Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নির্মাণে সুবচন নাট্য সংসদের ‘তীর্থঙ্কর’

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[নাটকের লোক মাত্রই জানেন যে, একটি পাণ্ডুলিপি হাতে নেয়ার পর মঞ্চায়ন পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত ঐ পাণ্ডুলিপির উপস্থাপন পরিকল্পনায় ঘটে নানা শৈল্পিক সংগ্রাম। নির্দেশক-সহ প্রত্যেক অভিনেতৃগণ ও সংশ্লিষ্ট শিল্পীগণ তাদের পরিবর্তনশীল মননশীলতার প্রকাশ ঘটান নাটক নির্মাণে। তাদের ভেতর চলে নাটকটি নিয়ে শিল্পভাবনার নানা আদান-প্রদান। নির্মাণপর্বের যে পথ-পরিক্রমা, সেই পথ-পরিক্রমায় একটি দলকে মুখোমুখি হতে হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের, নানা সংকটের। এ-সব সংকটের ভেতর দিয়েই একটি নাট্যদল দর্শকের সামনে আনে তাদের নতুন নাটক।

সুবচন নাট্য সংসদ, ঢাকা, মঞ্চে আনছে তাদের নতুন নাটক ‘তীর্থঙ্কর’। নাটকটি মহাকবি ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র ‘সোহরাব রোস্তম’ আখ্যান অবলম্বনে রচিত। লিখেছেন দলের সদস্য সামিনা লুৎফা নিত্রা আর নির্দেশনা দিচ্ছেন ফয়েজ জহির (আরণ্যক নাট্যদলের সদস্য)। থিয়েটারওয়ালা’র আয়োজনে নাটকটির নির্মাণপর্বের নানা শৈল্পিক ভাবনা-চিন্তা নিয়ে আড্ডায় বসা হয়েছিল। আড্ডায় ছিলেন- নাটকটির নাট্যকার সামিনা লুৎফা নিত্রা, নির্দেশক-মঞ্চ-আলোক পরিকল্পক ফয়েজ জহির, আছাদুল ইসলাম আসাদ, আলী হায়দার লিটু, আহম্মদ গিয়াস এবং সঙ্গীত পরিকল্পক আহসান হাবীব নাসিম। আড্ডায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন থিয়েটাওয়ালা সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার।

নির্মাণপর্বের এই আড্ডাটি পাঠকদের জন্য অনুলিখন করে প্রকাশ করা হলো বর্তমান সংখ্যায়। আড্ডাটি সুমন নিকলী কর্তৃক অনুলিখিত- সম্পাদক]

হাসান শাহরিয়ার
গিয়াসভাইকে দিয়ে শুরু করি, সুবচন নিয়মিত নাটক করে থাকে, তারই ধারাবাহিকতায় এই নাটক হাতে নিয়েছেন। আমি যদ্দুর জানি, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য হিসেবে- সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুদানে এই নাটকটি করা হচ্ছে। এই নাটককটি করার সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলেন?

আহম্মদ গিয়াস
মামুনুর রশীদের ‘রাষ্ট্র বনাম’ মঞ্চে আনার পর আমরা শেক্সপীয়রের ‘টুয়েলভথ নাইট’ মঞ্চে এনেছিলাম। ‘টুয়েলভথ নাইট’ নামানোর পর, আপনারা জানেন যে, আমাদের দলের প্রাণপুরুষ এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, আরজুভাই মারা গেলেন- আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। দু’বছর আগে... জুন মাসে আরজুভাই চলে যাবার পর স্বাভাবিকভাবেই সংগঠনে একটা হতাশা কাজ করছিলো। প্রায় স্থবির অবস্থা তৈরি হয়েছিলো। এটাকে কাটিয়ে তোলার জন্য আমরা নানা রকমের আয়োজন করেছি, উৎসব করেছি। তারপরতো একটা নতুন নাটক করতেই হয়- তো সেসময়েই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুদান পেলাম। প্রথমবার ঢাকার চারটি দলকে পঁচিশ হাজার টাকা করে অনুদান দিলো নাটক করার জন্য, তারমধ্যে আমরা একটি দল। তো যেহেতু অনুদান পেয়েছি নাটক করতেই হবে, তাছাড়া এমনিতেও নাটক করতে হবে আামদের, নিয়মিত নাটক প্রযোজনার জন্য, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর নতুন নাটক করার কথা আমাদের। তো তারপর আমরা কাজ শুরু করলাম। মামুনভাইয়ের (মামুনুর রশীদ) একটা স্ক্রীপ্ট নিয়ে। আমরা বেশ কিছুদিন মহড়া করার পর আমাদের সাংগঠনিক কিছু সমস্যার কারণে নাটকটি আর হয়ে উঠলো না। এরপর মামুনভাই চিন্তা করতে লাগলেন যে আমাদের নিয়ে কী করা যায়। জহিরভাই, আমি আর মামুনভাই- আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিলো কোন ধরনের নাটক করা যায়। তখন মামুনভাই বললেন, ‘সোহরাব রোস্তম’ করা যায় কিনা দেখো। কিন্তু সোহরাব রোস্তম কে লিখবে? এর আগে ‘টুয়েলভথ নাইট’ নাটক যেটি করেছি আমরা, শেক্সপীয়রের, সেটি অনুবাদ করেছে নিত্রা এবং আসাদ। সেই সময় মামুনভাই নিত্রাকে কিছুটা জেনেছে, নিত্রার লেখা সম্পর্কে, নিত্রার ভাবনা সম্পর্কে জেনেছে। মামুনভাই উৎসাহ দিলেন। বললেন- নতুন একটি নাটক লিখতে গিয়ে তোমাদের দলের কাউকে নাট্যকার হিসেবে এস্টাবলিস্ট করা যায় কিনা। তো খুব ক্রাইসিসের মধ্যে পড়লাম। নিত্রার সাথে ফোনে কথা বললাম। পরে মামুনভাই নিত্রাকে নাটকটি কিভাবে দাঁড় করাতে হবে সে সম্পর্কে একটি ধারণা দিলেন। দেয়ার পর নিত্রা তার কাজ শুরু করলো এবং যথারীতি একটা জায়গায় দাঁড় করালো। একটা সময় দেখলাম যে, নিত্রা স্ক্রীপ্টটা কমপ্লিট করেছে। করার পর মামুনভাইকে আমরা পড়ে শোনাবো কি শোনাব না ভাবছি। তখন আমরা চিন্তা করলাম যে মামুনভাইকে আমাদের দলের সমস্ত কর্মীদের সামনে স্ক্রীপ্টটি পড়ে শোনাবো।

তারপর ২৬ জানুয়ারি ২০০১, শুক্রবার, মামুনভাই আসলেন। মামুনভাইয়ের সামনে স্ক্রীপ্টটি পড়া হলো। মামুনভাই খুবই উৎসাহ দিলেন নিত্রাকে, সাথে আমাদেরও। বুঝলাম এই নাটকটি করা যায়। নাটকটি নির্দেশনা দেয়ার দায়িত্ব আমরা সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জহিরভাইকে দিলাম। দলে নানান ধরনের ক্রাইসিস তো থাকেই, আপনারা জানেন, শুধু আামদের দলের নয় সব দলেরই। দশ বছর আগে যাদের নিয়ে শুরু করেছিলাম এই সংগঠনের কাজ, তাদের মধ্যে আমার সহকর্মী দু’একজন আছে, প্রতিনিয়ত চেইঞ্জ হচ্ছে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কর্মী আসছে, যে সমস্যাটা সব দলেই থাকে। এই নাকটটি যাদেরকে নিয়ে শুরু করেছিলাম তাদের মধ্যে আজকে প্রথম দিনের থেকে ৪/৫ জন কর্মী অনুপস্থিত যারা শেষ পর্যন্ত অভিনয়ে থাকতে পারলো না। তো নাটকটি করার উদ্দেশ্য, নাটক থেকে মূল যে পাওয়া, তা হলো, আমাদের একজন নাট্যকার তৈরি হলো। ফয়েজ জহিরভাই ঢাকায় ‘বাঙলা থিয়েটার’-এর ‘মানুষ’ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। মুন্সিগঞ্জে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তারপর আমাদের দলে নাটকের নির্দেশনা দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে একটা নতুনত্বের স্বাদ ও কিছু প্রাপ্তি এই নাটকটিতে পাবো।

হাসান শাহরিয়ার
নিত্রাকে বলছি যে, নাট্যকার হিসেবে তো আপনার একেবারেই প্রথম কাজ। আমি স্ক্রীপ্টটাও পড়লাম। তো এই স্ক্রীপ্ট-এর বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলো একটু বলুন।

সামিনা লুৎফা নিত্রা
প্রথম শুরু করি ‘শাহনামা’ দিয়েই। ‘শাহনামা’কে নাট্যরূপ দেয়ার চেষ্টা ছিলো, যদিও আমার মনে এই প্রশ্ন সব সময় ছিলো যে- কেনো? মানে, ‘সোহরাব রোস্তম’ কেনো? আরও অনেক কিছুই তো আছে। আমি প্রশ্নটা প্রথমদিনই করেছিলাম। প্রথমেই মামুনভাইকে বলেছিলাম, কেনো এটার কথা বলছেন? মামুনভাই আমাকে যেটা বলেছিলেন তারপর সেটাই বোধহয় সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা হলো, আমরা আসলে প্রতিনিয়তই আমাদের প্রজন্ম হত্যা করার সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি করে রাখছি। নিজে হত্যা করি না, কিন্তু হত্যা হচ্ছে অথচ প্রতিবাদ করি না। আর এমন সব কাজ করি আমরা, যার কারণে আগামী প্রজন্মের জন্য জীবনটা আসলে মৃত্যুর সমান। সে জায়গাটা ধরে রেখে চেষ্টা করেছিলাম ‘শাহনামা’কে নতুনভাবে ভেঙে বের হয়ে যাবার। প্রথম যে স্ক্রীপ্টটা আমরা মামুনভাইয়ের সামনে সবাই পড়ি সেটাতে এই অবস্থাটা ছিলো না। এই ক্ষেত্রে যেটা না বললেই নয় সেটা হচ্ছে যে, জহিরভাই এবং আমি স্ক্রীপ্টটা নিয়ে কিছু কাজ করেছি। তারসাথে আমার একটা খুব বোঝাপড়া ছিলো। ইন্টেলেকচুয়াল বোঝাপড়ার ফলেই এই আইডিয়াটার সূত্রপাত হয়। আমরা দু’জন মিলেই কথা বলছিলাম যে সোহরাব রোস্তম হিরো এবং আমাদের ইতিহাস সবসময় হিরোদেরকেই হাইলাইট করে কিন্তু হিরোদের মধ্যে কতটুকু মনুষ্যত্ব, কতটুকু অমানবিকতা কিংবা সাধারণ মানুষরা আসলে এদের সাথে কোথায় লিংক করে এটা আমরা বুঝি না, দেখি না কোথাও। সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে আনার চেষ্টা থেকেই আসলে যে চারজন গল্পটা বলছে (নাটকের চরিত্র হিসেবে চারজন তীর্থঙ্করের কথা বলা হচ্ছে) তাদেরকে আনা হয়েছে। এই নাটকটা প্রতিনিয়ত ডেভালপ করেছে। আসলে এই স্ক্রীপ্টটা ২৬ জানুয়ারি যা ছিলো, আজকে সেখানে নেই।

হাসান শাহরিয়ার
সেদিক থেকেই আমি বলতে চাচ্ছি যে, স্ক্রীপ্ট-এর যে রচনারীতি, রচনারীতিটা কিন্তু... মানে, স্ক্রীপ্ট তো একটা পাঠ্য বিষয়ও হবে, সে জায়গাতে বোধহয় স্ক্রীপ্টটা যায়নি। স্ক্রীপ্টে ডিরেকশনের কথাও কিন্তু আছে। ডিরেকশন আপনি দিয়ে দিয়েছেন যে, অমুকে আসলো ক্লান্ত হয়ে বা এই ধরনের... তাহলে কিন্তু আপনি নির্দেশককে ডমিনেট করছেন। রাইটার বলে দিচ্ছে যে ডিরেকশনটা এরকম হবে। তাহলে কিন্তু এখানে দ্বিতীয় একজন ডিরেকটরের দরকার পড়ে না। ডিরেকশনটা আপনিই দিতে পারতেন যেহেতু এখানে লেখাই আছে। কিন্তু আধুনিক যে চিন্তা, নাট্য রচনারীতির ব্যাপারে, সেটা হচ্ছে যে, আপনি আপনার ভাব প্রকাশ করবেন নাটকের মাধ্যমে, যা হবে পাঠ্য। আর নির্দেশক সেটাকে রূপ দেবে দৃশ্যকাব্যে। মানে আপনি যেমন কবি, তেমনি নাট্য নির্দেশকও কিন্তু কবি। তো সেক্ষেত্রে আপনি যদি বলে দেন যে, চরিত্রটি এভাবে প্রবেশ করবে... তারপর ক্লান্ত হয়ে নিচু হয়ে বসবে... লাইট পড়বে তার উপর... ইত্যাদি ইত্যাদি... তাহলে কিন্তু নির্দেশকের কবি হওয়ার পথে বাধা আসবে। কবিতাটা লিখে দিয়েছেন আপনি কিন্তু নির্দেশক আপনার বাইরে কিছু একটা চিন্তা করার সুযোগ থাকতে হবে...

সামিনা লুৎফা নিত্রা
এখানে একটা কথা হচ্ছে যে, সব জায়গায় কিন্তু ঐ ব্যাপারটা মানা হয়নি.... মানে প্রথম স্ক্রীপ্ট লেখার সময় যেসব জায়গায় মনে হচ্ছিল যে মঞ্চে এভাবে আসবে... বা মানে এটা হচ্ছে যে, আমার মনে হচ্ছিলো যে এভাবে করলে ভালো হবে। কিন্তু নির্দেশক কিন্তু পুরোপুরি মানেননি...

হাসান শাহরিয়ার
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাইতো কথা যে আপনার স্ক্রীপ্টে যেভাবে আছে, সেখানে কিন্তু নির্দেশককে নির্দেশনা দেয়ার ব্যাপারটা আছে, যেটা আামদের সমস্ত স্ক্রীপ্টেই থাকে।... ঐ উইংস দিয়ে ঢুকলেন বা... আলো নিভে গেলো, অন্ধকার চলে আসলো... এগুলো কিন্তু একজন নির্দেশকের চিন্তাকে অনেকটা বাধাগ্রস্ত করে।

ফয়েজ জহির
আমি কিন্তু মানিনি...

হাসান শাহরিয়ার
হ্যাঁ, আমি যখন মহড়া দেখলাম, আপনাদের কয়েকটা দৃশ্য দেখলাম সেখানে কিন্তু মনে হচ্ছে যে নির্দেশক নিজের মতো করে করছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে স্ক্রীপ্টে তাহলে এভাবে নির্দেশনার আভাস দেয়ার প্রয়োজন আছে কি?

আহম্মদ গিয়াস
আসলে পাণ্ডুলিপি যখন তৈরি হয়... নাটক যখন তৈরি হয়, তখন একজন নাট্যকার লিখছেন একা... একা মানুষ, তার ভাবনা সে ট্রান্সলেট করে তুলে ধরেন কাগজে কলমে। তো এটা যখন নির্দেশকের হাতে চলে যায়, তখন এটা প্রাণ সঞ্চারের জায়গায় চলে যায়। নতুন করে এটাকে ভাঙতে হয়। নির্দেশক এখানে কলমের মানুষগুলোকে জীবন্ত দেখতে পায়। এই জীবন্ত মানুষগুলোর আচার-আচরণ বা চলাফেরা, কথা বলা, হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা এগুলোকে নিয়ে আসতে আসতে আসলে স্ক্রীপ্টের জায়গাটা কিন্তু থাকে না। একটা নতুন জায়গা তৈরি করে ফেলা হয়। একটা নতুন জায়গা তৈরি করে ফেলা হয় বলেই... আমার মনে হয় যে যতই নাট্যকার লিখে দিক... ‘ক্লান্ত হয়ে আসে’ বা ‘ক্লান্ত হয়ে প্রবেশ করে সোহরাব’... ইত্যাদি ইত্যাদি, সেটা মানা কিন্তু নির্দেশকের সম্ভব হয় না।

হাসান শাহরিয়ার
সেজন্যই আমি বলতে চাচ্ছি যে, একজন নাট্যকার হিসেবে যেহেতু নিত্রা গড়ে উঠছেন... সেখানে আসলে তিনি কী প্রকাশ করতে চান সেই জিনিসগুলোকেই তুলে ধরবেন, মঞ্চে নির্দেশক কী করবেন সেটা নির্দেশকের ব্যাপার। নাট্যকারের না বলাই ভালো যে এরপর এটা করাটা উচিত... ইত্যাদি। একজন আধুনিক ডিরেক্টর নিজের মতো করে কবিতা সৃষ্টি করবেন।

আহম্মদ গিয়াস
এবং এই নাটকটি করতে এসে... জহিরভাইয়ের সাথে কাজ করতে গিয়েও দেখলাম যে... আপনি যেটা ধরলেন যে... প্রথমে নিত্রার যে ডিরেকশন লাইনটা লেখা ছিলো জহিরভাই ইনটেনশনালিই হোক অথবা কী কারণে জানি না নিত্রার ডিরেকশন লাইনটা কিন্তু ফলো করেননি। উনি ভেঙেছেন....

হাসান শাহরিয়ার
আধুনিক নাটকতো সেখানেই চলে গেছে... আসলে ডিরেক্টর তো একজন শিল্পী। যাক, আমরা অন্য কথায় আসি। নিত্রা, সোহরাব রোস্তমের কাহিনীতো সবারই জানা... তো আমরা জানি যে কাহিনীতে এর পরিণতি কী। এই ঐতিহাসিক সত্যকে কিন্তু আপনি লুকোতে পারবেন না। তাহলে দর্শকের জানার বাইরেও আপনাকে নতুন কোনো বোধ দিতে হবে যেন সে দু’ঘন্টা পর এই অনুভূতি পায় যে, আরে... এই ব্যাখ্যায় তো আমি আগে যাইনি! তো সেই নতুন বোধ সৃষ্টির জায়গাটাতে গেলেন কিভাবে?

সামিনা লুৎফা নিত্রা
এটা আসলে... আমরা যখন কথা বলছিলাম... তখন আমাদের আলোচনায় আসে যে, সোহরাব রোস্তম কিন্তু আমাদের বক্তব্য না, তারা আমাদের মাধ্যম। আমরা প্রত্যেকেই কোন দিকে যাচ্ছি? আমার নাটকে চারটি চরিত্র আছে তারা আসলে এমন চারজন মানুষ যারা অনেক দূর থেকে দেখছে... নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তো তারা আসলে জীবনের পথ চলা চলছে... এই নির্মোহ মানুষেরা আমাদের এইসব সংকট, জীবনের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত এগুলোকে... এবং এই সমরতন্ত্র, যুদ্ধবাদী নেতা, ক্ষমতার লোভ... এগুলোকে অনেক ক্রিটিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ব্যাখা করার চেষ্টা করছে। এটাইতো দিতে হবে আমাদের। সোহরাব রোস্তমের কাহিনী হাজার বছর ধরে সবাই জানেন। অনেকদি ধরেই তো সবাই জানেন... আমরা প্রত্যেকে ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছি এবং সবাই জানি কী ঘটেছিলো, জানি এর পরিণতি। আজকে আমাদের প্রত্যেকের এভাবে ভাবা দরকার যে, কিভাবে আমরা প্রত্যেকে প্রতিনিয়ত এই ঘটনাগুলো ঘটিয়ে যাচ্ছি এবং ভালো, মন্দ, ন্যায়, অন্যায় বা... একটা কোনো ডিভাইডিং লাইন তো আছে.... সেই ডিভাইডিং লাইনটা এরা চারজন তুলে ধরছে। হয়তো তারা এমন কিছু মানুষ যারা আসলে এই পুরো জায়গাটাকে দূর থেকে দেখে ক্রিটিসাইজ করতে পারে।

আহম্মদ গিয়াস
আসলে দুইমাস পর্যন্ত আমাদের প্রায়ই সমস্যা হচ্ছিলো যে, এ গল্পটি তো সবার জানা... তাহলে কিভাবে এটাকে সবার সামনে উপস্থাপন করবো? তো নাটকের শেষে একটি কথা আছে- ‘এই গল্পের সোহরাব রোস্তম নিয়তি তাড়িত, আমরাও যেন তাই। এই ক্ষমতার লড়াই, যুদ্ধবাজী আর ঘৃণ্য হত্যার রাজনীতিতে আমাদের নিয়তি নির্দিষ্ট করে ফেলছি। হয় মারো নয়তো মরো’- এই কথাগুলোই টোটাল নাটকের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

ফয়েজ জহির
সোহরাব রোস্তমের জীবনটাকে... জাস্ট জীবন থেকে ওদের বিভিন্ন কার্যক্রমকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আসলে, আমরা যেটা করেছি...

হাসান শাহরিয়ার
এই স্ক্রীপ্ট এনালাইসিসটাতে আপনি গেলেন কিভাবে?

ফয়েজ জহির
আমরা গল্পটাকে ছেড়ে দিয়েছি... ছেড়ে দিয়ে চাচ্ছিলাম যারা পারফরমেন্স করবে বলে ভাবছে তারা পরস্পরের সাথে গল্পটা বলুক, তারা ফিল করুক, কোথায় আজকে কে কী বলছে। পুরো স্ক্রীপ্টটা প্রথমে পড়া হলো বেশ কয়েকবার ওদের সামনে, বলে দেয়া হলো যে, এই গল্পটা আমরা আগামীকাল বলবো, প্রত্যেকেই গল্পটা বলবো। একটা ডিটেইল বর্ণনা দিয়ে... যেমন বিল্ডিংয়েরে রঙটা কী ছিলো, আকাশের রঙটা কেমন ছিলো, গাছের পাতার রঙটা কিরকম ছিলো, ঘাসের কী রঙ ছিলো... ইত্যাদি ডিটেইল বর্ণনা করে গল্পটা বলা হলো। এই যে বর্ণের এভাবে বর্ণনা করতে করতে ওদের যাওয়া- এই যাওয়াটা ওদের আলোড়িত করেছে, ভাবিয়েছে, ওদের মনে হয়েছে ওরা ফিল করতে শুরু করলো।

সুবচনের কর্মীদের নাটক কিভাবে গড়ে ওঠে তা দেখা আছে। এই নাটকে আমরা দেখলাম স্ক্রীপ্ট কিভাবে বেড়ে ওঠে। একদম প্রথম আমাদের যে অবস্থা ছিলো... আমরা যারা স্ক্রীপ্ট পেয়েছি... মনে হয়েছে যে স্ক্রীপ্ট ভালো হয়েছে। এটাই হবে... জাস্ট সোহরাব রোস্তমের ইতিহাস, সোহরাব হচ্ছে হিরো, রোস্তম হচ্ছে হিরো, আর কিন্তু কেউ ছিলো না। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা নিজেরাই আলাপ আলোচনা করে প্রত্যেকদিন কিছু পরামর্শ দিচ্ছি, পরেরদিন নাট্যকার সেই জায়গাগুলো আবার নতুনভাবে লিখলো। এই স্ক্রীপ্ট তৈরির পাশাপাশি নাটক তৈরি, দুটোই একসাথে চললো এবং সুবচনের সবাইও পাশাপাশি চলছে। নাটকটা প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে, ইভেন গত পরশুরও দু’একটা ডায়লগ নতুন ইনক্লুড করেছে।

হাসান শাহরিয়ার
তারমানে যে জায়গাটায় একটু টোকা দিচ্ছিলাম যে, আসলে একটা টেক্সট যদি থাকে, একটা বিষয় যদি থাকে, তারপর বাদবাকীটা কিন্তু টোটাল ওয়ার্কের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই কাজটা হয়েছে যে আপনি টোটাল ওয়ার্কে গেছেন এবং অনেক চিন্তা ভাবনা ওদের উপরও ছেড়ে দিয়েছিলেন?

ফয়েজ জহির
এটা জরুরি ছিলো। কারণ আমি ভাবছি যে এভাবে আগানো উচিত। দেখি তারা কিভাবে ভাবছে, আমার পারফরমাররা কিভাবে ভাবছে, কিভাবে দেখছে আসলে এই পাণ্ডুলিপিটাকে বা এই গল্পটাকে কিভাবে দেখছে... তাদের মতো করেই বর্ণনা করছে। মনে করছি যে সবাই আমরা কন্ট্রিবিউট করছি।

হাসান শাহরিয়ার
আপনারও তো একটা আইডিয়া ছিলো যে আপনি কী করবেন। এই কনসেপ্টটা একটু তো থাকে যে এই জিনিসটা আমি নামাবো, এগোবো কী করে? কিন্তু এই নাটকে কেবল প্রি-কনসেপশন নিয়েই থাকেননি, আপনিও ইনফ্লুয়েন্সড হয়েছেন ওদের চিন্তা দ্বারা...

ফয়েজ জহির
হ্যাঁ, হ্যাঁ।

আহম্মদ গিয়াস
আমি একটু বলি এখানে, আসলে স্ক্রীপ্টের শুরুতে আমরা সবাই মিলে যখন কাজ করছি তখন আমাদের লক্ষ্যটা ছিলো যে, আমরা কিভাবে নক করবো, সমাজে কিভাবে নক করবো, কিংবা নাট্যাঙ্গনে কিভাবে নক করবো। বা নাটকটা নিয়ে আমরা আসলে কোথায় যাবো। মানে আমরা এই পয়েন্ট-টা খুঁজতে খুঁজতে... তীর্থঙ্কর, মানে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে এসেছি। এরাই আসলে পৌঁছে দিবে। দু’টা সমান্তরাল কাল পর্ব। অতীতের ঘটনাটা আর বর্তমানে ঘটনাটা। বর্তমান কিভাবে রিলেট করবে স্মৃতির সাথে আবার অতীত ঘটনাগুলো কিভাবে বর্তমানকে বিদ্ধ করছে... এই দু’য়ের সমন্বয় করার জন্যই আমরা তীর্থঙ্করদের নিয়ে এসেছি এখানে। আমরা মনে করি যে, নাটকের কেন্দ্র বিন্দুটা হচ্ছে তীর্থঙ্কর। এদের মধ্য দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটছে, এরাই ঘটনাটাকে ব্যাখ্যা করছে, এরাই আবার পৌঁছে দিচ্ছে। ওরা আলোড়িত হচ্ছে, আবার ঐটাকেই আমরা সম্প্রসারণ করছি সমাজের মধ্যে কিংবা আমাদের দর্শকের মধ্যে। আমরা আমাদের মেসেজটা বা দর্শনটা কিংবা আমাদের আবেগটা, বক্তব্যটা পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।

হাসান শাহরিয়ার
এই ডিজাইনটা কি আবিষ্কার করা হলো? মানে আপনারা একত্র হয়ে অনুসন্ধান করতে করতে বের করলেন?

আহম্মদ গিয়াস
আমাদের মনে হচ্ছে যে মানব জন্মের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত যে মানুষরা এসেছে ইট ইজ আ জার্নি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, আমরা সেই জার্নিটাকে চারটি মানুষের মধ্যে নিয়ে এসেছি। এই বর্তমান সময়ের কাল ও স্থানকে এনে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে এই চারজন মানুষের মাধ্যমে।

সামিনা লুৎফা নিত্রা
এরা বর্তমানের কথা বলেনি, এরা তো আসলে বর্তমানের না। ওরাই আসলে বিশ্ব। ঐটাই কিন্তু তাদের তীর্থ- চলাটাই তাদের তীর্থ।

হাসান শাহরিয়ার
নাটকের নাম ‘সোহরাব রোস্তম’ না হয়ে ‘তীর্থঙ্কর’ হলো কিভাবে?

আলী হায়দার লিটু
শুরুর থেকে একটু বলে নিই... শুরুতে নাট্যকার এবং নির্দেশক ওপেন করে দিয়েছিলেন যে, আমরা নামটা কী রাখতে পারি? আসলে নামটা নিয়ে আমরা একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। নাটকের নাম যদি ‘সোহরাব রোস্তম’ হয়, তাহলে এর আলাদা একটা শক্তি পাওয়া যাবে। এই নামের মাধ্যমে আমরা দর্শক আকৃষ্ট করতে পারবো। নাটকের মধ্যে টেনে নিয়ে আসতে পারবো... এই ধরনের একটা ভাবনা ছিলো। এমনকি সবার কাছ থেকে নাম আহ্বান করা হয়েছিলো, সেখানে আমিও নাম জমা দিয়েছিলাম। আমার ভাবনা ছিলো ‘রোস্তম সোহরাব’। ‘রোস্তম সোহরাব’-এর ব্যাপারে আমার ব্যাখ্যা ছিলো যে, এই যে নামের শক্তি, এই শক্তিটা দিয়ে যদি দর্শককে টানতে পারি তাহলে আমরা অন্তত কিছুটা লক্ষ্যে এগোতে পারবো।

আহম্মদ গিয়াস
ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র ‘সোহরাব রোস্তম’ ভেঙে ‘রোস্তম সোহরাব’। প্রি-টেকনিক্যাল-এর পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম যে ‘রোস্তম সোহরাব’ নামটা থাকুক।

সামিনা লুৎফা নিত্রা
প্রি-টেকনিক্যালের সকালেও ছিলো ‘রোস্তম সোহরাব’। পরবর্তী সময়ে হঠাৎ আমি জহিরভাইকে গিয়ে বললাম- জহিরভাই আমরাতো সাধারণ মানুষদের কথা বলতে চাচ্ছিলাম, আমরাতো হিরোদের কথা বলতে চাচ্ছিলাম না। তাহলে কেনো নাটকের নাম হিরোদের নামে দিলাম?

ফয়েজ জহির
অনেক ইন্টারেস্টিং নাম কিন্তু এসেছিলো।

এ প্রসঙ্গে একটু বলি। আসলে ঘটনাটা ছিলো ট্র্যাজেডির নায়কদের মহান, মহৎ বা মহত্বম, সর্বশ্রেষ্ঠ, এভাবে দেখা হয়। কিন্তু আমরা নাটক বা স্ক্রীপ্ট দাঁড় করিয়ে দেখলাম যে, আমরা আসলে ট্র্যাজেডির গল্প বলতে আসেনি, আমরা বলতে এসেছি ঘটনার যে চরিত্রগুলো, সেগুলো কিভাবে আমাদের দ্বন্দ্ব, একটা সংঘাতের মধ্যে... একটা সংকটের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায়গুলো খোঁজার একটা চেষ্টা করছি, কিভাবে আমরা...

সামিনা লুৎফা নিত্রা
ট্র্যাজেডিগুলোতে বেসিক্যালি দেখানো হয় যে, নিয়তি তাদেরকে এই দিকে ধাবিত করে। আমরা বলার চেষ্টা করি যে নিয়তি না, হয়ত আমাদের নিজেদের লোকই আমাদেরকে...

আছাদুল ইসলাম আসাদ
হ্যাঁ, নিজেদের কর্মফল।

সামিনা লুৎফা নিত্রা
ঠিক। তারাওতো মানুষ, তাদের ভিতরকার ঘাটতিগুলোর জন্যই তারা ঐ নিয়তি, ঐ দিকে ধাবিত হয়। সেজন্যই হিরোদের নামের পরিবর্তে পরবর্তী সময়ে আমরা নাটকের নাম ‘তীর্থঙ্কর’ রাখার সিদ্ধান্ত নিই।

হাসান শাহরিয়ার
কনটেন্ট-এ আমরা আবার আসবো। আমি নির্দেশকের কাছে যাচ্ছি। জহিরভাই, ক্যারেক্টার ডিসট্রিবিউশন... আপনি আগেও ডিরেকশনের কাজ করেছেন... এখানে কে কোন চরিত্রে অভিনয় করবে, এই সিদ্ধান্তগুলো শুরুতে নিশ্চয়ই নিতে পারেননি। চরিত্র বন্টনের প্রক্রিয়াটা কিভাবে এগুলো? কিছু দ্বন্দ্ব থাকতে পারে যে আপনি একটা ভালো ক্যারেক্টার একজনকে দিতে চেয়েছেন কিন্তু সে ইররেগুলার, তাই তাকে দিয়ে করাতে পারেননি... মানে, এই ধরনের কিছু সমস্যায় হয়তো-বা পড়েছেন।

ফয়েজ জহির
এই সংকট তো আছেই...

হাসান শাহরিয়ার
আছে বলেই জানতে চাচ্ছি, কিভাবে এই সংকট কাটিয়ে উঠলেন?

ফয়েজ জহির
কাজটা খুব কঠিন। কারণ হচ্ছে আমি জানি যে, আমি একটা নাটক যখন পাঠ করি তখন স্ক্রীপ্টের একরকম অবয়ব থাকে, অভিনেতৃগণের একধরনের ইমেজ থাকে। শেষে আমি যখন তাকে টেনে আনতে যাই যে, আপনি দাঁড়ান তখন তো ভিন্ন অবয়ব বা ইমেজ তৈরি হয়। এই যে অবয়বটা দাঁড়ায় সেখানে কাকে আমি আসলে চুজ করবো? কষ্টকর প্রক্রিয়া। এখানে, এই নাটকের বেলায় যেহেতু আমি একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছি, সেজন্য চুজ করার ব্যাপারে আমি আগে থেকেই সতর্ক ছিলাম এবং অবহিত ছিলাম, কে আমাকে বা দলকে ভোগাতে পারে আর কে পারে না। তারপরও পছন্দ করে যে আমি কোনো ক্যারেক্টর দিবো, তাতেও সংকট আছে। এক হচ্ছে, এই নাটকে যতগুলো চরিত্র তারচেয়ে এ দলের সদস্য বেশি কিন্তু তারা আবার সবাই নিয়মিত নন। নিয়মিত নন বলে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি যে, সে নিয়মিত নন, তবুও তাকে দিয়ে অভিনয় করাতে হচ্ছে। দেখা গেছে যে কিছু কিছু জায়গা বাধ্য হয়েই ছাড় দিতে হয়েছে।

হাসান শাহরিয়ার
অনেক ছাড় দিয়েই একজন কর্মীকে নিয়মিত বলা হয়। যেমন লেট করলেও যেহেতু সে আসে, তাই সে নিয়মিত। প্রত্যেক দলেরই এ এক দুর্ভাগ্য। যাক, জহিরভাই এখানে আপনি যাদের দিয়ে কাজটা করাচ্ছেন, পারফরমারদের কথা বলছি, আপনি কি মনে করেন যে, এই দলের জন্য এটাই হচ্ছে বেস্ট কম্বিনেশন?

ফয়েজ জহির
এছাড়া উপায় ছিলো না...

হাসান শাহরিয়ার
অন্য দলের কথা বাদ দিন। সুবচনে কাজ করতে হবে... তো এই সুবচনের এই প্রযোজনার জন্য এটাই বেস্ট কম্বিনেশন কি না?

আছাদুল ইসলাম আসাদ
মানে চরিত্রগুলো যদি... মানে, রোস্তম কিংবা সোহরাব যে অভিনেতা করছে, তারা ছাড়া যদি অন্য কেউ ক্যারেক্টরটা করতো তাহলে কি আমরা আউটপুট-টা বেশি পেতাম কি না?

ফয়েজ জহির
হ্যাঁ, সেটা হয়তোবা ছিলো। যদি তীর্থ যাত্রীদের বা তীর্থঙ্করদের একজন হিসেবে নিত্রাকে নিয়ে আসা যেতো এবং সেখানে তহমিনা চরিত্রটি (তহমিনা চরিত্রে নিত্রা অভিনয় করছে) অন্য কাউকে দিয়ে যদি করানো যেত, তাহলে হয়তো একটা বেটার রেজাল্ট পাওয়া যেতো। এটা পারিনি বলে তীর্থঙ্করদের দলটা একটু কম শক্তিশালী হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমাদের কিছু লিমিটেশন তো আছেই। আমরা যতোই চাই না কেন যে একটি দলের সদস্যরা সবাই ভালো হবে, সবাই দক্ষ হবে, আদতে তা হয় না। তাই কিভাবে চরিত্র বন্টন করলে ব্যালেন্স একটা টিম তৈরি করা যাবে সেদিকে নজর দিতে হয়।

হাসান শাহরিয়ার
নিত্রাকে তীর্থঙ্করদের দলে নেয়ার চেয়ে তহমিনা চরিত্রে রাখাটাই বেটার কম্বিনেশন মনে হচ্ছে, তাই না? ঠিক আছে। একটু জানতে চাই যে, ক্যারেক্টর ডিস্ট্রিবিউশন যখন হয়ে গেল তখন অভিনেতৃগণের সাথে আপনার লেনদেনটা কোন প্রক্রিয়ায় করলেন, মানে আপনি কতটুকু ভাবলেন এবং অভিনেতৃ এই ভাবনায় আপনাকে কতটুকু সহযোগিতা করলেন? অর্থাৎ নির্দেশক-অভিনেতা ও নাটকের চরিত্র, এই তিনের কেমিস্ট্রিটা কিভাবে এবং কতটুকু ঘটলো?

আলী হায়দার লিটু
আসলে প্রথমদিকে আমরা যখন স্ক্রীপ্টটা পড়ি, আমার মনে হয়, আমাদের দলে যারা আগের নাটকগুলোতে একটু ভালো কাজ করেছে, তাদের প্রত্যেকের টার্গেট ছিলো একটাই যে, ‘তীর্থঙ্কর’-এর প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করবো। আমারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা ছিলো... ‘হায়রে আমাকে তীর্থঙ্কর কেনো দিচ্ছে না’। তারপর আমার টার্গেট ছিলো ‘রোস্তম’ করবো, ‘রোস্তম’ও আমাকে দেয়া হলো না। শেষে আমাকে দিলো ‘সোহরাব’ চরিত্রটি। এটা অবশ্য আমার নিজের দোষ, নিজের দোষ এই কারণে যে, আমি আমার চাকুরিগত কারণে এক সপ্তাহ ঢাকার বাইরে থাকি এবং এক সপ্তাহ ঢাকায় থাকি। তো ‘সোহরাব’ যখন আমাকে দেয়া হলো তখন আসলে আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম... ‘সোহরাব’ নিয়ে আমি কী করবো? প্রথমদিকে আমি খুব একটা ক্লিয়ার ছিলাম না সোহরাবের চরিত্রটি কেমন। তীর্থঙ্করদের ডায়লগগুলো বলে যে মজা আছে, আনন্দ আছে, সোহরাবের ডায়লগে এই মজাটা, এই আনন্দটা নেই... আমার কাছে এখনও মনে হয় এবং এই নাটকের স্ক্রীপ্টের সমালোচনা যদি করি, তাহলে এই সমালোচনাটা করবো... এটা আমি নাট্যকারকেও বলেছি যে, চরিত্রগুলোর সংলাপ এত দুর্বল কেনো? তীর্থঙ্করদের সংলাপগুলো খুব ভালো, আমার কাছে অন্য চরিত্রগুলো কেমন যেন... একদম... মানে নরমাল আরকি। তো সোহরাবের সংলাপে নিজেকে তৈরি করা আমার কাছে খুব কঠিন মনে হয়েছে। আমি যখন রোস্তমের ডায়লগ শুনি বা সোহরাব হিসেবে যখন নিজের ডায়লগ বলি, তখন আমরা কাছে মাঝে মাঝে মনে হয় যে এটা মনে হয় ঠিক আছে। কিন্তু ডিরেক্টর যখন আবার ব্যাখ্যা করেন যে আপনি এভাবে করলেন কিন্তু বিষয়টা যদি এভাবে হতো... তখন দেখলাম যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। পুরো রিভার্স মনে হচ্ছে... ডিরেক্টর যা বলছে তা একদম অন্যরকম। তখন যেটা হচ্ছে কী ঐ ডিরেক্টরের সংলাপকে যখন আমি ধারণ করতে যাই, আমার পিছনের যে জায়গাটা, সেটা আবার নষ্ট হয়ে যায়। তখন সেই জায়গাটাকে ধারণ করে আমার পিছনের জায়গাটা আবার ঠিক করতে হয়... মানে খুব কঠিন মনে হয়।

হাসান শাহরিয়ার
মানে এভাবেই আপনার প্রি-কনসেপশনের কিছু ছাড় দিতে হচ্ছে এবং ছাড় দিয়ে ডিরেক্টরের ভাবনাটাকে ধরতে হচ্ছে এবং...

আলী হায়দার লিটু
এবং যখন একটা সংলাপ বলবো তখন প্রতি মুহূর্তেই দেখছি যে ডিরেক্টরের ধারে কাছে আমি নেই। ডিরেক্টর অন্যভাবে ভাবছে... বলছে যে, এই এই জায়গায় ভয়েজটা যদি এরকম হতো তাহলে আপনার কেমন লাগতো? তো আমি দেখলাম যে, আগের যে সংলাপ সেই সংলাপ থেকে আমার এ সংলাপে আসা মানে... কঠিন ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। তবে এখন হচ্ছে না, এখন আস্তে আস্তে নরমাল হয়ে আসছে। আমার যেটা করতে হচ্ছে সেটা হলো আগের জায়গাটাকে চেইঞ্জ করতে হচ্ছে।

হাসান শাহরিয়ার
আছাদুল ইসলাম আসাদ, আপনি অভিনেতা হিসেবে আপনার ক্যারেক্টার এনালাইসিস কিভাবে করলেন, সেই জায়গা থেকে একটু বলুন।

আছাদুল ইসলাম আসাদ
নাটকের শুরুতে আমার ক্যারেক্টারটা সৃষ্টি হয়নি। নাটকে শুরুতে অন্যান্য চরিত্রগুলো বের হয়ে আসতে আসতে আমার চরিত্রটা আসে। তা নাটকের মূল বক্তব্যের সাথে আমার ক্যারেক্টারটা সন্নিবেশিত। এই ক্যারেক্টারটা হচ্ছে নির্মোহ জগতের প্রতি একটু নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার চেষ্টা... মানে দূর থেকে দেখা, কিন্তু ঘটনা প্রবাহের সাথে যাওয়া। মানে অন্য ঘটনাগুলো সংক্রামিত করবে... মানে, অন্য সবাই যেভাবে সংক্রামিত করে চরিত্রকে, হয়ত সেভাবেই সংক্রামিত করে। কিন্তু সে নিরপেক্ষভাবে ঐ ঘটনাটা দেখার চেষ্টা করে। ব্যক্তি হিসেবে না, ব্যক্তি থেকে বাইরে নৈর্ব্যক্তিকভাবে, যার কারণে ক্যারেক্টারটা ঐভাবে আসে না... মানে, আমরা এই চরিত্রগুলোকে এভাবে দেখি না... মানে বাস্তবে দেখি না। কিন্তু ঘটনাটাকে আবার বাস্তবতার পক্ষে রূপ দিয়ে আমরা চরিত্র নির্মাণ করছি। সেই চরিত্রে আমরা, তীর্থঙ্কররা, যখন পরস্পর কথা বলছি তখন এক রকম, আবার যখন তীর্থঙ্কররাই ঘটনাটা দেখছে বা অবলোকন করছে তখন আরেক রকম। ঐ ঘটনা থেকে আরোহন করে নিজেদের মধ্যে আরেকটা সমালোচনা, বিতর্ক, নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে একটা জায়গায় যাওয়া। এই ক্ষেত্রে নির্দেশক আমাদের বলেছে যে, আপনি কিভাবে জড়িত হবেন? আপনি আপনার চরিত্রের একটা সংলাপ দেয়ার পর, সেখানে আরোহন করবেন এবং তারপর আপনি অনুভব করবেন, খোঁজবেন, জায়গাটা খোঁজবেন। এরফলে আপনার মধ্যে যদি কোনো ক্রিয়া হয়, তবে আপনি সেভাবে প্রতিক্রিয়াটা করবেন। ফলে বিষয়টা খুবই... মানে কঠিন, আমাদের জন্য, কারণ আমরা বেশির ভাগ হয় কী... আমরা কেউ কারো সংলাপ শুনি না...

হাসান  শাহরিয়ার
অর্থাৎ অ্যাকশন হবে, তারপর রিয়েকশন। যেন অভিনয়ে কেবল মুখস্ত বিদ্যা না থাকে। ব্যাপারটা ফিল করে আপনি বলবেন। এখন সেখানে পৌঁছানোর জন্য কো-অ্যাক্টর-এর দায়িত্বওতো রয়ে গেলো যে, আপনাকে ফিল করাতে হবে।

আলী হায়দার লিটু
আমাদের একটা সমস্যা আছে, আমরা খুব হাই স্কেলে অ্যাক্টিং করতাম। মানে আমাদের দলের ‘রাষ্ট্র বনাম’ ছাড়া প্রত্যেকটা নাটকে... ‘টুয়েলভথ নাইট’ এবং ‘খানদানী কিসসা’য় খুব হাই টোনে অ্যাক্টিং করতাম। যেখানে ঐ সংলাপের গভীরে যাওয়া খুব সমস্যা ছিলো। ইনার অ্যাক্টিং-টা আমাদের খুব কম ছিলো। এই নাটকের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা পারফরমারের ইনার অ্যাক্টিং-টা ডেভালপ করেছে।

হাসান শাহরিয়ার
এই ক্ষেত্রে আমি জহিরভাইকে বলছি, আপনিতো নির্দেশকের পাশাপাশি এই নাটকের কস্টিউম এবং সেট ডিজাইনার। আমি দু’টো বিষয়ে একটু জানতে চাই, আমাদের এখানে সাধারণত দেখা যায় যে অভিনেতৃগণ যার যার নিজস্ব ডিজাইন নিয়ে অর্থাৎ যাকে যে কস্টিউম দেয়া হলো, সে সেটা নিয়েই ব্যস্ত। এবং সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে পারফরমাররা জানেন না যে টোটাল মিনিংটা কী? একজন কো-অ্যাক্টরের সংলাপ যেমন ফিল করার ব্যাপার আছে, ঠিক তেমনি অন্যের কস্টিউম ডিজাইন এবং সার্বিক সেট ডিজাইনের ব্যাপারটাও কিন্তু ফিল করতে হবে। তো সেক্ষেত্রে আপনি ডিজাইন সম্পর্কে কতটুকু ধারণা দিয়েছেন? নাকি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে?

ফয়েজ জহির
চাপিয়ে দেয়ার বিষয় না। আসলে আদান প্রদানের বিষয়টা যদি বলি, একটা প্রসেসের মধ্যে আমাদের কাজ চলছে। এরা প্রতিদিন দেখছে... আমি চাচ্ছি যে ওরা কৌতূহলী হয়ে উঠুক সবাই। ওরা যদি কৌতূহলী হয়ে ওঠে তবেই তো তারা জানতে পারবে আমি...

সামিনা লুৎফা নিত্রা
সেট-এর যে জায়গাটার উপর আমি হাঁটছি, তা কেনো এইরকম সে-ব্যাপারে আমার কিউরিসিটিটা থাকতে হবে। না হলে আমি একজন নাট্যকর্মী হিসেবে...

ফয়েজ জহির
আমি প্রথমে ব্যাখ্যা দেইনি যে, এই এই কারণে করেছি। আমি তাদেরকে ভাবাতে চেষ্টা করেছি যে, এই কালার কেনো, এটা এভাবে আসলো কেনো, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এটা আমি বলবো না যে খুব সততার সাথে সবাই কাজটি করেছে।

ডিজাইনের ক্ষেত্রে একটা বিষয় আছে, আমরা যেহেতু নাটকের কোথাও সময়টাকে বা ভাবনাটাকে নির্দিষ্ট করিনি, কোনো একটা বিশেষ জনপদের রাখতে চাইনি, তাই এসব ডিজাইনের ক্ষেত্রেও, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর মিশ্রণ চলে এসেছে। এটা কিন্তু সবার সাথে শেয়ার করেই করেছি।

হাসান শাহরিয়ার
যতটুকু মহড়া দেখলাম তাতে দেখছি সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে আপনি তো রিয়েল কিছু ব্যবহার করছেন না...

আহম্মদ গিয়াস
ইন্টারেস্টিং যে জহিরভাই বলেছেন, যার বাসায় যা আছে নিয়ে আসবেন। আমরা যে যা পেয়েছি... একজন লাঠি নিয়ে আসছে, কেউ কৃষকের মাথায় যে পড়ে... পাৎলা বা মাথাল, ওটা নিয়ে এলো... মানে, পরে দেখা যাবে জাহিরভাই কী রাখবে না রাখাবে...

ফয়েজ জহির
জাস্ট পারটিসিপেশন। সেই লাঠি আর পাৎলা বা মাথাল কিন্তু এখন এই নাটকের প্রধান প্রপস।

হাসান শাহরিয়ার
পুরো সেট ডিজাইনেও কি এমন করা হয়েছে?

ফয়েজ জহির
সেট ডিজাইনটা অবশ্য এভাবে করা হয়নি। তবুও চেষ্টা করা হয়েছে কোনো একজনকে নির্দিষ্ট করে কোনো কিছুর ডিজাইনার করার চেয়ে, শেয়ারিং-টা বেশি করা।

হাসান শাহরিয়ার
মহড়ার সময় মিউজিকের একটা জায়গা শুনলাম, সেখানে কিন্তু আরব্য সুরের ব্যবহার বোধহয় করেছেন।

ফয়েজ জহির
না, সুরের কিছু কিছু জায়গায় আমরা মধ্য প্রাচ্যের ম্যান্ডেলিন ব্যবহার করছি, যেহেতু ঐ টোন-টা ঐ রকমই, তাছাড়া অন্য কোথাও... আসলে যেটা হচ্ছে যে, যেহেতু ‘সোহরাব রোস্তমের’ গল্পটা ঐ অঞ্চলের... কোনো না কোনোভাবে দর্শক কিন্তু ঐ অঞ্চলে চলে যেতে চায়। তবে আমরা হয়তো-বা বাধাগ্রস্ত করছি কখনও কখনও।

মিউজিকের ক্ষেত্রে আরো দু’টা কথা বলি... জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান নিয়ে এলো নাসিরুদ্দিন নাদিম, এই দলেরই একজন সদস্য। নিয়ে আসার পর বললো যে, এই গানটা ব্যবহার করা যায় কিনা। আমি প্রথমে বলেছিলাম শুরুতে একটা গান মিউজিক বা হামিং বা কিছু একটা দিয়ে শুরু করতে পারি কিনা। আহসাব হাবীব নাসিম, যিনি আমাদের সংগীত পরিকল্পক, বললো যে, এই গানটি বোধহয় দেয়া যেতে পারে। আমরা শুনলাম... হ্যাঁ, এই গানটি নাটকের সাথে যায়... কিছু শব্দ নিয়ে আমাদের মতদ্বৈততা আছে কিন্তু তারপরও আমরা ব্যবহার করছি। আছাদুল ইসলাম আসাদ, আবুল হাসানের একটি কবিতা নিয়ে বললো এটাকে সুরে ফেলা যায় কি না? নাসিমকে বললাম... সুর করোতো ভাই, দেখেতো এটা যদি যায় তাহলে ভালো। সে কাজ করেছে খুব এবং কষ্টও করছিলো। একটা কবিতাকে গানের জায়গায় নিয়ে যাওয়া... আবার প্যারোডি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো। সুতরাং ঐ জায়গাটিকে রক্ষা করা, নাটকের এই মুহূর্তটাকে যেন ভেঙে না দেয়, নষ্ট করে না দেয়, না দিয়েই যেন এটাকে আরও বেশি শক্তিশালী আবহ তৈরি করতে পারে...

আহম্মদ গিয়াস
সেকারণেই প্ল্যান করা হলো... ঢোল আছে, খোল আছে, ডুগি তবলা আছে...

ফয়েজ জহির
মিউজিকের ক্ষেত্রে, যখন তীর্থঙ্করদের বেলায় মিউজিক যায় তখন কিন্তু পাশ্চাত্যের কোনো বিষয় নাই, কিন্তু যখন রোস্তম, সোহরাব, তহমিনা এদের মিউজিকটা দরকার হয় তখন কিন্তু আবার আমরা আমাদের পার্সীয় মিউজিকে চলে গেছি।

হাসান শাহরিয়ার
আচ্ছা আমি কনটেন্ট নিয়ে আর একটু বলছি, মহড়ায় কিছু কিছু জায়গা দেখে এবং সংলাপ শুনে আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, দর্শককে ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। ঐ সময়ের ঘটনার সাথে আজকের বিশ্বের কী কী মিলে যায়, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে। আমি খোলামেলাভাবেই বলতে চাচ্ছি যে, দর্শক একটা জিনিস দেখে বুঝে নেয়া আর কোনো একজন ব্যক্তি এসে দর্শককে বুঝিয়ে দেয়া... আমার মনে হয় এটা দর্শকের চিন্তাশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করা বা অনেকটা হেয় প্রতিপন্ন করা।... দর্শক বোধহয় বুঝবে না, এই জন্য আমি বুঝিয়ে দিলাম যে, ‘এই’ কিন্তু তখনকার সময়ের ‘ঐ’। তখনকার সময়ের ‘ঐ’ যদি আমি দেখে না বুঝি তাহলে কেউ আরোপিতভাবে বুঝিয়ে দেয়া... এটা খুব একটা পজেটিভ মনে হয় না।

আহম্মদ গিয়াস
আমাদের এই নাটকটিতে কি এরকম জায়গা আছে কোথাও?

হাসান শাহরিয়ার
এমন কিছু কিছু আমার মনে হয়েছে... যেমন যুদ্ধের কথাগুলো, এ যেন আজকের যুগের ভিয়েতনাম... ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফয়েজ জহির
আমি একটু বলতে চাই, যদিও এটা নিত্রা ভালো বলতে পারবে হয়তো.... আমি বলতে চাই... যেমন, যখন বলা হচ্ছে আসাদ সাহেবের কথা...  সম্রাট আসাদ সাহেবের স্বর্ণমূর্তি দেয়া হবে তুরানের নগরে নগরে; তখন কিন্তু...

সামিনা লুৎফা নিত্রা
এটা কিন্তু সাদ্দাম হোসেনকেই বলা হচ্ছে।

আহম্মদ গিয়াস
না না সাদ্দাম হোসেনকে না।

সামিনা লুৎফা নিত্রা
মানে সাদ্দাম হোসেন থেকে আনা হয়েছে। মানে আমরা বলছিলাম যে... আজকের খবরের কাগজে কী আছে যা তুমি আমাদের নাটকের সাথে রিলেট করতে পারো। এভাবে জিনিসগুলো এসেছে...

ফয়েজ জহির
কিন্তু আমরা কোনো নাম মেনশন করিনি। তীর্থঙ্কররা নিজেরা বলে, আমরা দর্শককে বলছি না।

হাসান শাহরিয়ার
তীর্থঙ্কররাতো কোনো যুগের না, তারাতো সব যুগকেই দেখবেন। সুতরাং রিলেট করার দরকার আছে কি?

ফয়েজ জহির
হ্যাঁ, ওরা বলে যে আমরা দেখি আমাদের এই চারপাশে এই রকম, আমরা ধারণা করি...

সামিনা লুৎফা নিত্রা
ব্যাখ্যাটা কিন্তু করা হচ্ছে এখানে হিট করার জন্য।

হাসান শাহরিয়ার
আপনি যে কথাটা বলছেন, দর্শককে হিট করার জন্য... দর্শকতো নাটকটা দেখেই বুঝতে পারার কথা।

ফয়েজ জহির
শাহরিয়ার আপনার কথায় আমার কোনো আপত্তি নেই। বিষয়টা হচ্ছে, আমি যদি বলতাম... দেখুন শেখ হাসিনার নামে যুবকেন্দ্র হয়েছে, এই হয়েছে সেই হয়েছে...  তখন বলা যেতে পারতো যে দর্শকদের সরাসরি বলছি।

হাসান শাহরিয়ার
এটা যখন বলছেন তাহলে আমি বলি যে, অ্যাক্টিং লাইনটা আবার একটু দেখবেন। আমার মনে হয় সংলাপটা এভাবে বলে যে, মনে হয় এটা দর্শক বুঝবে না, তাই একটু বুঝিয়ে দিলো। আপনি একটু দেখতে পারেন যে... তাহলে কি পেস যেটা দিচ্ছে সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। মানে সংলাপের কোথায় কতটুকু এম্ফেসিস দেয়া হবে তার উপরতো মিনিং নির্ভর করে। যখন শো করবেন তখন হয়তো একটু সিরিয়াস থাকতে হবে যেন মিনিং-টা ঠিক থাকে।

ফয়েজ জহির
ঠিক আছে। নাটকে সোহরাব রোস্তমকে যে অন্যভাবে দেখালাম সেই জায়গায় কিন্তু আমরা পরিষ্কার। সোহরাব রোস্তম প্রত্যেক দেশেই আছে। কিন্তু এই বোধটাই একজন সাধারণ দর্শকের নেই। সোহরাব রোস্তম যে প্রত্যেক দেশে দেশে আছে আমার কাছে মনে হয়...

আহম্মদ গিয়াস
দর্শকের বোধ নেই একথাটা বলা যাবে না।

ফয়েজ জহির
বোধ না আমি বলতে চাচ্ছি...

হাসান শাহরিয়ার
সোহরাব রোস্তম এর গল্প দর্শক জানে। সেই জানা ঘটনাই দর্শক দেখতে আসবে, আর কোনো ব্যাখ্যা নিজেরা খুঁজে নেবে না, এটা ধরে নিলেই কিন্তু ক্ষতি হয়ে যাবে। দর্শক কিন্তু বুঝে যাচ্ছে আপনি কী দেখাতে যাচ্ছেন এবং এই জন্যই আমি বলছি যে, আপনি যদি মনে করে থাকেন যে দর্শক বুঝছে না, তাহলে আপনি কিন্তু তাকে বোঝাতে চেষ্টা করবেন এবং আপনার অ্যাক্টিং লাইনটা তখন এভাবে থ্রো করবেন।

সামিনা লুৎফা নিত্রা
এটা প্রথমেই আমি আপনাকে একটু বলতে চেয়েছি যে, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে যে, দর্শক হয়তো ক্লিয়ার থাকে না যে আমরা কেনো ‘সোহরাব রোস্তম’ করছি...

ফয়েজ জহির
মনে করুন যদি... পাণ্ডুলিপির কথাই বলি... অন্য কেউ যদি ‘সোহরাব রোস্তম’ নাটকটা লিখতো বা করতো, তাহলে কি এভাবেই ভাবতো? আমরা যেভাবে ভেবেছি পুরো ডিজাইনটাও সেভাবে হবে। অ্যাক্টিং লাইনটা দেখে যেন বোঝা যায় যে, আমরা কী চাচ্ছি।

আছাদুল ইসলাম আসাদ
দর্শককে আমরা বোঝাতেই যদি যেতাম তাহলে এই ক্যারেক্টর... এই কোরাসগুলো এভাবে আসতো না। কোরাসের দ্বন্দ্বগুলো কিন্তু অন্তর্গত। ওদের নিজেদের মধ্যে আসছে এবং সংক্রামিত করতে চাচ্ছে না।

হাসান শাহিরিয়ার
সেজন্যই, যখন আপনি সংলাপ দিবেন দর্শককে বুঝতে হবে যে এটা অন্তর্গত সংলাপ।

আহম্মদ গিয়াস
অন্তর্গত ভাবটা তাদের কাছে যেন সঞ্চারিত হয় সেটাইতো আমরা চাই। আমার অভিনয়টা দর্শক বুঝে নিবে, আমার যন্ত্রণাও দর্শক বুঝে নিবে।

হাসান শাহরিয়ার
আমরা মিউজিক ডিজাইন নিয়ে আবার বলি... নাসিমভাইয়ের কাছে জানতে চাই... মানে, এই ডিজাইনটা আপনি ডেভালপ করলেন কিভাবে?

আহসান হাবীব নাসিম
স্ক্রীপ্ট রিডিং থেকেই আমাদের ভাবনাগুলো বিস্তার করছিলো, কী করে সোহরাব রোস্তমকে বর্তমানের সমসাময়িক ঘটনার সাথে রিলেট করা যায়। তো নাটকটা এক পা এক পা করে কোন দিকে যাছে আমরা পরিষ্কার হচ্ছিলাম। প্রথমে একটা ধারণা ছিলো যে, মিউজিকটা হবে পার্শীয়... সেরকম ভাবনাও ছিলো, পরে যখন স্ক্রীপ্ট পরিবর্তন হচ্ছিলো, নির্দেশক ডিরেক্টরিয়াল লাইনটা বর্তমানের সাথে যেভাবে মিলিয়ে আসছিলেন, তিনি এভাবে চাচ্ছিলেন যে, মিউজিকটা যেন মিক্সড থাকে। যেমন আমাদের এই সাব-কন্টিনেন্টের যে মিউজিকের ধারা, সেটাও যথারীতি এর উপর আমরা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি। যখন সোহরাব আর রোস্তমের নিজস্ব জায়গাগুলো আসছিলো তখন আমরা আবার পার্সীয় মিউজিক আনার চেষ্টা করেছি...  হুবহু না, কিছুটা আঙ্গিকে রাখার চেষ্টা করেছি। এভাবেই ইন্ডিয়ান ও পার্সীয়... একটা মিক্সড মিউজিক হয়ে গেছে। গল্পের ক্ষেত্রেও যেমন দুই কাল উপস্থাপনার চেষ্টা করা হয়েছে, মিউজিকটাও সেভাবে রাখা হয়েছে।

হাসান শাহরিয়ার
মিউজিক ডিজাইনে ইন্সট্রুমেন্ট যা যা চাওয়া হয়েছিলো তা দিয়েই কি করা হচ্ছে?

আহসান হাবীব নাসিম
এখানে কিছুটা ঘাটতি আছে, আমরা যেসব ইন্সট্রুমেন্ট দরকার, সবগুলো পাইনি। তারপর হচ্ছে যে কাঠ, লোহা-লক্কর এইগুলো দিয়ে শব্দ করতে করতে, এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে কোন জায়গাটাতে কোন শব্দটা খাটছে... ছোট ছোট ড্রামগুলো আছে... ঐ ড্রাম এক ধরনের কট-খাট, কট-খাট আওয়াজ করে, সেটা আমরা কাঠে আনার চেষ্টা করেছি। পরে আর হুবহু শব্দ না করে কাঠের উপরে বা ড্রামের উপরে দুইটাকে মিক্সড করে...

হাসান শাহরিয়ার
আবহ তৈরি করার জন্যে...

আহসান হাবীব নাসিম
হ্যাঁ, আবহ তৈরির জন্য... আমরা অবশ্য সঙ্গীত তৈরি করতে চাইনি, আবহ সঙ্গীত তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কমপ্লিট মিউজিক না, এটাকে প্লে মিউজিক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্ট করা হয়েছে।

হাসান শাহরিয়ার
জহিরভাই, সেট ডিজাইনের আইডিয়াটা সম্পর্কে কিছু বলুন...

ফয়েজ জহির
আসলে আইডিয়াটা... আমি প্রথমেই বলেছিলাম যে, মানুষ চলছে... আসলে চলার পথটা কেমন, চলার পথ কী? পথ ভাবতে গিয়ে আমি প্রথমে কিছু স্পেস-এর কিছু স্ট্রাগল তৈরি করেছি... জাস্ট ইম্প্রোভাইজ করে। এ দলের যা আছে, ওদের রিসোর্স নিয়ে। এটা করতে গিয়ে যখন আমি দেখলাম যে ডেভালপ করছে, তখন... আমি যেটা করি আর কী, ভাবতে শুরু করি... ভাবনাগুলোকে তখন একটা জায়গায় নিয়ে দেখলাম যে, এটাতে পারফরমাররা খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে অর্থাৎ এটা ওয়ার্ক করছে, মানে সমস্ত প্লে জুড়েই ওয়ার্ক করছে এবং তখন আমার মনে হলো, যে হাইটগুলো আমি ব্যবহার করছি, হাইট অনুযায়ী আমি ডিভাইজ করছি, স্পেসটাকে ডিভাইজ করছি তাতে পুরো সেট-ই সহায়ক হয়ে উঠছে পারফরমারদের জন্য। সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে যেটা করেছি, যেমন সুউচ্চ স্থানকে... শেষ দিকে দুটো ভার্টিক্যাল লাইনকে যুক্ত করার চেষ্টা করেছি। এটার একটু ভিন্ন ইন্টারপ্রেটেশন আছে। মনে হচ্ছে যেন দুটো ভার্টিক্যাল লাইন, একটি ভার্টিক্যাল লাইন আরেকটিকে চেপে ছোট ছোট করে আনছে... প্রেশার, ওগুলো প্রেশার হিসেবে সব সময় কাজ করে বেড়ায়, আমাদের সোসাইটি বা সব জায়গায়। ঐ জায়গায়, একটা ভাবনা আছে, আমি জানি না কতটা ওয়ার্ক করবে।

হাসান শাহরিয়ার
লাইট ডিজাইন নিয়ে কিছু বলুন।

ফয়েজ জহির
আলোর ক্ষেত্রে, নাটকের যে গতি বা নাটকের প্রবাহের যে গতিটি আছে, তার সাথে তীর্থঙ্করদের মুভমেন্ট, সেটার সামঞ্জস্য রেখে কী করে আলোর মাধ্যমে গতি নিয়ে আসা যায় সেই চেষ্টা করা হয়েছে। তবে একটি জিনিস দেখা যায়... আমাদের নাট্যমঞ্চে আলোক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে... আমাদের ব্যাক লাইট ব্যবহার করার প্রবণতাটা খুব কম। তবে আমি ব্যাক লাইট ব্যবহার করছি, যেন চরিত্রটি হাইট পায় বা চরিত্রটিকে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান করতে পারি। স্পষ্টভাবে বলতে বোঝাতে চাচ্ছি যে, মুখাবয়ব বা সামনের দিককে আলোকিত করা শুধু নয়, তার পূর্ণ অবয়বটা তুলে ধরা। বহিরাবরণটা তুলে ধরলে একটা হাইট পায়, ডেপথ পায় একটা চরিত্র, দর্শক যেন থ্রি ডায়মেনশনাল চরিত্রটাকে দেখতে পায়। কিন্তু আমাদের এখানে প্রায়শই দেখা যায় যে, থ্রি ডায়মেনশনাল ব্যাপারটা আসে না। সেক্ষেত্রে একটা সংকট থেকে যায়। চেষ্টা করেছি সেই সংকট-টা যেন এই নাটকে না থাকে।

হাসান শাহরিয়ার
এমনিতে কি পারফরমাররা যখন চলে যায়, তখন স্টেজের বাইরে চলে যাবে... নাকি সবাই স্টেজেই থাকবে সব সময়?

ফয়েজ জহির
বাইরে চলে যাবে। শুধু চারজন সবসময় থাকবে...

হাসান শাহরিয়ার
আর বাদক দল? মানে মিউজিক যারা করবে?

ফয়েজ জহির
যারা বাদক, তারা সামনে বসবে। স্পেস তৈরি করে দেবো, সেখানে বসবে।

হাসান শাহরিয়ার
উইংস থাকবে?

ফয়েজ জহির
উইংস থাকবে, কারণ আমাদের এন্ট্রি হচ্ছে চারটি।

হাসান শাহরিয়ার
কোনো বিরতি আছে?

ফয়েজ জহির
ইন্টারভেল এখনো ভাবছি না। তবে ইন্টারভেলের একটা পয়েন্ট আমরা ঠিক করে রেখেছি, সে জায়গায় ইন্টারভেল দিতে পারি।

হাসান শাহরিয়ার
এমনিতে ডিউরেশন কতটুকু হলো?

ফয়েজ জহির
১ ঘন্টা ৪০ মিনিট হবে।

হাসান শাহরিয়ার
১ ঘন্টা ৪০ মিনিট। তাহলেতো ইন্টারভেল না দিয়েই করা যায়।

ফয়েজ জহির
আমাদের ভাবনা... মানে আমরা প্রিমিয়ার শোতে ইন্টারভেল না দিয়েই করবো। আমরা দেখতে চাই যে আসলে বিরতি না দিলে কিরকম হয়। বিরতি দিলে হয় কী এই নাটকের... সুরটা ছুটে যায়।

হাসান শাহরিয়ার
চার তীর্থঙ্কর সবসময় থাকছে, সে হিসেবে বিরতি দেয়ার প্রয়োজন বোধহয় নেই। তা ছাড়া এই ডিউরেশনে...

আছাদুল ইসলাম আসাদ
ইন্টারভেল দিলে দর্শক বাইরে চলে যায়। আবার এসে নাটকের মধ্যে মনোযোগ দিতে মুশকিল হয়।

হাসান শাহরিয়ার
তো এবার শেষ করি। এতক্ষণ ‘তীর্থঙ্কর’ নাটকের নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আলোচনা করার জন্য এই নাটকের নির্দেশক ও আর সুবচনের সবাইকে থিয়েটাওয়ালা’র পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

আহম্মদ গিয়াস
সুবচনের পক্ষ থেকেও আজকের এই বৈঠক আয়োজনের জন্য থিয়েটারওয়ালা’কে ধন্যবাদ।