Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নৈর্ব্যক্তিকীকরণ : থিয়েটারের অন্যতম প্যারাডক্স

Written by রবার্ট কোহেন.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

অনুবাদ : শুভাশিস সিনহা
থিয়েটার শিল্পের সঙ্গে অভিনেতা সম্পর্কিত হয় চরিত্র-রূপায়ণের সূত্রে। এই বৈশিষ্ট্য একমাত্র থিয়েটারেরই, যা চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, সঙ্গীত এবং এ-মতো অন্যান্য শিল্প-আঙ্গিক থেকে প্রকটরূপেই স্বতন্ত্র। সেই অভিনয়কলা থিয়েটারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট, এটি নিজেই এক চরম প্রতিষ্ঠান।

কল্পনা করার চেষ্টা করুন সেই প্রাচীন নাট্যশিল্পীদের, নাটকের নৈর্ব্যক্তিকীকরণের মূল শর্তসমূহের ওপর দাঁড়িয়ে কী তীব্র দার্শনিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো! দর্শকরা কীভাবে চরিত্রাভিনেতাকে তার ব্যক্তিসত্তা থেকে পৃথক করতো! কীভাবে আলাদা করতো অভিনেতার ব্যক্তিসত্তা থেকে তার চরিত্রকে; যখন নাট্যকার নিজেই অভিনেতা হতেন, দর্শকরা তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা এবং তার অভিনীত চরিত্রগত সত্তার চিন্তা-চেতনার পার্থক্য কীভাবে সূচিত করতো!

এরকম প্রশ্ন আজও শিশুদের জিজ্ঞাস্য হয়, যখন তারা কোনো নাটক দেখে। এটি অনিবার্য যে, যখন একজন সস্তা টিভি সিরিজের প্রযোজক তার সিরিজের অভিনেতাদের নিয়ে কোনো পাবলিক প্রেস-কনফারেন্স আয়োজন করেন, তখন ভক্তরা কোনো কোনো অভিনেতাকে সেই সিরিজে অভিনীত চরিত্রের নামে প্রশ্ন করে এবং তারা তাকে কেবল তার ওই নাট্যকাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করে থাকে। সুতরাং থিয়েটারের ক্ষেত্রেও এটি বোঝা সহজ, থিয়েটার একটি সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার পূর্বকালে কেন সেই প্রাচীন নাট্যকর্মীরা এই অভিনেতা-চরিত্র পৃথকীকরণজনিত সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল।

তখন তারা যে সমাধানটি খুঁজে পেয়েছিল, তা হচ্ছে মুখোশ (mask)। আমরা বলতে পারি, পাশ্চাত্য থিয়েটারের প্রকৃত আরম্ভই হয়েছিল তখন, যখন একজন অভিনেতা কোরাস-দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার অচিত্রিত-মুখোশ পরা অবস্থায় চরিত্রানুগ সংলাপ বলা শুরু করেছিল। জাপানের ‘নো’ নাটক এবং আফ্রিকা, এশিয়া ও আমেরিকার আদিবাসীদের কৃত্যমূলক নৃত্যনাট্যগুলোতে ঠিক সেই অর্থেই মুখোশ ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত মুখোশ হলো নৈর্ব্যক্তিকীকরণের হাতিয়ার। যদিও আজকাল নাটকে মুখোশের ব্যবহার খুব কম দেখা যায়, তবু কমেডি ও ট্র্যাজেডির যুগল-ভাবাত্মক মুখোশ, পাশ্চাত্যের অনেক নাট্যগৃহ, প্রসেনিয়াম ও নাট্যপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে অলংকৃত হয়ে থিয়েটারের প্রতীকরূপে আজও স্বীকৃত।

মুখোশের গুরুত্ব এই, এটি অভিনেতা এবং অভিনীত চরিত্রের মধ্যে শারীরিক ও প্রতীকী পার্থক্য সূচিত করে। একইভাবে সাধারণ দর্শকদের পূর্বের বাস্তব পৃথিবী সম্পর্কিত সব চেতনা ভুলে যেতে এবং মঞ্চের পৃথিবী সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করে। একটি নাটকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্রগুলোর যে-জীবন, অভিনেতাদের তাদের নিজস্ব চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা, ক্যারিয়ার, কামনা সবকিছু নিয়ে সেসব জীবনেই বিলীন হয়ে যেতে হবে। এই রীতি বা নিয়মই নির্মাণ করে থিয়েটারের অন্যতম paradox বা ডিলেমা,  যা অষ্টাদশ শতকের ফরাসি এনসাইক্লোপেডিস্ট ভেনিস দিদেরো-এর অভিনেতার প্যারাডক্র (The paradox of the actor) হিসেবে ব্যাখ্যায়িত হয়েছিল এভাবে; যখন কোনো অভিনেতা তার অভিনয়কর্মটি যথাযথভাবে সম্পাদন করে, তখন তা উদ্দিষ্ট চরিত্র হিসেবেই প্রতীয়মান হয়, নির্দিষ্ট মুখোশের মধ্য দিয়ে, যা আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে, তখন আর সেই প্রকৃত মানুষটি (person) সেখানে আদৗ কোনো জীবনের অংশীদারিত্ব করে না। এটি খুবই আশ্চর্য হওয়ার বিষয়, person শব্দটি ল্যাটিন mask শব্দ থেকেই খানিকটা বিবর্তিত হয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা নিশ্চয় জানি যে, অভিনেতা মুখোশের আড়ালে কখনই ‘মৃত’ হয়ে যায় না এবং এখানেই আরেকটি মহত্তর প্যারাডক্র খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা চরিত্রে বিশ্বাস করি, কিন্তু নাটক শেষে অভিনন্দন জানাই অভিনেতাকে। শুধু তাই নয়, যদি কোনো উৎকৃষ্ট থিয়েটার দেখি, মনের গহীন স্তর থেকে আমরা সর্বক্ষণই অভিনেতাকে প্রশংসা জানিয়ে থাকি। আমাদের থিয়েটার-উপভোগ বৃহৎভাবে নির্ভর করে অভিনেতা ও চরিত্র এবং তারা যে একই অবয়বের মধ্যে লীন হয়ে আছে-এ সম্পর্কে সচেতনতার ওপর।

অভিনেতাও অবশ্যই একইভাবে তার দ্বৈততা সম্পর্কে সজাগ থাকবে। তার কাছে অভিনয় শিল্প হচ্ছে অপরিচয়ের স্বাধীনতা (তার চরিত্রে সংশ্লিষ্ট হওয়ার আগে) এবং প্রদর্শনকামিতাজনিত স্বতন্ত্র বাসনা পূরণের ইচ্ছা- এ দুয়ের সমুন্নত সমন্বয়।

এভাবে অভিনেতারা সাধারণভাবে থিয়েটারের অভিনয়ে এ-ই প্রমাণ করে যে, তারা স্বতঃলীন ও স্বতঃআবিষ্কৃত এবং এটি সত্য, মাঝে মাঝেই বিষয়গুলো যুগপৎ ঘটে থাকে। এই মুক্তির জ্ঞান এবং তীব্রতর আত্মসচেতনতা, যা একটি মানোত্তীর্ণ নিয়মানুগ গঠনের ভিতরে পূর্ণ লক্ষ্যমুখী চিন্তায় দীপ্রমাণ, তা-ই হচ্ছে নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; এমনকি খেলাধূলার জন্যও। মুখোশ ব্যতীত বা মুখোশসহ যাই হোক, অভিনয়কর্মটি নির্ভর করে অভিনেতা ও দর্শকের অখ- চুক্তি বা চুক্তিগুলোর ওপর। চুক্তিটা এরকম যে, অভিনেতা পুরোপুরি একটি চরিত্র হয়ে যাওয়ার ভান করবে এবং দর্শক বোঝার ছল করবে অভিনেতা আসলে সেই চরিত্রই, যা সে হওয়ার চেষ্টা করছে। আবার এই চুক্তির অর্থ এই নয় যে, অভিনেতা একেবারে বাস্তবানুগ আচরণ প্রদর্শন করবে। বিপরীতভাবে এই চুক্তি পারস্পরিক ছল-কৌশলের সম্পর্ক ধারণপূর্বক নিশ্চিত অবস্থাসমূহের উভয় ক্ষেত্রেরই গ্রহণযোগ্যতার পথ তৈরি করে; যেমন চরিত্র একটি মুখোশ পরিধান করবে, কোনো মাইক্রোফোনে কথা বলবে, কোনো রাগান্বিত মুহূর্তে নাচবে ইত্যাদি ক্ষেত্রে অথবা যারা থিয়েটারে সবসময় গ্রহণযোগ্যতা খোঁজে তাদের কোনো ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও। এ শতাব্দীতে বিশেষ করে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের প্রসারের আগে, চরিত্র পরিস্ফূটনের জন্য অত্যধিক মনোযোগ দেওয়া হতো অভিনেতার নিজস্ব আচরণের প্রয়োগের ওপর।
 
এই গুরুত্ব একটি প্রবণতাকেই প্রতিফলিত করে, কিন্তু কোনো মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করতে পারেনি থিয়েটারের অভিনয়ে। মনে রাখার বিষয় হলো, অভিনয় এককভাবেই থিয়েটারের এক চিরন্তন বা ধ্রুব বিষয় হিসেবে থাকে। থিয়েটারের পরিবেশনা, ভাব ও রীতির সব রকম রূপবদল সত্ত্বেও। ইতিহাসজুড়ে অভিনেতারা প্রায়ই চরিত্রাভিনয়ে সন্দেহজনক নৈতিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অভিযুক্ত হয়েছে। দর্শকরাও এই অনৈতিকতাকে করতালি দিয়ে নিন্দিত করেছে ঠিক সেইভাবে। অভিনেতার গ্রিক প্রতিশব্দ হচ্ছে `Hypokrites’ যার অর্থ ‘উত্তরদাতা’ (Answerer)। অভিনেতা আসলে কোরাসের সমবেত গাথারই উত্তর দিতেন। পরে এর অর্থ হয় `Pretender’ বা রাজ্যাভিযোগী; নেতিবাচক গূঢ়ার্থে বলতে গেলে অভিনেতা সে-ই, যে ছদ্মবেশ ধারণ করে বা প্রতারণা করে (one who dissembles)। প্রকৃতপক্ষে থিয়েটারের ইতিহাসে প্রাচীনতম গাথাটি চিত্রিত করে এভাবে : প্রাচীন আইনপ্রণেতা সলোন প্রথম-অভিনেতা থেসপিসকে অনেক লোকের সামনে বকুনি দিচ্ছেন মিথ্যা বলার জন্য। কারণ থেসপিস বলছিলেন, নাটকে মিথ্যা বলা ক্ষতিকর কিছু নয়। সলোন শ্লেষভরে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আহ্, আমরা যদি নাটককে এ রকম সম্মান বা প্রশংসা দিয়ে থাকি, তবে আমাদের বাণিজ্যে কিছু দিনই কেবল আমরা এটাকে খুঁজে পাবো’। অন্ততপক্ষে সলোন-পূর্ব অভিনেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল বিভিন্ন মাত্রার সামাজিক সংশয়গ্রস্ততার সঙ্গে এবং সেই কুখ্যাতির সঙ্গেও, যা তাদেরকে উচ্চ পদমর্যাদা দিয়ে থাকে, আবার দশর্ককেও তাদের ব্যক্তিগত রুচি সম্পর্কে কৌতূহলাক্রান্ত করে তোলে। যা হোক, অভিনয় শিল্পের অধীনস্থ এই নৈর্ব্যক্তিকীকরণের লক্ষ্য ছলচাতুরী নয়। এর লক্ষ্য শৈল্পিকতা। অভিনেতা যে অন্য কারো মতো হওয়ার ভান করবে না, তার কারণ একটি নাটকীয় চরিত্র কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, সে একটি বিমূর্তন মাত্র; একটি ক্যানভাসের চিত্রকর্ম অথবা একটি পৃষ্ঠার ওপর বিন্যস্ত শব্দরাশির চেয়ে মানবিক কিছু নয়। এটি সত্য যে, নাট্যচরিত্র একজন জীবন্ত মানুষের দ্বারা উপস্থাপিত হয়, যে-মানুষটি চরিত্রটির ক্রিয়া ও গতিশীলতার মধ্য দিয়ে চলে। এও সত্য যে, কিছু চরিত্র আঁকা হয় জীবন থেকে এবং সেগুলোর সংলাপ নেয়া হয় কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার প্রকৃত প্রতিলিপি থেকে। চরিত্র কোনো ব্যক্তিমাত্র নয়, এটি একটি শৈল্পিক নির্মাণ- একটি গাঠনিক রূপ, যা অভিনেতা ও দর্শকের সুষম অখণ্ড (ইঙ্গিতিক) সমঝোতার গুণে একটি প্রকৃত (বাস্তব) মানুষের মতো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। নৈর্ব্যক্তিকীকরণে নিযুক্ত হয়ে অভিনেতা নৈতিক Approbation-এর সঙ্গে যুক্ত হবে না; অভিনীত চরিত্রের ক্রিয়া ও অনুভূতিতে মগ্ন থাকার ক্ষেত্রে সে কোনো ভণ্ডামির আশ্রয় নেবে না, কেন না এটি সহজভাবে প্রাচীন এবং অশেষ সৃষ্টিশীল পেশার শৈল্পিক কাজের অংশ।

ইদানীং আমরা দেখি, অভিনয়শিল্পে অভিনেতার মুখ লুকানোর জন্য খুব কমই মুখোশের ব্যবহার করা হয়, পরিবর্তে পোশাক, রূপসজ্জা, সংলাপ, উচ্চারণভঙ্গি, গতিবিধি, অঙ্গভঙ্গি এবং অভিনয় কলাকুশলীদের বিভিন্ন চরিত্র রূপায়ণে সাহায্য করে, যা আগে কেবল মুখোশ ও স্বরের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হতো। বিংশ শতাব্দীতে আপাত সত্যের ধারণার গুরুত্বের কারণে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক অভিনেতাই সম্পূর্ণত বা অংশত রুশ অভিনেতা, নির্দেশক এবং অভিনয় শিক্ষক কনস্তানতিন স্তানিস্লাভস্কির ধারণাকে সমর্থন করে, যিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, অভিনেতা মঞ্চে চরিত্রের জীবনকেই জীবন্ত করে তুলবে। এই দর্শন কেবল কলাকৌশল ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করে চরিত্রের শারীরিক পুঙ্খানুপুঙ্খ ক্রিয়াদির পরিবেশনা সমৃদ্ধিই নয়, চরিত্রের অনুভূতিগুলোর অভিজ্ঞতায়নেও যথেষ্ট সহায়ক হয়। বর্তমানে এই মুভমেন্টের একান্ত সমর্থক যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন কট্টর সমালোচকও।

পরিষ্কারভাবে বলা যায়, অভিনেতা এবং তার চরিত্র (role)-টির মধ্যকার সম্পর্কগত প্রশ্ন অথবা অভিনেতা নিজেকে তার অভিনীত অংশটির সঙ্গে সমসূত্রে যেভাবে সনাক্ত বা চিহ্নিত করে, তার মাপকাঠি সম্পর্কিত প্রশ্ন (যেগুলো ২০০ বছর আগেও ছিল এবং দিদেরো তখন অভিনয়ের প্যারাডক্স আবিষ্কার করেছিলেন) আজও আমাদের হতবুদ্ধি করে।

[লেখাটি আমেরিকান নাট্যবিদ ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট কোহেনের `Theatre’ গ্রন্থের `What is the Theatre’ অধ্যায়ের `Impersonation’ অংশের অনূদিত রূপ। গ্রন্থটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়।- অনুবাদক]

শুভাশিস সিনহা: নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক। প্রতিষ্ঠাতা- মণিপুরী থিয়েটার, মণিপুরী, সিলেট। ফোন- ০০৮৮-০১৭১৬৫৭৮৩০৩, ই-মেইল- This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.