্য গবেষণার খাতিরে দিল্লিতে থিতু হলেও ইনা আদতে বার্লিনের মেয়ে। ক’দিন আগেই বার্লিন থেকে এসে দিল্লি কলকাতা মাতিয়ে গেছেন ‘শাবুন থিয়েটার রেপাটরি’। ষোলআনা সরকারি খরচে চলা এইসব নাট্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের মতো দেশের নাটকের দলের কোনো তুলনাই চলে না। ইনা সেদিকে গেলেন না। তাঁর বক্তব্যে উঠে এলো পেডারবর্ন নামের এক মফস্বল শহরের কথা। কলকাতা থেকে যেমন গোবরডাঙ্গা বা ঢাকা থেকে যেমন সাভার, তেমনই বার্লিন থেকে কয়েকঘন্টা দূরে এই শহর। লোকসংখ্যা তিন লাখ। সেখানে সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক এক নাট্যমঞ্চ আছে। সেখানে বড় নাট্যদলের নাটক হয়। আছে আরও কিছু ছোটখাট নাট্যমঞ্চ। সেখানে হাত পাকান ছোট মাপের দল। এছাড়াও আছে আর্টিস্টস ইন রেসিডেন্স প্রোগ্রাম। নাটককারদের পুরস্কৃত করার রেওয়াজ আছে। তাদের মাজাঘষা করার জন্য কর্মশালা আলোচনাচক্রের বন্দোবস্ত আছে। বছরে একবার হপ্তা দু’য়েক ধরে নতুন নাটকের উৎসব হয়। শহরের সব ক’টা নাটমঞ্চে এই প্রতিযোগিতামূলক উৎসবের পালা পড়ে। সবার সেরা নাটককে পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কারমূল্য ৫০০ মার্কিন ডলারের সমতুল্য। কয়েক দশক আগে এই উৎসবে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে কীভাবে এটা চলে আসছে তা ভেতর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন ইনা।

ইনা বলছিলেন, ‘জার্মান থিয়েটার সিস্টেমের ভিতরে আছে প্রফেশনালিজম।’ নাটকের সঙ্গে যারা জুড়ে থাকেন, তাদের সবাই দস্তুরমাফিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। দিনভর তারা নাটকই করেন। সবাই সরকার থেকে মাস মাইনে পান। নিদেনপক্ষে একটা থোক পয়সা। ‘অ্যামেচার’ কথাটাই জার্মানিতে অচল। সেখানে শখের নাটকের কোনো জায়গা নেই।

তা বলে সে দেশের নাটকের সবটাই গড়গড়িয়ে চলছে এমন নয়। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে দেশজুড়ে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যাচ্ছে, বুড়োরাই নাটক দেখতে যাচ্ছেন বেশি। দর্শকের ৪০%-র বয়স ৬৫-র বেশি। ২৬ শতা!শের বয়স ৫০ থেকে ৬৪-র মধ্যে। ১৭%-র বয়স ৩৫ থেকে ৪৯। আর যাদের কম বয়সী বলা চলে সেই ১৮ থেকে ৩৪ বছরের দর্শক মোটে ১৭%। শুনে চমকে উঠলাম। পাই ডায়াগ্রাম খুলে ইনা দেখালেন যে, এই দর্শকের ৭২ শতাংশ স্নাতক। ১৭% তার আগের ধাপ বেরিয়েছে। স্বাভাবিক। জার্মানির শিক্ষার হার যেখানে গোটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চোখ টাটায়, সেখানে এমন পরিসংখ্যান তাজ্জব করে না। তাজ্জব কী বাত হলো জার্মান দর্শকের লিঙ্গভিত্তিক বণ্টনে। ৬৩% মহিলা, ৩৭% পুরুষ। এত গুছিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা না হলেও ভারত-বাংলাদেশের নাগরিকনাটকে মোটের উপর এর ঠিক উল্টো ছবিই দেখা যায়। শতাংশের হিসাবে মহিলাদের ২০-২৫ এর উপরে তোলা যাবে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু জার্মানিতে তরুণ প্রজন্ম কেনো নাটক দেখতে আসছে না, তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা চলছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগ নাট্যকার মেধা চর্চার মাধ্যম হিসেবে নাটককে দেখছেন। তারা নাটুয়াদের জন্য আর নাট্য সমালোচকদের মুখ চেয়ে নাটক করছেন। পাশাপাশি কীভাবে তাদের টেনে আনা যায় তার তোড়জোড় চলছে।

যুক্তি সাজাতে গিয়ে মার্কিন ঔপন্যাসিক হেনরি জেমস-এর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে লেখা উপন্যাস ‘দ্য অ্যামেরিকানস’র প্রসঙ্গ তুললেন ইনা। উপন্যাসের নায়ক ক্রিস্টোফার নিউম্যান এসেছিলেন প্যারিসে। এসে কী করলেন? অভিজাতদের সঙ্গে মেলামেশা করলেন, ল্যুভর মিউজিয়ামে ঘোরাঘুরি করলেন। আর? থিয়েটারে আনাগোনা করলেন। অর্থাৎ নাটক দেখা ছিল ইউরোপের বহুত্ববাদী সমাজের এক অনিবার্য আচরণ। থিয়েটার ছিল শিক্ষিত ও সভ্য মানুষের অবধারিত বিচরণক্ষেত্র। সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। পয়সা রোজগার করা আর উড়িয়ে দেবার মধ্যে কোনো ওস্তাদি ছিল না। চেকভের রাশিয়াতে, ব্রেখশটের জার্মানিতে, বেকেটের ফ্রান্সে এই ব্যাপারটা মোটের উপর অক্ষুণ্ন ছিল। ১৯২৮ সালে ব্রেখশট যখন ‘থ্রি পেনি অপেরা’ লিখেছেন, তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল নাটক করার খরচ কমিয়ে টিকিটের দর নামিয়ে আনা, যাতে ভিখিরিরাও সেই নাটক দেখতে আসতে পারে। তা সত্ত্বেও প্রলেতারিয়েতের বদলে বুর্জোয়ারাই দর্শকাসন ভরিয়ে দিলেন বলে ব্রেখশট হতাশ হয়েছিলেন। পিয়ের বুর্দো যাকে ‘কালচারাল ক্যাপিটাল’ বলছেন, তার ওজন কিছুদিন আগেও ইউরোপে নেহাত কম ছিল না। কে কোন নাটকের মুখ্য চরিত্র, কোন নির্দেশকের কাজ দেখতে লোকে ভিড় জমাচ্ছে- এসব খবর সভ্য-ভব্য মানুষের কাছে জরুরি ছিল। পেশার জগতে বা সামাজিক পরিসরে এসবের জ্ঞানগম্যি মানুষকে সামনের সারিতে এগিয়ে দিচ্ছিল।

ইনা বলছিলেন যে, খুব সম্প্রতি এসব মানদণ্ডে চিড় ধরেছে। লেডি ম্যাকবেথের নাড়িনক্ষত্র না জানলেও যুবক-যুবতীদের দিব্যি চলে যাচ্ছে। রবার্ট উইলসনকে না চিনলেও কিছু যাচ্ছে আসছে না। দ্রুত বদলে যাচ্ছে ইয়োরোপ। জনসংখ্যার রকমফের বাড়ছে। টানাপোড়েন বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়ার ধরণ একেবারে পাল্টে গেছে। নাটকের সঙ্গে শিক্ষা ও সভ্যতার সাবেক সম্পর্কে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে টনক নড়েছে জার্মান সরকারের। দায়িত্ব বেড়েছে ইনার মতো আর্টস ম্যানেজারের। পাবলিক রিলেশনশিপ ম্যানেজারদের ডাক পড়েছে। ‘আওয়ার থিয়েটার’- এই অনুভবকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গেঁথে দেবার জন্য আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছেন তারা। শুরু হয়েছে ‘সিটিজেন থিয়েটার’। এই ব্যাপারটা কী? ধরা যাক ড্রেসডেন বলে একটা মহানগর। সেখানকার মানুষের রোজকার সুবিধো অসুবিধে নিয়ে নাটক তৈরি হচ্ছে। মঞ্চস্থ হচ্ছে। আলবা নামের একটা নদী বয়ে যায় ড্রেসডেনের মধ্যে দিয়ে। সেই নদী হয়ে উঠছে নাট্যবস্তু। নাটুয়াদের সঙ্গে কোমর বেঁধে নাটক করতে আসছেন ড্রেসডেনের সাধারণ নাগরিক। ধ্রুপদী নাটককে আপাতত শিকেয়  তুলে রেখে তারা মর্যাদা দিচ্ছেন নিজেদের যাপিত জীবনকে। মাসে একবার করে বড় নাটমঞ্চে শো হচ্ছে। এই পার্সোনালাইজড থিয়েটার দেখতে বাড়ির সবাই সদলবলে আসতে শুরু করেছেন। এই তুকে কাজ হচ্ছে জাদুর মতো। আপনাআপনি তৈরি হয়ে যাচ্ছে নতুন দর্শক। তারা অন্যান্য নাটক দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বার্লিনও পিছিয়ে নেই। ফোকসবুনের মতো খানদানি থিয়েটারে নাটক ছাড়াও অন্যান্য শিল্পকলার চর্চা হচ্ছে। উইকএন্ড এন্টারটেইনমেন্টের জন্য তরুণ প্রজন্মকে ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে না। চাইলে নাটক দেখে দু পেগ মদে গলা ভিজিয়ে একটু নেচে নেওয়া যাচ্ছে। চাইলে একটা ডিসকাশন পারফরমেন্সে নাম লেখানো যাচ্ছে। এতে কাজ হচ্ছে। নাটক যেই লিভিং রিয়্যালিটি হয়ে উঠছে, অমনি নটগাছের গোড়ায় জল পড়ছে, সার পড়ছে। সে তরতরিয়ে বাড়তে পারছে।  

এখন আর থিয়েটার করার দরকার আছে কি?

মুম্বইতে ইংরেজি নাটকের একটা জমকালো যুগ ছিল। তাতে ভাটার টান এখন স্পষ্ট। খুব কম কথায় তাদের সংকটের কথা বয়ান করলেন রাহুল ডিকুনহা। মাঝবয়সী রাহুল একাধারে নাটককার, নির্দেশক এবং প্রযোজক। রাহুল বলছিলেন যে, একুশ শতকের আগে বিলেত-আমেরিকার নাটক তুলে এনে করে ফেলাটাই এই তল্লাটে রেওয়াজ ছিল। নতুন শতাব্দীতে এসে তাতে বদল এসেছে। নিজস্ব কণ্ঠস্বর খুঁজেছে মুম্বইয়ের ইংরেজি নাটক। এতে দু’টো সুবিধে পাওয়া গেছে। এক. সাহেবদের মতো করে ইংরিজি বলার ঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে না। মুম্বইয়ের মতো কসমোপলিট্যান সিটিতে যে জবান চালু আছে তার কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছে। কুইন্স ইংলিশের গায়ে লেগে থাকা শ্রেণিবৈষম্য চলে গেছে। দুই. নতুন দর্শকের কাছে যাওয়া যাচ্ছে।

তাতেও স্বস্তিতে থাকার জো নেই। মাল্টিপ্লেক্স অডিয়েন্সের দিকে মুখ চেয়ে বানানো হালফিলের সিনেমাতেও কতক একইরকম মজার খোরাক পাওয়া যাচ্ছে। এলফিনস্টোনের মতো রইস কলেজের তুখোড় ছাত্র দেখছে ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টসে যে নাটক হচ্ছে, তার সঙ্গে রাস্তার উল্টোপিঠের মাল্টিপ্লেক্সে যে সিনেমা হচ্ছে, তাদের মধ্যে বড় কোনো ফারাক নেই। ফারাক যেটা আছে সেটা টিকিটের দামে। নাটকের টিকিটের দাম সিনেমার চাইতে অনেক বেশি, ফলে ওই ছাত্রকে থিয়েটারে টেনে আনা দিনকে দিন কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। একে নাটক করে পয়সা রোজগার হয় না, তায় স্পনসরের দল পাততাড়ি গুটিয়েছে বললেই চলে। ওদিকে লোকসানের বহর বেড়েই চলেছে। তার-ওপর অল্পবয়সীরা স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকায় মূলত বুড়ো-বুড়িদের মনোরঞ্জন করতে হচ্ছে। ফলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে মাথা তুলছে একটা বিদঘুটে সওয়াল- থিয়েটার করার দরকার আছে কি?

থিয়েটার মিশন আর এর দায় ও দায়িত্ব

জার্মানির ইনা রস তরতরিয়ে ইংরিজি বলেন বলে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় নি। হলো ইতালি থেকে আসা আনা ডোরা ডোরনা আর নিকোলা পিরানজোলা-র বেলায়। এমনিতে ইতালিতে নাটক করার জন্য সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে বড় একটা শাবাশি পাওয়া যায় না। ইতালিয়ান অপেরার ঐশ্বর্য এখনো কমে নি। সে নিজের পায়েই খাড়া থাকতে পারে। কিন্তু আধুনিক ধাঁচের নাট্যকারদের অনেক বুঝে-শুনে পা ফেলতে হয়। কাজেই প্রোডাকশন নয়, দেশে বিদেশে ঘুরে প্রজেক্ট অনুযায়ী নাটক করার মধ্যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টা উপেক্ষিতই থেকে যায়। অথচ সেটাই করছেন আনা আর তাঁর সঙ্গী নিকোলা। স্বেচ্ছায়। সেই ২০০৪ থেকে। তাঁদের ডেরা মফস্বল শহর বোলোনিয়াতে। নিকোলা বলছিলেন যে, বোলোনিয়াতে নাকি ভালো করে নাটক করার চাইতে নাটক যে করা হচ্ছে সেটা দেখাতেই ব্যস্ত নাটুয়ারা। তাদের প্রিয় মঞ্চের নাম ফেসবুক। দল বেঁধে নাটক করাতে তাদের বয়েই গেছে। ওই মরা খাতে পরি নাচানোর চাইতে নাট্যপর্যটকের জীবন বেছে নিয়েছেন দু’জনে। আনা নির্দেশনা দেবার পাশাপাশি অভিনয় করছেন। নিকোলা অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকের আর পাঁচটাদিক সামলাচ্ছেন। দু’জনে মিলে দুনিয়াজুড়ে চরকিপাক খাচ্ছেন। ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে। এমন নাটুয়াযুগলের সঙ্গে মাঝেমাঝেই আমাদের দেখা হয়। তাদের দায়বদ্ধতা শিল্পের কাছে। গেল শীতেই ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে এক নাটুয়াযুগল এলেন ভারতে। মেরিলিন ক্লারা নুনেজ আর আলেহান্দ্রো রোসা। এলেন ক্লারিস লিসপেক্টর নামে এক প্রবাদপ্রতিম ইহুদি কথা সাহিত্যিকের সবচাইতে বিখ্যাত উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘স্টারস’ নিয়ে। গিন্নি তুখোড় অভিনেত্রী। একাই ঘন্টাখানেক ধরে আমাদের বসিয়ে রাখতে পারেন। কত্তা এমনিতে সঙ্গীতজ্ঞ। আবার লাইটবোর্ডে বসে বাদবাকিটা সামলে দেওয়া তার কাছে নস্যি। এঁদের মতো থিয়েটার মিশনারিদের কাছে অডিয়েন্সের স্বল্পতা বা স্পেসের অপ্রতুলতা কোনো ব্যাপারই নয়। যস্মিন দেশে যদাচার করাতে তাঁরা সিদ্ধহস্ত। কাজ চালানো গোছের ইংরিজি জানলে নাটক উতরে যায়।

আনার ইংরিজি বেশ নড়বড়ে। ফলে কথায় কুলোচ্ছিল না। বুদ্ধি খাটিয়ে মহিলা কিছু ফটো আর ভিডিও দেখালেন। বোঝা গেল শুধু দু’জনে নয়, দরকার পড়লে দশজনকে জুটিয়েও তাঁরা আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট সামলাতে পারেন। কর্মশালা পরিচালনা করতে পারেন। সেটা দেশের মাটিতে হোক বা চিনের আর্ট গ্যালারিতে। আর তারা যখন নাটক করেন তখন আশপাশে যা দেখেন, হাতের কাছে যা পান, সবকিছুকে জুটিয়ে নাটকের গায়ে জড়িয়ে নেন। আগে ইতালিয়ান ভাষার মাধুর্যকে দর্শকের প্রাণে-মনে পৌঁছে দেবার জন্য সচেষ্ট থাকতেন। টেক্সটের সঙ্গে বডির এক ধরনের সই পাতানো থাকতো। এডিনবরা ফ্রিঞ্জ ফেস্টিভ্যালে যাবার পর থেকে সব বদলে ফেলেছেন। যে দেশে যাচ্ছেন, সে দেশের ভাষা, সে দেশের ভঙ্গির সঙ্গে মানানসই নাটক তৈরি করার ব্রত নিয়েছেন তাঁরা। মেক্সিকোতে যখন নাটক করছেন, ড্রামাটার্জি তৈরি করছেন ইতালিয়ানের পাশাপাশি স্প্যানিশে। স্থানীয় অভিনেতৃদের যাতে কোনো অসুবিধে না হয় সেদিকে নজর রাখছেন। আবার ষোলআনা ইতালিয়ান অভিনেতৃরাও যাতে দলছুট না হন, সে পথও খোলা রাখছেন। যত দিন যাচ্ছে টেক্সটের সঙ্গে পারফরমেন্সের কেতাবি বাঁধুনিকে আলগা করে দিচ্ছেন তাঁরা। চেষ্টা করছেন টোট্যাল থিয়েটারের ভাষায় কথা বলার।

স্ক্রিপ্টের সরদারি শেষ

আর এখানেই চাপে পড়ে যাচ্ছেন নাটককার। এই সেদিনও নগরনাট্যের আদিতে ছিল নাটকের লিখিত পাঠ। স্ক্রিপ্ট বা টেক্সট। প্রথিতযশা অভিনেত্রী নীনা কুলকার্নি বলছিলেন, তাঁরা যখন ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে ছবিলদাস বা অন্য কোনো মঞ্চে অভিনয় করতেন, তখন প্লেস্ক্রিপ্টকে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হতো। সংলাপের একবর্ণও এদিক-ওদিক করার কথা ভাবতে পারতেন না তাঁরা। পনেরো-কুড়ি বছর আগে মিলিন্দ শি-ে-র মতো নামী মরাঠী অভিনেতা যখন অভিনয়ে আসেন, তখনও ঐ জায়গাটা ছিল। এখন সেটা নড়ে গেছে।

ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা প্রাক্তনী তথা হিন্দি নাটককার আসিফ আলী হায়দার খান যুক্তি সাজিয়ে বলছিলেন যে, সনাতন এই সম্বন্ধকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল ১৯৯০-এর দশক। এক এক করে বিশ্বায়ন আর উদারীকরণের দোলায় দুনিয়ার দোর হাট করে খুলে গেল। মানুষের চলাচল আরো সহজ হলো। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হলো। বাজার বাড়লো। যোগাযোগ বাড়লো। জাগতিক সুযোগ-সুবিধা বেড়ে গেল। লন্ডন-নিউইয়র্ক হাতের নাগালে চলে এলো। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া পাশের বাড়ি হয়ে উঠল। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা। আগে একশ্রেণীর মানুষ যত রাজ্যের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। সেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলো, কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের দূরত্ব মুছে গেল। পিছিয়েপড়া মানুষের চাপে এগোতে থাকা মানুষকে প্রমাদ গুণতে হলো। একচেটিয়া কারবারের দিন ফুরোলো। কেউ কেউ উল্কার গতিতে সামনে চলে এলেন। কেউ কেউ চোখের নিমিষে মিলিয়ে গেলেন। মোদ্দা কথা, আরো বেশি লোক আরো বেশি রকমের লোকের সামনে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে চড়ার উপায় খুলে গেল।

আসিফ বলছিলেন, নাটককেও এই হাটবাজারে এসে নিজেকে বিকোবার জন্য তৈয়ার হতে হলো। বাজারের মর্জিমাফিক চলতে হলো। নির্দেশক প্রবল হয়ে ওঠায় নাটককারের খবরদারি আগেই খর্ব হয়েছিল। আগে নাটককারের অঙ্গুলিহেলনে নাটক এগোতো। তাঁর নামেই নাটক চলত। মালিক টাকা ঢাললেও নাটকের মালিকানা নাটককারের জিম্মাতেই থাকত। নির্দেশকের মাতব্বরি এসবে জল ঢেলেছিল। বিশ্বায়নের ঢেউ এসে নির্দেশককেও কোণঠাসা করে দিল। বাজারের চাহিদা হয়ে উঠল নির্ণায়ক শক্তি। নাটক হয়ে উঠল যৌথ প্রক্রিয়া। কোলাবোরেটিভ এফোর্ট। তাতে নাটককার বা নির্দেশক আছেন, তেমনি আছেন অভিনেতৃ, মঞ্চস্থপতি, আলো পরিকল্পক। আছেন কোরিওগ্রাফার এবং সিনোগ্রাফার। বাংলা বা মহারাষ্ট্রের কথা আলাদা, কিন্তু দিল্লিতে থেকে হিন্দি নাটকের অভিজ্ঞতা থেকে আসিফের মনে হয়েছে নাটক ক্রমে প্রসেনিয়ামের বাইরে বেরিয়ে আসছে। নয়া আন্দাজের স্পেস ঠিক করে দিচ্ছে কোন ধরনের নাটক লিখতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি টেক্সচুয়াল কালচারের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে মিডিয়াটাইজড ইমেজ আর সাউন্ড কালচার। এ এক বহুমুখি বহুমাত্রিক নন্দনবিশ্ব। একে কেউ এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার বলতে পারেন। কেউ পোস্ট-মডার্ন বা পোস্ট-ড্রামাটিক থিয়েটার বলতে পারেন। ডিভাইসড থিয়েটার বলতে পারেন, ফিজিক্যাল থিয়েটার বা মাল্টিমিডিয়া থিয়েটার বলতে পারেন। কিন্তু এই বহুধাবিভক্ত নব্যনন্দনকে এড়িয়ে চলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ইতিহাস আর পরম্পরার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির সম্পর্ক ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি একই সঙ্গে বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার দাবিকে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। নিজের জাত, নিজের ধর্মের সঙ্গে নিত্যনতুন সম্পর্কে লিপ্ত হতে হচ্ছে নাটককারকে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি যখন আঞ্চলিক পরিচয়কে দুরমুশ করে দিতে চাইছেন, তখন নিজস্বতা রক্ষা করার দায় হচ্ছে। আবার নিজের বলতে কিছুই না-থাকলে থাকা আর না-থাকা সমান হয়ে যাচ্ছে।

নাটককারকে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে আপোষ করে আন্দাজ বদলে চলতে হচ্ছে।

শেকড় জল না পেলে তো নাটকই শুকিয়ে যাবে

এই যদি হালচাল হয়, তবে নাট্যসমালোচক আর নাট্যগবেষক কোন চুলোয় যাবেন? এর জবাব খুঁজতে আমার মনে হয়েছিল শিয়রে শমন এসে গেছে। তবুও আসিফের কথার খেই ধরে বলছিলাম কীভাবে পৃথিবীজুড়ে নাটককারের ভাত মারছেন নির্দেশক। সুজুকি তাদাশির কথা বলছিলাম। জাপানি এই নির্দেশকের ‘ট্রোজান উইমেন’ দিয়ে থিয়েটার ওলিম্পিকস-এর পথচলা শুরু হয়েছিল। আমি ‘ট্রোজান উইমেন’ দেখেছি গেল বছর, বেজিং-এর ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস-এ। দেখেছি ইউরিপিডিসের আড়াই বছরের পুরনো গ্রিক নাটকের খোলসটাই শুধু রেখেছেন সুজুকি তাদাশি। তাঁর নাটকে ট্রোজান ওয়ারের জায়গা নিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু আক্রমণে ধুলিস্যাৎ জাপান। নোহ-কাবুকি নাটকের বর্ণমালায় সেজেছে সেই নাটক। কিছুদিন আগে এই অষ্টম থিয়েটার ওলিম্পিকসের মঞ্চে জার্মানী থেকে আসা শাবুন থিয়েটারের ‘কমপ্যাশন: দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য মেশিনগান’ দেখেছি। তাতে নাটককারের ল্যাঠা চুকিয়েই দিয়েছেন নির্দেশক মিলো রাউ। সদলবলে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের নানান শরণার্থী শিবিরে, কঙ্গোর গৃহযুদ্ধের আশ্রয়শিবিরে। নাটক বলতে যেটা আমাদের দেখানো হয়েছে, সেটা দুই অভিনেত্রীর দু’টো স্বগতোক্তি। সেদু’টো তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। নির্দেশকের ঘাড়ে চেপেছে ড্রামাটুর্গ আর সিনোগ্রাফারের দ্বৈত ভূমিকা। ভারতের বুকেও ডিভাইজড থিয়েটার হচ্ছে, প্রোমেনাড থিয়েটার হচ্ছে। নীলম মানসিং চৌধুরী, সত্যব্রত রাউত, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়, দীপন শিবরামনদের নাটকে বড় জায়গা নিয়ে হাজির হচ্ছে রিচুয়াল, ভিসুয়াল, এমনকি স্পেস অ্যারেঞ্জমেন্ট। প্রতিবাদী নাট্যের পরম্পরাকে নীরবতার গয়না পরাচ্ছেন অতুল পেঠে। চৈতি ঘোষের অবজেক্ট থিয়েটারে নৈঃশব্দ বাক্সময় হচ্ছে। ড্রামাটিক থিয়েটারের ভূত বাংলাদেশের ঘাড় মটকাতে পারে নি বলে একটা বাড়তি সুবিধে মিলেছে। এমনিতে বাংলাদেশ এখনো লোকধর্মী নাট্যের জ্বলজ্যান্ত কিছু পরম্পরা আছে। সেখানে আইডিয়াই আসল। স্ক্রিপ্টের বালাই নেই। মনসুর বয়াতির কিসসা গানে দেশের মাটি ছেনে তুলে আনা গল্পেরা পেখম মেলছে। ময়মনসিংহের ছেলে সাইক সিদ্দিকীর স্বরচিত পালায় গীতিকার আঙ্গিক মিলেছে সমকালীন সমাজভাষ্যের স্রোতে। এখানে অভিনেতাই স্বরাট। নাটককার বা নির্দেশকের ঝুট-ঝামেলা নেই। অথচ এই নাটক আধুনিক নাট্যমঞ্চে দিব্যি মঞ্চস্থ হতে পারছে।

কিন্তু বিরাট সংকট এসেছে নাটক নিয়ে লেখালেখির বেলায়। নাটক হচ্ছে, কিন্তু নাটক নিয়ে লেখালেখি উঠেই গেছে। আগে খবরের কাগজে থিয়েটার রিভিউ হতো। নিয়ম করে। নাটকের খবর বেরোত। নিয়ম করে। এখন কালেভদ্রে বেরোয়। নেহাত জায়গা খালি পড়ে থাকলে অন্য কথা, নচেত জনপ্রিয় পত্রপত্রিকার পাতাতেও নাটকের ঠাঁই হচ্ছে না। আর্টস অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্টের জন্য বরাদ্দ সবটুকু জায়গা চেঁচেঁপুচে খেয়ে নিচ্ছে সিনেমা। এ ব্যাপারে বিলেত-আমেরিকার সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের তফাত নেই। আগে নাট্যসমালোচকদের কাজ ছিল, একদিকে পাঠককে কাগজের পাতায় আটকে রাখা, অন্যদিকে নাট্যাঙ্গনের খাসমহলের সব খবরাখবর সরবরাহ করা। নাটক আর দর্শকের মধ্যে সেতু বাঁধার কাজটা মূলত তারাই করতেন। একজন নাট্যসমালোচককে খাতির যত্ন করে প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে আসা হতো। একটা নাটক ভালো রিভিউ পেলে নাটুয়াদের মধ্যে উৎসাহের জোয়ার বয়ে যেত (উল্টোটা হলে মুখ ভার হতো)। দিনকাল পাল্টেছে। নাটকের অত গুরুত্ব সমাজ দেয় না। নাট্যসমালোচকদের আরো দেয় না। আর সোশ্যাল মিডিয়া এসে পড়ে নাট্যসমালোচকদের মুখে তো কার্যত কুলুপ এঁটে দিয়েছে। প্রচারসর্বস্ব যুগে নাটকের খবর ছড়াতে এক সেকেন্ডও লাগছে না। আর লিখবার মুরোদ থাকুক বা না-থাকুক, যার ইচ্ছে করছে সে-ই নাটক নিয়ে চাট্টিখানি লিখে দিচ্ছে। সেসব চটজলদি ফোন থেকে ফোনে ছড়িয়ে  যাচ্ছে। তোয়াজি লেখাতে ভরে যাচ্ছে ফেসবুক থেকে টুইটার। রেওয়াজি লেখার কদর হচ্ছে না। নাটকের ভালো-মন্দ ছাড়াও একজন নাট্যসমালোচককে অনেক গভীরে গিয়ে একটা নাটকের মর্ম বুঝতে হয়, দেশ ও সংস্কৃতির ইতিহাসের ধারায় সেই নাট্য কর্মের গুরুত্ব বিচার করতে হয়। সহজেই বাজিমাত হলে কে আর নাট্যসমালোচকের পেছনে ঘুরঘুর করবে? মুড়ি আর মুড়কির দর এক হয়ে গেলে কে আর নাট্যসমালোচককে পুঁছবে? কেউ করবে না।

এটা চলতে থাকলে যে নাটক নিয়ে সিরিয়াস রাইটিং বলতে কিছুই থাকবে না, আর আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পাতায় বিরাট শূন্যতা নেমে আসবে, সেটাই বলছিলাম। রাশিয়ার মতো কোনো কোনো দেশে নাট্যসমালোচকরা ব্লগ চালাচ্ছেন। ছাপার অক্ষরে না থাকলেও ডিজিটাল রেভুলিউশনের ভরা গাঙে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছেন তারা। আমাদের মতো দেশে এসবের চল হয় নি। নাট্যসমালোচকদের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর আড়াআড়ি বরাবরের। সরস্বতীর আসনেই তাদের ঠাঁই। এই সৌখিন মজদুরির জন্য এতটা কষ্ট স্বীকার করতে আমাদের বাধছে।

আমাদের ক্রিটিকাল রাইটিং-এর বাইরে নাটক নিয়ে একাডেমিক রাইটিং হচ্ছে না এমন নয়। সারা পৃথিবী জুড়েই হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশের নাটককে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেবার ক্ষেত্রে সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের একটা বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু নাটুয়াদের সঙ্গে টুলো পণ্ডিতদের ভাবসাব নেই বললেই চলে। পণ্ডিতদের জারিজুরি ছাপার অক্ষরেই আটকা পড়ে আছে। সেসব কোন কুলুঙ্গিতে কোন সিন্দুকে রাখা থাকে তার হদিস নাটুয়াদের কাছে নেই। এর দ্বারা কোনো মহৎ কার্য সম্পাদনের আশাও কার্যত জলে। ভারতের মতো দেশের নাটকের ইতিহাস লিখতে বসে এক টুলো পণ্ডিতকে দেখলাম, স্রেফ হিন্দি থিয়েটারের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিলেন! রামনগরের রামলীলা আর মথুরার নৌটঙ্কি ছাড়া ভারতের লোকনাট্যের কতটুকু সম্পদ লিখনবিশ্বের আওতায় এলো? বাংলাদেশ এদিক থেকে কয়েক কাঠি এগিয়ে আছে। প্রয়াত সেলিম আল দীন বা সৈয়দ জামিল আহমেদ, সাইমন জাকারিয়া, ইউসুফ হাসান অর্কের মতো নাট্যবিদ তথা গবেষক সক্রিয় থাকায় লোকনাট্যের মর্যাদা শুধু বেড়েছে তা নয়, মৃত্তিকালগ্ন নাটকই বাংলাদেশের নিজস্ব নাটকের সম্মান পেয়েছে। শুকনো পণ্ডিতের তাত্ত্বিক কচকচানিতে পর্যবসিত হয় নি।


তবে এটুকু নিয়ে তো সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। থিয়েটার অ্যাপ্রিসিয়েশনকে অবহেলা করলে চলবে না। নাটকের এত-শত দিক নিয়ে কর্মশালা হয়, কই, নাটক কীভাবে দেখবো, কীভাবে বুঝব, তা নিয়ে তো উদ্যোক্তাদের মাথাব্যথা নেই। কীভাবে নাটক নিয়ে লিখব তা নিয়ে তো কোনো প্রতিষ্ঠান মাথাব্যথা নেই। এমনটা চলতে থাকলে আগামী দিনে নাটকের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের সম্পর্ক স্রেফ ডিজিটাল ইমেজের সুতোয় ঝুলতে থাকবে। শেকড় জল না ফেলে নাটকই শুকিয়ে যাবে। অচিরে।

এইটুকু বলেই শেষ করেছিলাম।

আরো কেউ কেউ বলেছিলেন। ইতালি থেকে উড়িশাতে থিতু হওয়া নৃত্যশিল্পী ইলিয়ানা সিতারিস্তি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। আমাদের সবার বক্তব্য শেষ হবার পর অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন জয়ন্ত শেভতেকর, সংযুক্তা থোরাট, মনস্বিনী লতারবীন্দ্র, সুচিস্মিতা ভট্টাচার্যের মতো স্থানীয় নাট্যবিদ ও শিক্ষার্থী। কীসের তাগিদে মস্কো থেকে মুম্বই এসে নাটক করছেন বলেছিলেন লিকা ক্লিমোভা।

কেউ হাল ছেড়ে দেন নি। নটে গাছ মুড়োচ্ছে দেখেও কেউ রণে ভঙ্গ দেন নি। সবচাইতে বড় কথা, নাটকের মতো কালজয়ী শিল্পমাধ্যমের ওপর সবার আস্থা অটুট ছিল।

অংশুমান ভৌমিক ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। ভারতের প্রথমসারির দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ আর বাংলা মাসিক ‘কৃত্তিবাস’ এর নাট্যসমালোচক।