Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বাঙলায় অভিনয়-চেতনার উন্মেষ ও যাত্রাগানের উদ্ভব

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

সংস্কৃতসাহিত্যের ‘দৃশ্যকাব্য’ যুগপৎ দেখার এবং শোনার উপযোগী। দৃশ্যকাব্যকে বাংলাভাষায় বলা হয়েছে ‘অভিনেয়’ অর্থাৎ অভিনয় করার উপযোগী। ‘অভি’ অর্থ সম্মুখে আর ‘নী’ অর্থ নিয়ে যাওয়া বা তুলে ধরা।১  যেকোনো বিষয় বা ঘটনাকে দর্শকশ্রোতার সামনে উপস্থাপন করাই অভিনয়। মানবজন্মের শুরু থেকেই পারস্পরিক ভাববিনিময় বা তথ্য আদান-প্রদানের জন্যে অঙ্গভঙ্গি করার মধ্য দিয়ে এই অভিনয়ের শুরু। কিন্তু শাস্ত্র বা কলা হিসেবে অভিনয় এসেছে অনেক পরে।

এযাবৎ আবিষ্কৃত বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘ঋগ্বেদ’-এর কতিপয় সূক্ত সংলাপাত্মক এবং লক্ষ্য করা যায় যে, তার মধ্যে নাট্যগুণ বিদ্যমান। যম-যমী সূক্ত (১০/১০), পুরূরবা-উর্বশী সূক্ত (১০/৯৫), অগ্যস্ত্য-লোপামুদ্রা সূক্ত (১/১৭৯), পণি-সরমা সূক্ত (১০/১০৮), ইন্দ্র-মরুৎ সূক্ত (১/১৬৫,১৭০), ইন্দ্র-বসুক্ত সূক্ত (১০/২৮), ইন্দ্র-অদিতি-বামদেব সূক্ত (৪/১৮), দেব-অগ্নি সূক্ত (১০/৫১), বিশ্বামিত্র-নদী সূক্ত (৩/৩৩) প্রভৃতি সূক্তে নাট্যগুণের বা অভিনয়-উপাদানের বিশেষ আধিক্য প্রতীয়মান। বৈদিক যুগে বিভিন্ন যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকে নির্মল আনন্দ প্রদানের জন্য অভিনেয় দৃশ্যের আয়োজন করা হত। এই উদ্যোগ-আয়োজন থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, অভিনয়মূলক যাত্রার বীজ বেদ-গ্রন্থের মধ্যেই সুপ্ত ছিল। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রসমূহের মধ্যে আচার্য ভরত রচিত ‘নাট্যশাস্ত্র’ই প্রাচীনতম বলে স্বীকৃত। ‘নাট্যশাস্ত্রে’র শুরুতে নাটকের তথা অভিনয়ের উৎপত্তি নিয়ে একটি কাহিনী বলা হয়েছে। ভরত-কথিত সেই কাহিনীটি হল-

গ্রাম্যধর্মপ্রবৃত্তে তু কামলোভবশংগতে।
ঈর্ষ্যাক্রোধাভিসংমূঢ়ে লোকে সুখিতদুঃখিতে॥
দেবদানবগন্ধর্বযক্ষরক্ষোমহোরগৈঃ।
জম্বুদ্বীপে সমাক্রান্তে লোকপাল-প্রতিষ্ঠিতে॥
ন বেদব্যবহারোহয়ং সংশ্রাব্যঃ শূদ্রজাতিষু।
তস্মাৎ সৃজাপরং বেদং পঞ্চমং সার্ববর্ণিকম্॥
মহেন্দ্রপ্রমুখৈর্দেবৈরুক্তঃ কিল পিতামহঃ।
ক্রীড়নীয়কমিচ্ছামো দৃশ্যং শ্রব্যং চ য যদ্ভবেৎ॥ ২

এই শ্লোকের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়-প্রাচীনকালে জম্বুদ্বীপে অর্থাৎ ভারতবর্ষে ‘গ্রাম্যধর্ম প্রবৃত্ত’ হয়ে কাম ও লোভের বশবর্তী হলে জনগণের হৃদয়ে ঈর্ষা ও ক্রোধের সৃষ্টি হয়। সমাজের এই বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্যে মহেন্দ্র প্রমুখ দেবগণ পিতামহ ব্রহ্মার কাছে গিয়ে একই সঙ্গে দৃশ্য ও শ্রব্য এমন একটি ‘ক্রীড়নীয়ক’ সৃষ্টির প্রার্থনা জানালেন, যাতে সর্ববর্ণের অধিকার থাকে এবং যার প্রয়োগে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ব্রহ্মা যে ‘ক্রীড়নীয়ক’ সৃষ্টি করলেন তাই নাট্যবেদ বা পঞ্চমবেদ। এর উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে-

জগ্রাহ পাঠামৃগ্বেদাৎ সামেভ্যো গীতমেব চ।
যজুর্বেদাদভিনয়ান্ রসানার্থণাদপি॥৩

অর্থাৎ ঋগ্বেদ থেকে ‘পাঠ্যবস্তু’, সামবেদ থেকে ‘গীত’, যজুর্বেদ থেকে ‘অভিনয়’ এবং অথর্ববেদ থেকে ‘রস’ নিয়ে ব্রহ্মা ‘চতুর্বেদাঙ্গসম্ভব’ দৃশ্যকাব্য সৃষ্টি করলেন। উল্লেখ্য, ঐ সময়ে চতুর্বেদে শূদ্রদের কোনো অধিকার ছিল না। তাই ব্রহ্মা শূদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করতে যে নাট্যবেদ সৃষ্টি করলেন, তা চতুর্বেদের পরবর্তী সৃষ্টি বলে তাকে পঞ্চমবেদ বলা হয়।

দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে ব্রহ্মা এই পঞ্চমবেদ আচার্য ভরতকে প্রদান করেন এবং তাঁর শতপুত্র নিয়ে তা প্রয়োগের আদেশ দেন। ব্রহ্মার নির্দেশে ‘মহেন্দ্র বিজয়োৎসব’ উপলক্ষে ভরত এই নাট্যবেদ প্রয়োগ করেন।৪  আচার্য ভরত অভিনীত প্রথম নাটকের নাম দেবাসুরসংগ্রাম। ব্রহ্মার দ্বিতীয় নাটকের নাম অমৃতমন্থন এবং তৃতীয় নাটকের নাম ত্রিপুরদাহ।৫ এভাবে ভারতবর্ষে সংস্কৃত নাটকের শুরু। ভাস (খ্রি.পূ. ৫ম থেকে ১১শ’ শতকের মধ্যে), শূদ্রক (খ্রি.পূ. ৩য় শতক থেকে ৬ষ্ঠ শতক), অশ্বঘোষ (খ্রি.পূ. ১ম শতক), কালিদাস (খ্রি.পূ. ১ম থেকে ৪র্থ শতকের মধ্যে), ভবভূতি (খ্রি.পূ. ৬৫০ থেকে ৭৫০ এর মধ্যে), শ্রীহর্ষ (খ্রিস্টীয় ৭ম শতক), যশোবর্মা (খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের শেষ থেকে ৮ম শতকের প্রথম পাদ), ভট্টনারায়ণ (খ্রিস্টীয় ৭ম থেকে ৯ম শতক), বাণভট্ট (খ্রিস্টীয় ৭ম শতক), বিশাখ দত্ত (খ্রিস্টাব্দ ৮ম-৯ম শতক) প্রমুখ নাট্যকার সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থায়ী আসন লাভ করেছেন।

বাঙালির অভিনয়-চেতনার ক্রমবিকাশকে মোটামুটি তিন ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আদিযুগ, ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্যযুগ এবং তারপর উনবিংশ শতাব্দী থেকে চলমান সময় পর্যন্ত আধুনিক যুগ ধরা যেতে পারে। আদিযুগে বেদের সূক্তের মধ্যে অভিনয়-চেতনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে এই দেশে লোকায়ত ধর্মের চর্চার সংবাদ জানা যায়। এসময়ে বিষ্ণুমূর্তি, মন্দির ও পূজাপার্বণের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়।৬

যাত্রা বিষয়ে বিচ্ছিন্ন যে আলোচনা পাওয়া যায়, তাতে এর ঊন্মেষকাল নিয়ে ব্যাপক মতভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। নগেন্দ্রনাথ বসুর (১৮৬৬-১৯৩৮) বক্তব্য থেকে যাত্রার প্রাচীনতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়-

অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষের সকল স্থানেই প্রকাশ্য রঙ্গভূমে বেশভূষায় ভূষিত ও নানা সাজে সুসজ্জিত নরনারী লইয়া গীতবাদ্যাদি সহকারে কৃষ্ণপ্রসঙ্গ অভিনয় করিবার রীতি প্রচলিত। পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত ভগবদবতারের লীলা ও চরিত্র ব্যাখ্যান করা এই অভিনয়ের উদ্দেশ্য। ধর্মপ্রাণ হিন্দুগণ সেই দেবচরিত্রের অলৌকিক ঘটনা পরম্পরা স্মরণ রাখিবার জন্য এক একটি উৎসবের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। গীতবাদ্যাদিযোগে ঐ সকল লীলোৎসব-প্রসঙ্গে যে অভিনয়ক্রম প্রদর্শিত হইয়া থাকে, তাহাই প্রকৃত যাত্রা বলিয়া অভিহিত।৭

একাদশ শতাব্দী থেকে রাধা-কৃষ্ণলীলার উদ্ভব হয়। এই রাধা-কৃষ্ণলীলাই জয়দেবের গীতগোবিন্দ-এ রূপায়িত হয় কাব্য-সংগীত-অভিনয়গুণ ধারণ করে। গীতগোবিন্দ’র আঙ্গিক নিয়ে পণ্ডিতদের নানান অভিমত রয়েছে। তবে এই গীতগোবিন্দ যে যাত্রা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা জানা যায় ডক্টর নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা থেকে-

The well-known Sanskrit Idyll called Gita-gobinda, by Jayadeva Goswami, which, as has been well observed, is nothing but a Yatra in Sanskrit, is based on a part of the story, in as much as it depicts only the amours of Krishna with Radha in their various phases without referring to the other two periods of his life.

নিশিকান্তের এই অভিমত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একে যাত্রা ছাড়া আর কিছু মনে করতে চান নি। অনেক বাঙালি পণ্ডিত মনে করছেন, অপভ্রংশ ভাষার খোলস ছেড়ে যখন নতুন বাংলার সৃষ্টি হয়েছিল, তখনই যাত্রাগানের উদ্ভব হয়। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়-

The break up of the old orthodox drama was almost synchronous with the rise of Apabhramasa and modern Indian Literature; and along with it came popular entertainments of the type of semi-religious Jatra.

রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেবের গীতগোবিন্দম’কে ডক্টর আহমদ শরীফ ‘একটি নৃত্য সম্বলিত গীতিনাট্য’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।১০ সুকুমার সেন গীতগোবিন্দম’কে ‘পালাগান’ বলেছেন এবং একে যাত্রাগানের আদিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জয়দেবের স্ত্রী পদ্মাবতী এতে নাচতেন বলে জানিয়েছেন।১১ সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্রের ইতিহাস-প্রণেতা এবি কিথ গীতগোবিন্দম’র মধ্যে যাত্রার উপাদান খুঁজে পেয়েছেন।১২ প্রবোধবন্ধু অধিকারী লিখেছেন, ‘জয়দেব ছিলেন খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের কবি। তাঁর অভিনয়-পদ্ধতিকে ‘নাটগীতি’ ও ‘যাত্রা-নাট’ এই আখ্যাতেই ভূষিত করা হয়েছে’।১৩ এসকল বিবেচনায় প্রবোধবন্ধু যাত্রাকে আটশো বছর আগের অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দীর সৃষ্টি বলে মনে করেছেন। ফোকলোরবিদ আশরাফ সিদ্দিকীও যাত্রার নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। তিনি বলেছেন, ‘কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনের মধ্যেই যাত্রার নিদর্শনটি পাওয়া যাবে।’

ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো শাখারই বিস্তৃৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। গীতগোবিন্দ’র অনুকরণে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে অথবা পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’-এ-ও অনেক অভিনয়যোগ্য উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-সন্ধানী গবেষক ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য থেকে আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন- এ যাত্রার উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য পাই। তিনি একে লোকনাট্যের আদি-অবস্থা বলতে চেয়েছেন। তাঁর ভাষায়-

বেশধারী যাত্রাচরিত্রের ঈষৎ পূর্বাভাস শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন- এ মিলবে; এতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে নৃত্য গীতাত্মক লোকনাট্যের পূর্বরূপ ফুটে উঠেছিল এরকম অনুমান নিতান্ত অসম্ভব নয়। পরে যে সমস্ত কৃষ্ণযাত্রা অনুষ্ঠিত হত, তাতে এ-ধরনের লোকনাট্য পালাই অনুসৃত হয়েছিল।১৪

মধ্য-পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজজীবনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬-১৫৩৩) ব্যাপক অবদান রয়েছে। তিনি নিজে যাত্রাভিনয় করেছেন বলে তাঁর জীবনীপাঠে জানা যায়। কেউ কেউ একে যাত্রা না বলে নাটগীত বা লীলানাট্য বলতে চেয়েছেন। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের গীত, অভিনয়, আর নৃত্যের সমন্বিত পরিবেশনা ‘গীতাভিনয়’ কিংবা প্রকৃত অর্থে ‘যাত্রা’রই নামান্তর। চন্দ্রশেখরের গৃহে শ্রীচৈতন্যের অভিনয়ের বিবরণ পাওয়া যায় কবি কর্ণপুর পরমানন্দ সেনের চৈতন্যচন্দ্রোদয়ম’ নাটকে। ষোড়শ শতাব্দীতেই প্রথম অভিনয় অর্থে ‘যাত্রা’ শব্দের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বাংলার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল আসামের শঙ্করদেবে ‘অঙ্কীয়া নাটে’। নাট্যগবেষক মণীন্দ্রলাল কুণডু জানিয়েছেন-

১৪৮১ খ্রিস্টাব্দের পর চিত্রপট অঙ্কন করে শঙ্করদেব নাচগান সহযোগে যে ‘ভাওনা’ করেছিলেন তার নাম ছিল ‘চিহ্নযাত্রা’। এ থেকে মনে হয়, ‘যাত্রা’ শব্দটি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই পূর্বাঞ্চলে নাটকের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হতে থাকে। শঙ্করদেব অবশ্য নাট, নাটক ও যাত্রার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন নি। তবু যাত্রার বৈশিষ্ট্য থেকে তাঁর পালাগুলি বঞ্চিত ছিল না।১৫

কবি চণ্ডীদাস নিজে যাত্রা করতেন। কথিত আছে যে, যাত্রা করার সময় মণ্ডপ ভেঙে তার তলায় চাপা পড়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আসে শ্রীচৈতন্যদেবের যাত্রাভিনয় প্রসঙ্গ। নবদ্বীপে চন্দ্রশেখর আচার্যের গৃহে কৃষ্ণলীলার অভিনয় করার সময়কে ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দ অথবা ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে অনুমান করা হয়।১৬

ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতির অন্যতম বাহন ‘যাত্রাগান’-র উন্মেষ। দেববন্দনার অংশ হিসেবে গীতবাদ্য-অভিনয়ের উপস্থাপনা যাত্রাগান নামে পরিচিত হলেও অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু বলেছেন যে, ‘পাঁচালীগানের ক্রমিক পরিণতির ফলে যাত্রাগানের উৎপত্তি হইয়াছে’।১৭  বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসকার বিশিষ্ট গবেষক ডক্টর সুকুমার সেন যাত্রার উদ্ভবের কোনো নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেন নি তবে এর পুর্বরূপ হিসেবে পাঁচালীকে বিবেচনা করেছেন। তিনি বলেছেন-

পাঁচালী হইতেই যাত্রার উদ্ভব। যাত্রার সঙ্গে পাঁচালীর পার্থক্য এইমাত্র ছিল যে পাঁচালীতে মূল গায়েন বা পাত্র একটিমাত্র, যাত্রায় একাধিক, সাধারণত তিনটি।১৮

আমরা দেখেছি যে, যাত্রায় এখন আর তিনটি চরিত্রটি নেই, বিশ-বাইশটি চরিত্রও অভিনয় করে। অর্থাৎ তিনি যে যাত্রার কথা বলেছেন তা মূলত নৃত্যগীতাভিনয়। রামলীলা কিংবা কৃষ্ণলীলা পরিবেশনের জন্যে এই ধরনের নৃত্যগীতাভিনয় আঙ্গিক ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে যা রামযাত্রা বা কৃষ্ণযাত্রা হিসেব পরিগণিত হয়।

সময়ের বিবর্তনে যাত্রার বদল হয়েছে আঙ্গিকে ও উপস্থাপনারীতিতে। তবে নগর-সভ্যতার বাইরে এখনও সামাজিক বিনোদন, জ্ঞাপন, শিক্ষণ এবং প্রভাবনের ফলে প্রায়োগিক যোগাযোগ-মাধ্যমের দায়িত্ব পালন করে চলছে। তবু যাত্রা আমাদের গবেষকদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায় নি বলেই মনে হচ্ছে। নরেন বিশ্বাস (১৯৪৫-১৯৯৯) যথার্থই বলেছেন, ‘বঙ্গসংস্কৃতির ঊষালগ্নে এ যাত্রা শুরু হলেও আজো পর্যন্ত এর সঠিক তথ্যভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয় নি। বাঙলা নাট্যসাহিত্যে এ-অধ্যায় দুঃখজনকভাবে উপেক্ষিত’।১৯  এরকম ধারণা নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখেরও (জ. ১৯২৫)। তিনি বলেছেন-

যাত্রাগান পরিবর্তনশীল লোকনাট্যের নানারূপেরই একটি রূপ। কিন্তু এসম্পর্কে মতান্তরের অভাব নেই। কারও কারও মতে খ্রিস্টজন্মের আগে থেকেই ভারতে নাকি কৃষ্ণ-বিষয় নিয়ে যাত্রা রচিত হত। তারই ধারা জয়দেবের মাধ্যমে মধ্যযুগের বাংলায় এসে পড়ে। বাংলাদেশের পাঁচালীগান থেকেই যাত্রার উৎপত্তি, একথাও কেউ কেউ বলেন। তাঁদের মতে এর আগে যাত্রার অস্তিত্ব ছিল না। দুটি মত যে খুবই ভিন্ন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ... এই সব বিভিন্নতার কারণ, বিচার-বিশ্লেষণোপযোগী প্রচুর তথ্যের অভাব। অপ্রচুর তথ্যভিত্তিক আলোচনার ফাঁক অগত্যা ধারণা দিয়েই ভরে নিতে হয়।২০

উৎসব হিসেবে যাত্রার প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকে হলেও অভিনয়-অর্থে যাত্রার উৎপত্তি তার অনেক পরে। যাত্রার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় সংস্কৃত নাটকের আমল থেকেই। গবেষক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের (১৮৭৭-১৯০৪) অনুসন্ধানে জানা যায়-

প্রাচীনকালে যাত্রার অর্থ দেবতা বিশেষের লীলা বা চরিত্রের অংশবিশেষ সাধারণের হৃদয়ে জাগরূক রাখিবার কোনো উৎসব। গ্রিক মেগাস্থেনেসের বিবরণে আছে, আজকালকার যাত্রাভিনয়ের মতো যাত্রার গান পাটলীপুত্রে চন্দ্রগুপ্তের সভায় হইত। ভরত-নাট্যশাস্ত্রেও যাত্রার উল্লেখ আছে। ভবভূতির মালতী-মাধবে ‘ভগবান কালপ্রিয়নাথের যাত্রা’ভিনয়ের কথা আছে। এই যাত্রা উৎসবার্থে এবং পারিভাষিক উভয় অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। উৎসব হিসাবে মহাভারতে ঘোষ-যাত্রার কথা আছে। হরিবংশে বন-যাত্রার কথা আছে। বন-যাত্রা বনভোজন। ইহাতে নৃত্যগীতের ব্যবস্থার কথা আছে। তাহার সঙ্গে এক রকম অভিনয়ের কথা আছে। মনুসংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থেও অভিনেতা ও অভিনেত্রীর উল্লেখ আছে। ধর্ম-সম্বন্ধীয় ও পৌরাণিক বিষয় লইয়াই যাত্রা অভিনয় হইত। শিবযাত্রা সকলের চেয়ে পুরাতন। তারপর রামযাত্রার প্রবর্তন হয়। হিন্দুরাজত্বের সময় হইতেই রামযাত্রার প্রচলন দেখা যায়। রামযাত্রার অনেক পরেই কৃষ্ণযাত্রার উদ্ভব। ভাগবতে লীলাভিনয়ের কথা আছে।২১

যাত্রা-গবেষক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য ধারণা করেছেন যে প্রাচীনকাল থেকেই যাত্রার উদ্ভব হয়েছে। এব্যাপারে তিনি সংস্কৃত নাটক এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত তুলনামূলক আলোচনা করে যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তা হল-

যাত্রা অথবা উৎসব উপলক্ষে অভিনয়ের জন্য নাট্যরচনারীতিও প্রাচীনকাল হইতে ভারতের বিভিন্ন অংশে প্রচলিত। কালপ্রিয়নাথের যাত্রা উপলক্ষে ভবভূতি উত্তররামচরিত ও মালতীমাধব নাটকদ্বয় রচনা করেন। কালিদাস মালবিকাগ্নিমিত্র ও শ্রীহর্ষ রত্নাবলী নাটক বসন্তোৎসবে অভিনীত হইবার জন্য নাট্য রচনা করেন। নাট্যশাস্ত্রকার ভরতমুনি [শাস্ত্রানুযায়ী] জয়বিজয়-কাহিনী অভিনয়ের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন মহেন্দ্রবিজয়োৎসবে। বাংলায়ও দেব-ধর্মোৎসবে অভিনয় করিবার জন্যই যাত্রানাট্য রচিত হইতে আরম্ভ করে-ইহা দ্বিধাহীনভাবে মানিয়া লওয়া যাইতে পারে।২২

ডক্টর অজিতকুমার ঘোষ বলেছেন যে রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে মধ্যযুগে রামযাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীকালে দুর্গাপূজা উপলক্ষে দুর্গাপূজক রামের লীলা অনুষ্ঠিত হত।২৩  তবে রামযাত্রার অনেক আগেই যাত্রার উদ্ভব হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। তিনি বলেছেন-

যাত্রা কথাটি অতি প্রাচীনকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। অতীতে কোনো দেবতার লীলা উপলক্ষে লোকেরা এক জায়গা হইতে অন্য আর এক জায়গায় গমন করিয়া নাচগানের সঙ্গে সেই দেবতার মাহাত্ম্য প্রকাশ করিত। ইহাই যাত্রা নামে অভিহিত ছিল। সুতরাং প্রথমত, যাত্রা বলিতে উৎসব উপলক্ষে গমন এই ব্যাপারটা অপরিহার্য ছিল। কালক্রমে কোনো স্থানে গমন না করিয়া একই স্থানে বসিয়া দেবলীলা অভিনয় করা হইত। এইভাবে দেবযাত্রা অভিনেতব্য যাত্রারূপ লাভ করে।২৪

যাত্রার প্রাচীনতা উল্লেখ করে গ্রন্থ রচনা করেছেন অধ্যাপক মঈনউদ্দীন আহম্মদ। বাংলাদেশে তিনিই যাত্রা-সম্পর্কে গ্রন্থ প্রণয়নে প্রথম উদ্যোগী হন। তিনি লিখেছেন-

পালা, যাত্রাগান বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ। যদিও ইংরেজ আগমনের পরপরই ঊনবিংশ শতাব্দীতে এর প্রসার লাভ করে, তথাপি যাত্রাগানের সূত্রপাত বহু প্রাচীনকালের। আমরা পূর্বের আলোচনার সূত্র থেকে এটুকু বলতে পারি যাত্রার আদিম রূপ দেখতে পাই দ্রাবিড় সভ্যতার কালে। প্রাচীন ব্রতকথা বা এই জাতীয় অনুষ্ঠানের মধ্যেও এর বীজ লুকিয়ে আছে। বৈদিক যুগেও এর প্রচলন ছিল। কেননা ঋগে¦দের সূত্রগুলোর মধ্যে অনেকে যাত্রাগানের প্রাচীনতম নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন যা এসে ঠেকেছে জয়দেবের গীতগোবিন্দ-এ।২৫

ডক্টর সুশীলকুমার দে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস উদ্ধার করতে গিয়ে যাত্রার সন্ধানও পেয়েছেন। তাঁর মন্তব্য থেকে জানা যায় যে, যাত্রার উৎপত্তি হয়েছে বৈষ্ণব যুগে। সুশীলকুমার দে’র মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য-

The earliest reference to the Yatra probably dates from Baishanab era... The influence of Baisnabism therefore was hardly favorable to the development of the inherent dramatic elements in the Yatra; on the other hand it cherished its musical tendency and emphasised its religious predilections. Indeed we find the Baishanabas utilising the popular yatra as a mass of representing Krishna-Lila and diffusing its novel ideas.২৬

যাত্রা বিষয়ে প্রথম গবেষণা হয় ১৮৮২ সালে সুইজ্যারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষক নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় (১৮৫২-১৯১০) 'Yatras or The Popular Dramas of Bengal’ শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। যাত্রার উন্মেষ সম্পর্কে তাঁর অভিমত প্রণিধানযোগ্য-

... বস্তুত এই ধরনের উৎসব ভারতবর্ষে যে বেশ সুপ্রাচীনকাল থেকেই পালিত হতো, তার বহু প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়। বুদ্ধের প্রায় সমসাময়িক দুই শিষ্য মৌদগল্যন ও উপতিষ্যের আত্মজীবনীতে দেখি তাঁরা প্রায়ই রাজগৃহের উৎসব উপলক্ষে মিলিত হতেন পরস্পরের সঙ্গে। বার্লফ, লাসেন প্রমুখ বিশিষ্ট প্রত্নবিদ বুদ্ধের মৃত্যুর তথা মহানির্বাণের যে সময় ধার্য করেছেন (৫৪৩ খ্রিস্টপূর্ব) তাতে করে মৌদগল্যন ও উপতিষ্যের এই ভাষ্য খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের বলে গণ্য করা যেতে পারে। আরো একধাপ এগিয়ে গেলে দেখি ‘ললিতবিস্তার’-এ সিদ্ধার্থের নাট্য-অভিনয়-কুশলতার কথা বলা হয়েছে। এসব থেকে নিঃসংশয় হয়ে বোঝা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই নিয়মিত কৃষ্ণযাত্রার অভিনয় হতো এবং ভারতের সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছেই তা জনপ্রিয় ছিল।২৭

গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ (জ. ১৯৩৮) জানিয়েছেন, ‘ভারত নাট্যশাস্ত্রে, ভবভূতির ‘মালতি মাধব’-এ যাত্রার কথা আছে। ‘মালতি মাধব’-এ ভগবান কালপ্রিয়নাথের যাত্রাভিনয় বা যাত্রাগানের বিবরণ আছে। সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তাঁর অষ্টম শিলালিপিতে উৎসব অর্থে যাত্রা ব্যবহার করেছেন। তিনি যা লিখেছেন তা থেকে জানতে পারি, পূর্ববর্তীকালের রাজারা ‘বিহারযাত্রা’ করতেন। সম্রাট অশোকের অভিষেকের দশম বর্ষে তাঁর ‘ধর্মযাত্রা’ যাত্রার উৎসস্থল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে’।২৮  গবেষক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে-

জয়দেবের গীতগোবিন্দ, বড়ু-চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের অভিনয়লীলা ইত্যাদির সাক্ষ্যে যাত্রাগানকে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী বা তার পূর্ববর্তীকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বাঙালীর নাট্যরসপিপাসা নিবৃত্তির অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।২৯

মমতাজউদদীন আহমেদ যাত্রার উৎপত্তির সময় হিসেবে মনে করেন দ্বাদশ শতাব্দীকে। তিনি লিখেছেন-

Open-air opera has been popular in our country for a long time. This treatise is not meant for a detailed study. Some experts are inclined to go beyond the Vedic Age to seek the roots of this kind of open-air opera. Joy Gobinda (It may be Geetgobinda : researcher) of Joydev of the 12th century is identified as the origin in written form of the songs of open-air opera.৩০

যাত্রার আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ রূপকার পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে যাত্রা বিষয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকে। যাত্রার চলমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি তিনি অতীত উদ্ধারের চেষ্টাও করেছেন। তাঁর মতে যাত্রার জন্ম শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের আগে থেকেই। ‘যাত্রার পূর্বকথা’ নামের একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-

ঠিক কোন্ সময়ে যাত্রার সূচনা হয়েছিল, এই আত্মভোলা জাত সে ইতিহাস রাখে নি। তবে সে যে শ্রীগৌরাঙ্গের জন্মের বহু পূর্বের, তাতে সন্দেহ নেই। দেবদেবীর প্রতিমা নিয়ে রাজপথে যে শোভাযাত্রা বেরুত, তার মধ্যে বিভিন্ন কণ্ঠের গান ও বিভিন্ন ব্যক্তির নাচের অনুষ্ঠান হত। এই শোভাযাত্রাই একসময় পথ থেকে উঠে এল মাঠে, বাগানে বা ধনীর প্রাঙ্গণে। শোভাযাত্রা তখন যাত্রায় নামান্তরিত হল। ক্রমে বিচ্ছিন্ন নাচগান দানা বাঁধল এবং এক একটি পৌরাণিক কাহিনী আশ্রয় করে পালায় গ্রথিত হল; গ্রন্থনার জন্যে ততটুকুই গদ্যসংলাপ আমদানি করা হল। গীতপ্রধান এই পালাগুলো কয়েক শতাব্দী পরে গীতাভিনয় নামে পরিচিত হয়েছিল।৩১

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, বিশিষ্ট নাট্যগবেষক সুরেশচন্দ্র মৈত্র বাঙালির অভিনয়-ঐতিহ্যের পাঁচালী, যাত্রা, ঢপকীর্তন, কবিগান, তর্জা, ঝমুর, সঙ প্রভৃতি আঙ্গিক পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসছেন যে যাত্রা ষোড়শ শতকেই জন্ম নিয়েছে। তবে তা পাঁচালী থেকে আসে নি। পাঁচালী স্বতন্ত্র এক শিল্পমাধ্যম। তিনি বলেছেন-

আমাদের মতে ষোড়শ শতকেই যাত্রার উদ্ভব হয়েছিল; অষ্টাদশ শতকে যাত্রা সাধারণ প্রমোদকলায় রূপান্তরিত হয়েছিল। রাঢ়ের ভক্তি-প্লাবিত অঞ্চলে জন্মলাভ করে কলকাতায় যে আসর জাঁকাতে পেরেছিল, ধর্মীয় নিরপেক্ষতাই তার কারণ।৩২

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯) নিশিকান্তের অভিসন্দর্ভের সমালোচনা-সূত্রে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার তিনসংখ্যায় দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। ‘যাত্রার ইতিবৃত্ত’ নামক প্রবন্ধে তিনি লেখেন-

ইউরোপে যে অবস্থায় মিস্টরিজ (গুংঃবৎরবং) আরম্ভ হইয়াছিল, বাঙ্গালার সেই অবস্থায় যাত্রা আরম্ভ হয়। সে কতদিনের কথা, তাহা আমরা এক্ষণে নিশ্চয় করিয়া বলিতে প্রস্তুত নহি। শুনিতে পাওয়া যায় চৈতন্যদেবের বহু পূর্বে বাঙ্গালায় যাত্রা ছিল, সে যাত্রা কেবল শক্তি বিষয়ক, কৃষ্ণযাত্রা তখন একবারে হইত না। চৈতন্যদেবের পর যখন বৈষ্ণব সম্প্রদায় জাঁকিয়া উঠিল, তখন কৃষ্ণলীলার যাত্রা আরম্ভ করিবার ইচ্ছা অনেকের হয়। এই সময় একজন বৈষ্ণব এক নূতন পদ্ধতি অবলম্বনপূর্বক এক পুষ্করিণীর উপর কৃষ্ণযাত্রা অভিনয় করে। পুষ্করিণীটি বড় সুন্দর সাজানো হইয়াছিল। তাহার নাম কালীয় হ্রদ দেওয়া হইয়াছিল। মধ্যস্থলে এক অজগর কালীয় সর্প, জল হইতে ফণা বিস্তার করিয়া রহিয়াছে, সেই ফণার উপর শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়াইয়া বেণু বাজাইতেছেন। আর মধ্যেমধ্যে ‘নয়ন ঢোলাইয়া’ নৃত্য করিতেছেন। নৃত্যপীড়নে কালীয়ের প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছে। চারিপার্শ্বে তাঁহার স্ত্রীগণ জল হইতে অর্ধাঙ্গ তুলিয়া যোড় করে কৃষ্ণকে মিনতি করিতেছে- কখন তাহা কথায়, কখন বা গীতে। নিকটে এক মাচার উপর মৃদঙ্গ, করতাল, খরতাল বাজিতেছে, তথায় বসিয়া যাত্রাওয়ালারা ‘দোয়ার্কি’ করিতেছে।৩৩

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) সম্পাদিত ওই ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ভাষ্যমতে যাত্রার উন্মেষকাল চিহ্নিত করার পাশাপাশি এর নৈতিক মৃত্যুকালও চিহ্নিত করা হয়েছে, ‘চৈতন্যদেবের আগে ইহার জন্ম, রাজা রামমোহন রায়ের পর ইহার মৃত্যু’।৩৪  বিশিষ্ট নাটব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরী পঞ্চদশ শতকেই যাত্রার উপস্থিতি অনুমান করেছেন। তিনি বলেছেন-

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আমাদের দেশের লোকেরা এই প্রকারের ভক্তিমূলক আমোদ প্রমোদে উল্লসিত হোত। তারপরেই সংস্কৃত নাটকের ঐতিহ্য এবং প্রভাব অনুভূত হতে লাগল এবং যাত্রাও নতুনভাবে রূপায়িত হতে লাগল। প্রবেশ বহিরাগমন দুই অঙ্কের মধ্যবর্তী বিরতি, সাজসজ্জা, এবং আরও নানাপ্রকার শিল্পসংক্রান্ত ও খুঁটিনাটি বিষয় ক্রমশ এতে সন্নিবেশিত হল। গদ্যে উপযুক্ত সংলাপের অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো গান দিয়ে রচিত হোত।৩৫

ভারতের নাট্যগবেষক কপিলা বাৎসায়ন বলেছেন-

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে চৈতন্যের একই বৈষ্ণব আন্দোলন থেকে দুটি স্রোতধারার উদ্ভব হয়। এর একটি হল কীর্তনগান, অন্যটি হল কৃষ্ণ অথবা রাধাকৃষ্ণের কাহিনীকে ঘিরে রচিত নাট্যাভিনয়সমূহ। পরে মণিপুরও এই দুটি শিল্পরূপকে গ্রহণ করে। এইভাবে আমরা দুটি অঞ্চলেই কীর্তনসংগীতের সুস্পষ্ট এক ঐতিহ্যকে পাই, আর পাই যাত্রাভিনয়কে।৩৬

মন্মথ রায় (১৮৯৯-১৯৮৮) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ডি.এল. রায় রিডারশিপ স্মারক বক্তৃতায় শ্রীচৈতন্য জীবনী পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দশকে নবদ্বীপে চন্দ্রশেখর আচার্যের বাসভবনে শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং কৃষ্ণলীলায় অভিনয় করেছেন।৩৭  তাঁর মতে এসময় থেকেই অভিনয়কলা হিসেবে যাত্রার শুরু।

যাত্রাগান অতি প্রাচীন শিল্পমাধ্যম বলেই এর উৎস সম্পর্কে যৌক্তিক মতভেদ রয়েছে। প্রভাতকুমার দাসের মতে, ‘এ ঘটনাটি ঐতিহাসিক সত্য যে, ষোড়শ শতাব্দীতে বৈষ্ণব ধর্মের উত্থানের সময় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের উদ্যোগে ধর্মপ্রচারের বাহন হিসেবে যে অভিনয় অনুষ্ঠান সর্বপ্রথমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল, তাকে যাত্রাগান হিসেবে অভিহিত করা হলেও, তখনও পর্যন্ত এই বিশেষ অর্থে যাত্রা শব্দটির ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। প্রেম ও ভক্তির উদ্বোধনের লক্ষ্যে, বহু বাধা-বিছিন্ন সমাজের মধ্যে ঐক্য ও সাম্যবোধের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই এই লোকমাধ্যমটি ব্যবহার করেছিলেন শ্রীচৈতন্য’।৩৮ সময়ের বিবর্তনে যাত্রা এখন ‘অপেরা’ নামেও পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশিষ্ট গবেষক প্রভাতকুমার গোস্বামী যাত্রা ও থিয়েটারের একটি তুলানামূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে যাত্রার উন্মেষকাল চিহ্নিত করেছেন এবং বিকাশের প্রসঙ্গও নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন-

ষোড়শ শতাব্দীতে যাত্রার বীজ বাংলার মাটিতে উপ্ত হয়েছিল; তা অষ্টাদশ শতাব্দীতে অঙ্কুরিত হয় এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা নানা শাখা-প্রশাখা সমন্বিত বৃক্ষে পরিণত হয়। ‘যাত্রা’র জন্মটা আগে হলেও তার বিকাশটা ঘটেছে থিয়েটারের পাশাপাশি।৩৯

মণীন্দ্রলাল কুণ্ডুর ধারণা হচ্ছে, খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বাংলাদেশে প্রচলিত নাটগীতের ধারাটি ঈষৎ পরিবর্তিতরূপে যাত্রা নামে অভিহিত হতে থাকে। তিনি বলেছেন, ‘ষোড়শ শতাব্দীর আগে নাটক বা নাট্যাভিনয় অর্থে ‘যাত্রা’ শব্দের প্রয়োগ আমরা পাই না। অবশ্য অভিনয় ছাড়া অন্যান্য অর্থে ‘যাত্রা’ শব্দটির প্রয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল’।৪০ ষোড়শ শতাব্দীতে যাত্রার উদ্ভব বিষয়ে একমত হয়ে যাত্রানটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস (১৯২৫-১৯৮৭) লিখেছেন-

কোনও কোনও গবেষকের মতে সূর্যের কক্ষান্তর গমন উপলক্ষে যে উৎসব উদ্যাপিত হতো, তার প্রধান অঙ্গ অভিনয় ছিল বলে অভিনয় অর্থে যাত্রা বোঝায়। আবার কারও অভিমত দেবদেবীর দর্শন উদ্দেশে রঙ্গ-কৌতুক-নৃত্য-গীত সহযোগে গমনপূর্বক অভিনয় প্রদর্শনের মাধ্যমে দেবমন্দিরে পূজা-অর্পণ এবং সার্বিক কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যে যে উৎসব, সে উৎসবই যাত্রা। .. কারও কারও মতে রামায়ণ গান ও পাঁচালী থেকে যাত্রার উৎপত্তি। ... ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য স্বয়ং কৃষ্ণলীলায় অভিনয় করেছিলেন। চৈতন্যচরিত্রামৃতের আদিলীলায় পাওয়া যায় যে, শ্রীকৃষ্ণ সেজেছিলেন অদ্বৈত আচার্য আর শ্রীরাধা ও রুক্ষিণীর দ্বৈত ভূমিকায় রূপ দিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য।৪১

আমাদের নাট্যশিক্ষক কিংবা নাট্যগবেষকেরা যাত্রার উৎপত্তি বিষয়ে গভীর কোনো গবেষণায় ব্রতী হন নি। কোনো কোনো নাট্যজনের মতে মধ্যযুগ থেকেই যাত্রার উৎপত্তি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধে যেমন একজন লিখেছেন-

Native dramatic form of Bangladesh is Jatra. ... the most popular dramatic form in Bengal was 'Jatra' which is originated in the medieval period. Origin of drama in Egypt or Greece was held in honour of Gods, the same event happened in case of 'Jatra' in Bengal which was on the pretext of Devpuja (Worship of God). During the performance of Jatra, physical movements were done with dance and music. So, 'Jatra', at the time was called 'opera.৪২

এখানে মধ্যযুগে জন্ম নেয়া যাত্রাকে বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাত্রার শুরুতে যে গানের আধিক্য ছিল, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে গানের সংখ্যা কমে সংলাপের সংখ্যা বেড়ে গেল। শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত অভিনয়কলাই স্বতন্ত্র যাত্রামাধ্যম হিসেবে রূপান্তরিত হয়। বিশিষ্ট সংগীত-গবেষক ডক্টর করুণাময় গোস্বামী বলেন যে, ‘বড়ু- চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন-র দৃষ্টান্তেই যাত্রা রচিত হয়’।৪৩  নাট্যকার ও অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী অবশ্য যাত্রার ইতিহাস আরও আগে থেকে শুরু করতে চান। তিনি যাত্রার সঙ্গে নগরকীর্তন এবং গাজনের সঙের সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। বলেন-

ধর্মীয় শোভাযাত্রায় বিশেষ করে নগরকীর্তনে রাধা, কৃষ্ণ, বড়াই এবং বলরাম-শ্রীদাম-সুবলসহ সখা-সখী সাজিয়ে নগর পরিভ্রমণ করা হতো; আবার গাজনের সঙ হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তিতে হর-পার্বতী সাজিয়ে নৃত্যগীত পরিবেশিত হতো। এখনও বিভিন্ন জায়গায় এর প্রচলন রয়েছে। এই শোভাযাত্রাই আমাদের ‘যাত্রা’ বা নাটকের আদিরূপ। পরে ধর্মীয় কাহিনীর অংশীভূত বিদ্যাসুন্দরের প্রেমকাহিনী (কালিকামঙ্গল) অবলম্বনে তিন চরিত্রের নাটক পরিবেশিত হয়। বিদ্যা, সুন্দর ও হীরামালিনী সেজে সঙ্গীত-নির্ভর সংলাপে বিদ্যাসুন্দর পরিবেশিত হয়। ইউরোপীয় ঢঙে থিয়েটার ও নাটকের প্রবর্তনের পূর্বে এই ছিল বাংলা নাট্যজগতের পরিস্থিতি।৪৪

গবেষক ভূঁইয়া বজলুর রহমানও মনে করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর আগেই যাত্রার শুরু। এক্ষেত্রে তিনি দ্রাবিড় যুগের দিকেও দৃষ্টি দিতে চান। তাঁর ভাষায় বিষয়টি দাঁড়ায় এরকম-

 ... দ্রাবিড় যুগ হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যাত্রাগানের বিবর্তনের ইতিহাস অত্যন্ত ক্ষীণ এবং দুর্লভ বটে। এছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলার সমাজজীবন ছিল দ্বিধাবিভক্তির যুগ। এই যুগে বাংলার গণমানুষে একটা ‘ভ্যাকুয়াম’ সৃষ্টি হয়েছিল। তখন সেই শূন্যতা পূরণ করেছিল যে ক’টি গ্রামবাংলার মহৎ সংস্কৃতি-সম্পদ, তার মধ্যে পালা বা যাত্রাগানও ছিল অন্যতম স্তর নিয়ে।৪৫

নাট্যগবেষক ডক্টর সৈয়দ জামিল আহমেদের বিবেচনায় প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে থেকেই পেশাদার যাত্রাদলের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ যাত্রার উন্মেষ ষোড়শ শতকে। তিনি লিখেছেন-

In its nearly five-century-long history, Jatra has envolved from a simple devotional performance held in the open courtyards of homesteads to elaborate commercial ventures of itinerant professional troupes given in temporarily constructed performance space.৪৬

জিয়া হায়দার (১৯৩৬) যাত্রার দেখা পেয়েছেন প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে। তিনি বলেছেন, ‘প্রাচীন বাংলায় যাত্রাভিনয়ে কৃষ্ণবিষয়ক পালাগানই প্রধান ও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ছিল। অষ্টাদশ শতক থেকে, সম্ভবত তার আগে থেকেই ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদল গড়ে ওঠে। ঐ সময় থেকেই বিদ্যাসুন্দর, নলদময়ন্তী প্রভৃতি যাত্রার প্রাধান্য দেখা যায় বিশেষভাবে শহুরে বারোয়ারিতে ও ধনী ব্যক্তিদের গৃহে। সম্ভবত ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই যাত্রার উপস্থাপনরীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়’।৪৭ মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী যাত্রাকে সপ্তদশ শতকের কীর্তনগান থেকে উদ্ভূত বলে মনে করেন। তিনি বলেন-

Various cultural thinkers believe that with the emergence of the Kirtan songs during the 17th century, the Jatra came into being, as the Kirtan songs took the form of jatra songs.৪৮

মধ্যযুগের বাংলানাট্য নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন সেলিম আল দীন। তিনি অবশ্য অষ্টাদশ শতকের আগে যাত্রার কোনো নমুনা পাওয়া যাবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ‘যাত্রা’ কথাটার অর্থ সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই মূলত ‘যাত্রা’ নাট্যাদি অর্থে পরিচিতি লাভ করে’।৪৯  ‘পাঁচালী থেকে যাত্রার উদ্ভব’-সুকুমার সেনের এই অভিমতকে তিনি মানতে পারেন নি। তিনি বলেছেন-

যাত্রা নাট্য হিসেবে রূপলাভের পূর্বেই, যাত্রা-উৎসবে মধ্যযুগে, লীলানাটকের অভিনয় হতো। কৃষ্ণ জন্মযাত্রা বা জগন্নাথের রথযাত্রা উপলক্ষে লীলানাট্যের অভিনয় স্বয়ং চৈতন্যদেব দ্বারা সাধিত হয়েছিল। কিন্তু লীলানাট্য যে শুধু যাত্রা উপলক্ষেই অভিনীত হতো তা নয়। এর একটা আনুষ্ঠানিক রূপও ছিল। ‘চৈতন্যভাগবতে’ নিত্যানন্দের কৃষ্ণ ও রামলীলা বিষয়ক অভিনয় ছিল অনানুষ্ঠানিক, আচার্য চন্দ্রশেখরের গৃহপ্রাঙ্গণে চৈতন্যদেবের নাট্যানুষ্ঠানও তিথি নক্ষত্র বা যাত্রা উপলক্ষে পরিবেশিত হয় নি। কাজেই একথা বলা যায় যে, লীলানাট্য আনুষ্ঠানিক শোভাগমন বা উৎসব উপলক্ষ ব্যতিরিকেও স্বতন্ত্রভাবে সেকালে অভিনীত হতো।৫০

অভিনয়-আঙ্গিকরূপে যাত্রার বিবর্তনের আগেও যাত্রা ছিল। তবে তা ছিল শোভাযাত্রা বা উৎসব অর্থে। কিন্তু সেই শোভাযাত্রা বা উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অভিনয়রীতিই পরে কেবল ‘যাত্রা’ নামে অভিহিত হতে থাকে। শোভাযাত্রা কিংবা উৎসব কিংবা তিথি-নক্ষত্র গৌণ হয়ে ‘নৃত্য-গীত-অভিনয়’ই মুখ্য হয়ে ওঠে। চৈতন্যদেবের সময়েই এই অআনুষ্ঠানিক অভিনয়-আয়োজনের তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এটি যে তিথিনক্ষত্র মেনে-চলা শোভাযাত্রারই জনগ্রাহ্য রূপ, তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

ডক্টর সেলিম আল দীন স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ‘মধ্যযুগে অষ্টাদশ শতকের পূর্বে নাটক অর্থে ‘যাত্রা’ কোথাও দেখা যায় না।’ এ-মতের সমর্থনে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভক্তিসিদ্ধান্ত বাচস্পতি সম্পাদিত ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন-

কৃষ্ণযাত্রা অহর্নিশি কৃষ্ণসঙ্কীর্তন
ইহার উদ্দেশ্য নাহি জানে কোন জন॥৫১

চরণদ্বয়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন যে, ‘‘বলাবাহুল্য ‘কৃষ্ণযাত্রা’র অর্থ কৃষ্ণের জন্মতিথি উপলক্ষে ‘শোভাযাত্রা’ বা উৎসব।’’৫২  সেলিম আল দীনের এ-ব্যাখ্যা যথার্থ। কিন্তু এই জন্মতিথি উপলক্ষে প্রথম চরণে বর্ণিত যে ‘অহর্নিশি কৃষ্ণসঙ্কীর্তন’, তার ব্যাখ্যা করলে আমরা হয়তো দিনরাতব্যাপী নৃত্য-গীতের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতাম, যা শোভাযাত্রা বা উৎসবকে কেন্দ্র করে আয়োজিত অভিনয় তথা যাত্রারই সমতুল্য।

যাত্রার উদ্ভবকাল নির্ণয় করতে গিয়ে ডক্টর সেলিম আল দীন অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত একটি ‘পদ্যে’র উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যাতে ‘সেকালের আসরকেন্দ্রিক পাঁচালী, পালা, জারি, তরজা, মালসা, যাত্রা ও অধুনালুপ্ত কিছু বাংলা গানের সুর সংক্রান্ত বিবরণ পাওয়া যায়’ বলে মনে করছেন। পাদটীকায় গবেষক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছেন। খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, গৌরীশঙ্কর এটি গ্রহণ করেছেন জয়নারায়ণ ঘোষালের কাব্য করুণানিধান বিলাস থেকে। উদ্ধৃতিটি হল-

হিন্দুস্থানে শুনি ইহা করিল প্রচার
বাঙ্গালা দেশের ছাপ ভিন্ন রীতি তার॥
সঙ্কীর্তন নানা ভাঁতি অপূর্ব সুন্দর।
গড়াহাটি রানিহাটি বিরহ মাথুর॥
অভিসার মিলনাদি গোষ্ঠের বিহার
কবি পশতো তালফেরা শুনিতে মধুর॥
পাঁচালী অনেক ভাতি রামায়ণ সুর।
কত কথা তরজাতে সারিতে প্রচুর॥
ভবানী ভবের গান মালসীমায়ূর।
গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী বিজয়াতে ভোর॥
বাইশ আখড়া ছাপ প্রেম চূর চূর।
গোবিন্দমঙ্গল জারি গাইছে সুধরি॥
চৈতন্যচরিতামৃত প্রেমের অঙ্কুর।
শ্রবণে যাহার গানে ভকত আতুর॥
কালিয়দমন রাস চণ্ডীযাত্রাধীর।
রচিল চৈতন্য যাত্রা রসে পরিপুর॥
সাপুড়িয়া বাদিয়ায় ছাপের লহর।
বাঙ্গালার নবগানে নূতন ঝুমুর॥৫৩

এই ‘পদ্যে’র বিবরণ থেকে সেলিম আল দীন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে প্রকৃতপক্ষে ‘যাত্রা’ নাটকের প্রচলন হয়’। ‘পদ্য’টি অষ্টাদশ শতকে রচিত হলেই যে তাতে বিবৃত যাত্রার উদ্ভবকাল অষ্টাদশ শতক হবে, এমন যুক্তি মানতে কষ্ট হয়। জয়নারায়ণ ঘোষালের এই বিবরণ থেকে গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন-

উপরের বর্ণনা হইতে দেখা যায় যে অষ্টাদশ শতকে গড়ানহাটি, রানিহাটি প্রভৃতি ঢঙের কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পালা-কীর্তন, কবি, পাঁচালী, রামায়ণ গান, তরজা, সারি, মালসি, গঙ্গাগীতি, বিজয়াসংগীত, আখড়াই, জারি, সাপুড়ের গান, ঝুমুর গান প্রভৃতির পাশে গোবিন্দমঙ্গল ও চৈতন্য চরিতামৃত পাঠ এবং কালিয়দমন-রাস-চণ্ডী-চৈতন্য যাত্রার খুব প্রচলন ছিল।৫৪

অষ্টাদশ শতকে অন্যান্য আঙ্গিকের পাশাপাশি ‘কালিয়দমন-রাস-চণ্ডী-চৈতন্য যাত্রার খুব প্রচলন ছিল’ বলতে বোঝায় না যে এর উদ্ভব অষ্টাদশ শতকেই হয়েছে। বস্তুত এর উদ্ভব হয়েছে অষ্টাদশ শতকের অনেক আগেই। জয়নারায়ণ ঘোষালের রচনায় তার বিবরণ পাওয়া গেছে মাত্র।

যাত্রার উদ্ভব সম্পর্কে নানামুখী যত অভিমত পাওয়া যায় তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, যাত্রার উন্মেষকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ২৫ জন খ্যাতিমান গবেষকের মধ্যে মাত্র একজন গবেষক যাত্রার উদ্ভবকাল অষ্টাদশ শতক বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। অন্য ২৪ জন গবেষক বলেছেন অষ্টাদশ শতকের আগেই যাত্রার উদ্ভব হয়েছে। এঁদের মধ্যে ৯ জন গবেষক ষোড়শ শতককেই যাত্রার উদ্ভবকাল হিসেবে মন্তব্য করেছেন। আমরাও এই মতকে সমর্থন করি। কারণ শ্রীচৈতন্যদেবের অভিনয়কে যথার্থ অর্থে যাত্রাভিনয় বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। উৎসব অর্থে যাত্রার উন্মেষ হয়ত মানবসভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু অভিনয়কলা অর্থে যাত্রার উন্মেষ ষোড়শ শতকেই ধরে নেয়া যায়। এসময়ে যাত্রা ছিল আসরে বা চাঁতালে। আর অষ্টাদশ শতকে যাত্রা চাঁতাল বা আসর থেকে উঠে আসে মঞ্চে। যাত্রার মঞ্চকে এখনও আসর বলা হয়ে থাকে। অষ্টাদশ শতকের পর থেকে যাত্রা উৎসব কিংবা গীতাভিনয়ের আবরণ ঝেড়ে পরিণত হয় স্বতন্ত্র এক অভিনয়কলায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শিশুরাম অধিকারীর হাত ধরে যাত্রাগানের মধ্যযুগের সূচনা। যাত্রার পূর্ণবিকাশ সাধিত হয় ঊনবিংশ শতকের শুরুতে। যাত্রার এখন যে রূপ টিকে আছে তা মূল থেকে অনেক বিবর্তিত, অধঃপতিত, যুগের দাবির কাছে সমর্পিত। যাত্রার সঙ্গে বাঙালির নাড়ির টান খুব শক্ত। যাত্রায় বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ পাওয়া যায় তীব্রভাবে। যাত্রা তাই রূপ বদলালেও অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে।

তথ্য নির্দেশ :
১. দুলাল ভৌমিক, সংস্কৃত নাটকের ইতিহাস, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৪, পৃ. ০১, ২. ভরত, ‘নাট্যশাস্ত্র’, ১/১১-১২ [উদ্ধৃতি: দুলাল ভৌমিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯, ৩. প্রাগুক্ত, ৪. মণীন্দ্রলাল কুণডু, বাঙালির নাট্যচেতনার ক্রমবিকাশ, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ১৭, ৫. দুলাল ভৌমিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫, ৬. মণীন্দ্রলাল কুণডু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮, ৭. নগেন্দ্রনাথ বসু, বাংলা বিশ্বকোষ, পঞ্চদশ ভাগ, বিআর পালিশিং কর্পোরেশন, দিল্লী, (প্র-প্র. ১৮৮৬-১৯১১), পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৮, পৃ. ৬৯৭, ৮.Nishikanta Chattopadhyay প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩-৬৪, ৯. AHistory of Classical Sanskrit Literature, Vol 1, Calcutta, ১৯৬২, p. ৫০৮ [উদ্ধৃতি: মণীন্দ্রলাল কুণডু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮, ১০. আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, ঢাকা, বর্ণমিছিল, ১৯৭৮, পৃ. ৯৩, ১১. সুকুমার সেন, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড, আনন্দবাজার পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ৩৪, ১২. AB Keith, The Sanskrit Drama in its Origin: Development, Theory and practice, Oxford University Press, London, ১৯৫৪, p. ৪০, ১৩. প্রবোধবন্ধু অধিকারী, ‘আটশো বছর যাত্রারথে’, বাংলা লোকনাট্যের গতিপ্রকৃতি ( অজিত চক্রবর্তী ও অশোককুমার সরকার সম্পাদিত), নাট্যদর্পণ প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ৮৩, ১৪. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাসাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৪র্থ খণ্ড, পৃ ৪০৩ [উদ্ধৃতি: মণীন্দ্রলাল কুণডু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯], ১৫. মণীন্দ্রলাল কুণডু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬১, ১৬. প্রবোধবন্ধু অধিকারী, ‘আটশো বছর যাত্রারথে’, প্রাগুক্ত, ১৭. মন্মথমোহন বসু, বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, দ্বি-সং, ১৯৫৯, পৃ. ৪৮, ১৮. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস ২য় খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৩৮৯ (১৯৮২), কলকাতা, পৃ. ৫১১, ১৯. নরেন বিশ্বাস, প্রসঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ. ১৫১, ২০. আসকার ইবনে শাইখ, বাংলা মঞ্চ-নাট্যের পশ্চাৎভূমি, সাত রং প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃ. ১২৬, ২১. অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ‘যাত্রা’; লোকসংস্কৃতি গবেষণা, প্রাগুক্ত, পৃ ১১৫, ২২. গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, বাংলা লোকনাট্য সমীক্ষা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৭, ২৩. অজিতকুমার ঘোষ, ‘যাত্রা : সেকাল ও একাল’; লোকসংস্কৃতি গবেষণা, প্রাগুক্ত, পৃ ১৫৪-৫৫, ২৪. অজিতকুমার ঘোষ, বাংলা নাটকের ইতিহাস, জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যান্ড পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ৫ম-সং, ১৯৭০, পৃ ০৫-০৬, ২৫. মঈনউদ্দীন আহম্মদ, যাত্রার যাত্রা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৮, ২৬. Shushil Kumar Dey, Bengali Literature in the Nineteenth Century, Calcutta, p. ৪০৮-৯, ২৭. নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়, ‘যাত্রা’ [উদ্ধৃতি লোকসংস্কৃতি গবেষণা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৩, ২৮. গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ, ৩০০ বছরের যাত্রাশিল্পের ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ ১৭, ২৯. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ‘যাত্রা: কৃষ্ণকমল গোস্বামী’, লোকসংস্কৃতি গবেষণা, প্রাগুক্ত, পৃ ১৭৮, ৩০. Momtazuddin Ahmed, 'Practice of Jatra : The Crisis and Development', Jatra Our Heritage (Edited by SM Mohsin), Bangladesh Shilpakala Academy, Dhaka, June 2000, p. ৭৮, ৩১. ব্রজেন্দ্রকুমার দে, যাত্রার একাল সেকাল, ইম্প্রেসন সিন্ডিকেট, কলকাতা, পৃ. ৮১-২, ৩২. সুরেশচন্দ্র মৈত্র, বাংলা নাটকে বির্তন, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃ. ১২৯, ৩৩. সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘যাত্রা’; লোকসংস্কৃতি গবেষণা, প্রাগুক্ত, পৃ ৯০, ৩৪. সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘যাত্রার ইতিবৃত্ত’, বঙ্গদর্শন, ফাল্গুন, ১২৮১, ৩৫. অহীন্দ্র চৌধুরী, ‘যাত্রা’, বাঙালীর নাট্যচর্চা, শংকর প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ ৭৭, ৩৬. কপিলা বাৎসায়ন, ভারতের নাট্য-ঐতিহ্য : বিচিত্র প্রবাহ; (নারায়ণ চৌধুরী অনূ.), ন্যশনাল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ১৯৮০, পৃ. ১৬৫, ৩৭. মন্মথ রায়, লোকনাট্য : যাত্রাগান, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৯৭৬, পৃ. ০৪, ৩৮. প্রভাতকুমার দাস, লোকসংস্কৃতি গবেষণা, কলকাতা, ১১ বর্ষ ৪ সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ১৯৯৯, পৃ. ৬১১, ৩৯. প্রভাতকুমার গোস্বামী, ‘ঐতিহাসিক নাটক ও ঐতিহাসিক যাত্রা’, দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৩৮৫, পৃ. ২৯৩, ৪০. মণীন্দ্রলাল কুণডু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮, ৪১. অমলেন্দু বিশ্বাস, ‘বাংলাদেশের যাত্রা: অতীত ও বর্তমান’, ত্রৈমাসিক থিয়েটার (রামেন্দু মজুমদার সম্পা.), ঢাকা, জুন ১৯৮৭, ৪২. Jatra : Its Nature and Development, Jatra Our Heritage, Ibid, p. ৫৯-৬০, ৪৩. করুণাময় গোস্বামী, সঙ্গীতকোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৬১৬, ৪৪. নিরঞ্জন অধিকারী, লোকনাট্যে সমাজ ও জীবনের রূপায়ণ, মানিকগঞ্জ সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন ১৯৯৩ স্মরণিকা [নিরঞ্জন অধিকারী সম্পা.], মানিকগঞ্জ সমিতি, ঢাকা, ১৯৯৩, ৪৫. ভূঁইয়া বজলুর রহমান, ‘যাত্রা : রাষ্ট্রীয় আর্থিক উন্নয়নে এক বলিষ্ঠ লোকজ মাধ্যম’, জাতীয় যাত্রা উৎসব স্মরণিকা ১৯৯৪-৯৫, ৪৬. Sayed Jamil Ahmed, Ibid, p. ৫৯-৬০, ৪৭. জিয়া হায়দার, জাতীয় যাত্রা উৎসব স্মরণিকা ১৯৭৮-৭৯, ৪৮. Masuda M. Rashid Chowdhury, 'Jatra as a Cultural Identity'; Jatra Our Heritage, Ibid, p. ৫৯-৬০, ৪৯. সেলিম আল দীন, ‘যাত্রার উদ্ভব বিষয়ে’, জাতীয় যাত্রা উৎসব স্মরণিকা ১৯৯৪-৯৫, ৫০. সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃ. ১৮৭, ৫১. সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভক্তিসিদ্ধান্ত বাচস্পতি সম্পাদিত শ্রীচৈতন্যভাগবত, দেবসাহিত্য কুটীর, কলকাতা, ১৩৪২ বংগাব্দ, পৃ. ৪২৫ [উদ্ধৃতি : সেলিম আল দীন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৫, ৫২. সেলিম আল দীন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৫, ৫৩. করুণানিধান বিলাস, পৃ. ২৪৭, জয়ংনারায়ণ ঘোষাল, ১৮২০ [উদ্ধৃতি : ক) গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, বাংলা লোকনাট্য সমীক্ষা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৫-৬ এবং খ) সেলিম আল দীন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৫-৬], ৫৪. গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, বাংলা লোকনাট্য সমীক্ষা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬

ড. তপন বাগচী ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): কবি, গবেষক ও সাংবাদিক।