Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সোলায়মানের ‘গোলাপজান’: নাটকে সংগীত পুনর্গঠন কিংবা পুনর্সৃজনের অন্তরাভিযান

Written by শুভাশিস সিনহা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

যেখানে অশ্রুর ভিতরকার অশ্রুটি ঝরিয়া পড়ে না এবং হাস্যের ভিতরকার হাস্যটি ধ্বনিয়া উঠে না, সেইখানেই সংগীতের প্রভাব। সেইখানে মানুষের হাসিকান্নার ভিতর দিয়া এমন একটা অসীমের মধ্যে চেতনা পরিব্যাপ্ত হয়, যেখানে আমাদের সুখদুঃখের সুরে সমস্ত গাছপালা নদীনির্ঝরের বাণী ব্যক্ত হইয়া উঠে এবং আমাদের হৃদয়ের তরঙ্গকে বিশ্বহৃদয়সমুদ্রেরই লীলা বলিয়া বুঝিতে পারে।
- রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর

Theatre is a form of knowledge; it should and can also be a means of transforming society. Theatre can help us build our future, rather than just waiting for it.
- Augusto Boal

এই দুটি উদ্ধৃতিকে এই রচনার প্রবেশদরজায় তকমা করে লাগিয়ে দেয়ার একটা কারণ আছে, বুদ্ধিমান পাঠক তা খানিকটা আঁচ করে ফেলেছেন বলে বোধ করি।
 
আমরা কথা বলতে যাচ্ছি, মিউজিক ইন থিয়েটার নিয়ে অর্থাৎ নাটকে সংগীত। সংগীত বলতে এখানে গানও বোঝা যাবে। মানে কথাবার্তাকে রসসিদ্ধ করার জন্য গুঞ্জরিত সুরপ্রবাহমাত্র নয়, এটা শিল্পীর সুর-বাণীতে প্রকাশ পাওয়া গান।

সংগীতকে রবীন্দ্রনাথ দেখছেন এক ধরনের অন্তর্গত বা ইনার-একটিভ মিডিয়াম হিসেবে। সেখানে তিনি অন্তর আর বাহিরের এক ধরনের বৈপরীত্যকে খানিকটা উস্কে দিয়েছেন। অর্থাৎ সেটা জনরুচিকেও খানিকটা আমলে না নিয়ে সোজা কথায় না কেঁদে কাঁদানো বা না হেসে হাসানো যার কাজ।
 
এদিকে পাশ্চাত্যের নাট্যতাত্ত্বিক বলছেন, থিয়েটার, সোজা কথায় নাটক সমাজ বদলের হাতিয়ার। এটা ভবিষ্যতের জন্য বসে না থেকে ভবিষ্যৎকে তৈরি করারও একটা উপায়।
 
এই দুটি উদ্ধৃতিকে শুরুতেই রাখার কারণ হলো তাদের এই পরস্পরবিরোধী চরিত্র।
 
এখন এই পরস্পর বিরোধী চরিত্রকে কীভাবে মিলিয়ে নেয়া যায়?

কঠিন কাজ বটে। একটি হলো ভেতর থেকে আরও ভেতরে যাবার খেলা, আরেকটি ভেতরকে বাইরে নিয়ে আসা, মানে নৈর্ব্যক্তিককে ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক করে তোলা। এখন তাদের মিলন ঘটবে কীভাবে?

যে-নাটক ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য তৈরি হয়, যে নাটক মানুষের ভেতরকে ভেঙেচুরে বাহিরে নিয়ে আসার জন্য তৈরি হয়, তার সাথে সংগীতের সম্পর্ক কেমন হবে?
 
এই প্রশ্ন অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে আমরা আজ সোলায়মানের কাছে যাবো। কেননা, সোলায়মান তার প্রায় সব নাটকেই গান ও সংগীতকে করে তুলেছেন নাট্যপ্রবাহের গতি। এবং তা প্রায়শ এমনভাবে নাটকের অন্য অন্য উপাদানের সাথে যুক্ত যে তাকে নদীর স্রোতধারায় সহসা ভেসে আসা কচুরিপানা বা শ্যাওলার মতো বললে ভুল হবে, ভুল হবে তাকে স্থিরতরঙ্গের ওপর কোনো অভিঘাত বললেও। সেটি নদীর গতিধারার সাথে মিশে থাকা রৌদ্রঝলকিত জলস্ফটিক। জল থেকে আলাদা করলে তার কোনো তাৎপর্যই থাকে না। আর এই সংগীতের সাথে থাকে অভিনেতা বা মুদ্রাশিল্পীদের ছন্দময়, গীতল শরীরী প্রক্ষেপ, যা তাকে নির্দেশক হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে। তিনি নিশ্চয় মানেন যে আত্মার দুয়ার খুলে দেয়ার মন্ত্র মানবশরীরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। (The language of the body is the key that can unlock the soul. - Constantin Stanislavski )

আজ আমরা কথা বলব একজন দারুণ সৃষ্টিশীল, ক্ষ্যাপাটে, সতত নতুনত্বের জন্য তৃষ্ণার্ত, প্রচলকে ভেঙে পথ-চলা মানুষকে নিয়ে। তাকে নিয়ে নয়, তার নির্মাণের কৃৎকৌশল, সদর-অন্দর নিয়ে। তাও হয়তো বা মোটা দাগে নয়, তার একটিমাত্র নির্মাণ কিবা সৃষ্টিকর্মের ধরন-ধারণ নিয়ে। এবং আমরা বুঝতে চেষ্টা করব, এই বঙ্গের নাট্যজমিনের কোন এলাকাটি এই মানুষটার নিজস্ব চাষবাসের গন্ধে সুধায় বিশিষ্ট ও অনুপম হয়ে আছে।
 
এস এম সোলায়মান (জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ খ্রি., মৃত্যু ২২ সেপ্টেম্বর ২০০১ খ্রি.)। স্বাধীন বাংলাদেশের তুখোড়, মেধাবী, প্রাণবন্ত, শিল্প-দায়বদ্ধ স্বল্পায়ু একজন মানুষ। ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল’, ‘এলেকশান ক্যারিকেচার’, ‘ইংগিত,  ‘গণি মিয়া একদিন’, ‘এই দেশে এই বেশে’, ‘আমিনা সুন্দরী’, ‘কোর্ট মার্শাল’, ‘গোলাপজান’ ইত্যাদি নাট্যনির্মাণের মধ্য দিয়ে যিনি শিল্পের দৈশিক কিবা রাজনৈতিক দায় মিটিয়েছেন, এবং অবশ্যই একই সাথে সমন্বিত করেছেন তার সাবলিমিটি বা নান্দনিক রসসিদ্ধির তাগিদও। আমরা ভুলি না, ‘কোর্ট মার্শাল’ নাটকের প্রকট বাস্তবের রূপকে। একটি আদালতের জেরা প্রতিউত্তরের মধ্য দিয়ে একটি দেশের নাভিশ্বাস তোলা যন্ত্রণা, অবদমিত আত্মশ্লাঘা আর সংক্ষুব্ধ অভিমানকে প্রকাশ পেতে দেখা যায় নাটকটিতে। কেবল মঞ্চের ওপর নানান জ্যামিতিক সৌন্দর্যের পদচারণা ও সদর্প কথোপকথনে এক অনুপম নাট্য, যার শেষে সোলায়মানের নিজ কণ্ঠে গী’ত ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে...’।  সেই মা তার গায়কির আবেদনে, দৃশ্য-আবহে হয়ে ওঠে দেশ-এর ব্যঞ্জনাসঞ্চারী। ফাঁসির দড়ির ধীর নেমে আসা, আসামী সৈনিকের মৌন মৃত্যু-উন্মুখতা আর দর্শকের অশ্রুজলে ভেসে যাওয়া। এই আবেগের সিনথেসিস জানেন সোলায়মান। এই সুর আর দৃশ্যের সংবেদনশীল গ্রন্থনা সোলায়মানকে করেছে স্বতন্ত্র।
 
সোলায়মান তার নাটকের বিষয়ে, বক্তব্যে, ডিজাইনে সবসময়ই অ-স্থিত; সতত ছুটেছেন শৈল্পিক স্থানান্তরে। তার নাটকে অভিনয়য়ের সাথে নান্দনিক হয়ে ওঠে মুদ্রা বিন্যাস, শরীরী ব্যঞ্জনা; কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সোলায়মান একজন সংগীত-অন্তঃপ্রাণ নাট্যনির্দেশক।  (জেনে রাখা ভালো বিশ্বের ক্লাসিক সব নাট্যকার বা নির্দেশকই ছিলেন একাধারে সংগীতকার বা সুরস্রষ্টা, গ্রীসের এস্কাইলাস, সোফোক্লিস, এরিস্টোফেনিস তা-ই ছিলেন।) সংগীতকে তিনি তার নাটকের গ্রন্থনায় এক অনিবার্য সুতো করে তুলেছেন, যার মধ্য দিয়ে গেঁথে তোলা হবে শিল্পের পুষ্পমালা।
 
সংগীতের এই শক্তিকে রবীন্দ্রনাথ জায়েজ করেছেন এই বলে, ‘সংগীত হলো অন্তরের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম উপায়। ’(সংগীত ও ভাব/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) সেটাকে আরও সহজ করে বিশ্লেষণ করেছেন অন্য এক প্রবন্ধে : ‘গীত সুরের মাহাত্ম্যে প্রত্যেক কথাকে মনের মধ্যে সম্পূর্ণ নিবিষ্ট করিয়া দেয়। কথায় যে অভাব আছে, সুরে তাহা পূর্ণ হয়ে ওঠে। ’ (বাংলা শব্দ ও ছন্দ/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

নাটকে গান বা সংগীতের ব্যবহার কখন কীভাবে শুরু হয়েছিল, প্রথমে তার একটা হদিস আমরা নিতে চেষ্টা করব।
 
পাশ্চাত্যে রেনেসাঁর সময়ে মিউজিক্যাল থিয়েটার প্রথম আবির্ভাব লাভ করে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিতে। তা প্রায় সপ্তদশ শতকে। ব্যালাড অপেরা, কমিক অপেরা, প্যান্টোমাইম ইত্যাদি নানান আঙ্গিকে। নাটক গ্রীসে, অপেরা ইটালিতে, মিউজিক্যালস আমেরিকায়, লিরিক্যাল প্লে এশিয়ায়।
 
ভারতবর্ষে মিউজিক্যাল থিয়েটারের বয়স শিল্পের জন্মের সময় থেকেই বলা যায়। বেদ উপনিষদের শ্লোক থেকে শুরু করে মন্দিরের প্রার্থনা আরতি, মধ্যযুগের সকল পাঁচালিকাব্য, মঙ্গলকাব্য এখানে গীতকাব্যেরই রূপ। সেখানে গান অবশ্যই আখ্যানকে বয়ান করারই উপচার। ‘আর্যদের আসার আগে যে প্রাকৃতজনের নাট্যক্রিয়া ছিল, সেখানেও মূল অবলম্বন ছিল গানই’ (The Indian theatre/Hope Horowitz).
 
পাশ্চাত্যে মিউজিক্যাল থিয়েটার ধীরে ধীরে একটা পলিটিকাল স্ট্যান্ড নিয়েছে। কখনো অপেরা কিংবা কমিক অপেরার পথ ধরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অনেক সময় তা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। আমাদের এখানেও মূলত পথনাটকগুলোতে প্রতিবাদমূলক গীতিনাট্যের রূপ দেখতে পাই।
 
ময়মনসিংহ গীতিকাকে আমরা যুগসন্ধিক্ষণের সবচেয়ে শক্তিশালী গেয়কাব্য বলতে পারি। ধর্ম আর কৃত্যের গন্ধ মুছে ফেলে মাটির মানুষের কাছে কাহিনিকাব্যকে নামিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ময়মনসিংহ গীতিকা’র রচনাকাররা। সেখানে শ্রেণিদ্বন্দ্ব এবং প্রেম পরস্পর মুখোমুখি। কখনো বা ধর্মের অভিমান।
 
নাটকের ইতিহাসের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য দেশেরই শুরুটা মিউজিক্যাল থিয়েটারের গড়নেই হয়েছে। প্রাচীন গ্রীসে অ্যাক্রপলিসের মন্দিরে কৃত্যের উছিলায় গীতনাট্যক্রিয়া হতো কিংবা মিশরে অথবা ভারতবর্ষে সব জায়গাতেই।
 
জাপানের মূলধারার থিযেটারে যে কৃত্যমূলক নাট্যক্রিয়া ‘নো’ ও ‘কাবুকি’ নামে এখনো বেগবান, সেগুলো পুরোদস্তুর মিউজিক্যাল থিয়েটার।
 
পশ্চিমি দুনিয়ায় আধুনিক অপেরার জন্ম ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে।  তা সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে মাতিয়ে রেখেছিল পুরো ইউরোপ। আধুনিক অর্থে মিউজিক্যাল বা সাংগীতিক নাট্য অথবা গীতিনাট্য বলতে যা বোঝায়, তার গোড়াপত্তন বলা হয়ে থাকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে, কম্পোজার জ্যাকিস অফেনব্যাচ গ্রাম্যগীতিকা নির্ভর অপেরাকে একটা বৈশ্বিক সর্বজনীনতার রূপ দিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন। উইলিয়াম গিলবার্ট আর আর্থার সালিভিয়ান বৃটেনে, পরবর্তীকালে নানাজনের হাত দিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় মিউজিক্যাল কমেডির একটা ধারা জোরে-শোরে শুরু হয়ে যায়।
 
তার প্রায় শতবর্ষ পরে বিংশ শতকে এসে আমেরিকান মিউজিক্যাল থিয়েটার নিয়ে নেয় ইউরোপের স্থান। জর্জ কোহান, ভিক্টর হারবার্ট প্রমুখ গায়ক-নট-কম্পোজাররা মিউজিক্যাল থিয়েটারকে নানাভাবে জাগ্রত করে রাখেন। নিউইয়র্ক ব্রডওয়ে থিয়েটার এক্ষেত্রে নিয়ে নেয় প্রধান প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা।
 
১৯৬০ সালে হার্ড রক ধারার গানের উত্থানের সাথে সাথে বিশ্বখ্যাত নিউয়র্ক ব্রডওয়ের মিউজিক্যালস-এর দাপট কমে আসতে থাকে। নতুন ধারার সুর, অর্কেস্ট্রেশন, কোরাস আর নাট্য-অভীক্ষায় আমেরিকান গীতিনাট্যের নতুন এক অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়।

একবিংশ শতকের শুরু থেকেই ইউরোপ আমেরিকায় মিউজিক্যাল কমেডির অবস্থান শক্ত হয়, সেখানে অনুপ্রবেশ করে নতুন ঘরানার পপ গানের ধারা, দর্শককে আকর্ষণ করার জন্য শিল্পের এক ধরনের হাল্কা চালের সিনথেসিস।
 
ব্রডওয়ে থিয়েটারে কয়েক ডজন মিউজিক্যালস এখন পর্যন্ত টিকে আছে, যেমন- শো বোট (১৯২৭)। আর আমেরিকান মিউজিক্যালস-এর স্বর্ণযুগ বলা হয় যে সময়ে, সেই ১৯৫৫ সালে প্রদর্শিত ‘ড্যাম ইয়াংকি’ আজ পর্যন্ত মঞ্চায়িত হচ্ছে ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে।

ক্লাসিক গ্রিক ট্র্যাজেডি/কমেডিও অনেকটাই মিউজিক্যাল ছিল। এস্কাইলাস, সফোক্লিস, এরিস্টোফেনিস প্রত্যেক ক্লাসিক নাট্যকার কেবল নাট্যকার ছিলেন না, তারা ছিলেন গীতিকার আর কম্পোজার। তাদের থিয়েটারকে লিরিক থিয়েটার বললেও তেমন কোনো ভুল হবে না। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ অব্দে গ্রিক কমেডি নাট্যকার এরিস্টোফেনিস (৪৪৮-৩৮৫ খ্রিস্টপূর্ব) ‘দ্য বার্ডস’ নামে যে নাটকটি রচনা করেন সেটাকেই গোটা বিশ্বের ওল্ড কমেডির পয়লা নিদর্শন বলা হয়ে থাকে। এই নাটকেই প্রথম ধর্ম রাজতন্ত্র ইত্যাদি বিষয় থেকে নাটকের গল্প মানুষের একেবারে সাধারণ স্তরে প্রবেশ করে। নাটকটিতে সংগীতের সুচিন্তিত প্রয়োগ করা হয়েছিল। ২৫৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান পুল্লুতসই প্রথম রোমান কমেডি নাট্যকার যিনি অপেরা ধরনের নাট্য প্রযোজনা করেছিলেন।
 
আধুনিক মিউজিক্যাল থিয়েটার এশিয়াতেও প্রবলভাবে বেগবান। রবীন্দ্রনাথ অধুনা অর্থে তাকে এভাবে বিবৃত করেন: ‘এশিয়ার প্রায় সকল দেশেই আজ পাশ্চাত্য ভাবের সঙ্গে প্রাচ্যভাবের মিশ্রণ চলেছে, এই মিশ্রণে নূতন সৃষ্টির সম্ভাবনা। এই মিলনের প্রথমাবস্থায় দুই ধারার রঙের তফাতটা থেকে যায়, অনুকরণের জোরটা মরে না। কিন্তু আন্তরিক মিলন ক্রমে ঘটে, যদি সে মিলনে প্রাণশক্তি থাকে; কলমের গাছের মতো নূতনে পুরাতনে ভেদ লুপ্ত হয়ে ফলের মধ্যে রসের বিশিষ্টতা জন্মে। আমাদের আধুনিক সাহিত্যে এটা ঘটেছে, সংগীতেও কেন ঘটবে না বুঝি নে। যে চিত্তের মধ্য দিয়ে এই মিলন সম্ভবপর হয় আমরা সেই চিত্তের অপেক্ষা করছি।’ (পারস্যে/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

বাঙালির দার্শনিক ইশারাযুক্ত হাজার বছরের পুরনো কাব্য ‘চর্যাপদ’ গেয়কাব্যই ছিল, নৃত্য ছিল তার সহ-আঙ্গিক। (সূত্র প্রাচীন কাব্যের একটি পদ: ‘নাচন্তি বাজির, গায়ন্তি দেবী/বুদ্ধনাটক বিষমা হোয়ি।’ বুদ্ধ নাটক বলতে এখানে চর্যাপদকেই বোঝানো হয়েছে।) বৈষ্ণব পদাবলী হিন্দুস্তানী সুরকৈবল্যের সংগীত থেকে বাঙালির আত্মবয়ান প্রকাশক সহজিয়া গানের ধারা। বৈষ্ণব গানের ধারা পরবর্তীকালে বাংলার নাট্যমূলক কবিগানে প্রভাব রেখেছে। কবিগান বৈষ্ণব পদাবলীর মর্ম থেকে অনেক রস অধিগ্রহণ করেছে।
 
‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য তার মর্মার্থকে বা ভাষাকে পেরিয়ে গতি-ছন্দ-নৃত্যকে ধারণ করেই তার পরিপূর্ণ রূপ নিয়েছে। খোদ রবীন্দ্রনাথ এমনটাই বলেছেন। আধুনিককালের বাংলা নাটকে মিউজিক্যালস বা গীতনাট তৈরির পুরোধা রবীন্দ্রনাথকেই বলা যেতে পারে।
 
বিলাতে গিয়ে আইরিশ মেলোডিজ শোনার পর তার সংগীত বিষয়ে এক ধরনের পরিবর্তন আসে। দেশি আর বিলাতি সুরের মিলনেই জন্ম ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র। কবিভাষ্যেই তা জানা যায়। যে সুরের প্রয়োগকে কেন্দ্র করে তিনি নাট্যরচনার দর্শনকেও খানিকটা বদলে দিতে চাইলেন। বলছেন, “বাল্মীকি প্রতিভা’ পাঠযোগ্য কাব্যগ্রন্থ নহে, উহা সংগীতের একটি নূতন পরীক্ষা- অভিনয়ের সঙ্গে কানে না শুনিলে ইহার কোনো স্বাদগ্রহণ সম্ভবপর নহে। এটা য়ুরোপীয় অপেরার মতোও নয়, এটা হলো সুরের নাটিকা। নাট্য বিষয়কে সুর করিয়া অভিনয় করা হয় মাত্র।... স্বতন্ত্র সংগীতের মাধুর্য ইহার অতি অল্পস্থলেই আছে।” তিনি আরও বলছেন, ‘বিদেশী অলংকারশাস্ত্র পড়বার বহু পূর্ব থেকে আমাদের নাট্য, যাকে আমরা যাত্রা বলি, সে তো গানের সুরেই ঢালা, সে যেন বাংলাদেশের ভূ-সংস্থানের মতো; সেখানে স্থলের মধ্যে জলের অধিকারই যেন বেশি। কথকতা, যেটা অলঙ্কারশাস্ত্র-মতে ন্যারেটিভ শ্রেণীভুক্ত, তার কাঠামো গদ্যের হলেও স্ত্রী স্বাধীনতা-যুগের মেয়েদের মতোই গতিকলা তার মধ্যে অনায়াসেই অসংকোচে প্রবেশ করত।... আর আত্মপ্রকাশের জন্যে বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত করে চেয়েছে।’ (শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সংগীতের স্থান/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) প্রতীচ্যের নাট্যতাত্ত্বিক কনস্তানতিন স্তানিস্লাভস্কিও যেন সহমত প্রাচ্যের কবির কথায়। বলছেন, আবেগ আর সংবেদনকে ছোঁবার জন্য নাট্যসংলাপকে সুর গ্রহণ করতে হয়। (My life in art/ Constantin Stanislavsky)

কাজী নজরুল ইসলামও তার নাটকে প্রচুর গানের ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজে লেটো দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে গীতিময় গল্পকথনরীতিকে চিনে নিয়েছিলেন তিনি। ‘আলেয়া’, ‘মধুমালা’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘মদিনা’ প্রভৃতি নাটকে নজরুল ব্যাপক গানের সমাহার ঘটিয়েছেন, বাংলা নাটকে গানের ব্যবহারে তা বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য। ‘আলেয়া’ নাটকে ৪৩টি গান ছিল, যা সংখ্যায় বাংলা নাাটকে গানের ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
 
সোলায়মানের এই নতুন গীতনাট অভিনব। এর আগেও তিনি ‘আমিনা সুন্দরী’ নামে একটি গীতপ্রধান নাট্য রচনা ও নির্দেশনার কাজ করেছিলেন (ঢাকা পদাতিক কর্তৃক প্রথম প্রযোজিত, পরবর্তীকালে থিয়েটার আর্ট ইউনিটে রোকেয়া রফিক বেবীর নির্দেশনায় পুনর্নিমিত)। নছর মালুম ও ভেলুয়া সুন্দরী নামের দুটো লোককাহিনিকে অবলম্বন করে সোলায়মান ‘আমিনা সুন্দরী’ রচনা করেন। সেই নাট্যে গল্প গানের উপর ভর করে এগিয়েছে। ‘গীত সমৃদ্ধ নাট্যের প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে সেখানেই। এখান থেকেই বাংলা নাটকের আদি জায়গাটা যেখানে সংগীত দখল করে রেখেছিল প্রায় সবটাই, সেখানে প্রবেশ করেছিল সে।’ (এক অসমাপ্ত গানের বেদনা/মামুনুর রশীদ)  ‘আমিনা সুন্দরী’তে অনেক লোকপ্রচলিত গান তিনি গ্রহণ করেছেন, গান বেঁধেছেন নিজেও। ‘খানদানি কিসসা’ নাটকটিও মিউজিক্যাল ড্রামাই ছিল। কিন্তু ‘গোলাপজান’ সেসব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে একটিও নাট্য-উদ্দেশ্যে লিখিত গান নাই। সুরারোপ নাই। এমনকি অধুনার গল্পে বিধৃত এই নাটকের সাথে গানগুলোর কোনো সৃষ্টি-সম্পর্কও নাই। কিন্তু তিনি একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। শিল্পের ‘অপর’কে ‘আপন’ করে নেবার চ্যালেঞ্জ। এবং সংগীত নয়, ভিন্ন ভিন্ন সিনেমায় (হিন্দি) ভিন্ন ভিন্ন গল্প ও চরিত্রের সাথে অন্বিত গানকেই নাট্যকাহিনির নেপথ্যকথন (Background narratives) হিসেবে ব্যবহার করে একটিমাত্র গল্প বা কাহিনিকে এগিয়ে নেবার চ্যালেঞ্জ।
 
ব্যালাড বা অপেরা বা আমাদের গীতিকা কী গেয়কাব্যে গান ন্যারেটিভের অংশ। গান সুরে সুরে মূলত গল্পকথন। কিন্তু সোলায়মানের ‘গোলাপজান’-এ গান ন্যারেটিভ নয়, গানের চরিত্র পুরোটাই আবহসংগীতের মতো। ঘটনা ও মনোক্রিয়াকে তা ব্যাখ্যা করে, পরিবর্ধিত করে না, গানের প্রভাব এখানে ঘটনার বিস্তারে বা অভিপ্রকাশে নয়, ঘটনার অন্তর্গত ভাবকে আরও প্রগাঢ় করে তুলতে, যেটা সাধারণ মিউজিক্যাল টিউনিং বা সাংগীতিক অনুষঙ্গে সুরে যন্ত্রে হয়ে থাকে, এখানে একটির পর একটি পূর্ণ/ভাঙা/ বিক্ষিপ্ত গান সে কাজটি করে গেছে, সোলায়মানের অন্য কোনো নাটকেও তা নেই।
 
‘গোলাপজান’-এ পুরান ঢাকার সাথে ঐতিহ্যের সূত্রে হিন্দি গান এসেছে, কিন্তু তা না হলেও সাংস্কৃতায়নের যে নানান নমুনা আমরা দুনিয়া জুড়ে পাই, সেখানে থিয়েটারও তার বাইরে নয়। ভাষাটাই নিশ্চয় সব নয়, সুরেও তো অপর এবং আত্ম বলে কিছু থাকে। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের সুরেই পাশ্চাত্যের সুরের আদল আছে।

জোর্জি গ্রোটোওস্কি বেলে ড্যান্স দেখে প্রভাবিত, পিটার ব্রুক প্রাচ্যের মিথ থেকে, ব্রেশট চাইনিজ অপেরা থেকে। সোলায়মান হিন্দি গান থেকে প্রভাবিত হন নাই, বরং হিন্দি গানটাকে নিজের ভেতর পুনর্জন্ম দিয়েছেন। দুনিয়ার আন্তঃসাংস্কৃতিক নাট্যচর্চায় (Inter cultural theatre practic) এটা এক অনন্য দৃষ্টান্ত। অন্য একটি সংস্কৃতির উপাদান অনায়াসে থিয়েটারে প্রয়োগ করা হয়ে যেতে পারে, হতে পারে তার নবায়ন। সিঙ্গাপুরের বিশ্বখ্যাত ‘থিয়েটার ওয়ার্কস’ নামক দলটির অধিকাংশ কাজই এ-ধরনের সাংস্কৃতিক অভিযোজনের নমুনা। যেখানে আপন সংস্কৃতি বা তার মর্মটিই প্রাধান্য পায়, কিন্তু ভিন-সংস্কৃতির উপাদান সেখানে গৃহীত হয় অভিব্যক্তির প্রকাশকে বৃহৎ করে তুলতে। (The original culture dominates but it borrows foreign elements to enlarge the range of expression.- Intercultural theatre today/ Patrice Pavis)

‘গোলাপজান’ নাটকের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই সময়ের আবর্তে খাবি খাওয়া মানুষদেরকে। পরাজিত মানুষেরা মঞ্চের মাঝখানে এলোমেলো নুব্জ হয়ে আছে, তারা প্রত্যেকেই ‘মুসাফির’। জীবনের চলার পথে ক্লান্ত। এবং প্রত্যেকেই হয়তো বা গোলাপজানের সাথে সম্পর্কিত। গোলাপজানের বেদনার্তমুখ আলোর ছটায় আমরা পৃথকভাবে দেখতে পাই। নেপথ্যে গান ভেসে আসে: ‘দুর কা মুসাফির, হামকো ভি সাথ লে লে...’ যেন ‘উড়ান খাটোলা’ সিনেমায় গাওয়া মহম্মদ রফির গাওয়া গান ভেতরে অনুরণন তোলে রবীন্দ্রনাথের ‘পথের শেষ কোথায়’ কিংবা ‘সুদূর বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী, মোর ডানা নাই আছি এক ঠায়, সেকথা যে যাই পাশরি।’-এই গানগুলোর।  দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবনের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার আকুতি।
   
খানিক পরেই সে গান বদলে যায়: ‘বাচপান কি দিন ভুলা না দেনা/ আজ হাসি কাল রুলা না দেনা...।’  গোলাপজানের অভিব্যক্তিতে সেই শৈশবের চঞ্চলতা, উচ্ছ্বাস, গোলাপজান শ্রুতির স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। ‘দীদার’ সিনেমায় টগবগানো ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া দুই শিশুর উচ্ছ্বাস যেন গোলাপজানের চোখেমুখে।
 
এরপর  ‘মিলতে হি আঁখে দিল হুয়া, দিওয়ানা কিসিকা...’। ‘বাবুল’ সিনেমায় শামশাদ বেগমের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান, প্রখ্যাত সংগীতকার নওশাদ যার সুর সৃষ্টি করেছিলেন।
 
কাঠের ফ্রেমের মধ্য দিয়ে দেখা যায় গোলাপজানের প্রথম যৌবনের সেই প্রেমিককে, এক ঝলক, এক পলকেই প্রেম হওয়ারই তো সময় সেই যৌবন। গোলাপজানের সেই প্রেমিক, সেই স্বামী, যে আজ আর নেই, তার স্মৃতিচিহ্ন তার চালিত সেই ঘোড়ার গাড়ির চাকা পড়ে আছে মাটিতে, সে যে কোচোয়ান ছিল। একই সঙ্গে মঞ্চে সেট-এর অংশ হিসেবে রাখা সেই চাকাটা যেন সময়ের আবর্তকে, চলমান কালকে সূচিত করে। প্রতিটি গান নেপথ্যে বেজে ওঠে আর গোলাপজানের নস্টালজিক অভিব্যক্তির রূপবদল ঘটে। টুকরো টুকরো গানের মধ্য দিয়ে গোলাপজানের শৈশব ও কৈশোরকে আমরা পাই। মানুষকে, মানুষের মনকে বোঝার জন্য সোলায়মানের আলাদা তরিকা আছে টের পাওয়া যায়, কেননা  মানুষের বয়স হয়ে গেলে যে যে বিষয তার স্মৃতিকে নাড়িয়ে তোলে, সেসব স্মৃতিকেই তিনি নির্বাচন করেন।
 
তিনটি গানের টুকরোসমূহের নেপথ্য আবহে গোলাপজান তার জীবনের প্রিয় সময়ে বিহার করে। শৈশব ও প্রেম। তারপরই মঞ্চে নীরবতা। আবার তা একাকিত্বের গান। গোলাপজান ফেরে বর্তমানে। মঞ্চভূমে একলা। তার কল্পসংলাপ শুরু হয় ঘোড়া লাল্লুর সাথে। আর ছেলে সাল্লুর সাথে খুনসুটি ঘোড়াটিকে নিয়ে।

গোলাপজান তার শৈশব বা বাচপানকে যখন মঞ্চে হাজির করে সেটা একটা টেকনিক বটে। ঠিক ন্যারেটিভও নয়, আবার কারেক্টারিস্টিকও নয়, নিজেকেই যেন শোনাচ্ছে এমনভাবে বলে- ‘গোলাপজানের বাচপান’!  বলেই আবার গানটি শুরু হয়। যে গান একটু আগে গোলাপজানের স্মৃতিতে প্রলম্বিত বেদনাত্মক হয়ে বাজছিল, সেই গান এখন ছন্দময়, চঞ্চল, দ্রুত লয়ে কোরাস হয়ে ওঠে। সেই কোরাস নেপথ্যে নয়, গানের ছন্দে তালে মঞ্চে গোলাপজানের  শৈশবের বন্ধুদের ভানে নিয়ে আসে মক্তবের কাল।
 
গানের ভগ্নাংশের প্রলম্বিত গায়নের পরপরই গোলাপজান কেঁদে ওঠে প্রিয় স্বামীর গাড়ির চাকাটিকে বুকে আগলে ধরে। আর নেপথ্যে সেই গান ফের- ‘দূর কি মুসাফির, হামকো ভি সাথ লে লে...’। গোলাপজানের মনের ভিতর অতীত এসে হামলে পড়ে। অতীতের সুত্র ধরে গোলাপজান চলে যায় সেই মক্তবে পড়ার দিনগুলোতে। ‘বাচপান কি মোহাব্বত’ গানটি এবার চটুল লয়ে দ্রুত ছন্দে কোরাস গী’ত হয়। তখন সহসাই মক্তবের মৌলভী শৈশবের বাঁধভাঙা চাঞ্চল্য আর সাবলীলতাকে জীবনের দার্শনিক অভিক্ষেপে গম্ভীর করে তোলেন। সেখানে তার কণ্ঠের সংলাপও সাংগীতিক। প্রলম্বিত সুরাপাঠের সাথে তার সংলাপের এক ধরনের সুষমা লক্ষ্য করা যায়। (স্মর্তব্য, মৌলভী তথা মৌলানার নেপথ্য বচনে মোহাম্মদ বারীর অসামান্য কাব্যিক আবেদনময় এবং গম্ভীর সুরানুগামী কণ্ঠপ্রক্ষেপ।)
 
আবার পরক্ষণেই ‘বাচপান কি মহব্বত’ গানের সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় মক্তবে পড়ুয়া গোলাপজান আর সখাসখীদের খুনসুটি। শৈশবের চঞ্চলতা।

একটা গান চকিতে তার ছন্দ আর গতি পাল্টিয়ে গোলাপজানের নতুন জীবনের ব্যঞ্জনায় বেজে ওঠে। সেই একই ‘বাচপান কি মোহাব্বত’ গানটাই। তারই মধ্যে মক্তবে মৌলভী বিষাদমাখা কণ্ঠে শোনান গোলাপজানের বিয়ের খবর; জানান, সে কাল থেকে আর মক্তবে পড়তে আসবে না। মৌলভী যখন জীবনের নানান হিতোপদেশ দেন, তখন নেপথ্যে বাজে ‘বাচপান কি মোহব্বত’ গানটির সুর। গোলাপজান কিশোরী, তার এই বেদনার সাথে গানটির সম্পর্ক, যেন ধর্মবাণীর নয়, অন্য কিছু। আর তারপরেই গোলাপজানের বিয়ের প্রস্তুতি আমরা মঞ্চে দেখতে পাই। গোলাপজান তার বান্ধবী আফিয়ার কাছে তার প্রেমে পড়ার গল্প বলে। গোলাপজানের প্রেমে পড়ার দৃশ্যে যুক্ত হয় নতুন গান। ছোট্ট জানালার ফ্রেমে বাঁধা পড়া আলোকশিখায় ঝলমল করে প্রেমিকের মুখ, নেপথ্যে গান বাজে: ‘মিলতে হি আঁখি দিল হুয়া দিওয়ানা কিসিকা...’

এবার সেই গান নেয় অন্যরকম দ্যোতনা। এবার সে রোমান্টিক কমেডি! দর্শকমনে প্রেম আর হাস্যকৌতুকের যুগপৎ অনুভূতি। সোলায়মানের স্বভাবসুলভ রসবোধ। একই গানের নানান লয়ে, প্রক্ষেপে নতুন নতুন গায়নই নাট্যক্রিয়াকে ঘটনানুগ করে তোলে। সোলায়মানের সংগীত-ভাবনা ও তৎপরতার ক্ষমতাকে চিনে নেয়া যায়। তিনি অনুভব করেন যে, একটি গান তার বিবিধ স্পন্দন বা অনুরণনের গুণে পৌঁছাতে পারে তার মর্মমূলে। (The song becomes the meaning itself through the vibratory qualities. When we begin to catch the vibratory qualities... the song begins to sing us... I don't know anymore if I am finding that song or if I am that song. - Jerzy Grotowski) পোলিশ নাট্যনির্দেশক গ্রোটোওস্কির এই সংগীত-উপলব্ধি যেন সোলায়মানের নাট্যমিশনে ফলিত হয়ে ওঠে। পরক্ষণে আরেকটি গানের মুখরা, ‘তু মেরা চান্দ, মে তেরা চান্দনী...’, গোলাপজানের প্রেমের চঞ্চলতা, মঞ্চ জুড়ে, কয়েকটি নৃত্যমুদ্রা, লজ্জাভ অভিব্যক্তি, আফিয়ার সাথে প্রেমের টুকরো টুকরো অনুভূতিময় গল্প বলতে বলতে প্রথম গানটির অন্তরা ফের ঘুরে আসে, সেই গানের ভাব অনুযায়ী গোলাপজানের অভিব্যক্তি, গোলাপজানের কানের কাছে বাজছে ‘সেই মিঠা কথার মহব্বত’- তার ভাষ্যে, আর আমরা সেই একই অর্থ শুনতে পাই নেপথ্যে সেই গানের কলি- ‘পুচো না মোহাব্বত কা আসার, হায় না পুচো..’। সবশেষে গোলাপজান আর তার প্রেমিকের সংবদ্ধতা, গানের দ্রুত লয় এবং তাদের ঘনবদ্ধ রূপ।  প্রেম শরীর সম্পর্ক ইত্যাদি অনুভূতির গানের ছন্দ, লয়, নানামাত্রিক প্রক্ষেপে বিস্তারে এই অংশটি হয়ে ওঠে এক অনুপম বিন্যাস। দর্শককে ভরিয়ে তোলে প্রেমময় আনন্দে। কখনো বা সামান্য মেলোড্রামাটিক মনে হতে পারে, হয়তো বা খানিকটা চড়া। কিন্তু সোলায়মান জানেন, ‘অজস্র সংকীর্ণতার মধ্যে ধুঁকতে ধুঁকতেও সাধারণ মানুষ চায় প্রসারতা। একটা উঁচু পর্দায় বাঁধা টান টান জীবন্ত শিল্প, বাস্তবতা যার মূল অলংকার।’ (Political Theatre: Toward the question of reality/ Bertolt Brecht)

গোলাপজানের টুকরো টুকরো বয়ান পেশের সাথে সাথে প্রেমের একটি গান ভাগ হয়ে যায়, যেটা দর্শকমনে এক ধরনের আলোড়ন তোলে। ‘মিলতেহি আঁখে দিল হুয়া দিওয়ানা কিসিকা...’- প্রেমিকের সাথে প্রথম দর্শনে যে গান গোলাপজানের হৃদয়ের প্রতিনিধিত্ব করে তা-ই থেকে থেকে নানান চলনে, ঝমকে, চলা ও থামার সাংগীতিক ব্যাকরণে নাটকটির নানান সময়ে এগিয়ে যেতে থাকে। এবং কখনো তা প্রেমের চঞ্চলতা, কখনো অনুভবের প্রগাঢ়তা, কখনো বা খুব বাহারি ধরনে সামনে এসে দাঁড়ানো প্রেমিক তথা স্বামীর সাথে কৌতুককর দৃশ্যের আবহে।
 
সেই গানের শুরুটিই নাকি স্বরে খুব হাস্যরসাত্মক ভাবে গী’ত হয়, বাসররাতে গোলাপজানের সামনে যখন এসে তার স্বামী দাঁড়ায়। আদিরসকে হাস্যরস দিয়ে ঢেকে দেবার শৈল্পিক তরিকা। তারপর শুরু হয় গীত- ‘তু মেরা চান্দ মে তেরা চান্দনী...।’ ‘দিল্লাগী’ সিনেমায় সুরাইয়া আর শ্যামকুমারের প্রেম গোলাপজানের প্রেমাভিনয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

গোলাপজানের আবিষ্ট হৃদয়ের আপনকথনের প্রবাহে আলোর বিশেষ প্রক্ষেপে কোরাসমুদ্রার সাথে যুক্ত হয় গান: ‘বাহারো ফুল বরষাও/ মেরে মেহবুব আয়া হে...’ রাজেন্দ্রকুমার আর বৈজয়ন্তীমালার প্রেমের দৃশ্যের সাথে (‘সুরাজ’) এর মিল নাই, এখানে মঞ্চের নির্দিষ্ট আলোকবৃত্তসমুখে রঙিন কাপড়ের টুকরো নাচিয়ে গানের আবহটি তৈরি করা হয়।
     
এরপর গোলাপজান মীনা কুমারী আর ভরতভূষণের নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় দেখে বায়োস্কোপে। ‘তু গঙ্গা কি মাঝ মে যমুনা কি ধারা...’ ‘বাইজু বাওয়ারা’ সিনেমায় গাওয়া লতা মঙ্গেশকর আর মহম্মদ রফির কণ্ঠ যেন বিনির্মিত হয় ‘গোলাপজান’-এর নাট্যকোরাসে।

মঞ্চে আমরা সে-গানের থিয়েট্রিক্যাল দৃশ্যায়ন দেখতে পাই। গোলাপজানের চোখে মুখে অন্য এক আনন্দ। প্রেমের ফ্যান্টাসি। মঞ্চে সম্মিলিত নানান শরীরী মুদ্রাবিন্যাস, যা সোলায়মানের চিরায়ত নাট্যকল্প। সোলায়মান বিস্মৃত নন, ছন্দ-গতি কিবা লয় আমাদের অনুভূতিকে জাগ্রত ও সঞ্চারিত করে। (Political Theatre: Toward the question of reality/ Bertolt Brecht)
 
কিন্তু কোনো মুদ্রা বা অঙ্গ-অভিক্ষেপই নাটকের যে দুঃখান্তনিয়তিমুখি চলন, তাকে বাধাগ্রস্ত করে নি, গানের যে নরম মোলায়েম সুর-স্বরপ্রক্ষেপ তাতেও সেসব দেহপ্রক্ষেপ কোনোরূপ বিঘ্ন ঘটায় না। কেননা, মানুষের শরীরী ভাষার নাট্যক্রিয়া তখনই অনুঘটক বা প্রভাবক, যখন তা মানুষকে বা চরিত্রকে তার অন্তর্গত রূপে পরিভ্রমণ করার শক্তি দেয়। ব্রাজিলিয় নাট্যতাত্ত্বিক অগাস্তো বোয়াল বিষয়টা এভাবে বলেছিলেন: Theatre has nothing to do with buildings or other physical constructions. Theatre- or theatricality- is the capacity, this human property which allows man to observe himself in action, in activity. Man can see himself in the act of seeing, in the act of acting, in the act of feeling, the act of thinking. Feel himself feeling, think himself thinking.- Augusto Boal.

বাড়ি ফিরে স্বামীর সাথে তার সেই সিনেমাদর্শনের  মুগ্ধ, অভিব্যক্তিময় আলাপ। আলাপের মাঝে বিশ্লিষ্ট হয় আরেকটি গান: ‘এক পরদেশি মেরা দিল লে গেয়া/ যাতি যাতি মিঠা মিঠা ঘাম দে গ্যায়া...’, চরিত্রের একক সংলাপ আর গানের নানান পর্বিক বিন্যাস পুরো দৃশ্যটাকে প্রাণবন্ত ও ছন্দময় করে তোলে। মনে পড়ে যেতে পারে ‘ফাগুন’ সিনেমায় মধুবালা তার প্রেমের প্রথম চমককে নৃত্যগীতে এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন সঙ্গীদের কাছে।
 
এরপর গোলাপজানের বাৎসল্য রসের গান: ‘তুঝে সুরয কহু না চন্দা/ তুঝে দীপ কহু না তারা...’, ‘এক ফুল দো মালী’ ছবিতে মান্না দে’র কণ্ঠে বহুলশ্রুত গানের ভাব পালটে যায় গোলাপজানের বাৎসল্যে।

তারপর থাকে গোলাপজানের সাথে স্বামীর মান-অভিমানের ভানভনিতার কথা। নেপথ্যে সেই কৃত্রিম রাগ-অনুরাগের খেলাকে আন্দোলিত করে এই গান: ‘মোহাব্বত ছুমে জিনকে হাত/ পাও পরে দিনরাত...’, তারপরেই গোলাপজানের ছেলে সাল্লু আর তার সঙ্গীদের ঘুড্ডি বা ঘুড়ি খেলার দৃশ্য, নেপথ্যে থাকে গান- ‘হ্যায় আপ্না দিল, তু আওয়ারা/ না জানে কিস্ পে আয়েগা...’ গানটি ঘুড্ডিবাহিনী সেই কিশোরদের স্বাধীন দুরন্ত মনের প্রতিধ্বনি করে। দেবানন্দের একার হৃদয়োচ্ছ্বাস এখানে কিশোরদের সম্মিলিত হুল্লোড়। সেই দলের প্রতি-উত্তরে ঘুড্ডিদলের অন্য পক্ষ গায়: ‘আওয়ারা হু/ এয় গর্দিশ ম্যায় আসমান কা তারা হু...’, ‘আওয়ারা’ সিনেমায় রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা বোহেমিয়ান রাজকাপুরের চিত্তচঞ্চলতা এখানে বালকদের দুরন্তপনা ও স্বাধীনতার আনন্দের সাথে মিশে যায়।

দ্ইু দলে দুটো গান নিয়ে লড়াই চলে, কেবল দুটো গানের গায়কি, তাতে নানান তালে লয়ে ঝোঁক তৈরি করে সোলায়মান ঘুড্ডি খেলার প্রতিযোগিতাকে একেবারে জীবন্ত করে তোলেন। গানই হয়ে ওঠে তাদের মধ্যকার জেতাজিতির পারস্পরিক কথোপকথন।

ঘুড়ি যখন উড়তে থাকে তখন রাগরাগিণীর বিষাদময় তান। যেন সাল্লুর মৃত্যুর পূূর্বাভাস দেয়।
 
আর একটা সময় সাল্লুর পতন। ওদিকে গোলাপজানের মনে শঙ্কা। সাল্লুকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। গোলাপজানের স্বামী জানিয়েছে ছেলের চিকিৎসার জন্য তাদের পালিত ঘোড়া লাল্লুকে বেঁচে দিতে হবে। গোলাপজান শুনে বেদনায় মুষড়ে পড়ে। লাল্লু তার কাছে পুত্রের সমান। এ কী করে সম্ভব! আমাদের মনে পড়বে সেলিম আল দীনের ‘ধাবমান’ নাটকের কথা। এ যেন তারই পূর্বরাগ। আর কোনো উপায় নেই?- গোলাপজানের অসহায় রোরুদ্য প্রশ্ন। আবহসংগীত তখন পুরো দৃশ্যে তিন স্তরে কাজ করে। ধীর প্রলম্বিত বেদনার স্বর, দ্রুত লয়ে গোলাপজানের মনের অস্থিরতা, শেষে নিশ্চিত পরাজয়ে আবার শান্ত সমাহিত সুর।
 
যুগপৎ এই দৃশ্যভাব তৈরি করে সোলায়মান নাট্যক্রিয়ায় তৈরি করেন এক মানবিক উৎকন্ঠা। মৃত্যু যেন স্বতঃমুখর হয়ে ওঠে। মুখর তার উদ্যাপন। কিন্তু তারপরও ছেলেকে বাঁচানো যায় না। স্বামী নিশ্চুপ। কিন্তু গোলাপজানের আকুল প্রশ্নরাশির সামনে নীরব স্বামীর কান্না সংগীতের রাগিণীর মধ্য দিয়ে আছড়ে পড়ে, উচ্চনাদে, উতরোল তরঙ্গে, বুক ফাটা আর্তনাদে সংগীত হয়ে ওঠে শরীরী ও মানবিক। (সেলিম মাহবুবের নেপথ্য গায়কি, অসামান্য দরদি কণ্ঠ এই সাংগীতিক মুহূর্তকে অশ্রুসিক্ত করে তুলতে যথেষ্ট।) সোলায়মান দুঃখ ও বেদনার সংগীত নিরুপণের তরিকা জানেন। তিনি বোঝেন, ‘দুঃখের রাগিণী দুঃখের রজনীর ন্যায় ধীরে ধীরে চলে, তাহাকে প্রতি কোমল সুরের উপর দিয়া যাইতে হয়।’ আর এও জানেন, ‘আমাদের দেশের সংগীতে রোদনের সুরের অভাব নাই। সকল রাগিণীতে প্রায় কাঁদা যায়, একেবারে আর্তনাদ হইতে প্রশান্ত দুঃখ, সকল প্রকার ভাবই আমাদের রাগিণীতে প্রকাশ করা যায়।’ (সংগীত ও ভাব/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
 
তবে এই সংগীতায়োজনের সবকিছুই দর্শককে ঘটমান নাট্যক্রিয়া ও কাহিনির সাথে একাত্ম করে ফেলতে তীব্রভাবে কাজ করে। সোলায়মান বোঝেন, সংবেদন কিংবা সহমর্মিতার খেলাই শিল্প (Empathy is the most powerful weapon. - Augusto Boal). সেলিম আল দীন যে ‘বেদনা ও সহমর্মিতা’র কথা বলেছিলেন, তাও এই শিল্পেরই প্রয়োগ-রসায়ন।  কিন্তু লক্ষণীয় যে, অন্যান্য বিষয়ের খুঁটিনাটি সংলাপে রাখলেও এই মৃত্যু তিনি ঘটান নেপথ্যে। সংলাপে সেটি আসে না। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র যে বলে, ‘রসবিচ্ছেদ হেতুত্বাৎ মরণং নৈব বর্গ্যতে’ (কখনও মৃত্যু বর্ণনা করতে নেই, তাহলে রসভঙ্গ হবে।), সোলায়মান কি তা জানতেন? বা, মানতেন!

এরপর গোলাপজানের একলা নিঃসঙ্গ দিন। স্বামী আঠারো দিন ধরে নিখোঁজ। গোলাপজানের মনে নারীসুলভ শঙ্কাও দানা বাঁধে। আর নেপথ্যে থাকে ‘বাদল’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গানটি, শিমুল খান কিংবা আনিকা মাাহিনের নেপথ্য কণ্ঠে: ‘দুনিয়া বদল রাহি হে/ আশু বাহানে ওয়ালে...’, গোলাপজানের অন্তর বিদীর্ণ হয়। বেদনায় আকাক্সক্ষায় একাকিত্বে গী’ত হয়: ‘মেরা দিল ফুকারে আজা...’। শুধু স্বামী নয়, যেন গোলাপজানের হৃদয় তার হারানো ভালোবাসার সমস্তকিছুকে প্রাণ উজাড় করে ডাকে। এই গানের মধ্য দিয়েই মঞ্চে প্রবেশ করতে দেখি তার স্বামীকে। একটা ক্র্যাচে ভর করে। রিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় একটি পা সে হারিয়ে এসেছে।
 
এর পরের গান: ‘প্রিত্ হ্যায় ক্যায়সে বল রে দুনিয়া...’, শুরু হয় গোলাপজানের চরম দুর্দশার অসহায় নতুন অধ্যায়। গোলাপজান রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করতে থাকে পসরা। নেপথ্যে গী’ত হয় ‘রেলওয়ে প্লাটফর্ম’ সিনেমায় মহম্মদ রফি আর এস ডি বাতিশ-এর গাওয়া সেই গান: ‘বস্তি বস্তি পর্বত পর্বত গাতা যাহে বানজারা/ লে কর দিল কি একতারা...’, তারই মাঝে কোনো এক শিশুর কাছে যখন ঘুগনি বেঁচে গোলাপজান, তখনই নেপথ্যে গী’ত হয় ‘বরসাত’ সিনেমায় শংকর জয়কিষাণের সুরে মহম্মদ রফির গাওয়া গান: ‘ম্যায় জিন্দেগি মে হরদম রু তাহি রাহা হু...’। তারপর মৃত্যুর সময় তার স্মৃতির উপচে পড়া মুহূর্তগুলো, পুরনো গীতের সূত্র ধরে: ‘তু গঙ্গা কি মাঝ মে যমুনা কি ধারা’ এবং ‘বাহারো কে ফুল বরষাও’, সবশেষে ‘দূর কি মুসাফির ম্যায়, হামকো ভি সাথ লে লে...’ গানের মধ্য দিয়ে যার শেষ।
 
এই গানেরই প্রতিধ্বনি যেন আমাদের কবির কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল:
‘ওগো আমার এই জীবনের
শেষ পরিপূর্ণতা
মরণ আমার মরণ তুমি
কও আমারে কথা।
সারা জনম তোমার লাগি
প্রতিদিন যে আছি জাগি
তোমার তরে বহে বেড়াই
দুঃখসুখের ব্যথা
মরণ আমার মরণ তুমি
কও আমারে কথা।’
(গীতাঞ্জলি/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

যে-শিল্প কথিত বস্তুকে পেরিয়ে দর্শকমনে অকথিত কিংবা কহতব্যের নানান ইশারা ইঙ্গিত মেলে দেয়, সেটাই হয়ে ওঠে ক্লাসিক বা সাবলাইম অফ দ্য আর্ট। তাই একটি নারীর জীবনের নানান বাঁক গলি ঘুরে যে যাত্রা অন্তিমে পৌঁছায়, সেখানে আমাদের ভেতর কাজ করে বেদনার এক সর্বজনীন ভাষা। গান কিবা সংগীত সেখানে প্রধান অবলম্বন। সংগীত এখানে হয়ে উঠেছে ফিগারেটিভ ও থিয়েট্রিক্যাল। তার এক ধরনের শারীরবৃত্তীয় সত্তা যেন দাঁড়িয়ে যায়।
 
‘গোলাপজান’-এ প্রায় ১৮টি হিন্দি গান ব্যবহৃত হয়েছে। গানগুলো চল্লিশ থেকে ষাট-এর দশকের মধ্যকার সিনেমা থেকে নেয়া (বিস্তারিত তথ্যাবলী সংযুক্ত)। পুরান ঢাকার পুরনো দিনের জীবনচিত্রের সাথে সম্পর্কিত করতেই হয়তো-বা এই প্রয়াস। অধিকাংশ গানেরই গায়কি, তাল, লয়ে এনেছেন পরিবর্তন। অবাক করা বিষয় ১৮টি গান ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন সিনেমা থেকে নেয়া। কোনো কোনো গান একাধিকবার ভিন্ন ভিন্ন মুডে বা ভাবে গী’ত হয়েছে। কিন্তু আমরা যখন শুনি, মনে হয় একটিমাত্র সিনেমা থেকেই গানগুলো নেয়া হয়েছে, একটিমাত্র কাহিনির সাথে তারা সম্পর্কিত। সোলায়মান গানগুলোকে তার কথিত গল্প বা আখ্যানের সাথে এতটাই একাত্ম করে ফেলতে পেরেছেন। কখনো মনে হয়, গানগুলোকে ভাবানুযায়ী পরপর সাজিয়ে নিয়ে তারপর সোলায়মান সেসবের সূত্রে নাটক লিখতে বসেছিলেন! প্রতিটি নাট্যমুহূর্তের জন্য এমন যথানুগ গান ভিন্ন ভিন্ন সিনেমা থেকে খুঁজে বের করা রীতিমতো দুঃসাধ্য একটি কাজ। সোলায়মানের ভাবনার বিচিত্র সংগীত-যাপন এই দুঃসাধ্যকে সাধন করার শক্তি দেয়, হয়তো-বা।  সেলিম আল দীন কথিত শিল্পের একাঙ্গীকরণ বা ফিউশন তত্ত্বে যেন এই একাত্মতার কথাও বলা আছে। ‘শিল্পকর্মের ভাব ও বিষয়কে কেন্দ্র করে শিল্পীর আহৃত উপাদান একটি বিশেষ শৃঙ্খলা-রচনা দ্বারা এক অনিবার্য পরিণতি ও রূপ লাভ করে’ (শিল্পে একাঙ্গীকরণ বা ফিউশন তত্ত্ব/সেলিম আল দীন)। তিনি বলেন, সেইসব উপাদান এমন কী বিপরীত স্বভাবের হতে পারে, হতে পারে সব ও বিষম দুই-ই, কিন্তু তা রচয়িতা বা শিল্পীর সৃষ্টিকৌশলে তা একাঙ্গীভূত হয়ে ওঠে। ‘গোলাপজান’-এর এই গীতিকল্পে সোলায়মান যেন সেলিম আল দীনের সেই তত্ত্বকথারই প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত।

যে-সোলায়মান সতত গানের বিচিত্র ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ, পারঙ্গম, তিনি এ নাট্যের কোথাও জনপ্রিয় বহুলশ্রুত হিন্দি গান ছাড়া আর কোনো গান গ্রহণ করলেন না। না রবীন্দ্রনাথ, না লালন, না লোকজ বা নাগরিক আর কিছু। এমনকি গান লিখতে আর সুর করতে যিনি সিদ্ধহস্ত (স্মর্তব্য এস এম সোলায়মানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী, বন্ধু নাট্যনির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদের স্মৃতিচারণ; যেখানে তিনি বলেছিলেন, সোলায়মান এক অসাধারণ সংগীতপ্রতিভা। কোনো একটা নাটকের নির্মাণকালে দৃশ্যের প্রয়োজনে গান দরকার পড়লে সোলায়মান তৎক্ষণাৎ তাকে একাধিক গান লিখে সুর করে শোনাতে পারতেন। কিংবা ‘এক অসমাপ্ত গানের বেদনা’ নামক স্মৃতিচারণমূলক লেখায় নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা মামুনর রশীদের ভাষ্য: ‘কোর্ট মার্শাল’-এর নির্দেশনায় কাজ করার সময় তাকে ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখেছি শেষ দৃশ্যের সংগীতের ভাবনাটা নিয়ে। সুধীরলালের সেই অমর গানকে ব্যবহার করেছিল, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি...’। কী যন্ত্র ব্যবহার করা যায়, গায়কিটা কেমন হবে এই নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না। ‘কোর্ট মার্শাল’ সবটাই সংলাপ। তার মধ্যে সংগীতের ব্যবহারের জায়গা খুবই কম। ঐটুকু ছোট্ট জায়গাতেই সে তাঁর কাজটুকু করে ফেলেছিল।), তিনি নিজেও তার সকল ইচ্ছাকে হয়তো-বা দমিয়েই প্রয়োগ করেন নি নতুন কোনো গান। কারণ পুরান ঢাকার যে জীবনকে তিনি মঞ্চে এঁকে তুলছেন, দৃশ্যকাব্যে, সেখানে হিন্দী গানের প্রয়োগটা একটা মোটিফ হয়ে যায়। সেটা অনেকটাই চরিত্র ও গল্পের সাথে প্রতীকীভাবেই স্থানিক (খড়পধষরংবফ) হয়ে যায়। দর্শক ততক্ষণে ওইসব গানের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে, ওই গানগুলোর মধ্য দিয়েই তারা গোলাপজানের জীবনের নানান অনুভূতির সাথে যুক্ত হয়। সোলায়মান তার নাট্যক্রিয়ায় এমনই সতর্ক যে, সেখান থেকে এক বিন্দু বিচ্যুতি যেন না ঘটে কারুর, সেদিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। কারণ তিনি জানেন, ‘মানুষ শিল্পের মধ্যে চেনা দৃশ্য দেখতে চায়। জীবনের বাইরেকার কোনো ব্যাপারকে জোড়াতালি দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়ার ফাঁকিটা তারা মানতে পারে না। বুদ্ধির দীপ্তির সঙ্গে জীবনের প্রকৃত রূপ-রস-গন্ধ জড়ানো না থাকলেই তা অবাস্তব মনে হয়। মানুষ তুলনা হিসেবে বেছে নেয় সমসাময়িক জীবনকেই। তার হেরফের দেখলেই প্রকৃত দর্শক অখুশি হয়। যাবতীয় মোহিনী আড়াল করে শিল্পের মর্মে পৌঁছতে দেরি হলে দর্শক অস্বস্তি বোধ করে। যে কোনও শিল্পের প্রাথমিক শর্ত এই বোধগম্যতা নির্ভর করে বাস্তবতার ওপর।’ (Political Theatre: Toward the question of reality/ Bertolt Bresht) আর সোলায়মান যিনি কিনা ‘গোলাপজান’ নামের একটি থিয়েট্রিক্যাল মাইলফলক তৈরি করতে যাচ্ছিলেন, এসব সৃষ্টিশীল লোভ-মোহ থেকে তার দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয় বৈকি। হয়তো-বা তিনি ভুলে যান না গ্রোটোওস্কির কথাটি: If you want to create a masterpiece, you must always avoid beautiful lies.

‘গোলাপজান’ পুরান ঢাকার এক নারীর জীবনের বিয়োগান্ত কাহিনি। গোলাপজান তার নাম। রক্তমাংসের এক নারী, এক মানুষ। তারই জীবনের প্রেম,ভালোবাসা, দুঃখ, পীড়ন, ভাঙন, বিরহ নাটকের বিষয়-আশয়। বের্টল্ট ব্রেশট যে বলেছিলেন, ‘থিযেটারে এমন চরিত্রকে নিয়ে নাটক করা হবে, যে তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে হবে উজ্জ্বল। সে কোনো  দার্শনিক বা সমাজ-রাজনৈতিক তত্ত্বের মুখপাত্র হবে না।’ সোলায়মানের ‘গোলাপজান’ এমনই বর্ণাঢ্য, হাস্যলীলাময়ী এক চরিত্র। মোহাম্মদ আবু তাহেরের ‘গোলাপজানের অশ্বারোহন’ নামের একটি গল্প সোলায়মানের এই নাট্যরচনার আখর। ১৯৯৫ সালের ২৮ অগাস্ট তারিখে এ নাটক প্রথম মঞ্চায়িত হয়। এই গল্পের বয়ানরীতি খুব সরল, কোনো জটিলতার মার-প্যাচ এতে নাই। সোলায়মানের নাট্যনির্মাণে এই সহজতার সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। পূর্বপ্রজ মনীষীর উক্তি যেন তিনি বিস্মৃত হন না কোনোদিন। (প্রাচ্যদেশের ক্রিয়া-কর্ম্ম-খেলা-আনন্দ সমস্ত সরল-সহজ।- রঙ্গমঞ্চ/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) বাংলার যে গল্পকথন রীতি তাকে আমলে নিয়েই এ গল্পের বুনন। ইউরোপ মিউজিক্যাল থিয়েটার বলতে যা বোঝে, আমাদের এখানে সাংগীতিক নাট্য বলতে আমরা তাকে বুঝব না। এখানে সংগীত অনেকাংশেই গান। সুরসঙ্গতের চেয়ে এখানে গানের প্রয়োগই আবহ তৈরি করে বেশি। সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের সাথে তর্কবিতর্কের কালে বাণীপ্রধান সংগীতের প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, সংগীতে রাগরাগিণীমাত্রের ব্যবহার শিল্পকলার আদি ব্যাপার। মুখের ভাষা আবিষ্কারের পরে আর সেই ইঙ্গিতাত্মক ভাষায় ফেরার কোনো মানে নাই।
 
এস এম সোলায়মান ‘গোলাপজান’কে একটি তথাকথিত সমাজ-বাস্তবতার সংকট ও ট্র্যাজেডির মধ্যে রেখেই কেবল দেখার চেষ্টা করেন নাই, তিনি একটা প্রবহমান বেদনার আবহের মধ্যে তাকে রেখে এক ধরনের মিথ তৈরিরও চেষ্টা করেছেন। সংবেদনশীল দর্শকমাত্র টের পাবেন নাটক শুরুর সময় থেকে একটা বিষাদকে আবহে রাখা হয়েছে পুরো নাটকে। মক্তবে যখন মৌলভী বা হুজুর ধর্মতত্ত্ব বলেন, তখনও তার কণ্ঠে এক ধরনের উদাত্ত বিষাদের সুর পাওয়া যায় এবং নাটক শুরুর থেকেই আমরা সেই বিষাদকে টের পাই। সেই বিষাদগাথাকে অশ্রুসিক্ত আর জীবন্ত করে তোলেন একজন অভিনেত্রী তিনি রোকেয়া রফিক বেবী। যিনি মঞ্চজুড়ে তার ছন্দময় গীতল শরীরী প্রক্ষেপে, মুহুর্মুহু নানান অভিব্যক্তিতে, আবেদনময় সংলাপ প্রক্ষেপণে অতিক্রম করেন চরিত্রায়নের সকল বাধা, অনায়াসে। তার অভিনয় বাঁধা থাকে না কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে বা পদ্ধতিতে। শিল্পী তো সর্বদাই ছাঁচ ভাঙেন। তৈরি করেন নিজের সংবেদনায় গড়া নিত্য নতুন আদল। (Create your own method. Don't depend slavishly on mine. Make up something that will work for you! But keep breaking traditions, I beg you. - Constantin Stanislavski)
 
গোলাপজান সময়ের কাছে মানুষের পরাজয়ের দৃশ্যকাব্য। গোলাপজানের পরাজয় পরিবর্তিত হতে থাকা সময়ের কাছে সংবেদনশীল মানুষের পরাজয়, যারা এখনো একটি ঘোড়া বা একটি পালিত পশুকে নিজের সন্তানের সমান আদর করতে পারে, নিজের পুত্র ঘোড়ার সাথে দুর্ব্যবহার করলে পুত্রকে গালমন্দ করতে পারে, আর পশুটিকে বিক্রি করার অনিবার্য বেদনায় মুষড়ে পড়তে পারে।
 
‘গোলাপজান’ কেবল একটি জীবিকার সংকট নয়, একটি পরিবার বা একটি জনপদের সংকট নয়, শেষাবধি এক নারীর মৃত্যুর কাছে ঢলে পড়ার আগ পর্যন্ত জীবনের আপাত তুচ্ছ কিন্তু গভীরতর বৃহৎ হৃদয়ের ভালোবাসার অবলম্বনকে নিয়ে বেঁচে থাকার নিষ্ফল লড়াইয়ের গল্প। সেই গল্প সোলায়মান বলেছেন খুবই সরলভাবে। সিম্পলিসিটি  বা সহজতা তার ধর্ম। সোলায়মান মানেন, ‘জটিলতা অক্ষমতারই পরিচয়; বাস্তবিকতা কাঁচপোকার মতো আর্টের মধ্যে প্রবেশ করিলে তেলাপোকার মতো তাহার অন্তরের সমস্ত রস নিঃশেষ করিয়া ফেলে।’ (রঙ্গমঞ্চ/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) অতীত আর বর্তমানের গল্পকথনে আনাগোনার যে খেলা, তা কোনো ক্যারিশমাটিক উপায়ে বা খুব একটা ম্যাজিক্যালি হয়েছে তা বলা যাবে না। বরং ম্যাজিক রয়েছে তার কোরাসের ব্যবহারে, তাদের প্রত্যেকেই গোলাপজানের সহ-অভিনেতা, গোলাপজানের সাথে নানান চরিত্রের ভূমিকায় তাদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়, গানেও কণ্ঠ মেলায় কখনো-বা, কিন্তু তারা কোনো কথা বলে না। সোলায়মানের নাট্যনিরীক্ষার এও এক নতুন ধরন। গোলাপজানের ট্র্যাজেডিকে যেন দর্শকমনে গভীর, একাকী, নিঃসঙ্গ করে গেঁথে দেয়ার জন্য তাদেরকে নিয়ে এমন অদ্ভুত কিন্তু চমৎকার, ডিপ্লোমেটিক এ্যাকটিং ডিজাইন বা অভিনয়কল্প, নাট্য-আঙ্গিকে সে এক ধরনের উপভোগ্য বিবমিষা তৈরি করে। সেই বিবমিষার মধ্য দিয়েই বলা হতে থাকে গল্প।  কিন্তু যে গল্পটা বলা হয়, পুরো যে গল্পের বাঁক, ঘাত প্রতিঘাত, সংকট, বেদনা সবকিছুকে বাঁধা হয়েছে সংগীতের তানেই। অন্য অন্য সাংগীতিক নাটকের সাথে ‘গোলাপজান’-এর এখানেই পার্থক্য।

সোলায়মান যেমন ভোলেন না, সংগীত কেবল শ্রুত স্বর বা সুরের মধ্যে থাকে না, সংগীত থাকে স্বর ও সুরের মাঝখানকার বা দুটি নোটের মাঝখানকার নৈঃশব্দ্যেও। (The music is not the notes but in the silence between. - Mozart) তাই একটি গান থেকে আরেকটি গানে গল্প ফেরি হওয়ার মাঝখানটায় অনাবশ্যক সোলায়মান আবহ সুরের প্রয়োগ ঘটাননি। আমরা বরং গী’ত গানের রেশ এবং গোলাপজানের পরবর্তী অভিব্যক্তির সূত্র ধরে পেয়ে যাই বেদনার দূরাগত সুর। আরবি কবি কাহলিল জিবরান যেমন বলেন, সংগীত আত্মার ভাষ্য (Language of Spirit), ‘গোলাপজান’-এ গানকে সোলায়মান তেমনি গোলাপজান নামের এক নারীর আত্মার সকল অনুরণন-এর সাথে বেঁধে দিয়েছেন।
 
সংগীত বা গান এখানে ইম্পোজড বা এক্সপোজড কিছু মনেই হয় না; গান ও আখ্যান এখানে একাত্ম ,অভেদ। কখনো-বা মনে হয়, এখানে সমান্তরালে দু’ভাবে গল্পটি বলা হচ্ছে। একটি মঞ্চে অভিনয়ে, আরেকটি কেবল নেপথ্যে গী’ত গানের পরম্পরায়। কেবল গানগুলোকে পরপর সাজিয়ে দিলেও একটি সম্পূর্ণ শ্রুতিকাহিনি যেন পাওয়া হয়ে যায়। সোলায়মানের মিউজিক্যাল কারিশমা এমনই!

এ নাটকে গান নাট্যসজ্জার অলঙ্কার নয়, গল্পের বিন্যাসে পরিয়ে দিয়ে তাকে সাজানো হয় নাই। এখানে যা গল্প তা-ই গান, তা-ই আবেগ এবং অভিব্যক্তি।  যেমন- গোলাপজানের স্বামী যখন পঙ্গু হয়ে আসে, এক দৃশ্যের নেপথ্যে উচ্চনাদে ভেসে আসে আবহের সুর। এবং সেই সুর আর্তনাদ করে গোলাপজানের বিপর্যয়ের, বেদনার বিদীর্ণ অন্তরকে প্রকাশ করে। সেই সুর গায়কীতে বা সুর-অভিব্যক্তিতে স্বয়ং কান্না হয়ে যায়। আবার ঘুড়ি খেলার প্রতিযোগিতায় দুই দলের বাদানুবাদ বা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া ইত্যাদি বিষয় কোরাসের গানের সুর দিয়েই প্রকাশ পায়, সুরে সুরে তর্ক বাঁধে, সুরই যেন-বা শ্লোগান, এমনই বাক্সময় সেই সুর।
 
সোলায়মানের ‘গোলাপজান’-এ সংগীত আদতেই আত্মার বয়ান। একেবারে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার বাজার-চলতি গানগুলোকে সোলায়মান কীভাবে দেশীয় প্রেক্ষাপটে দেশের গল্পে দেশের মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে একাত্ম করে ফেললেন, তা যেন কেবল সোলায়মানের ক্যারিশমাই হয়ে থাকে না, তাকে ছাপিয়ে ঘোষণা করে সংগীতের নিজের বিশ্বজনীনতার স্বভাবশক্তিকেও (Powered by nature)। সংগীত যদি হয় আত্মা বা অন্তরের ভাষা, আত্মার কি পরিচয় আছে কোনো? সেই আত্মার ভাষা পেশ করে শিল্প তাকে তো যে-কোনো অঞ্চলের মানুষের সাথে একাত্ম করে ফেলতেই পারে। কিন্তু তাকে নিজের মতো করে যুৎসই চিনে নিতে হয়, সোলায়মান তা পেরেছেন। পেরেছেন বলেই, অন্য একটি ভাষার অন্য সাংস্কৃতিক এলাকার গানকে নিয়ে এসেছেন বাংলার নাট্যজমিনে। চরিত্রের সাথে তার ঐতিহ্যগত স্বতঃস্ফূর্ত সংযোগ ঘটিয়েছেন। বের্টল্ট ব্রেশট বলেছিলেন, নাটকে গানের ব্যবহারে প্রধান শর্তই থাকা উচিত তার সাবলীলতা আর স্বতঃস্ফূর্ততা এবং অবশ্যই চরিত্রানুগত্য। পুরান ঢাকার গোলাপজানকে তার স্থানিক চরিত্রের বিশেষতার সাথে যুক্ত রাখার জন্য নাটকে সোলায়মান হিন্দি গানের সমাহার ঘটিয়েছেন। গানগুলোকে অভিযোজিত করেছেন নাটকের ভিন্ন-ভাষা কিন্তু ভাব-ঐক্যের ঘটনারাশির সাথে। ‘আমিনা সুন্দরী’ কিংবা ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’ অথবা ‘কোর্ট মার্শাল’-এ গল্প অভিযোজনে সোলায়মানের যা পরীক্ষিত।

পুরান ঢাকার লোকের সাথে আচারে চলনে ভারতের দিল্লি অঞ্চলের লোকদের খানিকটা মিল আছে বলে জানা যায়। খাবার-দাবারের মধ্যেও সেই মিল পাওয়া যায়। তারা হিন্দি গান বেশি শোনে। (তথ্যসূত্র: অনলাইন পত্রিকা ‘জাগোনিউজটুয়েন্টিফোর’-এর রিপোর্ট  ‘বদলে যাচ্ছে পুরান ঢাকা, হারাচ্ছে ঐতিহ্য’) সেই সূত্রে ‘গোলাপজান’-এ হিন্দী গান আসতে পারে। কিন্তু সেই গান সোলায়মানের অভিযোজনে বিন্যস্ত হয়েছে নতুন গড়নে, চলনে, আমেজে। ফলে পুরো একটি প্রযোজনায় শতভাগ হিন্দি গান বা অপর ভাষার গান ব্যবহার সত্ত্বেও তা কখনোই বাংলাদেশের কালচারাল হেজিমনিকে উস্কে দেয় বলে মনে হয় না। বরং লক্ষ্য করা গেছে, কী শহরে কী গ্রামে ‘গোলাপজান’ মানুষকে কাঁদিয়েছে, গোলাপজানের সকল বেদনায় ও বিয়োগান্ত পরিণতিতে বিষাদগ্রস্ত হয়েছে দর্শকসমাজ। এর আজোবধি সফল মঞ্চায়নের ধারা সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে বৈকি। সমস্ত প্রযোজনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক বিষাদের সুর বেজেছে সকল সুরের নেপথ্যে। এক জনপদের লুক্কায়িত হাহাকার। গোলাপজানের সকল রঙিন গল্পের বা ঘটনার বাকল খুললে সেই আদি-অন্ত বিষাদকে আমরা পাই। সেই বিষাদ বা করুণ রাগিণীই ‘গোলাপজান’-এর অশ্রুভেজা শিল্পসার্থকতা ও সাফল্য। কেননা, এই দুঃখ/বেদনা/বিষাদ মানবজন্মের চিরায়ত নিয়তি। প্রাচীন গ্রিস তাকে সর্বোচ্চ শৈল্পিকভাবে উন্মোচন করেছিল। একদার তীঘ্ন রাজনৈতিক নাট্যসচেতন সোলায়মান কেনো এমন দুঃখ কিবা বিষাদবিলাসে মাতলেন? মাঝেমধ্যেই নাটকটিতে গোলাপজানের মনোসূত্রে সময়কে দোষারোপ করা, বদলে যাওয়া মানুষের প্রতি অভিমান দেখানো কিংবা ‘ভগবান’ বা বিধাতাকে নিষ্ক্রিয় ‘পাথর’ বলে অভিযোগ করা হলেও তাতে কোনো শ্রেণি-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কথা অনুপস্থিত। ক্ষোভ, অভিযোগ সবকিছুকে ছাপিয়ে নাটকের প্রধান সুরটি বিষাদেরই। তবে, বিষাদ কি ঋণাত্মক বা নেগেটিভ? সোলায়মান কি শিল্পের ইতিবাচকতা বা স্বপ্নের জায়গা থেকে সরে এসে মানুষকে পিছু টানতে চান? না, বিষাদ মাত্র নেতিবাচক বা ঋণাত্মক ভাব নয়। দেখুন এই বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট কী বলছেন? `Sadness is a state of happiness because it is an emotion and emotions allow us to solve problems and solving problems allows us to live as fully as we are capable.’(Sadness is a state of happiness/ Monica A. Frank)- আধুনিক ফ্রেঞ্চ-রোমানিয়ান নাট্যকার আয়োনেস্কোও তারই জয়ধ্বনি করেন। (No society has been able to abolish human sadness, no political system can deliver us from the pain of living, from our fear of death, our thirst for the absolute. It is the human condition that directs the social condition, not vice versa. - Eugene Ionesco). এই দুঃখ বা বিষাদকে জারিত করা তো শিল্পেরই কাজ, এরিস্টোটল যাকে ‘ক্যাথারসিস’ বলেছিলেন। সোলায়মানের ‘গোলাপজান’ সময়ের মানবিক নিষ্ঠুরতার কাছে হার মানা, অসহায়, সর্বহারা মানুষের বেদনার এক অনুপম ক্যাথারসিস।
 
ফরাসি দার্শনিক, শিল্পতাত্ত্বিক দেনিস দিদেরো বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের ট্র্যাজেডি কী, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’ সোলায়মানের ‘গোলাপজান’ দেখে আমাদের মনে হয়, সত্যিকারের ট্র্যাজেডি এত দূরে কোথাও বা আড়ালে নয়, নিকটেই থাকে, তাকে খুঁজে পাওয়ার মন বা হৃদয় থাকতে হয়। আমাদের সোলায়মানের তা ছিল, ছিল বলেই তিনি এক পুরনো সাধারণ শহরের সাধারণতম নারীর জীবন-ট্র্যাজেডিকে আপামর মানুষের কাছে মিথতুল্য এক ট্র্যাজেডি করে ফেলতে পারেন। ‘গোলাপজান’-এর শততম মঞ্চায়ন, হলভর্তি দর্শক, আজোবধি নাট্যামোদীদের অগাধ কৌতূহল সেই সত্যকে দৃঢ় করে বৈকি।
 
চীনা দার্শনিক লাও জু বলেন, সংগীত সেই আত্মার অনুরণন, যা শুনতে পায় নিখিল বিশ্ব। সেই সংগীত যখন সুরের কৈবল্য ডিঙিয়ে গান হয়ে ওঠে, সেখানে কথার প্রাবল্য দেখা দেয়, তখন ধীরে ধীরে তা চিহ্ন লাভ করে, নির্বিশেষ থেকে বিশেষায়িত হতে শুরু করে। থিয়েটার বা নাট্য সেই গান হয়ে ওঠা বিশেষ সংগীতকে নিয়ে কায়কারবার করে থাকে। সোলায়মানের এই নতুন গীতনাট অভিনব। এখানে একটিও নাট্য-উদ্দেশ্যে লিখিত গান নাই।  নাই গানের সুরারোপ। এমনকি অধুনার গল্পে বিধৃত এই নাটকের সাথে গানগুলোর কোনো সৃষ্টিসম্পর্কও নাই। কিন্তু তিনি একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন, গানের এক অভিনব সন্নিবেশের।
 
সৈয়দ জামিল আহমেদের ‘কমলারানীর সাগরদীঘি’’ কিংবা ‘বেহুলার ভাসান’ এবং এ-মতোন ঐতিহ্যানুগামি নবনাট্যে সংগীত প্রধানত ন্যারেটিভ। গান সেখানে কাহিনির অন্তর্গত ভাবের নেপথ্য-বিস্তার নয়, গান সেখানে কাহিনিরই বয়ানবিস্তার। আর সোলায়মানের ‘গোলাপজান’-এ গানের সাথে কাহিনির বা আখ্যানের বয়ানের কোনো সম্পর্ক নেই, তা গল্পের ও চরিত্রের মর্মভাবের বাখান বা ব্যাখ্যা। এর আধুনিক ঐতিহ্যের শক্তি খোদ রবীন্দ্রনাথ। সেখানে গান সততই ঘটনা-নেপথ্যের উৎসার (Subtextual harmony)। কিন্তু সেখানে গান গল্পের ওপর অসতর্ক প্রয়োগে হতে পারে এক ধরনের ভার, বোঝা; সেরকম সম্ভাবনা অনেক নাটকেই আছে, সোলায়মানে তা হয়নি। কারণ সোলায়মান জানেন আমাদের পপুলার আর্ট পারফরমেন্সের মিউজিক কীভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হতে পারে।
 
তিনি সংগীত এবং নাট্যের এই পপুলারাইজেশন বা জনপ্রিয়করণ এজন্য ঘটাতে চান, যেন এই থিয়েটার শেষাবধি মানুষের মনের দুয়ারে পৌঁছায়। কারণ তিনি জানেন মানুষের মন জয় করতে হলে তাদেরকে এমন কিছু দিতে হবে যাতে তারা তৃপ্ত হয়। (To win the people, always cook them some savoury that pleases them. -The Knights/ Aristophanes) এই জনপ্রিয়তার তরিকায় খানিকটা আবেগ থাকতে পারে, থাকতে পারে সামান্য মেলোড্রামাও, কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করার কিছু নেই, কেননা থিয়েটার শেষ পর্যন্ত জনগণেরই শিল্প। যৌথ ও সমন্বিত শিল্প (Composite art) হিসেবে এর অন্যতম দায় জনগণের কাছে (Popular feeling is very often sentimental, muddle-headed, and eminently unsound, but it cannot be disregarded for all that.- Murder in the Mews/Agatha Christie)। বের্টল্ট ব্রেশট বিষয়টাকে ঘুরিয়ে বলেছিলেন তার রাজনৈতিক থিয়েটার বিষয়ক একটি প্রবন্ধে:  যা অধিকাংশ মানুষের ছবি- তাকেই বাস্তবতার প্রতিনিধি বলা চলে। সেই বাস্তবতার সঙ্গে আসলে জনপ্রিয়তার কোনো বিরোধ নেই। অন্যভাবে বললে, যা অধিকাংশ জনগণের কথা, তা-ই জনপ্রিয়। (Political Theatre: Toward the question of reality/ Bertolt Bresht) এবং অবশ্যই নাট্যবিষয়টি হতে হয় কোনো না কোনোভাবে সমসমায়িক জনগণের কোনো একটি অংশের চলমান বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত। বিশ্বখ্যাত থিয়েটার ক্রিটিক কেনেথ টাইনান এমনটাই বলার চেষ্টা করেছিলেন তার এক প্রবন্ধে। (For a story to be loved and appreciated it must be relatable to its audience, in the same manner, for theatre to be relevant, it must have a symbiotic relationship with society. - Kenneth Tynan)

‘গোলাপজান’ এ-সকল জনসামাজিক দায় মেটানোর পরও শেষাবধি এক প্রাণময় আনন্দের নাট্য। গতি, মুদ্রা, অভিব্যক্তি আর গল্পের ভাঙাগড়ার উপকাহিনির মধ্য দিয়ে আমরা মঞ্চে একটি জীবনের বর্ণাঢ্য রূপ দেখতে পাই। ভারতীয় নন্দনতাত্ত্বিক আনন্দ কুমার স্বামী তার ‘রূপদর্পণ’ বইতে এটাকেই বলেছিলেন শিল্পের বিমল আনন্দ (‘নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতির প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে আধ্যাত্মিক মিলনের তুল্য এক ধরনের কালহীন বিমল আনন্দ।’) সোলায়মান তার নাট্যশিল্পে সততই এই বিমল আনন্দকে ঝলমল করে তুলতে চেয়েছেন, সকল অশ্রুকণার ঝিকমিকানো বেদনার চিহ্ন নিয়েও। সেই আনন্দের অন্তর্গত রূপ নান্দনিক, সুন্দর। কেন সে সুন্দর, তা কি সবসময়ই বিশদ ব্যাখ্যা করে বলা যায়? শিল্পী, শিল্পরসিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বলেন, ‘আর্টের মধ্যে রীতিনীতি, চক্ষু-জুড়ানো, মন-ওড়ানো, প্রাণ-ভোলানো ও কাঁদানো গুণ, কিংবা এর যে-কোনো একটা যেমন আর্ট নয়, আর্ট বলেই যেমন সে আর্ট, সুন্দরও তেমনি সুন্দর বলেই সুন্দর।’
 
‘গোলাপজান’ শেষত এইসব সুন্দর, আনন্দ, হাহাকার আর ভালোবাসার এক নাট্য, যেখানে রচিত হয় গানের ভাষার ‘অপরত্ব’কে দূরে সরিয়ে আপন করে নেয়া সাংগীতিক ব্যঞ্জনার এক অভিনব ব্যাকরণ; সোলায়মান তার রচয়িতা। সকল রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বাস্তবতার আড়ালেও অন্তর যেখানে বলে ওঠে:
‘মিলবে যে আজ অকূল পানে
তোমার গানে আমার গানে... ’
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

সেই গানের আত্মাকে বুঝতে পারা সোলায়মান, আপনাকে শরতের একগুচ্ছ কাশফুলের শুভ্র শুভেচ্ছা।

শুভাশিস সিনহা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার-নাট্যনির্দেশক। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য- মণিপুরি থিয়েটার, সিলেট।