Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গৌতম হালদারের অভিনয় : অভিনব এক প্রবর্তনা

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

‘প্রাঙ্গণে মোর’-এর ‘দুই বাংলার রবীন্দ্রনাটক ও অন্যান্য’ নাট্যোৎসবে কলকাতার ‘নয়ে নাটুয়া’-এর নাটক দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেলো- গৌতম হালদারের অভিনয় আমরা প্রথম দেখি কলকাতার ‘নান্দীকার’ দলের ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ নাট্যে- মহিলা সমিতি মঞ্চে, গত শতকের নব্বুয়ের দশকে। সোভিয়েট রাষ্ট্রের শেষদিকে এক মন্ত্রী- একদা পার্টি-সদস্যের নৈতিক সংকট নিয়ে ছিল সে নাটক। ‘নান্দীকার’ পশ্চিমবঙ্গের বাম জমানার পরিপ্রেক্ষিতে রূপান্তর করেছিল আখ্যান। একদা কমরেড এক মন্ত্রী অভিযুক্ত হয়েছিলো সেখানে ব্যক্তিগত ক্ষমতাভিলাষ পূরণে অনৈতিক এক কর্মকাণ্ড করে। তাই নিয়ে মন্ত্রী বাহাদুরের সংকট-আর্তি আমাদের অভিজ্ঞতায় কখনো ঘটেনি যদিও। তবুও মানবিক নৈতিক সে টানাপোড়েন আমাদের হতবিহ্বল করে ছেড়েছিল- নাটক ও অভিনয়ের দুরন্ত দ্বৈরথে। গৌতম সে নাট্যে অভিনব এক শারীর-বাচনে অভিনয় করেছিল। বাস্তবোত্তীর্ণ সে রূপায়ণে আঙ্গিক অভিনয় হয়ে উঠেছিল সংকট-তীব্র আততির মোক্ষম ভোকাবুলারি, বাচন। জীবনের বাস্তবে মুখের ভাষার বিবিধ মিথ্যায়, মুখোশে ঢেকে ফেলি তো আমরা আমাদের মুখ- স্বভাব, সত্তাস্বরূপ; শরীরও সেখানে বাধ্য বশংবদ হয়ে ওঠে গূঢ় গোপনাচারী লুকোচুরিতে- সত্য ঢাকতে, লুকাতে অধিক পারঙ্গম হয় সে। যদিও বলে থাকি আমরা, যে, মুখের ভাষায় সত্য গোপন করা গেলেও শারীর-ভঙ্গী বলে দেয় তবু অনেককিছু।

শরীরের সে স্বাভাবিক চরিত্র-বৃত্তি শালীন নিয়ন্ত্রণে অধিক পোষ্য ভৃত্য হতে পারে। ক্ষমতার সমাজ-সভ্যতা ভালোই সে শিক্ষা দিয়েছে। সহজাত আত্মপ্রকাশের মানব-বৃত্তি তাতে করে শৃঙ্খলিত দাসের যোগ্য বাহন হয়ে ওঠে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চায়, পরিমার্জিত শীলনে। শিল্পকর্মে তো আমরা মুক্তিপন্থা খুঁজি মনের যত ভাবের সত্যতর প্রকাশ ব্যাকুলতায়। অভিনয়েও সত্তার আরোপিত সে অষ্টাবক্র বন্দিদশা থেকে মুক্তি চাই। বাস্তবমন্য রীতি-ভঙ্গী তার নিরাকরণ পদ্ধতি বের করেছে। স্তানিস্লাভস্কি তারই এক যুক্তিযুক্ত উপায় নির্ধারণ করেছেন।

অভ্যস্ত সহজ বহু-ব্যবহারে তার ধারও বুঝি ক্ষয়ে যায়। বাস্তবিকতা তখন আর যথেষ্ট মনে হয় না। তার জন্যই তো নানা শিল্পমাধ্যমে প্রকাশের বিচিত্র টেকনিক উদ্ভাবন করে চলে। চিত্রে-কবিতায়-গল্প-উপন্যাসে নানা ইজম সেই সূত্রে অভিব্যক্ত হয়েছে।

নাট্য বা অভিনয় সেক্ষেত্রে বুঝি পিছিয়ে আছে। মঞ্চে অভিনেতৃর দায় থাকে তো জীবন্ত দর্শকের সামনে বাস্তবানুগ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করার। পূর্বকালের অতিরেক অবাস্তব অভিনয়রীতি থেকে অধিক বাস্তবোচিত হয়ে উঠতে চেয়েছে নাটক, অভিনয়। চরিত্রাবলীর পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপে যুক্তিযুক্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ-সমর্থ হয়ে উঠতে চেয়ে স্বাভাবিক-রীতির সে অভিনয় চর্চা দীর্ঘ অনুশীলনে লভ্য হয়।

বাংলাদেশের অভিনয়ে আমরা সেই কঠিন চর্চায় অনাগ্রহী হয়েই বুঝি নাট্যের প্রকাশরীতির নানা রূপরোপ ভঙ্গী আশ্রয়ের সহজ পন্থা খুঁজেছি। আবুল হায়াতের স্বচ্ছন্দ বাস্তবানুগ অভিনয়ের পারদর্শিতা অর্জনের চেষ্টা-চর্চা করেনি তেমন কেউ- আসাদুজ্জামান নূরই বুঝি একমাত্র তার অনুগামী হয়েছেন। রাইসুল ইসলাম আসাদ, হুমায়ূন ফরীদি, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই ঘরানার অনুসারী।

তবে পশ্চিমবঙ্গে স্বাভাবিক রীতির অভিনয়ের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। থিয়েটারের আদিযুগে গিরিশ ঘোষের দর্শকধন্য উদাত্ত সুরেলা কাব্য-আবৃত্তিময় অভিনয়ের পাশাপাশি অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির বাস্তবানুগ কথ্যসুরের অভিনয়ের এক ধারা বরাবরই ছিল। মহানট শম্ভু মিত্রের সঙ্গে যেমন বিজন ভট্টাচার্য্যরে অভিনয়রীতি একেবারে বিপ্রতীক। এই দুই রীতির পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় অভিনয়ে নানা মিশ্ররীতির বিচিত্র প্রবর্তনা ঘটেছে বাংলা নাগরিক অভিনয়ে।

হাল-আমলে কলকাতার চেতনা নাট্যদলের ‘জগন্নাথ’ নাট্যে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের শারীর অভিনয়রীতি অভিনব লেগেছিল দর্শকের। চরিত্রটির নিহিত স্বভাব-বৈকল্য তাতে অভিব্যক্ত হয়েছিল উপযুক্ত সৃজন অভিনবত্বে। অক্ষম, ভীতু, অপদার্থ মানুষটির অষ্টাবক্র দশা যথামুক্তি পেয়েছিল সে অভিনয়ে। ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ নাট্যে গৌতমের অভিনয়রীতিও চরিত্রের ব্যক্তিগত সংকটদীর্ণ মানস-পরিস্থিতিতে লাগসই হয়ে ওঠে। মনে হতে থাকে, মানুষটির আক্রান্ত সত্তাস্বরূপ যদি প্রকাশ হতে চায়, তাহলে মন্ত্রীর সুভদ্র পরিশীলিত ক্ষমতা-ভঙ্গী ও বাচনের কথিত বাস্তবানুগ ধরন তাতে না ভেঙ্গে পারে না; পাল ছেঁড়া, নোঙর হারানো মানুষটি যেন প্রকাশের খড়কুটো হাতড়ে ফিরছে শারীর-বাচনের নানা বিভঙ্গে, আশ্রয়ে- যাতে করে সে আর থাকছে না কেতাদুরস্ত, ফিটফাট সামাজিক নাগরিকজন। ক্ষমতার লাগসই মুদ্রা ও মুখোশ তার খসে পড়েছে তখন। ভেতরের দিশেহারা, অসহায় মানুষটি ছটফট করছে যেন নিজের কাছেও সাফাই গাইতে, নিজের অপকর্মের অজুহাত হাতড়ে ফিরে। আর যতই সে মুখোমুখি হয়ে নাছোড় অভিযোগকারীর যুক্তির জালে আটকা পড়ছে ততই যেন বেসামাল হয়ে, ভেতরের পর্যুদস্ত মানুষটিকে ঢেকে রাখতে পারছে না।

অভিনয়ে আমরা কি ব্যক্তি মানুষের সমগ্র এই সত্তা-সংকট প্রকাশ রূপায়ণ চাইবো না? অভিনয় কেবলি কি বাইরের সামাজিক ভদ্রজনোচিত আরোপিত শারীর-বাচন-ভঙ্গীর অভ্যস্ততায় আবদ্ধ থাকবে? জীবনের বাস্তবে তা না করতে পারলেও অভিনয়ে কি সত্য মনোভাবের নানা ধরন-রীতি উদ্ভাবন করবো না- নাটকের বিষয়-রীতি, পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচিত্র প্রকাশের ভাষায়?

গৌতম হালদার যেন একক বীরত্বে নানা নাটকে শারীর-বাচনের বাস্তবোত্তর নানা ভঙ্গী-রীতির উদ্ভাবন করে চলেছেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-র একক অভিনয় সংগীত-বাদ্য-নৃত্য যোগে মহাকাব্যোপোম দৃশ্যকাব্য রূপায়ণ করেছেন। একালের সে মহাকাব্যের আখ্যান পরিস্থিতি, চরিত্রাবলীর ব্যক্তিত্ব ও কাব্যভাষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ছিল সে অভিনয়-প্রবর্তনা। আবার ‘ফেরিওয়ালার মৃত্যু’ নাট্যে উদ্ভ্রান্ত, বেকার যুবকের দিশেহারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ট্র্যাজিক পরিস্থিতির কিম্ভুতকিমাকার বাস্তব শারীর-বাচনে যে প্রতিক্রিয়ায় রূপায়িত হয়- তাতে দর্শকও আপনাকার অষ্টাবক্র দশার অভিনব প্রকাশে বেঁকেচুরে, থেৎলে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে চায়। কোনো বাস্তবানুগ-রীতির সাধ্য নেই তার নাগাল পায়। ‘নগরকীর্তন’ নাট্য আবার নাচে-গানে-প্যারোডিতে অন্যতর ব্যঙ্গখর কমিক্যাল হয়ে ওঠে। হিন্দী-বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের কিম্ভুত নানা ভঙ্গী-নৃত্য-অভিনয়ের ভিন্নতর ব্যবহারে- তুমুল হৈ-হল্লা চ্যাংড়ামি পুংটামির মাস্তিÍ-ধামাকায়। আমাদের নাগরিক রুচির আপাত শালীনতা তাতে মজতে দ্বিধাচ্ছিন্ন হয় ছদ্মবেশী সন্ত্রস্ত আড়ালে। অথচ নাগরিক ছদ্মবেশই তো ঘোচাতে চায় ‘নগরকীর্তন’ নাটকে গৌতমের লাগসই অভিনয়-তূণ। এই কিছুদিন আগে ‘বিসর্জন’ নাটকের পরিচিত রঘুপতি চরিত্র গৌতমের অভিনয়ে হয়ে উঠেছিল একালের সেয়ানা চতুর, চালিয়াত ধর্মীয় হেন রাজনৈতিক এক পাণ্ডাবিশেষ- এ-ক্যারিকেচারে মেতেছিল যেন সে চরিত্রাভিনয়ে- রঘুপতির গাম্ভীর্যের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে চরিত্রটির অন্তঃস্থ সরীসৃপ কুটিলতা শারীর-বাচনে অভিব্যক্ত করে। অভিনব এই শারীর-বাচন কিন্তু আর সকল স্বাভাবিক রীতির চরিত্রাভিনয়ের সঙ্গেই করেন গৌতম। তাতে দেখি বেমানান লাগে না তাকে, ছন্দপতন ঘটে না। সেটা বেশি করে চোখে পড়ে ‘মিসড্ কল’ নাটকে আরেক দুরন্ত নট দেবশংকর হালদারের সঙ্গে অভিনয়ের বেলা। দেবশংকর তো প্রচলিত স্বাভাবিক বাস্তবানুগ ঘরানার অভিনেতাই। এই নাটকে দুই ভিন্ন রীতির অভিনয়ে ভিন্ন দুই চরিত্রায়ণ যথা রূপায়ণ হলো- কোনোই খটকা লাগলো না। বৈপরীত্বের এই সুছন্দ কী করে রূপায়িত হলো? সেই কৃতির দায় গৌতমকেই দিতে হবে নিশ্চয়। তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব এই সহাবস্থান সম্ভব করে তোলা সহজ কথা তো নয়। সহ-অভিনেতৃর সঙ্গে এই অসম রীতির জটিল সামঞ্জস্য উভয় তরফেই সম্পন্ন করে তুলতে হয়েছে নিশ্চয়।

গৌতমের এই রীতির বিরুদ্ধে এইটিই অভিযোগ তোলা হয়: সব নাটকে একই অভিনয় করে। কথাটা কতটা ঠিক বলা? নানা নাটকে সে কি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র হয়ে ওঠে না? অভিনয়ে সেই ভিন্নতা থাকে না? অভিনীত চরিত্রগুলি ভেবে দেখুন তো। তাছাড়া প্রচলিত রীতির অভিনেতৃ কি একই রীতিতে নানা চরিত্রে ভিন্ন অভিনয়ই করেন না? তাহলে? সব চরিত্রে একই বিহেভ যারা করেন, যারা ‘টাইপ’ অভিনয় করেন তাদের কথা বলছি না। ধরুন, হুমায়ূন ফরীদির কথা। তিনি কি সব চরিত্রে একই অভিনয় করতেন? কিন্তু করতেন না কি তিনি একই রীতিতে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রাভিনয়? রীতিটা একই বলে কি তাকে বলা যাবে সব চরিত্রে একই অভিনয় করতেন? আচ্ছা, চার্লি চ্যাপলিন কি সব চরিত্রে একই অভিনয় করতেন? অথচ করেছিলেন তো তিনি বিশেষ এক রীতি-ধরনেই। তাকে কি তবু একই চরিত্রে অভিনয় করতেন বলা যায়? ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকেই কি পাই না নানা চরিত্রের অভিনয়ে? তাহলে গৌতমের বেলা সে কথা ওঠে কেন? তিনি আমাদের পরিচিত বাংলাভাষার অভিনেতা বলে? চার্লির উদ্ভাবিত অভিনয়ের রীতির মধ্যে ব্যালে নৃত্যের সঙ্গে চিনা অপেরা কি আমাদের সঙ বা সার্কাসের জোকার কী যাত্রার ভাঁড়ের আদল দেখতে পাই না? লক্ষ্য করলে গৌতমের অভিনয়েও নানা রীতির এক সমন্বয় দেখতে পাই- যদিও শেষ পর্যন্ত তা এক বিশেষ রীতির প্রবর্তনা বলে চিনতে পারি- যা তারই উদ্ভাবন। বাংলাদেশে ‘কিত্তনখোলা’ নাটকে জহিরউদ্দিন পিয়ারের অভিনয়ে মায়ারহোল্ড কথিত বাই-মেকানিকস পদ্ধতির প্রয়োগ দেখি। প্রতি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় শরীরের বিশেষ ব্যবহারের আধিক্য। এই রীতির প্রয়োগ আর কোনো নাটকে কোনো চরিত্রের অভিনয়ে দেখি নি। যেমন কিনা ‘সংবাদ কার্টুন’ বা ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসী’ নাটকে চলনবলনের বিশেষ বাস্তবোত্তর ধরন, প্রায় যেন নৃত্যভঙ্গিমা দেখি। তবে বাংলাদেশে চরিত্রাভিনয়ে না হলেও যূথ অভিনয়ের কোরিওগ্রাফিতে নানা শারীর-ভঙ্গী দেখা যায়। কোনো কোনো নাটকের বিশেষ চরিত্রে বিশেষ রীতি-ধরন চোখে পড়ে। যেমন অনেকদিন আগে দেখা পালাকার দলের ‘ডাকঘর’ নাট্যে কবিরাজ চরিত্রে বিশেষ শারীর-ভঙ্গীর অভিনয়- যাতে নিরাবেগ যান্ত্রিক চিকিৎসা-পদ্ধতিতে আসত্তা-গ্রস্ত এক যন্ত্র মানবকে যেন দেখি। নির্দেশক শামীম সাগরের নিশ্চয় মনে হয়েছে, এই চরিত্রায়ণ বাস্তবানুগ রীতিতে তত লাগসই হবে না। তবে সচরাচর কমিক-ক্যারিকেচার করতেই চরিত্রাভিনয় কার্টুন-বৎ করা হয়। অবশ্য ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’ নাট্যে মূল চরিত্রাভিনয় কার্টুন-বৎ করেন দক্ষ অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। ‘রূপবতী’ নট্যের যাদুকর চরিত্রে আসাদুল ইসলামকে শারীর-ভঙ্গীতেই অধিক বাস্তবমন্য লাগে।

মনে হয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে তথাকথিত বাস্তব সম্মত চলন-বলন ভেঙ্গে পড়ে- ভেতরে চাপা পড়া, ঢেকে পড়া নানা চেহারা বেরিয়ে পড়ে- যা ঠিক আর বাস্তবমন্য থাকে না। অভিনয়ে তারই নানা বিস্তার বৈচিত্র্য, আরোপন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। নাট্যের বিষয়-রীতির অঙ্গাঙ্গীতায় অভিনয়ে নানা ধরন-রীতি অনিবার্য অভিব্যক্ত হয়। তাকে বাস্তবিকতার ঘেরাটোপে আর বেঁধে রাখা যায় না। মানবমন তার সমগ্রতার নিহিত প্রকাশস্ফূর্তিতে বাক্সময় হয়ে উঠবেই। অভিনয়েও তার সৃজন প্রবর্তনা ঘটবে। কিছুতেই কোনো এক অভ্যস্ত রীতির বাধ্যতায় তাকে ঠেকানো যাবে না। গয়ংগচ্ছ আরাম আর টিকবে না।

‘প্রাঙ্গণে মোর’ আয়োজিত নাট্য উৎসবে কলকাতার ‘নয়ে নাটুয়া’ দলের ‘বড়দা বড়দা’ নাটকের একক অভিনয়ে গৌতম হালদার আরেক সৃজন-স্পর্ধা দেখান। মহান লেখক প্রেমচাঁদ-এর আখ্যান তাকে উদ্বোধিত করেছে নিশ্চয়। ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ভারত উপমহাদেশীয় এক সাধারণজনের প্রতিক্রিয়া তাতে প্রতীক-প্রতিম মহাকাব্যিক অনেকান্ত, অতলান্ত হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা-প্রভুর শিক্ষা-সংস্কৃতি আরোপনের পদ্ধতি-ব্যবস্থাপনায় মানুষ কতটাই যে নাস্তানাবুদ ট্র্যাজি-কমেডি-ক্যারিকেচারে কার্টুন-বৎ হয়ে ওঠে! মানব-স্বভাব আর মানব-সম্পর্ক, আত্মরক্ষার নিজস্ব ন্যায়ে মরিয়া হয়ে ওঠে। পিতৃতুল্য বড়ভাই আর তার অনুজকে নিয়ে এই আখ্যান গঠিত। ইংরেজি শিক্ষায় সফল অনুজ সাক্ষাৎকারে তার জীবনকথা শোনায়। বড়দার সঙ্গে তার সম্পর্কের অমল মহিমা বসে বসেই বয়ান করে গৌতম তার অভিনয়ে। পেছনের পর্দায় তার নানা কৌণিক চলচ্চিত্র পটে বিচিত্র অভিব্যক্তি-মুহূর্ত চিত্রকল্পের বিবিধমুদ্রায় সমন্বিত হয় সামনে বসা আপ্লুত কথকের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী বাক্সময়তায়। উপবেশিত জীবন্ত মানুষের ঊর্ধ দেহ-বিভঙ্গের শারীর-বাচন, পেছনের পর্দায় তার চলচ্ছবির বিচিত্র দোহারকিতে অভিনব দৃশ্যকাব্যের এক নাট্যভাষার প্রবর্তনা ঘটায়। মঞ্চনাটকের প্রচলিত রীতি-অভ্যস্ততায় তাকে কি আমরা খারিজ করে দেবো? প্রযুক্তির এই বিশেষ ব্যবহার মঞ্চনাটকের এক সৃজন রূপায়ণ করেছে বলা যায়। ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটি  যদি জীবন্ত জঙ্গম রিয়ালিটি প্রকাশের অনন্য অভিনব এক মাধ্যম হয়ে ওঠে তাতে কোনো বর্ণনাত্মক অভিনয়-রীতির ব্যত্যয় বলে অগ্রাহ্য করা কি সঙ্গত? বর্ণনাত্মক রীতির এক ধারক-বাহক এমনই রায় দিতে চায়- বসে বসে প্রজেক্টর লাগিয়ে ভালোই ফাঁকিবাজির থিয়েটার হয়েছে। মঞ্চে লম্ফ ঝম্ফ নৃত্য-বাদ্য-চরিত্র-সংলাপ ব্যতিরেকে আবার নাটক হয় নাকি? যত্তসব মুদ্রাদোষের বাহাদুরি। যেমন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নাট্যে গৌতমকে ধমকিয়েছিল এক নাট্যবিদ্- কেন সে বাস্তব ক্রিয়া অনুকরণ করে অভিনয়ে- এটা তো বাংলারীতি নয়। কেবল ফর্ম বা রীতিই যেন আধুনিক থিয়েটার।

‘বড়দা বড়দা’ নাট্যে অন্তঃস্থ বিষয়ের মানব-মহিমা কোথাও কি অভিভব জাগায় না মনে? কবেকার হারিয়ে খুঁইয়ে বসা ভাতৃসম্পর্কের এহেন গভীর নাট্য তাহলে আমাদের মানববৃত্তি-অবসিত মনে কোনোই সাড়া পায় না? উপনিবেশী চক্রব্যুহেও এমত মানব সম্পর্কের অমলিন বৃত্তি-বিভা প্রাচ্য-উপমহাদেশীয় মানস-পরাক্রমের পরাকাষ্ঠা বলা যায়। বিস্ময় লাগে, শতবর্ষ পূর্বকার অবাঙালি অগ্রজ-অনুজের মৌলিক শুদ্ধ মানব স্বভাব-সারল্য একালের নাগরিক নট কী করে ছুঁতে পারলো! যার অমন কথন-বাচন বয়ান অন্তর্ভেদী হয়ে ওঠে গৌতমের অভিনয়ে! অভিনব এক নাট্য রীতি-ভাষায় যা তিনি রূপায়ণ করেন!

‘মিসড্ কল’ নাট্য মূলত দুই ধীমান নটের অভিনয় যুগলবন্দি। ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটির আদি বিকার- যা কিনা কৈশোর থেকে সংক্রমিত হয়ে আধিব্যাধির মানসিক প্রতিবন্ধীতায় গ্রাস করে অমল কিশোর মন। সেলুলার-মোবাইলফোন-বাহিত এক ফাঁসে পড়ে ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটির অলাতচক্রে নিমজ্জিত সমগ্র বিশ্ব আজ। দেবশংকর হালদার নাটলিপি রচনা করেন। তারপর মেধাবী দুই নট এর আশ্চর্য দৃশ্যকাব্য অভিনয় করেন। শুরু হয় মোবাইল কথপোকথনের এক হিস্ট্রিয়াগ্রস্ত রঙ্গলীলার দৃশ্যক্রিয়াকল্প কমিক-ক্যারিকেচারে। তরুণ-যুবা সহোদর দুই ভাই দুরন্ত রগড়ে মাতে কিশোর-তরুণ-বৎ পাল্লাপাল্লিতে। এক মেয়ের সঙ্গে কার কেমন ভাব-ভালোবাসা- জন্মদিনে বাড়িতে এসে কার ঘরে গিয়ে কী কথা বলেছিল সে, বেড়াতে বেরিয়েছিল কার সাথে, কী রঙের জামা কী শাড়ি পরে, ফোনে কাকে কী মেসেজ পাঠিয়েছিল মির্জা গালিবের পংক্তি লিখে, আর্টস পড়তে চাইলেও বাবা কাকে জোর করে সায়েন্স নিতে বাধ্য করেছিল আর যে কিনা কবিতা লিখতো, ছবি আঁকতো, নাটক করতো- তাকে বাণিজ্য পড়িয়ে চাইছে বাবার বিজনেসে হাত দিতে; মেয়েটি আর বাবা কখন কাকে কী বলেছিল, তারা কে বাবাকে নিয়ে কী বলে প্রতিবাদ করেছিল, দুজনে মিলে অভিনয় করে করে তাই দেখায় আর অপ্রকৃতিস্থ হুল্লোরে মাতে শিশু-কিশোরের মান-অভিমান-রাগ-ক্ষোভের পাল্লাপাল্লিতে; এ্যাপ্রোন পরা এক মেয়ে এসে প্রতিজনের বান্ধবী হয়ে গপ্পে মাতে; কবে কী কী কথা হয়েছিল অভিনয় করে মনে করে, একভাইকে মেয়েটি বলে- রূপকথার রাজপুত্র না হয়ে বাস্তবে কিছু করে দেখাক, আর অন্যজনকে- শিল্পী হবার বাহানা ছেড়ে বাপের টেকনোলজির ব্যবসায় নামতে; দুজনের স্বপ্ন-কল্পনা বাস্তবের আঘাতে ভেঙ্গে পড়ে- তাতে দুজনের দু’রকম প্রতিক্রিয়া হয়; পরে বোঝা যায় মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটছে; লেডি ডাক্তার ওদের সায় দিয়ে গল্পে মাতে, তাদের বাবার সঙ্গে ফোনে এদের মানসিক অবস্থা জানায়- নিশ্চিন্ত হতে বলে, শেষে দুজনকে আলাদা ভাবে বলে, তার সময় নেই, পাশের ঘরের নার্সকে বলা আছে, গিয়ে যেন ইনজেকশন নেয়- বোঝা যায় চিকিৎসা চলছে এদের; শেষে পর্যুদস্ত ছোটভাই লেডি ডাক্তারকে মোক্ষম কথাটি বলে- এই জীবনটা একটা ফ্যান্টাসি, টেক ইট ইজিলি। তারপর দুই ভাই মোবাইল-কথপোকথনের অন্তহীন আত্মরতি-বিকারে মেতে ওঠে।

সব মিলে ‘মিসড্ কল’ এই ভার্চ্যুয়াল প্রযুক্তির বাজার-মিডিয়া-মোবাইল বিশ্বের কেস স্টাডি বিশেষ। নাট্যে, অভিনয়ে তার রূপায়ণ বলার মতো ঘটনা বটে- যখন আমরা কিনা পালিয়ে হারিয়ে খুঁইয়ে সর্বস্বহারা- একাকী মোবাইলকল-মিসড কলের ফ্যান্টাসি-ইলিউশনে কল্প-অস্তিত্ব মরিয়া যাপন করছি। নাটক শেষে গৌতম জানায় পশ্চিমা বিশ্বের ভয়াবহ তথ্য: শতকরা ৭৩ ভাগ কথা উগড়ে চলে আপন মনে, স্বমেহনের রমন-রতির পুলকে- কেউ নেই যে কারো তার কথা কিছু শোনে। শৈশব থেকে এক ভয়াল নিঃসঙ্গ সে যে বাড়িতেও- মা-বাবা-ভাই-বোন থাকুক আর নাই থাকুক তার- তাদেরও যে একই দশা; পাড়া-স্কুল-আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী কেউ কারো আর নেই যে বিশ্বজোড়া ঊনপঞ্চাশ বায়ুচড়া মাতম হিক্কায়, গোঙানিতে, সভ্যতার এই এক নবতর প্রজাতি-প্রজন্মের উদ্বর্তনে। ‘মিসড্ কল’ নাটকে শরীরে তরুণ-যুবা দুই ভাই শৈশব কৈশোরেই মাথা খুঁড়ে নিরুপায় অস্তিত্ব যাপন করে। বড়ই ট্র্যাজি-কমেডির কমিক-ক্যারিকেচার আজ যে মানবনিয়তি- তারই প্রতিস্পর্ধী নাট্যভাষ্য ‘মিসড্ কল’- অলাতচক্রে আসত্তা নিমজ্জিত মানবনিয়তির করুণ-কার্টুন-বৎ এহেন চংক্রমন।

গৌতম হালদারের অভিনয় রীতির প্রবর্তনায় মৌল নির্ভর তথাকথিত বাস্তবতা ভেঙ্গে দেওয়া- ব্যঙ্গচিত্র কার্টুন চরিত্রায়ণ- যেহেতু সে-ই হয়তো যথা চারিত্র্য আমাদের এহেন অ্যাবসার্ড জীবন-বাস্তবের। বাঙালি সঙ-ভাঁড়-ক্লাউন-জোকার, পাগল-ফকির, ভারতীয় বিদূষক কী ইউরো-শেক্সপীয়রীয় ভড়ড়ষ বা আরবি কিসসাদার, স্পেনের ‘দন কিহেতো’ সাধারণ ঐতিহ্যধারা ইতিহাসে culture of silence ভাঙ্গা তুর্কি তেজে। গত শতকে মায়ারহোল্ড-চ্যাপলিন-ব্রেশট-বেকেট-পিন্টার তাকে নাট্যে-চলচ্চিত্রে একালের নব প্রবর্তনায় খাপখোলা তলোয়ার করেছে। গৌতমের রীতি কোথাও এই মিলিত যৌথধারার ব্যক্তিগত সৃজন উদ্ভাবন। ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’ এর নূরভাই বা ফরীদির নানা অভিনয়, আশীষ খন্দকার, আজাদ আবুল কালামের কোনো কোনো অভিনয়ে একই ইশারা-ইংগিত মেলে। ঢাকা থিয়েটার ‘কিত্তনখোলা’ থেকে বর্ণনাত্মক ধরনে বা আরণ্যক-এর ‘সংক্রান্তি’ বা ‘রাঢ়াঙ’ নাট্যের অভিনয়-রীতি নাগরিক বাস্তবোত্তীর্ণ মুক্তি খুঁজেছে।

বাস্তব স্বাভাবিকতা তো ক্ষমতা-নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-শ্লেষের ব্যঙ্গে-হাস্যে তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায় শিল্প টেকনিকের নানা সৃজন বাচন- জীবনেও আমরা তা করতে চাই- যখন যতটা পারি। গৌতমের শারীর-ভঙ্গীতে এই কার্টুন ব্যঙ্গচিত্র ধরনের সাথে বাচনের শ্লেষ ব্যঙ্গ, ভেঙ্গানোর সুরটি কেবলই এক মুদ্রাদোষ ভেবে ভুল করে অনেকেই।

নাগরিক বর্ণনাত্মকবাদীদেরও মনে পড়ে না, গায়েণ-বায়েন-কথকের নারী-পুরুষে মেলানো অর্ধনারীশ্বর সজ্জায় আখ্যান বর্ণনের অমিত পরাক্রম সুর-ছন্দের নৃত্য বিভঙ্গে- যার অনুকরণে নির্মিত নাগরিক কোনো অভিনয় যতই তাদের আপ্লুত, বিহ্বল করুক।

তাছাড়া, যদি আমরা নিজেদের মনে প্রায় নিয়ত ঘটে চলা গোপন প্রতিক্রিয়ারাজি লক্ষ্য করতাম- দেখতে পেতাম না কি উদ্ভট, কিম্ভুত, জটপাকানো অষ্টাবক্র নানা বিভঙ্গদশা- গুমড়ে মরছে ভেতরে- বাইরে যা প্রকাশে অসমর্থ বলে? একলার নির্জনে তবু ঘটে কখনো তারই মত্ত মরিয়া বিস্ফার- শারীর বাচনের অনাগরিকতায়- প্রতিবন্ধী-প্রায় নিষ্ফল আক্রোশে, আত্মঘাতের বেঘোর উচ্চণ্ডতায়। শিল্প চিরকাল সেই আবাঙমানস গোচরের নির্জ্ঞান অচেতন-অবচেতনের নাগাল চেয়ে স্বতোঃরূপান্তরিত- পরিমিত অল্পে তার সুখ নেই যে- সেই অমৃত কোনোকালেই বলহীনের লভ্য নয়।

ড. বিপ্লব বালা : শিক্ষক, সমালোচক