Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : প্রবাসে নাট্যের দেশে

Written by আশিস গোস্বামী.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

‘গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার’ নিয়ে আলোকপাত করার আগে সংগত কারণেই আমি একটু পেছন থেকে শুরু করতে চাচ্ছি। কারণটা এই যে, আমি অনেকটা প্রবাসীর চোখ দিয়ে বাংলাদেশের নাটককে দেখতে পেয়েছি। তাই, বাংলাদেশের নাটকের সাথে আমার পরিচয় হয়ে ওঠার পর্বটাও একটু পেছন-ফিরে দেখে নিতে চাই।

সেটা ছিল ইংরেজি ১৯৮২ সাল। ডিসেম্বর মাস। আমার প্রথম বাংলাদেশ-যাত্রা। নয় নয় করে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। তখন আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেখানে নেতা এবং অভিনেতা হিসেবে বেশ জান-পেহচান ছিল। আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই আমার পরিচিত। তাদেরই সুবাদে পরিচয় (বাংলাদেশের) তৎকালীন শিক্ষার্থী রহমত আলী আর ওয়াহিদা মল্লিক জলির সাথে। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা পেতে আমাদের খুব বেশি দেরি হয় নি। সেই পরিচয় আজো একইরকম শক্তপোক্ত রয়ে গেছে। ওরা আমাকে একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মামুনুর রশীদের সাথে। তিনি তখন কলকাতায় গিয়েছিলেন কোনো এক অভিনয়ের সুবাদে। অনেক হারিয়ে যাওয়া আলাপের মতো এই আলাপও হয়তো স্থায়ী হতো না। কিন্তু মামুনভাই একদিন আমাকে আবিষ্কার করে ফেললেন উৎপল দত্তের বাসায়। মামুনভাইও প্রবলভাবে উৎপল-অনুরাগী। ফলে দুই উৎপলভক্তের গুরুভাই হয়ে উঠতে সময় লাগলো না। মামুনুর রশীদ একদিন কথাচ্ছলে বললেন, চলে আসো বাংলাদেশে। ব্যস, সেই আমন্ত্রণ আজো অসম্পূর্ণ আমার কাছে। আজও কিছুদিন না গেলে মনে হয় অনেকদিন কত কত বন্ধুর সাথে দেখা হয় নি। যাই ঘুরে আসি। আবার এবং আবার।

সেই ডাকে সাড়া দিতেই ছুটে গেলাম বাংলাদেশে। ট্রেনে করে বনগাঁ হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে রাতের বাসে গিয়ে নামলাম গাবতলী। গাবতলী থেকে ইন্দিরা রোড- মামুনুর রশীদের বাড়ি। তখনো ভোরের আলো ভালো করে ফোটে নি। আমি দরজায় কড়া নাড়লাম। অনেক ডাকাডাকির পর দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মামুনভাই। পথে আসতে আসতে জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রায় আমার দীর্ঘ সময়ের শঙ্কা দূর হলো। সেবারের আশ্রয়স্থল ছিল সেই বাড়ি।

এসব ব্যক্তিগত ভূমিকা করলাম এই কারণে যে, ১৯৭১ যদি বাংলাদেশের বর্তমান নাট্যচর্চার শুরুয়াত হয়, তাহলে আমার সেই নাট্যচর্চার সাক্ষী হবার সময়কাল ঠিক এগারো বছর পর। আর সেই সময়ের নিরিখে বাংলাদেশের নাটকের সাথে আমার যোগাযোগের বয়স প্রায় ৩৬ বছর- মানে ৩ যুগ। কখন পেরিয়ে গেল এতটা সময় তা ঠাওর করার আগেই মনে হলো দীর্ঘ এক সময়কাল অতিবাহিত ‘আর-এক-দেশের’ নাট্যচর্চার সাথে। যে দেশ আমারও দেশ হবার কথা ছিল, কিন্তু হয় নি। যে চর্চার আমিও একজন হতে পারতাম, কিন্তু হতে পারি নি। দেখা ছাড়া আর কোনো ভূমিকায় অংশ নেবার অধিকার আমার নেই। তবু আমি আমারই খ-িত এক সত্তার সাক্ষ্য নিতে ছুটে ছুটে যাই। কেউ গ্রহণ করেন, কেউ করেন না। ভালোবাসেন বা ভালোবাসেন না। তবুও যাই এবং যাবো। বাংলাদেশ যে আমাকে এত সময় ধারণ করছে তাকে অস্বীকার করবো, তার কোনো পথ খোলা নেই। আমিও জড়িত কোনো না কোনোভাবে।

বাংলাদেশের নাট্যচর্চার প্রবল জোয়ারের আঁচ আমি কিছুটা হলেও পেয়েছি। আজ যত কালজয়ী প্রযোজনার কথা বলা হয়, তার কিছু কিছু আমি দেখেছি। কিছু মানুষ, যারা আজ আর নেই, তাঁদের অনেকের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। হয়তো এভাবে আমিও এক ইতিহাস বা ইতিহাসের সাক্ষী। মনে আছে মামুনুর রশীদ প্রথমদিন বিকেলে নিয়ে গেলেন আরণ্যকের (আরণ্যক নাট্যদল। নাটকের দলগুলোর নামোল্লেখ করার সময় লেখা ও পড়ার সাবলীলতার জন্য আমি দলের সংক্ষিপ্ত বা বলা যায় ‘ডাকনাম’ উল্লেখ করবো।) মহলায়। সেদিন যাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম আজ অনেকেই স্বনামধন্য তারা। সকলের নাম হয়তো এক লহমায় মনে করতে পারবো না। তবু মনে আছে, দেখা হয়েছিল- আজিজুল হাকিম, আজাদ আবুল কালাম, ফজলুর রহমান বাবু, মান্নান হীরা, ঠাণ্ডু রায়হান, হারুন অর রশীদ, আব্দুল্লাহেল মাহমুদ, তমালিকা, শাহআলম দুলাল, মোমেনা চৌধুরী, ফয়েজ জহিরসহ অনেকের সাথে। আমিও হয়ে উঠলাম আরণ্যকের বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব, সেই জোর, আজো রয়ে গেছে আমার। সত্য হয়তো এই যে, আজ শত ব্যস্ততায় আমাদের মধ্যে হয়তো দেখা হয় না, কিন্তু আমাদের আন্তরিকতায় একটুও ভাটা পড়ে নি। কেউ কেউ এখনো প্রিয় বন্ধুর তালিকায় রয়ে গেছে। আরণ্যকের সেই সময়ে যেমন, আজো তেমন নিয়মিত খোলা হয় মহলা ঘর। কত অদল বদল হয়ে গেছে, অনেকে চলে গেছে দল ছেড়ে, তবু আরণ্যক স্বীয় মহিমায় রয়ে গেছে। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার তালিকায় আরণ্যকের বহু প্রযোজনা থেকে যাবে ইতিহাসে। আর আমি সেইজন যে ‘ইবলিশ’ থেকে ‘দি জুবিলী হোটেল’ পর্যন্ত সবগুলো প্রযোজনা দেখেছি একজন নিবিষ্ট দর্শক হিসেবে। সব প্রযোজনা হয়তো দর্শক গ্রহণ করে নি, হয়তো সেটা করেও না, কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে চলা একটা বড় ব্যাপার। আমি সেই চলার পথের অনেক ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছি। এ আমার এক গোপন অহংকার।

আরণ্যক নিয়ে এত কথা বললেও ঐতিহাসিকভাবে সত্য হলো গত শতকের একাত্তরের পরবর্তী সময়ে একসাথে অনেকগুলো নাট্যদল আত্মপ্রকাশ করেছিল। একটা প্রবল ঢেউয়ের মতো জনমানসে আছড়ে পড়েছিল নাটকের অভিঘাত। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ এর মধ্যে ৩৬ টি নাট্যদল প্রযোজনার কাজ শুরু করেছিল। তারা অনেকেই প্রবল সক্রিয় নয় আজ, কিন্তু নাগরিক, আরণ্যক, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার অবশ্যই তাদের মধ্যে অন্যতম। আরো দল থাকলেও এই চারটি দল যেন দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছিল। তাদের পথ আলাদা, তাদের অন্বেষণ আলাদা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের থিয়েটার সামগ্রিকভাবে এদের নির্ধারিত পথেই এগিয়ে চলেছে আজো- নির্দ্বিধায় বলা যায়। ‘নাগরিক’ পৃথিবীর ভালো থিয়েটারকে ভালোভাবে মঞ্চস্থ করতে শুরু করলো। আলী যাকের, আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, খালেদ খান কত নাম লিখবো যাদের পরিচালনায়-অভিনয়ে-বাংলা অনুবাদে অবিরত ঋদ্ধ হয়েছে এই বাংলা থিয়েটার। রবীন্দ্রনাথ, বাদল সরকার থেকে ব্রেখট, শেক্সপীয়র, সৈয়দ শামসুল হক সর্বত্র বিচরণ তাঁদের ঘটেছে। যা পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আবার ‘আরণ্যক’-এর নাট্যচর্চার পথ ছিল একেবারেই ভিন্ন। তাদের রাজনৈতিক থিয়েটারের প্রতি প্রবল আস্থা। থিয়েটার শ্রেণিসংগ্রামের হাতিয়ার- এই স্লোগান শিরোধার্য তাঁদের কাজে। শেক্সপীয়রের একটি নাটক বাদে আর কোনো অ্যাডাপটেশন তাঁরা করেছেন বলে মনে পড়ছে না। মূলত মামুনুর রশীদ নাটককার-পরিচালক হলেও পাশাপাশি আছেন মান্নান হীরা, আব্দুল্লাহেল মাহমুদের মতো নাট্যকার। ‘থিয়েটার’ নাট্যদলের কাজ মানেই আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক ও পরিচালনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের কথা, মধ্য ও নিম্নবিত্তের ছবি বারবার দৃশ্যমান তাঁদের কাজে। তাঁদের পথ নাগরিক দলটির মতো নয়, নয় আরণ্যকের রাজনৈতিক স্লোগান তবুও একান্তভাবে ভিন্নধর্মী এক মেজাজ। ফেরদৌসী মজুমদারের মতো বিরল এক অভিনেত্রীর কাজ দেখেছি এই দলে। আর শেষে আমার সকল শ্রদ্ধা ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর প্রতি। বাংলা থিয়েটারের গতিপথকে অন্যধারায় প্রবাহিত করে দিল তাঁদের কাজ। সেলিম আল দীন নামক মানুষটি তাঁর নাটক রচনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আঙ্গিক, ভিন্ন এক ভাষা প্রয়োগে বাংলাদেশের থিয়েটারকে পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিতে চাইলেন অন্য এক মাত্রায়। আজ এত বছর পরেও আলোচিত নাট্যদলগুলোর অনেক প্রযোজনাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। আমরা যারা কলকাতাবাসী, এখনো আমাদের কাছে বাংলাদেশের সেরা প্রযোজনার তালিকায় এই প্রযোজনাগুলোই উঠে আসে। গ্যালিলিও, ঈর্ষা, ইবলিশ, ওরা কদম আলী, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, কোকিলারা, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ইত্যাদি। যদিও আমার ব্যক্তিগত তালিকায় ভালোলাগা প্রযোজনার তালিকা অনেক অনেক দীর্ঘ। সব নাম হয়তো মনে করে বলতেও পারবো না। দলীয় পরিচয়ের বাইরে একজন নাটককারের নাম উল্লেখ না করলেই নয়- তিনি সৈয়দ শামসুল হক। মণিমুক্তোর মতো তাঁর সৃষ্টি জ্বলজ্বল করছে আমাদের থিয়েটারে। মূলত সাহিত্যের অন্য ধারায় অবাধ বিচরণ করতে করতে তাঁকে আমরা পেয়ে যাই নাটককার হিসেবে। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় থেকে গণনায়ক, ঈর্ষা, নূরলদীনের সারাজীবন-এর মতো নাটক। তাছাড়া শেক্সপীয়র-অনুবাদ তো বাংলা নাটকের জগৎকে ঐশ্বর্যশালী করেছে। তাইতো তিনি সব্যসাচী লেখক। ভালো লাগে এসবের স্বাদ গন্ধ নিতে পেরেছি, বাংলাদেশে যাতায়াতের সুবাদে।

এবার গত ২০ বছরের থিয়েটার নিয়ে বলা যাক। আগের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতাতেই নতুন নতুন অনেক বন্ধুর সাক্ষাৎ ঘটেছে ক্রমশই। এত যাতায়াত, এত বন্ধুতার সুবাদে অনেক বেশি বেশি ভালোলাগার স্বাদও পেয়েছি। নাট্যকেন্দ্র, লোকনাট্য দল, পালাকার, প্রাঙ্গণেমোর, সুবচন, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, প্রাচ্যনাট, বটতলা বা ঢাকার বাইরে বিবর্তন যশোর, তির্যক নাট্যদল, নান্দীমুখ, অনুশীলন, মণিপুরি থিয়েটার, জীবন সংকেত, ফেম, শব্দাবলী এই দলগুলো ধীরে ধীরে কেমন প্রথম উচ্চারিত দল হয়ে উঠছে তাদের কাজের মধ্যদিয়ে, তাও তো চাক্ষুষ করবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। কিন্তু বড় খামতি থেকে গেছে জেলার ভালো কিছু দলের কাজ আমি দেখি নি, যাদের মধ্যে অনেকেই এখন আর তেমন সজীব নন। নাটককার হিসেবে এসময়ে অনেকেই আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন। আমার ভালো লাগে যখন মলয় ভৌমিক, রবিউল আলম, মাসুম রেজা, অলোক বসু, শাকুর মজিদের নাটক দেখি বা পড়ি। সম্প্রতি দেখা প্রযোজনা সুবচনের ‘মহাজনের নাও’ যখন দেখি, বাকার বকুলের ‘ঊর্নজাল’ দেখি, সাইফ সুমনের ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’র নাট্যরূপ পড়ি, সাধনা আহমেদের ‘মাতব্রিং’ পড়ি, আসাদুল ইসলামের ‘নদ্দিউ নতিম’ দেখি, নাট্যম রেপার্টরির ‘দমের মাদার’ আর মেঠো পথে’র ‘অতঃপর মাধো’ দেখি কিংবা ভীষণভাবেই উদ্বুদ্ধ হই প্রাঙ্গণেমোরের ‘কনডেমড সেল’-এর মতো সাহসী প্রযোজনা দেখে। তখন ভাবতে ভালো লাগে বাংলাদেশের মঞ্চনাটক আগের মতোই গতিশীল, ঋদ্ধ। আবার বিপরীতভাবে নিজেকে অপরাধী মনে হয়, যখন ভাবি, দেখা হয় নি সৈয়দ জামিল আহমেদ বা তারিক আনাম খানের কাজ। এস এম সোলায়মান অথবা কামালউদ্দিন নীলুর কাজও খুব বেশি দেখে উঠতে পারি নি, কিংবা দেখা হয় নি আশীষ খন্দকারের কাজ। এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাবে। তাই আমার দেখা অসম্পূর্ণ, এ আমি মানি।

বাংলাদেশের সাথে আমাদের পশ্চিম বাঙলার পরিবেশ পরিস্থিতি অনেক আলাদা। সেই ১৯৪৭ এর পর থেকে অনেকগুলো লড়াই আর অগুনিত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে, যা আমাদের হয় নি। কারণ, ভারতবর্ষের মতো বিশাল একটা দেশের এক রাজ্যের বাসিন্দা আমরা। দেশভাগের ক্ষত ছাড়া ঐ জাতীয় কোনো যুদ্ধ বা লড়াই বাঙালি হিসেবে করতে হয় নি আমাদের, যদিও অনেক রাজনৈতিরক পটপরিবর্তন হয়েছে অবশ্যই। কিন্তু রক্তক্ষয়ী বলা যাবে না তাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশে অনেক ধর্মীয় অন্ধতার বিরুদ্ধে এখনো রোজ লড়াই করতে হয় নাট্যকর্মীকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই অবস্থার কথাটা জানি। তাই উদ্বেগ থাকে আমারও। তবে এখানকার রাজনীতি নিয়েও আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাই যখন দেখি দু’বছর ধরে মামুনুর রশীদ আমার দেশে আসবার অনুমতি পান না, যিনি আমাদের প্রিয়জন, যাঁর প্রতিটি কথায় উচ্চারিত হয় দুই বাংলার থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা। আমরা নিরুপায় হয়ে বসে দেখা ছাড়া কোনো উপায় বের করতে পারবো  না। অথচ জানি এর বিপরীতে কিছু হলে বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ভারতবর্ষের আঞ্চলিক এক রাজ্যের মানুষ হয়ে লজ্জিত হওয়া ছাড়া, সাক্ষী হয়ে থাকা ছাড়া উপায়হীন আমি বা আমরা।

কেউ কেউ ভাবেন বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় গত ২০ বছরে কিছুটা ভাটার টান লেগেছে। দর্শকশূন্যতা বড় চিন্তার কারণ। কিন্তু আমি তাতে হতাশ নই মোটেই। শিল্পের যেকোনো শাখায় এমন সাময়িক নিস্ফল সময় আসে। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের হাতে শিল্প পরিণত রূপ নিতে কিছুটা সময় তো নিবেই। মনে রাখতে হবে নতুন এক প্রজন্মের সংকেত কিন্তু পাওয়া যায় বাংলাদেশের নাট্যচর্চায়। যাদের অনেকের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। অন্যরকম করে ভাবছেন তারা। লেখক হিসেবে রুবাইয়াৎ আহমেদ, সামিনা লুৎফা নিত্রা, রুমা মোদক, সৌম্য সরকার, মাহফুজা হিলালী যেমন আছেন, তেমনি নির্দেশক হিসেবে আছেন আজাদ আবুল কালাম, ফয়েজ জহির, আমিনুর রহমান মুকুল, অনন্ত হিরা, মোহাম্মদ আলী হায়দার, পান্থ শাহরিয়ার, ইউসুফ হাসান অর্ক, ইশরাত নিশাত, মোহাম্মদ বারী, ত্রপা মজুমদার, অসীম দাস, অভিজিৎ সেনগুপ্ত, শামীম সাগর। আরো কত নাম আমি জানি না, যাদের কাজ দেখি নি, কিন্তু ঠিক জানি সেখানেও স্ফূলিঙ্গের চিহ্ন আছেই। থাকতে বাধ্য। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ আজো চলছে। থিয়েটার তার অস্ত্র নিয়ে লড়ে যাবে, যাবেই। যাদের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আমি।

তবে থিয়েটারকেন্দ্রিক একটা বিষয়ে আমার নিজস্ব আক্ষেপের কথা বলার আছে। যেমন, এতদিনেও ‘থিয়েটার’ পত্রিকা ছাড়া নতুন কোনো থিয়েটারের পত্রিকা থিতু হলো না। রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত এই একটি মাত্র পত্রিকা টিকে আছে এতকাল যাবৎ। আর সব পত্রিকাই হয় অনিয়মিত, নতুবা বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক দু’একটি নাটকের পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলছে অনেকদিন ধরে। কিন্তু তা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র করে হওয়ায় বহুল প্রচারিত নয়। ‘গ্রাম থিয়েটার’ জাতীয় পত্রিকা একটি সুনির্দিষ্ট আন্দোলনকেন্দ্রিক হওয়ায় সামগ্রিক চিত্র সবসময় মেলে না। নাটকের পত্রিকা বলতে যা বোঝায় তার মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল প্রথমে খালেদ খান ও পরে অনন্ত হিরা সম্পাদিত ‘মঞ্চপত্র’, অভিজিৎ সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘ফ্রন্টলাইন থিয়েটার’, সেলিম রেজা সেন্টু সম্পাদিত ‘দুই বাংলার থিয়েটার’, ইনামুল হক সম্পাদিত ‘শুধু নাটক’। কিন্তু এই সবক’টি পত্রিকাই অনিয়মিত বা বন্ধ হয়ে গেছে। পাভেল রহমান সম্পাদিত ‘ক্ষ্যাপা’ এবং রহমান রাজু সম্পাদিত ‘আনর্ত’ কেবলই হাঁটতে শুরু করেছে। তাদের হাঁটা যেন না থামে সেই প্রত্যাশা করি। তবে ‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকাটি ১৪/১৫ বছর প্রিন্ট আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর গত ৪/৫ বছর ধরে অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। বক্ষমান প্রবন্ধটি পত্রিকাটির ২০ বছর পূর্তিসংখ্যার জন্য লেখা। ২০ বছরের স্মারকসংখ্যাটি অনলাইন ও প্রিন্ট উভয় ভার্সানেই প্রকাশ হওয়ার কথা। সে-হিসেবে ‘থিয়েটারওয়ালা’র চলার পথ ধীর গতির হলেও সচল আছে বলতে হবে। রামেন্দু মজুমদারের আর একটি বড় কাজ হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিআই), বাংলাদেশ’ শাখাটির প্রতিষ্ঠা এবং সংগঠনটিকে জনপ্রিয় করে তোলা। এর ফলে থিয়েটারের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সহজ হয়ে উঠেছে। পরবর্তী সময়ে তাঁর আইটিআই বিশ্বসভাপতি নির্বাচিত হওয়া বাংলাদেশের থিয়েটারে এক বড় অর্জন বলে মনে করি।

আমি দু’একটি থিয়েটার দলের সংরক্ষণ বিষয়ক কাজ করবার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছিল, ইতিহাসের তথ্য হিসেবে যদি দলের কাজকর্মের তথ্য সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে আগামী দিনে তাঁদের কাজের মূল্যায়ন সম্ভব হবে। মনে হবার আরো কারণ, যাদের হাতে স্বাধীনতাপরবর্তী থিয়েটারচর্চা গড়ে উঠেছে, তাঁরা অনেকেই জীবিত। তাঁদের সামনে রেখে কাজটা হলে অনেক বেশি যথার্থ সংরক্ষণ হবে। এ বিষয়েও প্রথম সুযোগ করে দিয়েছিলেন মামুনুর রশীদ। আরণ্যকের তথ্য সংরক্ষণের কাজ। আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে এ কাজটা করেছিলাম। বইটিতে কী থাকবে না থাকবে তা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে কাজটা হয়েছিল। কারণ, অন্য এক দেশ থেকে গিয়ে কাজটা করা বেশ কঠিন। তাতে নানা অসম্পূর্ণতা থাকার আশঙ্কা থেকে যায়। কেননা, আমি সরাসরি সেই কাজটার প্রতিদিনের শরিক নই। বন্ধু বাবুল বিশ্বাস বহুদিন ধরে থিয়েটারের নানা ডকুমেন্টস সংরক্ষণের কাজ করছে। আমি তার বাইরে একটা বইয়ের ফরম্যাট তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। কাজটায় কিছুটা সফল হলেও সবটা হতে পারলাম না। এই খেদ থেকে যাবে হয়তোবা। আমার মনে হয়েছে, অনেকেরই আমাকে মেনে নিতে অসুবিধা হয়েছে। প্রথম বই প্রকাশের পর নানা কথা উঠেছিল। এই কাজের জন্য আমাকে কেনো বেছে নেয়া হলো বা আমার যোগ্যতাই বা কী- এসব নিয়ে। হতেই পারে, আমি ভিনদেশী, বাংলাদেশে কী কেউ নেই যে এই কাজটা করতে পারে!

তবুও মনে করি, যে দু’একটি কাজ করেছি তা যদি উদাহরণ হিসেবে গৃহীত হয় কোনোকালে, তাহলে কৃতজ্ঞ থাকবো বাংলাদেশের থিয়েটারের কাছে। আমার কোনো প্রতিপক্ষ নেই, প্রতিপক্ষ দাঁড় করাবার প্রয়োজনও নেই। কারণ, আমি আর এই মুহূর্তে এ ধরনের কাজ করতে আগ্রহী নই। যদি কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয় আমি থাকবো তাঁর সাথে। কারণ, আমি চাই থিয়েটারের ডকুমেন্টস সংরক্ষণের কাজ হোক। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এই দায়িত্ব আরো জরুরিভিত্তিতে গ্রহণ করুক। দেরি করলে বহুকিছু হারিয়ে যাবে। বন্ধুবর লিয়াকত আলী লাকী প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মহাপরিচালক। তিনি একজন কর্মদক্ষ মানুষ। তাঁর বিবেচনায় এই কাজ অগ্রাধিকার পাক, এটা আমার কাম্য।

আমি মনে রাখতে চাইছি, বাংলাদেশের থিয়েটারকে আপন ভেবে এদেশ থেকে যাওয়া সেইসব মানুষের কথা, যাঁরা ছুটেছুটে গিয়েছেন, বন্ধুত্ব করেছেন, অনবরত লিখেছেন। দুই বাংলার থিয়েটারের আদান প্রদানে অসম্ভব ভূমিকা নিয়েছেন সেইসব মানুষের কথা মনে রাখতে চাই। অরুন সেন, বিষ্ণু বসু, নৃপেন সাহা আরো কেউ কেউ। আজ যোগাযোগের পরিধি বেড়েছে। অনেক যাতায়াত, চেনাজানার পরিধি বেড়েছে। এই বেড়ে ওঠার ইতিহাসে এইসব মানুষগুলো যেন উল্লেখিত থাকেন, এটুকুই চাওয়া। অংশুমান ভৌমিক বা অভীক ভট্টাচার্যদের পথ চলা এই উত্তরাধিকারের অনিবার্য ফলশ্রুতি। এটা যদি ইতিহাসের স্বীকৃতি পায় মনে মনে খুশি হবো।

থিয়েটারের জয়যাত্রা অব্যাহত থাক।

আশিস গোস্বামী ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যগবেষক, নাট্যসমালোচক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।