Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : কিছু কথা কিছু ভাবনা

Written by আব্দুল্লাহেল মাহমুদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

প্রায় বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রকাশ করে, প্রায় বিনামূল্যে বিতরণ করে, একটি পত্রিকা কী করে এতদূর এলো, সে এক বিস্ময়! অবশ্য এ-সময়ের মাঝে একটা পরিবর্তনও এসেছে, তা হলো, মূদ্রিতরূপ ফেলে অন্তর্জালে প্রবেশ।

২০ বছর মানুষের ক্ষেত্রে যৌবনকাল। একটা নাট্যপত্রেরও কি তাই? স্নেহভাজন সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার যখন তার পত্রিকার ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একের পর এক তাগাদা দিচ্ছিল, তখন ভেবে পাচ্ছিলাম না কোথা থেকে শুরু করবো। সম্পাদকের অনুরোধ, আমি যেন এই সময়কালে আমাদের থিয়েটারের পরিবর্তন নিয়ে লিখি। বিষয়টি কঠিন, কিছুটা জটিলও বটে। বাংলাদেশের নবনাট্যের প্রায় সূচনালগ্ন থেকে নানাভাবে নাটকের সাথে যুক্ত থেকে যে পরিবর্তনগুলো ধরা পড়েছে, তাই তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আমাকে লিখতে হবে থিয়েটারওয়ালার অর্থাৎ গত ২০ বছরের কথা। বলাবাহুল্য এই কালখণ্ডে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্ভব নয়। আমাদের নাটকের যাকিছু পরিবর্তন তার আলোচনায় কখনো একটা নির্দিষ্ট সময়কালে আবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়। তাই কিছুটা সময় পিছিয়ে শুরু করতে হচ্ছে।

আমাদের এই বর্তমান বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে থিয়েটার, নাটক ছিল না বললেই চলে। তাদের অবস্থান ছিল দর্শক হিসেবে। তৎকালীন অবিভক্ত ভারত তথা বাংলাদেশে ‘যাত্রা’, ‘নাটক’ এসবের প্রচার, প্রসার ও চর্চা ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে। আর সেসবের মূল নিয়ন্তা ছিলেন মধ্যবিত্ত বাবুরা। সাতচল্লিশে বিভক্তির পর ‘যাত্রা’, ‘নাটকে’ মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়লেও তা ছিল অনিয়মিত বার্ষিক অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এসবের বাইরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ছিল পরিচর্যা ও আনুকূল্যবিহীন যাত্রাপালা, ঘেটুগান। পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নাটক-যাত্রা’র তেমন কোনো অগ্রগতি হয় নি বললেই চলে।

বাংলাদেশের নাটকে চোখে পড়বার মতো যাকিছু উন্নতি তা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে। এ সময়কালে গুণগত ও পরিমানগত সবদিক থেকেই চোখে পড়বার মতো পরিবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায়। এ পরিবর্তন সূচিত হয় যুদ্ধফেরৎ একদল তরুণের হাতে। নাটক ছিল তাদের আরেকটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র, নতুন রাজনীতি। এ সময়ের পরিবর্তনের প্রধান প্রধান দিকগুলো হলো- ১. নিয়মিত নাট্যচর্চা, ২. দর্শনীর বিনিময়ে নাটক, ৩. সংঘ নাট্য (গ্রুপ থিয়েটার), ৪. সমাজ-রাজনীতিনির্ভর নাটক। এসব ছাড়াও ছিল নাটককে আরো বেশি দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। মুক্তনাটক, গ্রাম থিয়েটার এরকম কিছু উদ্যোগ আয়োজন। শুরুটা হয়েছিল মূলত রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে। মঞ্চের অপ্রতুলতা, কারিগরি সুযোগ-সুবিধার অভাব, সর্বোপরি পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব এরকম একটা বাস্তবতা থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের নবনাট্যযাত্রা। এসব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নাটককে এগিয়ে নেয়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল একদল নাট্যকর্মীর ক্লান্তিহীন প্রয়াস।

সময়ের সাথে সাথে এসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আমাদের নাটক এগিয়েছে বহুদূর। অনেকেই বলে থাকেন নাটক আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল। শ্রেষ্ঠ ফসল কিনা সে বিচারে না গিয়ে বলা যায় স্বাধীনতা-উত্তর নাটক আমাদের অন্যতম অর্জন। এ সময়ের মাঝে আমাদের নাটকের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। রাজধানী ঢাকার অনুকরণ ও অনুসরণে মফস্বল শহরেও নাট্যচর্চা বেগবান হয়েছে। আমাদের নাটক আজ দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে। প্রতিবছর নতুন নতুন প্রযোজনা আসছে মঞ্চে। ব্যাপকভাবে না হলেও দর্শনীর বিনিময়ে দর্শক নাটক দেখছেন। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানান নাট্যোৎসব। প্রতিবেশি ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে নাটকের দল। নাটক মঞ্চায়নের সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। বিশ্বনাট্যমঞ্চেও ভূমিকা রাখছেন আমাদের নাট্যজনেরা। বিশ্বনাট্যসংস্থায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়ে যোগ দিয়েছেন নাট্যচর্র্চায়। নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে বেশ কিছু নাট্যপত্র। দেশীয় নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার নাটক অনূদিত ও রূপান্তরিত হয়ে মঞ্চস্থ হচ্ছে। শুরুর দিকে যেখানে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করা কোনো নাট্যকর্মী ছিল না, এখন সেখানে বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এ সময়ের মাঝে আমরা পেয়েছি বেশ ক’জন বিশ্বমানের নাট্যকার ও নির্দেশককে। এ সময়ে গড়ে উঠেছে বহু নাট্যদল। ভেঙ্গেছেও অনেক। ভাঙ্গাগড়া সৃষ্টিশীলতারই চিহ্ন। এসবই আমাদের অর্জন। এসব নিয়ে আমরা উল্লসিত হতে পারি কিন্তু আত্মশ্লাঘার কোনো সুযোগ নেই। যে বিপুল উদ্দীপনা আর বিশাল স্বপ্ন নিয়ে আমাদের নাট্যযাত্রা, তার কতটুকু স্পর্শ করতে পেরেছি আমরা? সেটাই এখন ভেবে দেখার বিষয়। আমাদের নাটক আজ বিশ্বসভায় পৌঁছে গেছে। প্রতি বছরই আমরা নাটক নিয়ে ছুটে যাচ্ছি দেশের সীমানা পেরিয়ে কিন্তু যেতে পারি নি ভুরুঙ্গামারী, চরমসনন্দ কিংবা নলুয়া বাজারের দর্শকের কাছে। নাটক এখন আটকে গেছে বড় বড় শহরগুলোর হাতেগোনা মঞ্চে। গত শতাব্দীর আশির দশকের গোড়ার দিকে নাটককে প্রান্তজনের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপক উদ্যোগ আয়োজন ছিল, তা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ নিবন্ধকার নিজেও সরে এসেছে সেই প্রয়াস থেকে। সত্যিকার অর্থে নাটক এখন শহরের সামান্য ক’জন মধ্যবিত্তের গণ্ডিতে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমরা যেমন নাটক নিয়ে যেতে পারি নি, তেমনি প্রান্তবাসীদের নাটকও আনতে পারি নি কেন্দ্রে। বহুপথে বিচরণ করেও তা হয় নি সর্বত্রগামী। সে-অর্থে বাড়ে নি দর্শকসংখ্যা।

নাটকের সাফল্যবিচারে একটি মানদ- হতে পারে এর দর্শকসংখ্যা। যদি আমাদের রাজধানীকেন্দ্রিক নাট্যচর্চাকে বিবেচনায় আনি তাহলেও সাফল্যের পাত্র ফুটো হয়ে যাবে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতার মাঝেও যত দর্শক নাটক দেখতেন, এখন প্রায় পঞ্চাশবছরে সেসংখ্যা খুব একটা বাড়ে নি। তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল বড়জোর দশ-বারো লাখ। আর এখন সেসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। দুই কোটি জনসংখ্যার এই নগরে প্রতিদিন গড়ে কতজন দর্শক নাটক দেখেন? বড়জোর পাঁচ’শ। তাহলে অগ্রগতির চিত্রটা কী দাঁড়ায়? বছরে এসংখ্যা এক-দেড় লাখ। ঢাকার বাইরের দর্শক কত হবে? এসব হিসাব বিবেচনায় নিয়ে এলে উল্লসিত হওয়ার কিছু থাকে না। ষোল-সতের কোটি জনসংখ্যার বিশাল দেশে কতদূর এগুতে পেরেছি আমরা? এ প্রশ্নটি মোটেও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে নাটমঞ্চে আমরা যে রাজনীতি অর্থাৎ মতাদর্শগত লড়াই শুরু করেছিলাম, সে জায়গা থেকেও আমরা অনেকটাই সরে এসেছি। নাটক রচনা ও প্রযোজনার ক্ষেত্রে আমরা প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, দেশি-বিদেশি নানা ভাববস্তু ও প্রয়োগ কৌশলের ব্যবহার করেছি কিন্তু খুব কমক্ষেত্রেই আমরা বৃহত্তর দর্শককে স্পর্শ করতে পেরেছি। শুধুমাত্র বিনোদনের উপর নির্ভর করে অনেক নাটকই হয়ে উঠেছে অপ্রয়োজনীয় প্রযোজনা।  

বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে এমন বিস্তৃত ক্যানভাসের বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়সমৃদ্ধ নাটক আর এখন মঞ্চে হয় না। বড় বড় দলগুলোও এখন অধিক চরিত্রের বিশাল ক্যানভাসের নাটক থেকে সরে আসছে। মঞ্চে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মঞ্চস্থ করছে দু’চারটি চরিত্রের ছোট ছোট নাটক। সেজন্য তৈরি হচ্ছে রেপাটরি থিয়েটার, স্টুডিও থিয়েটার। অনেকেই এটাকে পাশ্চাত্যের মিনিমালিস্টিক শিল্পদর্শনের সাথে মিলিয়ে বলছেন ‘মিনিমালিস্টিক থিয়েটার’।অর্থাৎ যতটা সম্ভব কম চরিত্রের ও আয়োজনের নাটক। এটা এক ধরনের আপোশ। আপোশ করে কোনো শিল্প হয় না। এসব নাটকের বিষয়বস্তুও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সংকীর্ণ। পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঈর্ষা, ব্যক্তিগত ক্ষোভ লালসা। বড় কোনো ভাবনা এতে নেই বললেই চলে।

থিয়েটারওয়ালা যেমন ফেরিওয়ালা হতে পারে নি, তেমনি আমাদের নাটকও হয়ে উঠতে পারে নি জীবন-জীবিকার উপায়। নাটক রচনা করে, নির্দেশনা দিয়ে কিংবা অভিনয়জীবন ধারণ করে বেঁচে থাকা- সে এক কষ্ট-কল্পনা। নাটক করে কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি করলেও কিংবা সাংসদ-মন্ত্রী হলেও নাটককে তারা পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন নি। এর প্রধান কারণ, আমরা সে-পরিমান দর্শক তৈরি করতে পারি নি। নাটক বলতে দেশের বেশিরভাগ লোকই টেলিভিশন নাটককে বুঝে থাকে। অথচ মঞ্চনাটকের ঐতিহ্য শত শত বছরের। আকাশ সংস্কৃতির এই সময়ে মঞ্চনাটকের একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে টেলিভিশন নাটক ও ধারাবাহিকগুলো। তারপরও নাটকের যে অগ্রগতিটুকু সম্ভব ছিল তা হয় নি আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছি বলে। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে যে বিশাল প্রতিশ্রুতি আর প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেছিলাম, এখন আমরা সেখানে নেই। কারিগরি ও অবকাঠামোগত অনেক অগ্রগতি হলেও নাটক সে-অর্থে জনবান্ধব হয়ে ওঠে নি।

থিয়েটারওয়ালা’র গত দুই দশকের সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ লেখা সেখানে প্রকাশিত হয়েছে, নাটক নিয়ে, নানা তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কও হয়েছে; কিন্তু নাটককে আরও বেশি দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা সেখানে নেই। নাটক একটি শক্তিশালী জনশিক্ষার বাহন হতে পারতো, কিন্তু হয় নি। নাটক ক্রমশ শহরের মধ্যশ্রেণির সীমিত কিছু মানুষের মাঝে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

এখন আবার নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। নতুন উদ্দাম আর আয়োজনের মাধ্যমে নাটককে সকল দর্শকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর এক্ষেত্রে ভরসা নাট্যকর্মীদের নতুন উদ্যোগ, আয়োজন।

আব্দুল্লাহেল মাহমুদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার। সদস্য- আরণ্যক নাট্যদল।