Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সংস্কৃতির শেকড় সংস্কৃতির লড়াই

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

‘মানুষের এই বিশাল পরিবর্তনের ধারা সুগোল চাঁদ ও নদীর বুকে জমা হয় নাকি? চাঁদও রূপান্তরিত হয় কনায় কনায়, নদী নিরন্তর সঞ্চরণশীল। তারও আছে জোয়ার ভাটা, চর, ভাঙা কুল-প্লাবন ও শীর্ণতা। এই তেতো লবনাক্ত জীবনের বাঁকে বাঁকে মানুষের জন্য অপেক্ষা করে রূপান্তর। কিন্তু সে কি এতই সহজ! তার জন্য আছে অশ্রুঘামরক্তমৃত্যু দুয়ার। আছে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা।’- সেলিম আল দীন, কিত্তনখোলা

সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আমরা কিছু মৌলিক প্রশ্ন মোকাবিলা করছি যেগুলো সেলিম আল দীনের কাজের ক্ষেত্রেও মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল। এগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে নিজের পরিচয়কে সনাক্ত করা। শেকড় সন্ধান করা। কী আমি? কার আমি? কোথায় আমি? কোথায় আমার ঘর? কোথায় আমার বসত? কী আমার পরিচয়? কোনদিকে যাবো আমি?

উনিশ শতকে বাংলাসহ ভারতবর্ষ যখন উপনিবেশ তখনই জাতিরাষ্ট্র কাঠামোয় দুনিয়ার ভৌগোলিক চিত্র একটি সংহত রূপ নেয়। রাষ্ট্র বলতে তখন ছিল শুধু ঔপনিবেশিক কেন্দ্রগুলো। পুরো দুনিয়ার মধ্যে এগুলো ছিল দ্বীপের মতো, বাকি পুরো সাগরই তখন উপনিবেশ। উপনিবেশ শৃঙ্খলে থেকে থেকে এসব অঞ্চলের মানুষ ভুলতেই বসেছিল তারাও স্বাধীন মানুষ ছিল কিংবা হতে পারে। কিংবা প্রশ্ন এখনও করা যায়, ভুলতে বসেছিল বলবো নাকি বলবো যে ভুলেই আছে? না এর বিপরীত চিত্র সবসময়ই ছিল। দৃষ্টিগ্রাহ্য মাত্রা তা লাভও করেছে কখনও কখনও।

দূররাজ্যের রাজা-বাদশার দখল, লুণ্ঠন, নির্যাতন আধুনিক ঔপনিবেশিক কাল দিয়েই শুরু হয় নি। কিন্তু আধুনিক ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার স্থায়ীত্ব ও প্রভাব তুলনায় অনেক বেশি। এটি শরীর মন শুধু নয় অস্থি তরুনাস্তি পর্যন্ত স্থায়ী বসত গাড়ে। এই ব্যবস্থা শুধু অর্থনৈতিক লুণ্ঠন বা রাজনৈতিক নির্যাতন করে না, সমাজের চিন্তাশক্তির মধ্যে ঔপনিবেশিক ভক্তির ভাইরাস ছড়িয়ে দেয় পোক্তভাবে। দেখতে মনে হয় মানুষ, কিন্তু আসলে উপনিবেশ। কিন্তু আমরা এখনও যে দাঁড়িয়ে নিজেদের চিন্তা নিজেরা করতে পারছি এর কারণ একটাই যে, উপনিবেশিক প্রবল জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্যের শিকার পুরো সমাজ হতে রাজী হয় নি। বাংলাতেও না, পৃথিবীর কোথাও না।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে একজন বৃদ্ধ মানুষের চরিত্র আছে। গ্রামের সেই মানুষ দীর্ঘকাল জমিদারের সেবা করেছেন শরীর মন সব দিয়ে, তারপরও লাথিগুতা খেয়েছেন বেশুমার। জমিদার গেছে, জমিদারী গেছে, কিন্তু যৌবনকালে জমিদারের কাছ থেকে খাওয়া শক্ত একটা জুতার লাথির দাগ ঘাড়ের কাছে রয়েই গেছে। শীতে তাতে ব্যথার টনটনও করে। তারপরও বৃদ্ধ সেই জায়গা নিয়ে কোনো চিকিৎসা করতে নারাজ। বরং পরম যত্নে প্রায়ই ঐ দাগের উপর হাত বুলানো আর সুযোগ পেলেই গর্বের সঙ্গে তা মানুষদের দেখানোতেই তার প্রবল আগ্রহ। ঘটা করে বলেন কি জবরদস্ত লোক ছিলেন তার প্রভু। এমন লাথি দিয়েছেন যার দাগ এখনও যায় নি।  বলে বলে নিজের ওজন বাড়াতে অস্থির তিনি। যেন সেই দাগ হারিয়ে গেলে তার গুরুত্বও চলে যাবার সম্ভাবনা।  

শৃঙ্খল থাকলেই দাস হয় না, তা তার মনোজগত কতটা দখল করে ফেলে সেটাই তার পরিচয় নির্ধারণ করে। সেই প্রকৃত দাস যে তার দাসত্বের শৃঙ্খলকে উপলব্ধি করতে জানে না; দাসত্বকে নিজের ভেতর লালন করে, দাসত্ব বহন করে যায়। বাংলাদেশে অর্থবিত্ত দাপট ক্ষমতাওয়ালা হিসেবে যারা পরিচিত, যারা নীতি নির্ধারণ করেন এমনকি সংস্কৃতি জগতেও যারা হোমড়াচোমড়া তাদের অনেককে দেখলে আমার সেই বৃদ্ধ দাসের কথাই মনে পরে। কী পরম যত্নে, আগ্রহে এবং আনন্দে এরা দাস হিসেবে নিজেদের জাহির করে। আর যারা ভেতর থেকে দাস তারা আবার স্বাধীন মানুষ দেখলে সন্ত্রস্ত হয়, শক্তি থাকলে তাকে গুড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু এই দাস সংস্কৃতির আধিপত্য মানুষ মানবে কেন?   

একসময় পর্যন্ত উন্নয়ন চিন্তা বলি আর সংস্কৃতি চিন্তা বলি সর্বত্রই বিদ্বৎ সমাজের মধ্যে ঔপনিবেশিক ভাইরাসের আধিপত্য ছিল সর্বব্যাপী। নাটক বলি, সঙ্গীত বলি, চলচ্চিত্র কিংবা বলি অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল সেখানে প্রকরণ, আঙ্গিক, লক্ষ্য এবং সর্বোপরি দর্শন সবকিছুতেই অনুকরণ বা নির্দেশ পালনের অশ্লীলতা এখনও অব্যাহত। দীর্ঘদিনের দাসত্বের মধ্য দিয়ে বরীন্দ্রনাথের খাঁচার পাখির মতো চিন্তা সক্রিয়তায় অক্ষম বা অপটু শিক্ষিত সমাজের মধ্যে টোকা দেওয়াও দুঃসাধ্য।

কিন্তু মানুষ যেহেতু মানুষ, সেহেতু কালে কালে দ্বান্দ্বিক নিয়মে অধঃস্তন অবস্থার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভূমিলগ্ন মানুষ, নানা মাধ্যমে স্বকীয় চিন্তা সক্রিয় থেকেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই স্রোত ভৃত্যের শান্তিসুখে মগ্ন মধ্যবিত্তকেও অশান্তির মধ্যে ফেলেছে, বিদ্বৎ সমাজকে ভেঙেছে, সেলিম আল দীন এর মতো শক্তিশালী ধারা নির্মিত হয়েছে। যা ঔপনিবেশিক কেন্দ্র আর নানা প্রান্ত ঘুরে নিজেকে নিজের আত্মাকে নিজের ভূমিকে সনাক্ত করবার স্বাধীন অবস্থান তৈরি করেছে। প্রশ্ন তুলছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, আধুনিকতা, প্রগতির চলতি অর্থ নিয়ে।  

তারপরও প্রশ্ন থাকে এই যে, নিজের মানে কী? জাতি, ধর্ম ভাষা, বর্ণ দিয়ে বিভাজন আর বৈষম্য নিপীড়ন যতই চলুক মানুষ তো মানুষই। নিজের শেকড়ে ফেরা মানে কী খণ্ডিত একটি জগতে ফিরে যাওয়া? ভাষা কিংবা ধর্ম দিয়ে একটি দেয়াল নির্মাণ করা? আর শ্রেণীগত বিভাজন? সে তো এক জায়গায় স্থির নয়। আর ফিরে যেতে চাইলেই কি ফিরে যাওয়া আমাদের সাধ্যের মধ্যে? আর ফিরে যাবো কোথায়, কোথাও কি ছিল কোনো স্বর্ণদ্বীপ? তাহলে নিজের সংস্কৃতির শেকড় সন্ধান মানে কী? ফিরে যাওয়া নাকি নতুন স্বপ্নের ভিত্তি নির্মাণ করা? বিভিন্ন মাধ্যমে কিংবা একই মাধ্যমের বিভিন্ন প্রকাশে সেলিম আল দীনের কাজ যে নতুন স্বপ্নভিত্তি নির্মাণেই মাটি খুঁড়েছে এতটুকু তো আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি।       

সংস্কৃতির ভাষা

সংস্কৃতি হল একই সঙ্গে ধারণ ও প্রকাশ ধারণ-বিশ্বাস, প্রথা, অনুশাসন, প্রকাশ-ভাব, সক্রিয়তার ভঙ্গি। আমরা মানুষরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে ও কালে কী ধরনের জীবন জীবিকার মধ্যে যুক্ত থাকি; সৎভাবে দেখি নিজেকে ও চারপাশকে; আমাদের খাওয়া-পরা, খাওয়া-পরার নানা কিছুর মধ্যে পবিত্র, করণীয়, অপবিত্র-নিষিদ্ধ ভেদকরণ; আমাদের নিজেকে প্রকাশের ভঙ্গি, আমাদের আনন্দ-বেদনার অভিব্যক্তি, সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক দূরত্ব কিংবা কাছেত্ব; মানুষে মানুষে সম্পর্কে শ্রেণী-জাতি-লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্ম নানা পরিচয়ের মানুষের ঐক্য কিংবা অনৈক্য, সংহতি কিংবা বৈরিতা ইত্যাদি সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সংস্কৃতি তাই ধারণ করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিদিষ্ট স্থানে ব্যক্তি মানুষ ও সমষ্টি মানুষের বিশ্বাস, চর্চার সকল দিক। ধর্ম, ভাষা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তা ও চর্চা ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতিরই অংশ।

মানুষ তাই প্রকাশিত হয় সংস্কৃতি দিয়ে, সংস্কৃতি তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিচয় দান করে। জন্মগতভাবে, ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে, মানুষ একেক ধরনের সংস্কৃতি কাঠামোয় প্রবেশ করে বেড়ে ওঠে। তবে মানুষের একক বৈশিষ্ট্য এটাই যে, সে সেই কাঠামোর মধ্যে নিষ্ক্রিয় সত্তা নয়। শারীরিক ও মানসিক সক্রিয়তা দিয়ে, মানুষ জন্মগতভাবে পাওয়া সংস্কতি কাঠামোয় প্রবেশ করে বেড়ে ওঠে। শারীরিক ও মানসিক সক্রিয়তা দিয়ে, অন্য আরও অনেক মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, মানুষ জন্মগতভাবে পাওয়া সংস্কৃতির বাইরেও তাকাতে চেষ্টা করে। তাই মানুষের সংস্কৃতি স্থির অনড় থাকে না, তার পরিবর্তনও নানাভাবে ঘটতে থাকে । আবহমান বা একটি নিদিষ্ট কাঠামোর সংস্কৃতি বলে কার্যত কিছু টিকে থাকে না। কিন্তু এই পরিবর্তন কীভাবে ঘটবে তা নির্ভর করে রাষ্ট্র, রাজনীতি, দর্শন সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের উপর। সেখানেই প্রশ্ন সংস্কৃতির শেকড় নিয়ে, সংস্কৃতির ভেতর অনিবার্য অনুধাবন তাই গুরুত্বপূূর্ণ হয়ে উঠে।

একের মধ্যে বহু

বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতির ভেতরের নানা উপাদানের চলমানতা, ক্রমাগত তার সাথে ‘অন্য’ অনেক উপাদানের মিথষ্ক্রিয়া, এই দেশের মানুষের মধ্যেকার নানা ভিন্নতা ও বিভেদ থেকে উদ্ভূত বিশ্বাস, স্বপ্ন আর জীবন-জীবিকার পার্থক্য, একক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণার অসারতা দেখায়। একক আবহমান বাঙালি সংস্কুতি, একক অখণ্ড মুসলিম সংস্কুতি তাই কল্পজগতের নির্মাণ; ‘বাঙালি মানুষ’ বা ‘মুসলিম মানুষ’ বলে অটল একক অনৈতিহাসিক কিছু নেই, তাই সেরকম অপরিবর্তনীয় এককাট্টা সংস্কৃতিরও আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই।

বাংলাদেশ কেবল বাঙালির বাসভুমি নয়, বাংলাদেশ কেবল মুসলমানের বাসভূমিও নয়। বস্তুত, এখানে অ-বাঙালি ও অ-মুসলিম জনগোষ্ঠীসমূহের বয়স দীর্ঘতর। এই অঞ্চলে আদিকাল থেকে একক কোনো বাঙালি বাস করে নি। বাইরে থেকে নানাভাবে নানা কাজে মানুষ এসেছে, এসেছে সংস্কৃতি। মিলেমিশে দাঁড়িয়েছে, ভেঙেছে, দাঁড়িয়েছে আবার। সাম্প্রতিক ইতিহাস অর্থাৎ আমরা যদি গত একদেড় হাজার বছরের বিভিন্ন পর্বের অভিজ্ঞতা খেয়াল করি তাহলেই দেখবো ইতিহাসের নানা পথের নানাবিধ যোগ-বিয়োগ আমাদের একের মধ্যে বহুকে নির্মাণ করেছে।

ধর্মীয় দিক থেকে বিচার করলে দেখবো, বিভিন্ন ধর্মের শাসকেরা এই অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে। দেশের মানুষের উপর শাসক হিসেবে ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু (যাদের আদি এ দেশে নয়, কিন্তু থেকে গেছেন), বৌদ্ধ (যাদের আদি এই অঞ্চল), মুসলমান (তুর্ক, মোগল, পারসী- বাইরে থেকে এসেছেন রাজ্য শাসন করতে, স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন) এবং খ্রিষ্টান (ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। এখানে বসত না গাড়লেও যাদের পরিচয়ে নতুন জনগোষ্ঠী দাঁড়িয়েছে)।

এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা ধর্ম প্রচারে আরব ও মধ্য এশিয়া থেকে মুসলমান এসেছেন, ইউরোপ থেকে এসেছেন বিভিন্নজন- পর্তুগিজ, ফরাসি, ব্রিটিশ কোম্পানি ও খ্রিষ্টান মিশনারি। বিভিন্ন সময়ে রাজভাষা বা ক্ষমতার ভাষা হিসেবে সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজি এই অঞ্চলের মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে প্রভাবিত করেছে। লিখিত ও মান বাংলা ভাষা হিসেবে এখন যা আমরা দেখছি তাই এসবের প্রভাবকে ধারণ করেই দাঁড়িয়েছে, বিকশিত হয়েছে, বহু ভাষার শব্দ ও ধারণা ক্রমান্বয়ে এতে প্রবিষ্ট হয়েছে।

এই অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও অন্যান্য ভাষাভাষী জাতি-গোষ্ঠীর বয়সও দীর্ঘদিনের। চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, গারো প্রমুখ জনগোষ্ঠীর ভাষা, জীবন-যাপন, বিশ্বাস প্রথাও এই অঞ্চলের সংস্কৃতি-পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এসব জনগোষ্ঠী জাতি হিসেবে প্রান্তিক অবস্থান থাকলেও তাদের প্রভাব বা চিহ্ন বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙালির খাওয়া-পরা ভাষার অনেক কিছুতেই আমরা চাকমা, মারমা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি পাই; উত্তরবঙ্গের অনেক অঞ্চলের বাঙালির মধ্যেই সাঁওতাল এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাঙালির মধ্যে গারো জনগোষ্ঠীর প্রভাব শনাক্ত করা কঠিন নয়।

বিভিন্ন বর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ-পীতবর্ণ, বিভিন্ন অঞ্চল আরব-পারস্য-উত্তর ভারত-দক্ষিণ ভারত-মধ্য এশিয়া, বিভিন্ন ধর্ম হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান ছাড়াও বিভিন্ন ভাষা এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষ এখানে স্থায়ী বসতি গেড়েছেন; এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন। দেহের গড়ন, দৈর্ঘ্য, অবয়ব, নাক-কপাল, চোখ ইত্যাদিতেও তাই স্বাক্ষর ‘বহু’র। বাংলাদেশ পূর্ব ও পশ্চিমের, উত্তর ও দক্ষিণের সংস্পর্শে ধারণ করে আছে মহাবিশ্ব। এই বহুবিধ স্রোতের সম্মিলন তার দুর্বলতা নয়, শক্তি।

বাজারের টান এবং পুরনোর বিহবলতা

বর্তমানকালে যে তথাকথিত বিশ্বায়নের প্রবাহে ‘বাইরের’ সংস্কৃতির প্রভাব বাড়ছে তা একেবারে নতুন কিছু নয়। ‘বাহির’ এবং ‘ভেতর’, ‘নিজ’ এবং ‘ধপর’ এভাবে বিভাজনও তাই কাল থেকে কালে, এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীতে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। যেটাকে এখন মনে হয় ভেতর, সেটাই হয়তো এক সময় ছিল বাহির; যেটাকে মনে হয় পর সেটা অন্য দৃষ্টিতে নিজের, অথবা যেটাকে মনে হয় নিজ সেটা আবার ভিন্ন দৃষ্টিতে অপর।

শুধু বাইরের প্রভাব নয়- ভেতরে বস্তুগত অবস্থা, উৎপাদন সম্পর্কে অনেক পরিবর্তন এখন নতুন সংস্কৃতির সন্ধানে। বাংলাদেশের সমাজ এখন অনেক বেশি বাজারীকৃত, পুঁজিবাদী সম্পর্ক অনেক বিকশিত। বাজার ও মুনাফামুখিতা বাংলাদেশে দুর্বল উৎপাদনশীল ভিত্তির একটি দোকানদারি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। একদিকে পুঁজিবাদী সম্পর্কের দিক থেকে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশ অনেক বেশি অঙ্গীভূত, অন্যদিকে পরিচয়ের সংকটে হীনমন্যতা আর দিশেহারা বোধে আক্রান্ত সমাজ, এক দিকভ্রান্ত অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে।

‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলতে সাধারণভাবে এখনও যাকে নির্দেশ করা হয়, বেতার-টিভি অনুষ্ঠানাদিতে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যে জনজীবন বা সুর এখনও উপস্থিত করা হয় সেটি আসলে, নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করলে, সমতলের গ্রামীণ কৃষক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিতে পাহাড় নেই, নগর নেই, এমনকি কৃষক সংস্কৃতি বলে যা উপস্থিত করা হয় তার অনেক কিছুই বাস্তবে গ্রামীণ জীবনে আর অবশিষ্ট নেই। অনেক কিছুই গত প্রায়। পুরনো ধাঁচের কৃষিকাজ, হাজারো বীজ, নদী, বন, মাছ, পশুপাখি, বৃক্ষ- সেই জীবন বিষয়ে লোককথা, লোকবিশ্বাস, গান, বাদ্যযন্ত্র ... অনেক কিছুর রেশ আছে কেবল।

বলিল অশ্বত্থ সেই

বলিল অশ্বত্থ ধীরে: কোন দিকে যাবে বলো-
তোমরা কোথায় যেতে চাও?
এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:
ম্লান খোড়ো ঘরগুলো- আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;
এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের
তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!
বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,- ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;
আবার কোথায় যেতে চাও?

‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো- এই-তো সেদিন
তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়
-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-
এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে
এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে
জীবনের ক্লান্তি-ক্ষুধা আকাঙ্ক্ষার বেদনার শুধেছিল ঋণ;
দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,- মনে হয় যেন সেই দিন!

‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?
সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?
আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্ক্ষার ঘর! ...
যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর!’
- বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।
(জীবনানন্দ দাশ, আশ্বিন ১৩৪৩)

মানুষের অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা, পোশাক সবকিছুই কয়েক দশকে অনেক ভিন্ন। গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর অনেক আগে থেকেই ঘটছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই হার বেড়েছে অনেক। সঙ্গে যোগ হয়েছে অস্থায়ী অভিবাসন, নারী পুরুষ উভয়ের। কাজের খোঁজে কাছের শহর, দূরের শহর, ঢাকা শহর এমনকি দূর কোনো দেশ। এভাবে মানুষ যায়। তার থেকে টাকা আসে, অভিজ্ঞতা আসে, আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। সেই মানুষ যখন ফেরে তখন সে পোশাক-আশাক ভাবভঙ্গী কথাবার্তা খাদ্যাভ্যাস অনেক কিছু পাল্টে আসে। কিশোরী তরুণী যায়, বদ্ধ ঘর থেকে বের হবার জন্য আর শতজন ছটফট করে। ধর্ম সামাজিক অনুশাসন পরিবার পথ আগলে দাঁড়ায়, সংঘাত হয় কিংবা মানুষ তার বোধই বদলে নেয়। সমাজ তার অনুশাসন পাল্টায়।      

মাছে ভাতে বাঙালি এক পরিচয়। কিন্তু মাছের উৎস, নাম এখন অনেক পাল্টে গেছে। নদীনালা, খাল-বিলের মাছ ক্রমে কমে যাচ্ছে, মৎস্য খামারের যেসব মাছ এখন বাঙালির পাতে তার অনেকগুলোই নতুন। অন্য ভাষার নাম। মুনাফা উপযোগী মোটা মাছ, মোটা গরু, খামারের মুরগী, মা ছাড়া মুরগীর বাচ্চা, রঙিন চকচকে ফলমুল, সবজি ‘আবহমান’ দৃশ্যপটের সঙ্গে একদমই মেলে না। যন্ত্রচালিত সেচ, রাসায়নিক সার, গ্রামের জীবনে নতুন শব্দ ও গন্ধ তৈরি করেছে।
 
যেই গ্রাম নিয়ে শেকড়ছাড়া নগরবাসী মধ্যবিত্তের হঠাৎ হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস পড়ে, সেই গ্রাম এখন তাই অনেকখানি গত। গাড়িয়াল ভাই-এর সেই গরু বা মোষের গাড়ি এখন নাই, সেখানে এখন রিকশা বা ভ্যান, কিংবা অগভীর নলকূপের মেশিন বা ট্রাক্টর চালিত যান। নদীগুলো শীর্ণ হয়ে গেছে, তাকে শীর্ণতর করেছে বড় বড় সড়ক। বাস-ট্রাক সবকিছু দাপিয়ে চলে যাচ্ছে। কবিগানের আসরের জায়গায় টিভি ভিসিআর ঘিরে ভিড়। সেখানে ছায়াছবি-বাংলা বা হিন্দি এমনকি ইংরেজি। বাউল বয়াতির গান এখনও শোনা যায় তবে তার উপস্থিতি ভিন্নরকম। সিডি বা ক্যাসেটবন্দি হয়ে তা দোকানে বা ঘরে হঠাৎ হঠাৎ বাজে। যেকোনো সময় ওটা বন্ধ হয়ে হিন্দি গান বা অন্য সাম্প্রতিক চটুল গান শুরু হতে পারে, শুরু হতে পারে ওয়াজও। কিংবা শুরু হতে পারে সিডি প্লেয়ারে ছায়াছবি। রাত ধরে যাত্রা বা পালাগানের মৌসুমি আবহ বদলে এখন বছর ধরে ভিসিআর প্রদর্শনীর বাণিজ্যিক ব্যবস্থা জোরদার হচ্ছে। এখন যে আবার লোকগানের জনপ্রিয় ফিউশন শুরু হয়েছে সেও টেলিভিশন বা সিডি প্লেয়ার ভর করেই। তারপরও বলতে হয়, কবিগানের আসর যাত্রা পালাগান বাউল বয়াতির গান এখনও মানুষকে টানে অন্য যেকোনো মাধ্যমের তুলনায় অনেক বেশি। এই টান এবং বাজারে এসব গানের নয়া কদর এমনকি এই ফিউশন আসলে শেকড়ের টানকেই নির্দেশ করে।

ধর্মের বিবেচনা 

বাংলাদেশে অন্য অনেক দেশের মতোই ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে নানা টেনশন আছে। কোন আচার প্রথা হিন্দুয়ানি, কোনটা মুসলমানি সংস্কৃতি এ নিয়ে বাছ-বিচার-বিতর্ক-উদ্বেগ আমাদের সমাজে কম নেই। মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এটি যেন আরও ক্রমবর্ধমান। কিন্তু কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে মুসলিম সংস্কৃতি বা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি? প্রতিটি ধর্মেরই, বিশেষত শাস্ত্রভিত্তিক ধর্মের কিছু নিদিষ্ট নীতিমালা আছে। সেগুলোতে অভিন্নতা থাকলেও কাল থেকে কালে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে, বিভিন্ন সামাজিক অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে লিঙ্গ মতাদর্শিক পার্থক্য হেতু আচার, পোশাক, প্রথায়, অনুশাসনে একটি নিদিষ্ট ধর্মও অভিন্ন বা অখণ্ড থাকে না। এক ধর্মের মধ্যেই উপস্থিত হয় বহু ধর্ম।
 
সারা বিশ্বের বহু দেশে মুসলমান জনগোষ্ঠী আছেন। তাদের ধর্মীয় পরিচয়ে অভিন্ন রীতি ও বাধ্যবাধকতাও বিদ্যমান- নামাজ, রোজা, হজ্জ, জাকাত, কোরআন তেলাওয়াত, শরিয়া বিধি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর উপস্থাপনা বা অনুশাসন মেনে চলাতে অঞ্চলভেদে তৈরি হয় অনেক পার্থক্য। তাছাড়া সামজিক অনুশাসন, উৎসব পার্বণ, খাদ্য, বস্ত্র, জীবন-জীবিকা প্রকৃতি সম্পর্ক ইত্যাদিতে তৈরি হয় বিবিধ তফাত। কোথাও শবেবরাত, ঈদে মিলাদুন্নবী উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠান কোথাও তা নেহাত সাদামাটা। এবং কোথাও এগুলোর উদযাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
 
যে অঞ্চল মরুভূমি সেখানে উৎসব কিংবা বিবাহ-পার্বণে ফুল-লতাপাতা-বৃক্ষের কোনো স্থান নাই, মিথ সেখানে মরুভূমির আশ্রয়ে, পশুপাখির বৈচিত্র্যও খুব কম, তার তাপ আর শীতলতা ঘিরে তৈরি হয় কল্পজগত। যে অঞ্চল সবুজ, নদী-নালা, খাল-বিল ভরা, সেখানে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে লতাপাতা-পাছপালা, পানি, পশু-পাখির সঙ্গে অবিরাম চলাফেলা; অবিচ্ছিন্নতার এই সম্পর্ক থেকেই বোধ বিশ্বাস রীতি-নীতি, এমনকি মিথ-এর ধরনও ভিন্ন। উৎসব পার্বণে তাই এগুলোর নানাবিধ উপস্থিতি অস্বীকার করা দুঃসাধ্য। নানা বিশ্বাস প্রথা আনুষ্ঠানিকতায় থাকে লতাপাতা ঘাস দুর্বা শস্যের নানা ব্যবহার। গান এখানে পদে পদে, রঙিন প্রকৃতি জগতের কারণেই হয়তো বহু রঙের উপস্থিতি। এই অঞ্চলের নানা সম্পদ, প্রথা, বিশ্বাস ও বৈচিত্র্য তাই তথাকথিত হিন্দুয়ানি নয়, এগুলো অঞ্চলের মানুষ-প্রকৃতি সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। এর সঙ্গে মিলন ঘটেছে মুসলিম সাধকদের। এভাবে মুসলিম সমাজ নানা ভাব ও ভাষা তৈরি করেছে ভেতর ও বাহির থেকে নিয়ে, এক মুসলিম সমাজেই কত স্রোত। বৌদ্ধ এমনকি খৃষ্টান সমাজেও তাই। এসব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিংবা এগুলোকে অস্বীকার করে টিকে থাকা কঠিন। টিকে থাকলেও তা হয়ে পড়ে শেকড়হীন।
 
সংস্কৃতির বিবিধ মাত্রা, মিত্রষ্ক্রিয়া এবং জড়াজড়ি লেগে থাকাকে অস্বীকার করা, খণ্ডিত অংশকে সম্পূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা এবং তা আরোপ করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা নয়। ক্ষমতা এভাবে মানুষকে খণ্ড খণ্ড করে ফেলার পক্ষপাতি। এগুলো যে বিদ্বেষ, খণ্ডিত চিন্তা ও আত্মকেন্দ্রিকতার বোধ তৈরি করে, সেটাই জন্ম দেয় ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি। বিশ্বব্যাপী এই সংস্কৃতির দাপট এখন প্রবল।
 
ধর্ম মানেই যে প্রাক-পুঁজিবাদী নয়, পুঁজিবাদ যে ধর্মকেও তার আগ্রাসন থেকে রেহাই দেয় না, ধর্ম যে পুঁজিবাদের সঙ্গে সচল কর্মসম্পর্ক তৈরি করতে পারে তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত খ্রিষ্টান-হিন্দু-মুসলমানসহ সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে অনেক স্পষ্টভাবেই এখন উপস্থিত। বাজার ও মুনাফা উপযোগী হিসেবে ধর্মকেও এখন সাজানো হয়। ঈদ, পূজা, ক্রিসমাস সবই এখন বিশাল পুঁজি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্র। ধর্মের নাম যুক্ত করে বিনিয়োগ, ব্যাংকিং, পোশাক নির্ধারণ, অডিও-ভিডিও বাণিজ্য সবই এখন ভালো মুনাফাযোগ্য ক্ষেত্র। ধর্মের নাম ব্যবহার এই সময়ের লাভজনক প্রজেক্ট। ধর্ম নিজেই এখন অনেক বাণিজ্যিকীকৃত। বাণিজ্য এখন ধর্মকে ধারণ করেই সক্রিয়।

পুঁজি যখন ঈশ্বর

কার্যত পুঁজিই এখন ঈশ্বর, নিরাকার। বিভিন্ন রূপে তা সক্রিয়, সর্বত্র বিরাজমান। দখল, ধ্বংস এবং উন্মাদনা সৃষ্টিতে সদা নিয়োজিত। পুঁজিবাদ টিকে থাকে, বিকশিত হয়, মানুষকে পাগল বানায় নানাভাবে। মানুষকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা, বৈরী করা, যন্ত্র বানানো ছাড়া পুঁজিবাদ টিকতে পারে না। মানুষের মধ্যে পণ্য কেনার উন্মাদনা, অর্থকেন্দ্রিক অস্থিরতা, হিংস্র প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনমুখিতা পুঁজির সচলতার জন্য দরকার। মিডিয়া মানুষের প্রয়োজন নির্ধারণ করে, ব্যক্তিত্বের মান নির্ধারণ করে, তৈরি করে সৌন্দর্যের মাপ। গায়ের রং, পোশাক, চোখ হাত পা নখ বুক পিঠ, হাঁটা, কথা বলা সবকিছু নির্ধারিত হয় বাজার থেকে। এই বাজার, মুনাফাকেন্দ্রিক, অর্থ-উন্মাদ-সংস্কৃতি শুধু একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষকে নয়; এক ব্যক্তি মানুষকেও নিজের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্নতার অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। এক ব্যক্তির মধ্যে মানুষ এবং ক্রেতা ভিন্ন হয়ে যায়। ক্রেতার সুখই মনে হয় আসল সুখ। প্রকৃতি, সবুজ ভূমি, আকাশ, নদী, পাখি, বৃক্ষ, লতাপাতা সবই আড়ালে চলে যায়। পণ্য লক্ষ্য হতে হতে মানুষ নিজেও পণ্য হয়ে ওঠে। মানুষের মেধা, সৃজনশীলতা সবই তখন পণ্য। বাজারমূল্যের অধীনস্ত হয়ে পড়ে মানুষের অন্তর্গত ক্ষমতা।
 
এই বাংলাদেশে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই, শুধু ব্যবসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজন নয়, নাট্যপ্রতিভা-চলচ্চিত্রপ্রতিভা-সঙ্গীতপ্রতিভা নিয়োজিত হয় দেশি বিদেশি নানা কোম্পানির পণ্য বিক্রির পথ প্রশস্ত করার কাজে, বিজ্ঞাপন নির্মাণে। পণ্য বিক্রির জন্য মোহ তৈরি, মিথ্যাচার, মানুষের মনোজগৎ দুর্বল ও দখল করবার জন্য নতুন নতুন কায়দা-কানুন বের করাই তখন হয় কৃতিত্বের কাজ। এ এক বিশাল প্রতারণা শিল্প। সে কারণে বিশ্বব্যাপীই পণ্য গবেষণা ও উন্নয়নের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থব্যয় করা হয় জনসংযোগমূলক বা পিআর তৎপরতায়, যার কাজ প্রকৃত অর্থে মানুষকে ভোক্তা হিসেবে উন্মাদ বানানো, মানুষের মধ্যে আচ্ছ'ন্নতা ও মোহ তৈরি। গবেষণা সংস্থা, বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ বিজ্ঞাপনী সংস্থারই সম্পূরক। একচেটিয়া পুঁজির ধ্বংসক্রিয়াকে উন্নয়ন হিসেবে, যুদ্ধকে শান্তি, দখলকে গণতন্ত্র হিসেবে উপস্থিত করায় এদের ভুমিকা একটি বড় জালের অন্তর্গত।
 
মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী তাই বিশাল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলছে: চলচ্চিত্র, প্রকাশনা, সঙ্গীত, থিয়েটার, বিজ্ঞাপন, প্রচারণা সব এখানে একাকার। এটাই বিশ্ব সংস্কৃতির একটি অভিন্ন আবহ তৈরি করেছে। স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যা কিছু অগ্রগতি তার একটি বড় শক্তি বিশ্বব্যাপী এক অভিন্ন পুঁজি-দাস, নিষ্ক্রিয় মস্তিক, বিভ্রান্ত, সেজোফ্রেনিক মানব সমাজ তৈরিতে নিয়োজিত থাকে। এখানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, বাঙালি-অবাঙালি, মুসলমান-অমুসলমান একাকার। পার্থক্য তৈরি হয় ভাষা, অঞ্চল বা ধর্ম দিয়ে নয়, বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। প্রতিরোধ তৈরি হয় সেই জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে যারা এই অভিন্নতা, মোহ, বিভ্রান্ত এবং রোগগ্রস্ত অবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করে দুনিয়া দেখতে সক্ষম হয়। সক্ষম হয় মানুষ হিসেবে উপলব্ধির ক্ষমতা রক্ষা করতে। সেই সমতা নির্মাণে প্রয়োজন হয় শেকড় সংলগ্নতার। 

প্রযুক্তির বিকাশ আর নিমজ্জন 

সেলিম আল দীনের শেষের কাজগুলোর একটি হলো নিমজ্জন। শত হাজার বছর ধরে এই সুন্দর পৃথিবীতে, এই সুন্দর মানুষদের মধ্যেকার বীভৎস অভিজ্ঞতার বয়ান। এত সম্পদ, এত উন্নয়ন, এত প্রযুক্তি কিন্তু দমবন্ধ করা রক্তাক্ত জনপদের সংখ্যা যেন বাড়তেই থাকে। সেলিম আল দীন আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে নিমজ্জন এ যোগ হতো এই সময়ে গাজা উপত্যকায় শিশুদের ছেঁড়াখোঁড়া লাশের চিত্র। প্রযুক্তির উন্নয়নে জীবন মুক্ত না হয়ে শৃঙ্খলে আর দখলে আরও বিপর্যস্ত হয়।

প্রযুক্তিগত দিক থেকে বর্তমান বিশ্ব এখন অনেক নিকটতর হয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আদান-প্রদান বেড়েছে, নিজস্ব ভৌগোলিক সীমানার বাইরে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের বিভেদ, সংঘাতও অনেক মূর্তরূপ নিয়েছে। পুরনো পরিচয় হুমকির মুখে, পরিচয়ের সন্ধানে ধর্ম, জাতি, বর্ণ আবার নুতনভাবে জায়গা করে নিচ্ছে।
 
সম্পদ ও প্রযুক্তিগত দিক বিবেচনা করলে এখন সারাবিশ্বের মানুষ তার নানা বৈচিত্র্য নিয়ে এক সমৃদ্ধ অখণ্ড বিশ্ব গড়ে তুলতে সক্ষম। কিন্তু এই ক্ষমতার সামনে বড় অচলায়তন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন। জীবন্ত মানুষের উপর পুঁজি বা মৃত শ্রমের আধিপত্য। বর্তমান বিশ্বায়ন বলে যে প্রক্রিয়া নির্দেশ করা হয় তার আসল পরিচয় হচ্ছে পুঁজির আন্তর্জাতিকীরণ এবং একচেটিয়াকরণ। এই প্রক্রিয়ায় সম্পদ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে ব্যবস্থার কেন্দ্রে।  বর্তমানে যার রাষ্ট্রমুখ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এই একচেটিয়া পুঁজির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হচ্ছে বহুজাতিক সংস্থা। সুতরাং পুরো ব্যবস্থার মূল প্রবণতাই হচ্ছে পুঁজির নিজস্ব তাগিদের প্রতিফলন: অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা, মুনাফার সন্ধানে দখল, ধ্বংস, আধিপত্য, সন্ত্রাস, যুদ্ধ। এর মধ্যেই যদি মানুষের সম্পদ, মেধা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা সবকিছু সমাবেশ আটকে যার তাহলে কীরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হতে পারে? সেটাই হয়েছে।
 
সারা বিশ্বের সকল মানুষের বিশুদ্ধ পানি পান নিশ্চিত করবার জন্য যে অর্থ ব্যয় প্রয়োজন তার পরিমান ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থব্যয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় অনেক পেছনে, অথচ দূষিত পানি পান করবার কারণে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যাই অধিক। অথচ এই বিশ্বেই এর ১০০ গুণ বেশি বা ৯০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ প্রতি বছর ব্যয় হচেছ মারণাস্ত্র উৎপাদন ও বাণিজ্যে। যার সর্বশেষ রক্তাক্ত চেহারা দেখতে পাচ্ছি গাজায় ইসরাইলী-মার্কিনী গণহত্যায়, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে। এই বিনিয়োগ উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করে নানাভাবে, এই বিনিয়োগ সমর্থন পায় বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর, নেতৃত্ব যার এখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। আর এর চাপেই বিশ্ব অর্থনীতি এখন যুদ্ধকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। শুধু যে দেশ দখল, ধ্বংস, লুন্ঠন, গণহত্যা এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল তাই নয়- দেশে দেশে সন্ত্রাস, খুন, সহিংসতার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এরই সহযোগী। মুনাফা পুঁজিবাদের প্রাণ ভোমরা, মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য অস্ত্র, মাদকদ্রব্য, যৌন বাণিজ্যের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ।
 
এই বিশ্ব ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য গতি হচ্ছে ভয়াবহ অসঙ্গতি ও বৈষম্য বৃদ্ধি। তাই এই ধরনের ব্যবস্থা রক্ষা করবার জন্য দরকার হয় নিপীড়নমুলক যাবতীয় সাজসরঞ্জাম। আর এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার মধ্যে দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে বল প্রয়োগ- সামরিক বাহিনী-আইন-পুলিশ ইত্যাদি দিয়ে তা কার্যকর হয়। অন্যটি হচ্ছে সমাজের মধ্যে এই ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি সৃষ্টি। এই সম্মতি বা দাসত্ব সৃষ্টি প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয় বৈষম্য-নিপীড়ন-অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থার পক্ষে সংস্কৃতির ডামাডোল। শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া, প্রকাশনা, গবেষণা ইত্যাদি ধর্ম, শ্রেণী, জাতি-বর্ণ-লিঙ্গীয় আধিপত্যের মতাদর্শ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন  করে। দেশে দেশে, দেশের অভ্যন্তরে ভিন্ন জাতি বর্ণের বিনাশকারী গণহত্যা বৈধতা লাভ করে জাতীয়তাবাদ, সন্ত্রাস দমন আর নিরাপত্তার নিনাদে। এই সংস্কৃতি এখন বিশ্বব্যাপী অধিপতি সংস্কৃতি, বাংলাদেশেও তাই। এই অধিপতি সংস্কৃতির রাজনীতি ও অর্থনীতি শনাক্ত না করে, তার মুখোমুখি দাঁড়াবার কোনো উপায় নাই। এসব না করে বাঙালি বা মুসলিম বা প্রাচ্য সংস্কৃতির আওয়াজ কোনো নতুন দিশা দেবে না। আর মানুষের দিশাহীনতা প্রবল অধিপতি গোষ্ঠীর জন্য খুবই নিরাপদ।

লড়াই দেশে লড়াই বৈশ্বিক

‘বিদেশী সংস্কৃতি’র আগ্রাসন থেকে ‘দেশীয় আবহমান সংস্কৃতি’র রক্ষার আওয়াজ আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। দেশে যারা সরকারে থাকেন কিংবা সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র আধিপত্য দিয়ে পরিচালনা করেন তাদের অনেকেই এসব কথা বলেন। তাদের মুখ থেকে আমরা এটাও শুনি যে, আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে, আমাদের সমাজের নিয়মনীতি, অনুশাসন রক্ষা করতে হবে। ঐতিহ্য, অনুশাসন, দেশীয় সংস্কৃতির এসব অজুহাত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শোনা যায় নারীর গতিশীলতার মুখে ভীত সমাজপ্রভুদের মুখে। এদের দেশমুখিতার আসল চিত্র কেমন?
 
যেসব ক্ষমতাবান রুটিনমাফিক এসব কথা বলেন, তারা দেশের সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দিতে সর্বশক্তি দিয়ে নিয়োজিত; বাংলা ভাষা তাদের কাছে অপাঙক্তেয়; দেশের নদীনালা-খালবিল তাদের দখলে পর্যুদস্ত; দেশের মধ্যে নারী পাচার, যৌন বাণিজ্য, অস্ত্র বানিজ্য, মাদক বানিজ্য তাদের অনেকের চোরাই কোটিপতি হবার মাধ্যম। বাঙালি হিসেবে বা মুসলমান হিসেবে তাই তার সেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্মতি দরকার যাদের সর্বনাশ করেই তার প্রতিপত্তি  ও প্রতিষ্ঠা।
 
‘বাহির’ ও ‘বিদেশী’ সংস্কৃতির নানাকিছু ধারণ একটি অনিবার্য প্রক্রিয়া। সকল জীবন্ত সংস্কৃতির অভিজ্ঞতাই তাই। শেকড় শক্ত থাকলে এর মধ্য দিয়ে সব মানুষই সমৃদ্ধ হয়। বিদেশী সংস্কৃতি  থেকে গ্রহণ আর ধারণ কোন সংস্কৃতি অস্বীকার করতে পারে? দাসত্ব আর মিথষ্ক্রিয়া এক কথা নয়। আর বিদেশী মানে কী? দেশী মানেই বা কী? কোন জায়গায় তার সীমানা? ভৌগলিক সীমানা রাষ্ট্র গঠন সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে ঠিক কিন্তু সেই সীমা দিয়েই কি সংস্কৃতির বিভাজন করা যায়? বিশ্ব পুঁজিবাদী আধিপত্যের নাটবল্টু যারা এই দেশে, তারা সংস্কৃতির কোন কোন ক্ষেত্রে কেন এত দেশি? একই সঙ্গে পুঁজিবাদী উন্মাদনা তৈরির সংস্কৃতি বিদেশী যেমন পশ্চিমা, আবার এর বিরুদ্ধে লড়াই ধারাও বিদেশে কম নেই। কোনটার আমরা বিরোধী? সবাই সবগুলোর বিরোধী নয়। শাসকগোষ্ঠী নিজেরা প্রথম ধারার অংশ, তাদের বিরোধ দ্বিতীয় ধারার সঙ্গে। আমাদের বিরোধ প্রথম ধারার সঙ্গে, দ্বিতীয় ধারায় আমরা যুক্ততা বোধ করি। প্রথম ধারায় উন্মূল হলে সমস্যা নেই, কিন্তু দ্বিতীয় ধারায় শেকড় নিয়েই কেবল ডালপালা ছড়ানো যায় বিশ্বলোকে।
 
একইভাবে ঐতিহ্য রক্ষায় প্রশ্নও অখণ্ড নয়। ঐতিহ্য মানেই আদরনীয় নয়, ঐতিহ্য মানেই সকল মানুষের জন্য অভিন্ন অর্থবহ নয়। বাউল, বয়াতি মানেই অখণ্ড জনগোষ্ঠী নয়। তার সুর মর্ম সব এক নয়। নারীকে অস্তিত্বহীন, বিলীন করে দেখার একটা ঐতিহ্য আছে আমাদের, আবার নারীর নিজের শক্তিতে দাঁড়ানো চেষ্টার ঐতিহ্যও আছে। কোনটি আমরা গ্রহণ করবো? কর্তৃত্ব, শাসন, নিপীড়ন, বৈষম্যকে মহিমান্বিত করবার ঐতিহ্য আছে আবার এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঐতিহ্যও আমাদের কম নেই। ধর্মীয়, জাাতিগত বৈরিতাকে গ্রহণ করবার বিশ্বাস, প্রথা, ঐতিহ্য যেমন আছে, তেমনি সবার উপরে মানুষকে সত্য ভাবার ঐতিহ্যও আছে আমাদের। কোনটি কার কাছে গ্রহণযোগ্য? শ্রেণী বৈষম্যকে ললাট লিখন বা ঐশ্বরিক বিধান হিসেবে গ্রহণের ঐতিহ্য যেমন আছে, তেমনি আছে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঐতিহ্যও। কোনটিকে আমরা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করবো? এসব প্রশ্নের উত্তর থেকেই আমরা আমাদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারি। সেলিম আল দীন তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন মানুষ আর প্রকৃতির পক্ষে।  

আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সংস্কৃতির লড়াই জনসমাজের সেই ধারার টানেই অগ্রসর হয় যা শ্রেণীগত, জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গীয় বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখে এবং তার জন্য মানুষকে সমবেত করবার চেষ্টা করে। বৈষম্য ও নিপীড়ন থেকে, দাসত্বের ভাবজগত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হলে আমাদের সামনে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার পথ আরও স্পষ্ট হবে।  

এই স্বপ্ন ও লড়াই কোনো দেশের একক নয়; কোনো জাতি বা ধর্মের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিশ্বজোড়া, এটি সমগ্র মানুষের। বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বায়িত সমাজে আমাদের সংস্কৃতির লড়াই, তার ভেতর-বাহির, তাই নতুন সমাজ ও নতুন বিশ্ব নির্মাণের সুর, ভাষা, চিহ্ন, সৃজনশীলতার উপর ভর করে অগ্রসরমান। সেই ধারাতে সেলিম একটি দৃঢ়মূল খুঁটি।

[সেলিম আল দীন স্মারক বক্তৃতা। ১৬ জানুয়ারি ২০০৯। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা-য় পঠিত] 

আনু মুহাম্মদ: লেখক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়