Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

৮ম থিয়েটার অলিম্পিকস: দর্শক খরা ও কোটি টাকার অপচয়ের উৎসব

Written by নূনা আফরোজ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

কোটি কোটি টাকার অপচয় শুনে জানি সবাই বিস্মিত হবে, কিন্তু আমি তাই বলবো। ভারতে এবার বসেছিল বিশ্ব থিয়েটারের সবচেয়ে বড় উৎসব থিয়েটার অলিম্পিকসের ৮ম আসর। ভারত, যেখানে নাটকের ঐতিহ্য হাজার বছরের। অবিভক্ত বাংলার প্রথম থিয়েটার শুরু হয় কলকাতায়। কালিদাস, ভবভূতি, শ্রী চৈতন্য থেকে শুরু করে বিনোদিনী, গিরিশ ঘোষ, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, তৃপ্তি মিত্র- বাংলা থিয়েটারের বুকে একেকজন মহীরূহ, পরম পূজনীয়। সেই খ্যাতিমান নট-নটীদের দেশেই হয়ে গেল ৮ম থিয়েটার অলিম্পিকস।

১৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের লালকেল্লায় বর্ণিল এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু ৮ম থিয়েটার অলিম্পিকস এবং শেষ হয় ৮ এপ্রিল। ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে দেশটির ১৭টি শহরে একই সঙ্গে বিভিন্ন মঞ্চে হয় এই আসর। যেখানে বিশ্বের ৩৫টি দেশের ৪৬৫টি নাটকের ৬০০টি প্রদর্শনী হয়।

এক নাগাড়ে দিল্লিতে ৭টি মঞ্চে প্রতিদিন ৪/৫টি করে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। দিল্লিতে ৫১ দিনে সর্বমোট ১৬১টি নাটক মঞ্চস্থ হয়। এছাড়া চেন্নাইয়ে ১৮ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি মোট ১০ দিন, থিরুবান্তপুরমে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ মোট ১০ দিন, ভুবনেশ্বরে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ মার্চ মোট ১৫ দিন, কলকাতায় ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ মোট ১৫ দিন, ব্যাঙ্গালোরে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ মোট ৭দিন, পাটনায় ৩ থেকে ৭ মার্চ মোট ৫ দিন, আগরতলায় ৭ থেকে ১৬ মার্চ মোট ১০ দিন, গৌহাটিতে ১১ থেকে ২৫ মার্চ মোট ১৫ দিন, বারনসিতে ১১ থেকে ২৫ মার্চ ১৫ দিন, ভূপালে ১৪ থেকে ২৮ মার্চ ১৫ দিন, ইম্ফলে ১৬ থেকে ২৬ মার্চ মোট ১১ দিন, জয়পুরে ১৮ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল ১১ দিন, আহমেদাবাদে ২৪ থেকে ৭ এপ্রিল ১৫ দিন। দিল্লি ছাড়া অন্যান্য শহরে প্রতিদিন একই সাথে ২/৩টি মঞ্চে ২/৩টি করে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রায় ২৫০টি যুব নাট্যদল মঞ্চের বাইরে তাদের নাট্য কৌশল প্রদর্শন করেছে। সর্বমোট ৪৬৫টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার নাট্যশিল্পী ও নাট্যকর্মী অংশগ্রহণ করেছে এবং ১৭ জন নাট্যবিশেষজ্ঞ ও সমালোচক অংশগ্রহণ করেছে এই আসরে।

থিয়েটার অলিম্পিকস এর প্রথম আসর ১৯৯৫ সালে গ্রিসে, ১৯৯৯ সালে জাপানে, ২০০১ সালে রাশিয়ায়, ২০০৬ সালে তুরস্কে, ২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায়, ২০১৪ সালে চীনে, ২০১৬ সালে পোল্যান্ড এবং এবার, ২০১৮ তে ভারতে। থিয়েটার অলিম্পিকস-এর প্রতিটি আসরের একটা থিম থাকে। ১৯৯৫ সালে প্রথম থিয়েটার অলিম্পিকস-এর থিম ছিল ‘ট্র্যাজেডি’। ১৯৯৯ সালে ছিল ‘ক্রিয়েটিং হোপ’, ২০০১-এ ছিল ‘থিয়েটার ফর পিপল’, ২০০৬-এ ছিল ‘বিয়ন্ড বর্ডারস’, ২০১০-এ ছিল ‘লাভ এন্ড হিউমিনিটি’, ২০১৪-এ ছিল ‘ড্রিম’, ২০১৬-তে ছিল ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড হ্যাজ এ প্লেস ফর ট্রুথ’ এবং এবার ২০১৮-এর ৮ম থিয়েটার অলিম্পিকস এর থিম ছিল ‘ফ্ল্যাগ অফ ফ্রেন্ডশিপ’।

এই রকম একটি মহা উৎসবে বাংলাদেশ থেকে ৮টি প্রযোজনা নিয়ে ৮টি নাট্যদল অংশগ্রহণ করেছে (১টি নৃত্যনাট্য বাদে)। বিবর্তন যশোর, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, প্রাঙ্গণেমোর, সুবচন নাট্য সংসদ, প্রাচ্যনাট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ফেইম স্কুল অব ডান্স ড্রামা এ্যান্ড মিউজিক ও থিয়েটার (নাটক সরণি)। এই উৎসবে যোগদান করতে পেরে আমরা নিজেদের নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান মনে করছি।

কিন্তু আমরা যারা থিয়েটার করি তাদের মূল আনন্দ কোথায়? মূল তৃপ্তি কোথায়? বিশেষ করে বাংলাদেশে যারা থিয়েটার করি, তারা তো দিনের পর দিন শ্রম দেই বিনা পয়সায়, মনের আনন্দে। এই বিনা পয়সার শ্রম আমরা কোথা থেকে উসুল করি? উসুল হয় কি আদৌ? হ্যাঁ হয়, যখন কানায় কানায় হলভর্তি দর্শক দেখি, তখন উসুল হয় বৈকি। এ এক অপার আনন্দ! আজকের এই কঠিন সময়ে বিনা পয়সার শ্রম সার্থক হয় দর্শকের চোখের কোণে একটুখানি ভালোলাগা দেখে। প্রশ্ন উঠতে পারে, যেসব দেশে থিয়েটার করে শিল্পীরা সম্মানী পান, হলভর্তি দর্শক দেখে তারা কি আনন্দ পান না? নিশ্চয়ই পান। কিন্তু দর্শকখরায় আমাদের প্রাণ যেমন তীব্রভাবে হাহাকার করে ওঠে, তাদের বোধকরি তেমনটা হয় না। তো এই ৮ম থিয়েটার অলিম্পিকস-এর আয়োজনে কোনো কিছুরই ঘাটতি ছিল না, এই এক দর্শকঘাটতি ছাড়া। যে তুখোড় অভিনেতা দেবশংকরের নামে রঙ্গমঞ্চ দর্শকপরিপূর্ণ হয়ে যায়, সেই দেবশংকর অভিনীত ‘ধর্মাশোক’ নাটকে শুনেছি মাত্র ৯ জন দর্শক হয়েছিল, তাও আবার দিল্লিতে। ভাবতে অবাক লাগে! এতো বড় একটা থিয়েটার আসরের কর্তাব্যক্তিরা দর্শক সমাগম কীভাবে হবে ভাবলেনই না!

তাহলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের এই আয়োজনে লাভ কী হলো? জানি না কার কী মনে হয় কিন্তু আমার কাছে তখন ফাইভ স্টার/ থ্রি স্টার হোটেলে থাকা, প্লেনে যাওয়া-আসা, প্রতি ’শো বাবদ ভারতীয় টাকায় দেড় লক্ষ টাকা সম্মানী পাওয়া- সব মূল্যহীন হয়ে যায়। আমি বলছি না দর্শকের হার সব রজনীতে এমনই ছিল। আমার নিজের দল প্রাঙ্গণেমোর-এর ‘ঈর্ষা’ প্রদর্শনীতে আগরতলায় ৮০% দর্শক ছিল এবং দিল্লিতে ১৫০-এর মতো দর্শক ছিল। আমাদের এইটুকু দর্শকও নিজেদের চেষ্টায় পেয়েছি। কারণ, যাবার আগেই খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে জেনেছি এই দর্শক সংকটের কথা। তখন আমরা নিজেদের উদ্যোগে দর্শক ঘাটতি যেন না হয় সেই চেষ্টা করেছি। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নাটকের প্রদর্শনী করার কারণে দিল্লিতে আমাদের নাটকের কিছু বাঙালি দর্শক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এবং দিল্লিতে আমাদের কিছু নাট্যবন্ধুও তৈরি হয়েছে। তারমধ্যে দিল্লির গ্রীণরুম থিয়েটারের অঞ্জন কাঞ্জিলাল, মহুয়া দাশগুপ্ত, সুমনা কাঞ্জিলাল অন্যতম। যারা আমাদের হয়ে নাটকের প্রচার করেছেন, দর্শক এনেছেন। তো বলছিলাম দিল্লির বাইরে অন্য শহরগুলোতে তবু কিছু দর্শক পাওয়া গেছে কিন্তু দিল্লি, যেটা কিনা ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি)-র শহর, সেই শহরে দর্শকের পরিসংখ্যানটা ৯/১০০/১৫০ এর উপরে যেতে পারলো না? দু’একটি নাটকে এর বেশি দর্শক যদি হয়ে থাকেও তা ভালো নাটকের বিবেচনায় নয়, সৌভাগ্যক্রমেই হয়ে গেছে হয়তো।

যাই হোক, এতো বড় একটা আয়োজনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, ভারত সরকারের থিয়েটার নামক এই ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প মাধ্যমটির প্রতি তাদের উদার প্রেমেরই পরিচয় বহন করে। একই সঙ্গে এনএসডি নাট্যমনস্ক সৃজনশীল কারিগর তৈরির একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এবং এই প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হওয়া কারিগররা নানাভাবে, নানা জায়গায়, নানা প্রক্রিয়ায় থিয়েটারের কাজের সাথে যুক্ত রয়েছে। এছাড়াও এনএসডির ত্রিপুরাসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে রয়েছে শাখা প্রতিষ্ঠান। সমগ্র ভারত জুড়ে এনএসডি এ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ছড়িয়ে থাকা সদস্যদের নিয়ে মূল প্রতিষ্ঠান দিল্লির এনএসডির যে সাংগঠনিক শক্তি বা কাঠামো সে কারণেই এতো ব্যাপক কর্মযজ্ঞের আয়োজন সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। তাই থিয়েটারের এমন একটি বিশাল আয়োজনের আসরকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। যেখানে ১৫/২০টি নাটক নিয়ে একটি উৎসব করতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে বিশ্বের ৩৫টি দেশের ৪৬৫টি নাটকের ৬০০টি প্রদশর্নী চারটিখানি কথা নয় সেটাও সত্য।

তবু... তবু থিয়েটারে দর্শকই মূল শক্তি, প্রেরণা- সে কথা ভুললে চলবে না। থিয়েটারের উৎসবের মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত দর্শক সমাগম। এবং কীভাবে, কী প্রক্রিয়ায় সেটা সম্ভব সবকিছুর আগে সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।

নূনা আফরোজ: অভিনেতা ও নির্দেশক। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ‘প্রাঙ্গণেমোর’।