Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

দ্য মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং [লো মালওঁতুদু]

Written by আলব্যের কামু.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

অনুবাদ - তানভীর নাহিদ খান

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

(বিকেল, একটি ছোট সরাইখানার অভ্যর্থনা কক্ষ, ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন।)

মা
সে ফিরে আসছে। সে থাকতে চায়।

মার্থা
তুমি কি নিশ্চিত?

মা
সে তাই বললো। তুই চলে যাওয়ার পর বললো।

মার্থা
একাই?

মা
তাতো বলেনি।

মার্থা
তাকে কি খুব মালদার মনে হয়েছে? সাথে কি প্রচুর টাকা এনেছে?

মা
ভাড়ার বিষয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নাই।

মার্থা
যদি সে পয়সাওয়ালা হয় তাহলে ভালো হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তাকে অবশ্যই একা আসতে হবে।

মা
(দীর্ঘশ্বাস) হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়, যদি তাই হয় তবেই হবে কাজের সূচনা।

মার্থা
হ্যাঁ, তাই। এটাই কাজের সূচনা। কিন্তু তুমি ভয় পেও না। আমরা কাজের উপযুক্ত পুরস্কারই পাবো। (নীরবতা, মার্থা মায়ের দিকে তাকায়।) কী হলো মা? কিছুদিন আগেও তুমি এরকম ছিলে না। কিছু একটা হয়েছে, আমি জানি।

মা
কিছুই হয়নি। আমি একটু ক্লান্ত, এই যা। একটু বিশ্রাম নিতে হবে আরকি।

মার্থা
বিশ্রাম? এতো সহজেই। আমি ঘরের সব কাজ করবো! তোমার কিছুই করা লাগবে না। সারাদিন তোমার পড়েই থাকবে। সারাদিন প্রতিদিন।

মা
আমি তা বলিনি। এরকম বিশ্রাম নয়। না এটা শুধু একজন বুড়িরই স্বপ্নমাত্র। আমি শুধু শান্তি চাই, নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাই (দুর্বল হাসি)। আমি জানি বোকার মতো শোনাচ্ছে, তবু বলছি, যদি ধর্ম বলে সত্যিই কিছু থেকে থাকে অবশেষে তা আমাকে আকর্ষণ করেছে। এটা তুই বুঝবি না। সত্যি, আমি উতলা হয়ে উঠেছি।

মার্থা
মা তুমি এখনও অতটা বুড়ি হওনি। তোমার এসবের দরকার নেই। এখনও এর চাইতে অনেক ভালো কিছুই তুমি করতে পারবে।

মা
আরে, আমিতো ঠাট্টা করছিলাম। কিন্তু তারপরও কেনো নয়? এ বয়সে এসে তো আর কোনোকিছুই দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না। আমিতো তোর মতো শক্ত নই। আমার বয়স হয়েছে। তোর বয়সে তো এটা অস্বাভাবিকই লাগবে। অন্য মেয়েদের কথা আলাদা, ওরা সবসময় ভালোভাবে সময় কাটাতে চায়। প্রতিমুহূর্তে। আমি অনেকের কথাই জানি, যারা কিছুই না ভেবে অলস দিন কাটায়।

মার্থা
আমরা আমাদের মতো ভালো সময় কাটাই, সবসময়। তুমি নিশ্চয়ই জানো। ওরা আমাদের সাথে কখনই ওদের তুলনা করে না। করে কি?

মা
সে কথা এখানে আনবার দরকার নেই।

মার্থা
(চিন্তিত) কী হয়েছে? তুমিতো এভাবে কথা বলো না!

মা
আমাকে একা থাকতে দে। তোর নালিশ করার মতো কিছু হয়নি। আমি আমার কাজটুকু ঠিকই করবো। এতে আর কী সমস্যা? আমি কি মাঝেমধ্যে তোর মুখে একটু হাসিও দেখতে পাবো না?

মার্থা
আমি তো হাসি, মা।

মা
কই আমিতো কখনও দেখলাম না।

মার্থা
আমার রুমে যখন থাকি তখন হাসি। এভাবে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। এই হাসি একান্তই আমার জন্য।

মা
(তার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে) মার্থা তোর মুখটা বেশ কঠিন।

মার্থা
(মায়ের দিকে শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে আসে) কিন্তু ভালোবাসাপূর্ণ। অন্তত তোমার জন্য।

মা
(এখনো তাকিয়ে থেকে এবং বিরতি নিয়ে) হ্যাঁ, ভালোবাসাপূর্ণ, আমিও তাই মনে করি। কঠিন হোক আর যাই হোক।

মার্থা
(আবেগ উদ্দীপ্ত) মা, ও মা, শোনো, আমাদের এখন টাকার দরকার। প্রচুর টাকা থাকলে এ ধূসর ও আর্দ্র আকাশ আর স্যাঁতস্যাঁতে বদ্ধ ছাদের অবসান হতো। আমরা এই সরাইখানা আর শহর ছেড়ে যেদিন পালাতে পারবো আর এর বদলে আমার চিরদিনের স্বপ্নে দেখা সাগর-পাড়ের সেই জায়গায় যেতে পারব, সেদিন তুমি আমাকে হাসতে দেখবে, তার আগে নয়। আর মনে রেখো, সেখানে থাকতে হলে প্রচুর টাকা দরকার। সুতরাং আমাদের ভয় পেলে চলবে না। আজকে আসা অতিথির প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। যদি তার কাছে টাকা থাকে, প্রচুর টাকা, তবে আমার স্বাধীনতার সূচনা ওর দ্বারাই রচিত হবে। তোমার সাথে যখন দেখা হলো, ওই লোকটা কি তোমাকে কিছু বলেছে?

মা
না, তেমন কিছু বলেনি।

মার্থা
রুমের ব্যাপারে কথা বলার সময় ওর ভাবভঙ্গী কেমন ছিল?

মা
তেমন করে দেখিনি। তাছাড়া চোখের অবস্থাও ভালো না। তবে এতোদিনের অভিজ্ঞতায় এতটুকু বলতে পারি এসব ক্ষেত্রে লোকের চেহারার প্রতি তীক্ষ্মভাবে না তাকানোই উচিত। অচেনা মুখ খুন করা সহজ। (নীরবতা) যাই হোক তুই জেনে খুশি হবি আমি আর কোনো কিছুর পরোয়া করি না। সেই মুহূর্ত পার হয়েছে।

মার্থা
বেশতো, আমি সহজভাবে বলতে পছন্দ করি। অন্যায় অন্যায়ই। মূলকথা হলো তুমি কী করতে যাচ্ছ তা তোমার জানা উচিত। ভদ্রলোকের কথার জবাব দিতে গিয়ে তুমি তাই করেছ।

মা
আমি এসব চিন্তা করিনি। অভ্যাসবশত কথা বলেছি কেবল।

মার্থা
অভ্যাস? অদ্ভুত একটি শব্দ শোনালে। এমন অভ্যাসের চর্চা করার সুযোগ তুমি কমই পেয়েছো।

মা
হয়তো তোর কথাই ঠিক। কিন্তু অভ্যাসের শুরুতো হয়েছে দ্বিতীয় অপরাধ থেকে। প্রথম অপরাধ তো করা মাত্রই শেষ। ঘটনা ছিল ক্ষণস্থায়ী আর তাদের মধ্যে ফারাকও ছিল বিস্তর। সময়ের প্রভাবে অভ্যাস শক্তিশালী হয়। স্মৃতি সবকিছুতে পর্যবসিত হয়েছে। সুতরাং আমার সুযোগ ছিল। অভ্যাসবশতই আমি উত্তর দিয়েছি এবং অভ্যাসই তার প্রতি ভালো করে তাকাতে দেয় নি। ওতো আমার শিকার।

মার্থা
তাকে মরতে হবে।

মা
অবশ্যই, তাকে মরতে হবে। নিশ্চয়ই সে মরবে।

মার্থা
কেমন অদ্ভুতভাবে বলছো কথাটা। তুমি কি নিশ্চিত, এতে কোনো ভুল নেই?

মা
সত্যি কথা হলো, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ওকে দিয়েই অপরাধের যবনিকা টানতে পারলে মুক্তি পেতাম। হত্যা আমাকে অবসাদগ্রস্ত করে ফেলেছে। আমি কোথায় মরবো তা নিয়ে চিন্তিত নই। এই সমতলেই হোক কিংবা সাগরতীরে আমার কাছে একই কথা। সত্যিই তা আমাকে মোটেও বিচলিত করে না। কিন্তু একটি ব্যাপারে আমি জানতে চাই, আমরা যাচ্ছি কি না?

মার্থা
অবশ্যই আমরা যাব। এটাই আসল কথা। সময় কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রস্তুত হও মা। বেশি কিছু করতেও হবে না। তাছাড়া, তুমি ভালো করেই জানো সত্যিকার অর্থে হত্যা করার বিষয়টি এর মধ্যে আসবে না। যা ঘটবে তা হলো ’ও এসে ওর চা খাবে, ঘুমিয়ে পড়বে, তারপর তাকে আমরা জীবিত নদীতে ফেলে দিয়ে আসবো। কিছুদিন পর ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে, বাঁধের লোহার গায়ে ঝুলে থাকা অবস্থায়। সেই সাথে অন্যদেরকেও পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা দুর্ভাগা, কেননা তাদের সজ্ঞানে খোলা চোখে নদীতে ঝাঁপ দিতে হয়েছিল। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, বাঁধ পরিষ্কার করার দিন তুমি বলেছিলে, ‘আমাদের শিকারগুলোই কম কষ্ট পায়, যাপিত জীবনের তুলনায়, কোমলতা’। ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই। আবারও বলছি, তৈরি হও। তুমি তোমার চাহিদা মতোই বিশ্রাম পাবে, যখন আমরা এখান থেকে চলে যাবো।

মা
হ্যাঁ, প্রস্তুত হচ্ছি। সামান্য হলেও সান্ত্বনা যে, ওরা আমাদের হাতে কষ্ট পায় না। এভাবে চিন্তা করলে আমাদের কাজ অপরাধের পর্যায়েই পড়ে না। অনেকটা হাতের ছোট ধাক্কার মতো। স্কেলের মুখ ফেরানোর আলতো স্পর্শ মাত্র। তুই ঠিকই বলেছিস। জীবন এর চাইতে অনেক নিষ্ঠুর। এ জন্যই সম্ভবত আমি নিজেকে কখনও অপরাধী ভাবি না।

(বৃদ্ধ চাকর এসে নিঃশব্দে ডেস্কের পেছনে বসলো। দৃশ্যের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত একচুলও নড়বে না।)

মার্থা
আমরা তাকে কোথায় থাকতে দেবো?

মা
এটা কোনো ব্যাপার না, দোতলার যেকোনো ঘরে।

মার্থা
হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। গতবার উপরতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে কী ঝামেলাটাই না পোহাতে হয়েছিল। একতলার ব্যবধানই যথেষ্ট (প্রথমবারের মতো সে বসলো)। আচ্ছা মা, এটা কি সত্যি, ওপারে আফ্রিকার সাগরতীরের বালিতে নাকি পা পুড়ে যায়?

মা
আমি কিভাবে জানবো, আমি তো কখনও যাইনি রে। তবে শুনেছি ওখানকার রোদ সবকিছু গ্রাস করে ফেলে।

মার্থা
একটা বইয়ে পড়েছিলাম, ওখানকার রোদ শরীরে প্রবেশ করে আত্মা অবধি শুষে নেয়। দেহের বাহ্যিক উজ্জ্বলতা ভেতরের শূন্যতাকে ঢেকে দেয়।

মা
এটাই কি তোর সেই স্বপ্ন?

মার্থা
হ্যাঁ। আমি এমন জায়গায় যেতে চাই যেখানে রোদ সমস্ত প্রশ্নকে খুন করবে। এখানে, যদিও আমি অনুভব করি আমার একটি আত্মা আছে কিন্তু এর ভার সহ্য করতে পারছি না। আমি একে মুক্ত করতে চাই মা।

মা
বেশ, আমাদের বসে থাকলে চলবে না। সময় চলে যাচ্ছে, এর মধ্যে অনেক কাজও সারতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো হলে আমিও তোর সাথে যাবো, ভয় পাসনে। কিন্তু যদি ঘরের কথা বলিস, আমার বয়সে এসে ঘর ছাড়া অন্যকথা ভেবে স্বস্তি পাওয়া যায় না। তুই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করতে পারিস। কেননা তোর নিজের একটি বাড়ি আছে। এরকম একটি মর্মস্পর্শী জায়গা। ইট-কাঠ দিয়ে নির্মিত স্মৃতিবহুল আসবাবপত্রে ঘেরা। ভাগ্য ভালো হলে এখানেই কেবল মাঝেমাঝে ঘুম আসতে পারে। তাছাড়া, ঘুমের দ্বারা সবকিছু ভুলে যাওয়া, সমস্ত প্রশ্ন- সমস্ত জিজ্ঞাসা থেকে মুক্তি পাওয়া সত্যিই আকর্ষণীয়। (মা উঠে দরজার দিকে এগুলো।) নিশ্চিত হয়ে নে সবকিছু তৈরি, মার্থা। অবশ্য  সত্যিই যদি তোর মনে হয় এতো বিড়ম্বনার প্রয়োজন আছে।

(মার্থা মায়ের চলে যাওয়া দেখল। তারপর নিজেও অন্য একটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।)

দ্বিতীয় দৃশ্য

(বৃদ্ধ চাকরটি জানালার কাছে গেল। জাঁ মঞ্চে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর প্রবেশ করলো। একটু থেমে ঘরের চারদিকে চোখ বুলালো, তারপর জানালার পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধকে দেখতে পেল।)

জাঁ
কেউ কি আছেন?

(বৃদ্ধ তার দিকে তাকালো এবং মঞ্চের উপর দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল।)

তৃতীয় দৃশ্য

(মারিয়ার প্রবেশ, জাঁ দ্রুত ঘুরে তার মুখোমুখি হল।)

জাঁ
তুমি আমাকে অনুসরণ করেছ।

মারিয়া
আমি দুঃখিত, না এসে পারলাম না। বেশিক্ষণ থাকব না আর কিছু জিজ্ঞেসও করবো না। কেবল দেখে গেলাম, তোমাকে কোথায় রেখে যাচ্ছি।

জাঁ
তুমি কি বুঝতে পারছো, এখনই কেউ চলে এলে সবকিছু ভেস্তে যাবে।

মারিয়া
কিন্তু এটাই আমাদের একমাত্র সুযোগ। তুমি যা খুশি বলতে পারো, যদি কেউ আসার আগ পর্যন্ত আমি থাকি তাহলে তোমার পরিচয় প্রকাশ করতে তোমাকে বাধ্য করবো।

(জাঁ ঘুরে বসলো, নীরবতা।)

মারিয়া
(চারপাশে তাকিয়ে) তাহলে এটাই সেই জায়গা?

জাঁ
হ্যাঁ, এটাই। বিশ বছর আগে এই দরজা দিয়েই আমি বের হয়েছিলাম। আমার বোন তখন একেবারেই বাচ্চা। ওই কোণে বসে ’ও খেলছিল। আমার মা আমাকে বিদায় জানাতেও আসেনি। অবশ্য তখন আমি কিছু মনেও করিনি।

মারিয়া
কিন্তু জাঁ, আমার এটা বিশ্বাস হচ্ছে না, তুমি এখানে আসার পরও তোমার মা তোমাকে চিনতে পারেনি। মা তো সবসময়ই তার ছেলেকে চিনতে পারে।

জাঁ
হয়তো, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে বিশ বছর মা আমাকে দেখেনি। তাছাড়া আমি বেশ ছোট ছিলাম। তখনও কৈশোর পার হয়নি। ওনারও বয়স হয়েছে। তাছাড়া চোখেও ভালো করে দেখেন না। ভাগ্যিস আমিই তাকে চিনতে পেরেছি।

মারিয়া
(অধৈর্য্যরে ভঙ্গিতে) হ্যাঁ, এসব শুনেছি, তুমি ভেতরে প্রবেশ করলে, সুপ্রভাত জানালে এবং এখানে এসে বসলে। কোনো প্রকার মিল খুঁজে পাওনি, এইতো?

জাঁ
জানি না। আসলে আমি কিছু মনে করতে পারছি না। তারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করলো। একটি বাক্যও উচ্চারণ করলো না। পছন্দসই বিয়ার এনে দিল। ওরাও তাকিয়েছিল আমিও তাকিয়েছিলাম কিন্তু ওরা বারবার আমার দিকেই তাকাচ্ছিল। আমি যেভাবে কল্পনা করেছিলাম, তার চাইতে পুরো ব্যাপারটা অনেক কঠিন ছিল।

মারিয়া
তুমি ভালো করেই জানো, এটা কঠিন ব্যাপার নয়। তুমি মুখ ফুটে কথা বললেই সব পরিষ্কার হতো। এসব ক্ষেত্রে যেকোনো স্বাভাবিক ব্যক্তিই ‘এই তো আমি, হ্যাঁ আমিই তোমার ছেলে’ বলে এগিয়ে যেত। এতেই সবকিছু ঠিক হতো।

জাঁ
হ্যাঁ, আমি জানি। আসলে আমি কল্পনায় আচ্ছন্ন ছিলাম। তুমিতো জানো কীরকম চমৎকার অভ্যর্থনা আশা করেছিলাম অথচ কিনা একগ্লাস বিয়ার পেলাম তাও আবার টাকার বিনিময়ে। আমি বলার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলাম না।

মারিয়া
একটি কথাই হয়তো যথেষ্ট হতো।

জাঁ
তা জানি না কিন্তু আমি যথার্থ শব্দটি খুঁজে পাইনি। তাছাড়া তাড়াহুড়ো করবারই বা কি প্রয়োজন? আমি এখানে পকেটভর্তি টাকা নিয়ে এসেছি এবং সাধ্যমত তাদের সুখি করার চেষ্টা করবো। যেদিন শুনলাম বাবা মারা গেছে, সেদিনই বুঝেছিলাম ওদের দু’জনের উপর আমার দায়িত্বের কথা। এটা বোঝার পরই ঠিক করলাম,আমি কী করবো? কিন্তু আসার পর বুঝলাম কাজটা অতো সহজ নয়। একেবারে বাইরের একজন মানুষের হঠাৎ ছেলে হয়ে ওঠা নিঃসন্দেহে কঠিন।

মারিয়া
কিন্তু তুমি যে এসেছো, একথা বললে কী সমস্যা? এসব কাজ তো গতানুগতিকভাবেই করতে হয়। স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নিজের পরিচয় প্রদানের চাইতে আর কিইবা ভালো হতে পারে। তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে অন্য কিছু করতে গেলে শেষে তুমি জট পাকিয়ে ফেলবে। কিভাবে তুমি আগন্তুকের বেশে এসে চমৎকার অভ্যর্থনা পাবার আশা করো? জানি না। এসব আমার কাছে অনর্থক মনে হচ্ছে।

জাঁ
মারিয়া, এটা কিছুই না। তাছাড়া, আমার লক্ষ্য পূরণে এটি বরং সাহায্য করবে। বাইরে থেকে ওদের আরও ভালোভাবে সাহায্য করতে পারবো। আমার কা-জ্ঞান ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বুঝতে পারবো ওদের সুখি করতে সত্যি কী প্রয়োজন? তারপর সময় এলে নিজেকে উন্মোচন করবো। কেবল একটি যথার্থ বাক্যের জন্য অপেক্ষা।

মারিয়া
আর পেয়েছো তুমি, (অবজ্ঞা) আমি মনে করি, একটি পথই রয়েছে, দরজা খুলে প্রবেশ করবে এবং বলবে, এই হলো আমি, তারপর প্রাণ খুলে কথা বলবে।

জাঁ
হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু হৃদয় যখন তীব্রভাবে যুক্ত থাকে, তখন ব্যাপারটা অতো সহজ নয়।

মারিয়া
এখানেই তুমি ভুল করছো। প্রাণের ভেতর থেকে আসা কথা সবসময়ই সহজ, সরল। অতো জটিল হতো না যদি তুমি সামনে গিয়ে বলতে, ‘আমি তোমার ছেলে! এই আমার বউ! সমুদ্রের ধারে, উষ্ণ রোদ বিশিষ্ট একটি অঞ্চলে ছিলাম আমরা। কিন্তু সত্যিকার সুখি হবার জন্য আমার বিশেষ কিছুর প্রয়োজন ছিল। আর সেই বিশেষ কিছুটি হলো তুমি।’

জাঁ
আমাকে ভুল বুঝো না মারিয়া, এটা ঠিক হলো না। এমন নয় যে আমার ওদের প্রয়োজন। কিছু জিজ্ঞেস না করেই আমি বুঝতে পেরেছি বরং আমাকে ওদের কতটা প্রয়োজন। একজন পুরুষ-মানুষ কখনোই বিশ্বাস করতে চায় না সে একা, তা এই পৃথিবীতেই হোক কিংবা পরকালে।

(নীরবতা, মারিয়া ঘুরে দাঁড়ালো।)

মারিয়া
দুঃখিত, হয়তো তুমিই ঠিক। কিন্তু এখানে আসার পর আমার মন কেমন যেন আত্মরক্ষা করতে চাইছে। আমার চারপাশে কারও মুখেই সুখের লেশমাত্র দেখতে পাইনি। তোমার এই ইউরোপ তো ভীষণ দুর্দশাগ্রস্ত। এখানে এসে তোমার মুখেও আমি হাসি দেখিনি। জায়গাটা আমার ভীষণ অপছন্দ হয়েছে, আমি শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। উফ, জাঁ, কেনো তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে? এখানে আশা মোটেও উচিত হয়নি। আমাদের জন্য এখানে কিছুই নেই। কিছুই নেই আমাদের সুখি করবার।

জাঁ
আমরা এখানে সুখের সন্ধানে আসিনি। আমরা তো ইতোমধ্যেই সুখি।

মারিয়া
(জোর দিয়ে) তাহলে সেই সুখ নিয়ে সন্তুষ্ট হচ্ছি না কেনো? নাকি তা তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?

জাঁ
না। সুখই সবকিছু নয়। মানুষের জীবনে কিছু কর্তব্যও থাকে। আমার কর্তব্য মাকে খুঁজে বের করা এবং স্বদেশে আমার অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করা।

(মারিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জাঁ তাকে থামিয়ে দেয়, কেননা বাইরে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। বৃদ্ধ লোকটি জানালার পাশ দিয়ে এগিয়ে আসে।)

জাঁ
কেউ আসছে। দয়া করে তুমি চলে যাও।

মারিয়া
কখনই না, এভাবে আমি যেতে পারি না।

জাঁ
(পায়ের শব্দ আরও কাছে চলে আসে।) দ্রুত, এখানে লুকিয়ে পড়ো, প্লীজ। (দরজার আড়ালে মারিয়াকে ঠেলে দিল।)

চতুর্থ দৃশ্য

(পেছনের দরজা খুলে গেল। বৃদ্ধ লোক প্রবেশ করে আবার বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। মারিয়াকে দেখতে পায়নি)

জাঁ
দয়া করে এবার তুমি চলে যাও। দ্রুত। আমার এখনও সুযোগ আছে।

মারিয়া
আমি থাকতে চাই। তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করবো। কথা দিলাম, যতক্ষণ না ওরা তোমায় চিনতে পারছে আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করবো না।

জাঁ
না, তাহলে আমি ধরা পড়ে যাবো, আমি জানি, মারিয়া...

(মারিয়া ঘুরে জাঁ এর কাছে চলে এলো। দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে)

মারিয়া
জাঁ, পাঁচ বছর হলো আমরা বিয়ে করেছি।

জাঁ
কিছু দিনের মধ্যেই পূর্ণ হবে।

মারিয়া
(চোখ নিচু করে) গত পাঁচ বছরে আজই প্রথম আমরা আলাদা রাত্রি যাপন করছি। (জাঁ নিশ্চুপ, মারিয়া জাঁর দিকে আবার তাকালো) সারাজীবন আমি তোমার সবকিছুকে নিঃসংকোচে ভালোবেসেছি, এমনকি কোনো কিছু না বুঝলেও। আমি আমার হৃদয়ে দিয়ে জানি এর ব্যত্যয় ঘটবে না। আমি তোমার অপরিণত স্ত্রী নই, তবু আজ আমি শঙ্কিত। জাঁ, আমি চোখের সামনে শূন্য বিছানা দেখতে পাচ্ছি এবং মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছো।

জাঁ
তুমি আমার ভালোবাসায় সন্দেহ প্রকাশ করছো, মারিয়া?

মারিয়া
না, তা আমি করছি না, অবশ্যই না, কিন্তু ভালোবাসা এক জিনিস স্বপ্ন আরেক, অথবা তুমি যাকে বলছো কর্তব্য, তা একই কথা। প্রায়ই তুমি যেন কোন স্রোতে ভেসে চলে যাও। মনে হয় তুমি আমাকে নিয়ে ক্লান্ত এবং তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু আমিতো কখনো বিশ্রাম পাইনি। আমি তোমার ব্যাপারে কখনোই ক্লান্ত হইনি। আজকের সন্ধ্যার কথা ভাবতেই (সে কাঁদতে কাঁদতে জাঁর উপর শরীর এলিয়ে দেয়) না, আমি সহ্য করতে পারব না।

জাঁ
(শক্ত কওে জড়িয়ে ধরে) কী ছেলেমানুষি করছো!

মারিয়া
জানি আমি ছেলেমানুষ, কিন্তু ওখানে কী সুখিই না ছিলাম আমরা! এখন এই অচেনা দেশে রাতের অন্ধকার মুহূর্ত যদি আমার ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে কিইবা করতে পারি আমি? এটা একেবারেই আলাদা, তোমাকে রেখে আমি একা যেতে পারব না, সত্যিই পারব না।

জাঁ
কিন্তু আমিতো অনেকদিনের জন্য যাচ্ছি না। বোঝা উচিত, আমাকে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই হবে।

মারিয়া
তোমার প্রতিশ্রুতি?

জাঁ
নিজের কাছে করা প্রতিশ্রুতি। আমি এটি সেদিনই করেছিলাম যেদিন বুঝলাম আমার মায়ের জীবনে আমি কতোটা অপরিহার্য।

মারিয়া
তোমার আরেকটি প্রতিশ্রুতি আছে।

জাঁ
কী?

মারিয়া
সেই প্রতিশ্রুতি, যেদিন আমরা একসাথে থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম।

জাঁ
হ্যাঁ, কিন্তু এর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। আমি সবদিকই রক্ষা করতে পারব, আমিতো বেশি কিছু চাচ্ছি না। চাচ্ছি কি? আমি এটি মজা কিংবা স্ফূর্তির জন্য করছি না। একটি সন্ধ্যা, একটি রাতই না হয় আলাদা থাকছি। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজব, আমার স্বজনদের জানব এবং খুঁজে বের করব কিভাবে তাদের সুখি করা যায়।

মারিয়া
(মাথা নাড়ে) এটি তার চেয়েও বেশি, প্রিয়জনের বিচ্ছেদ সবসময়ই ভয়ংকর তা সংক্ষিপ্তই হোক আর দীর্ঘ।

জাঁ
এটা নিষ্ঠুরতা, জানোইতো তোমাকে আমি কতো ভালোবাসি।

মারিয়া
না, কতো নয় বরং একজন পুরুষ যতটুকু ভালোবাসতে পারে, ততটুকু। কিভাবে ভালোবাসতে হয় পুরুষরা জানে না। কোনো কিছুই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। তারা স্বপ্নচারী। এই কাজটিই তারা ভালো জানে। তারা কর্তব্যের স্বপ্ন দেখে। প্রতিদিন নতুন করে, নতুন দেশের খোঁজে, নতুন চাহিদা, নতুন ডাকের অন্বেষণে। আর আমরা কেবল এটুকু জানি, ভালোবাসা অপেক্ষা করতে জানে না। একটি যুগলশয্যা, হাতের আলতো ছোঁয়া- এগুলোই আমাদের সবকিছু। ভয়ের চাইতে কুৎসিত আর কিছু হতে পারে না। আর যদি তা হয় একা থাকার ভয় তাহলে তো কথাই নেই। ভালোবাসা অপেক্ষা করতে অক্ষম। যদি তুমি কাউকে ভালোবাসো তাহলে খেয়ালিপনার সময় কোথায়?

জাঁ
এতো কথার কী প্রয়োজন? এখানে এসেছি কেবল মাকে দেখতে, সাহায্য করতে আর তাকে সুখি করবার উপায় জানতে। যদি একে তুমি খেয়ালিপনা আর কর্তব্যের অজুহাত হিসেবে দেখতে চাও তাহলে বলব তোমায় ওদেরকে গ্রহণ করতে হবে। ওদের ছাড়া আমার অস্তিত্ব শূন্য আর ওরা না থাকলে তুমিও আমাকে ভালোবাসতে পারতে না।

মারিয়া
(এক ঝটকায় ওর পেছন দিকে ঘুরল) জানি, তোমার নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। বরাবরের মতোই আমি হার মানলাম। ওগুলো আমি আর শুনতে চাই না। আমি কান বন্ধ করলাম কারণ এটা ভিন্ন স্বর। এ স্বর প্রেমের নয়, এটা তোমার আত্মকেন্দ্রিকতার স্বর।

জাঁ
(মারিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে) থাক মারিয়া আর না। তুমি আমাকে একা থাকতে দাও, তাহলে এখানে স্পষ্টভাবে সবকিছু দেখতে পাব। নিজের মায়ের সাথে এক বাড়িতে থাকায় প্রশ্নের কিছু নেই, ভয়ের কিছু নেই। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও। তিনি জানেন, আমি এতো সব করছি তোমাকে ভুলে যাবার জন্য নয়। সুখি থাকতে চাইলে কেউই বহুদিনের নির্বাসনবরণ করতে কিংবা মধুর স্মৃতিকে পেছনে ফেলে যেতে চাইবে না। এটা আমার জন্মভূমি এবং আমি অবশ্যই আমার মা ও বোনকে সুখি করবার চেষ্টা করব। এইতো বেশ।

মারিয়া
সবকিছুই তোমার হাতের নাগালে। কেবল কিছু কথা সহজ করে বলা যাতে ওরা বুঝতে পারে। অথচ তুমি চলেছো উল্টো পথে।

জাঁ
উল্টো নয় বরং এটিই সরল পথ। তুমি দেখতে পাচ্ছো না? এই পথে হেঁটেই আমি বুঝতে পারব, আমার স্বপ্নের আদৌ কোনো মূল্য আছে কিনা।

মারিয়া
ভালো, আমি আশা করছি তা থাকবে। আমার দিক থেকে জীবনের একমাত্র স্বপ্ন শুধুই তোমার সাথে সুখের জীবন কাটানো। আর আমার কর্তব্যও কেবল তুমি।

জাঁ
(কাছে টেনে নিয়ে) আমাকে একা থাকতে দাও। কথা দিচ্ছি আমি সঠিক কথাগুলোই বলব। সহজেই সমস্যার সমাধান হবে।

মারিয়া
(ছাড়িয়ে নিয়ে) সেই তুমি আর তোমার স্বপ্ন। ওহ, জাঁ, তুমি কী করলে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। যতক্ষণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। এটা সর্বদাই সমান। তুমি পাশে থাকলে নিজেকে অসহায় মনে হয় না। ঠিক আছে, পরিস্থিতি স্বচ্ছ হওয়া পর্যন্ত আমি ধৈর্য্য ধরব এবং তারপর আবার তুমি আমার হবে। এই মুহূর্তে যদি অসুখী হয়েও থাকি কেবল তোমার কারণেই। কারণ, তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি তুমিআমাকে চলে যেতে দিবে। সবাই বলে পুরুষের প্রেম হলো নিষ্ঠুরতা এবং এটাই সত্যি। তারা নিজেকে থামাতে পারে না। একান্ত যা কাম্য তাকেই অবলীলায় ফিরিয়ে দেয়।

জাঁ
(মারিয়ার মুখে হাত রেখে হাসতে হাসতে) এটা সত্যি, কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, আমাকে কি ভীত মনে হচ্ছে? যা করব ভেবেছিলাম, ঠা-া মাথায় তাই করছি। কেবল এক রাতের জন্য আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? তোমার মনে রাখা উচিত, আমার মা ও বোনের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, এতে তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

মারিয়া
(নিজেকে সরিয়ে) ঠিক আছে, তাহলে বিদায়। আশা করছি তুমি ভালো থাকবে। (হেঁটে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে থামল, ঘুরে নিজের শূন্য হাত দেখাল) দেখতে পাচ্ছো? আমি শূন্য হাতে ফিরছি। তোমার আবিষ্কারের নেশা আমাকে একাকী করেছে। আমি তোমার পথ চেয়ে রইলাম। (ইতস্তত করে বেরিয়ে পড়ল।)

পঞ্চম দৃশ্য

(জাঁ বসল, বৃদ্ধ মানুষটি এসে দরজ টেনে ধরল। মার্থা এসে প্রবেশ করল। বৃদ্ধ লোকটি বেরিয়ে পড়ল।)

জাঁ
শুভ অপরাহ্ন। ঘর দেখে নিতে এলাম।

মার্থা
জানি। আপনার জন্যই ঘর গোছানো হয়েছে।

জাঁ
বুড়ো লোকটি একটু অদ্ভুতকিসিমের!

মার্থা
তাই! এই প্রথম ওর নামে অভিযোগ শুনলাম। ওর কাজ ও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।

জাঁ
আসলে আমি অভিযোগ করছি না। ওনাকে আমার একটু আলাদা মনে হয়েছে। উনি কি বোবা?

মার্থা
কই নাতো!

জাঁ
তার মানে কথা বলতে পারে।

মার্থা
অবশ্যই, যখন দরকার কেবল তখন। যতটা সম্ভব কথা না বলে থাকতে চেষ্টা করে।

জাঁ
আচ্ছা! ওনাকে দেখে অবশ্য মনে হয় না উনি কিছু শুনতে পান।

মার্থা
এটাও ভুল। ও শুনতে পায় তবে আর দশজনের চাইতে একটু কম। যাই হোক আপনার নাম এবং বংশপদবী দয়া করে বলতে হবে।

জাঁ
হাসেক, কার্ল।

মার্থা
কেবল কার্ল?

জাঁ
হ্যাঁ।

মার্থা
জন্মতারিখ এবং স্থান?

জাঁ
আটত্রিশ বছর।

মার্থা
আর জন্মস্থান?

জাঁ
(ইতস্তত) বোহেমিয়া।

মার্থা
পেশা?

জাঁ
নেই।

মার্থা
পেশা নেই! খুব ধনী কিংবা গরীবদেরই কোনো পেশা থাকে না।

জাঁ
(হেসে) খুব একটা গরীব আমি নই আর নানা কারণেই ভীষণ সুখি।

মার্থা
(ভিন্ন স্বরে) আপনি চেক?

জাঁ
ঠিক ধরেছেন।

মার্থা
থাকেন কোথায়?

জাঁ
বোহেমিয়া।

মার্থা
ওখান থেকেই এলেন?

জাঁ
না, আফ্রিকা থেকে এলাম (মার্থার চেহারায় বুঝতে না পারার ছাপ) সমুদ্র পাড়ি দিয়ে।

মার্থা
হুম, তা জানি। ওখানে কি প্রায়ই যান?

জাঁ
তা প্রায়ই যাই।

মার্থা
(খানিকটা সময় স্বপ্নাবিষ্ট, তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে) কোথায় যাচ্ছেন?

জাঁ
জানি না, কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করছে।

মার্থা
আপনি কি এখানে স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাবছেন?

জাঁ
তাও জানি না। দেখি কী হয়।

মার্থা
ওতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু আপনার অপেক্ষায় কেউ নেই?

জাঁ
না, আসলে কেউ নেই।

মার্থা
আপনার পরিচয় প্রদানের প্রামাণ্য কিছু আছে?

জাঁ
হ্যাঁ, আপনি দেখবেন?

মার্থা
না, ঠিক আছে। এটা কি পাসপোর্ট না পরিচয়পত্র?

জাঁ
(ইতস্তত) পাসপোর্ট। এইতো, দেখুন। (সে হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল তখনই বৃদ্ধকে দরজায় দেখা গেল)

মার্থা
সব ঠিক আছে, আমিতো ডাকিনি তোমাকে। (বৃদ্ধ চলে গেলো, মার্থা পাসপোর্ট না দেখেই ফেরত দিলো, তাকে অন্যমনষ্ক দেখাচ্ছে।)

জাঁ
হ্যাঁ। (মার্থা উঠে দাঁড়ালো, ডেস্ক বন্ধ করার উপক্রম করল, কিন্তু না করে কিছু ভাবতে লাগল।)

মার্থা
(হঠাৎ অপরিচিত স্বরে) ওহো, ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনার কি পরিবার আছে?

জাঁ
তা ছিল, তবে বহুদিন ধরে তাদের সাথে যোগাযোগ নেই।

মার্থা
না, আমি বলতে চেয়েছি আপনি কি বিবাহিত?

জাঁ
কেন? কোনো হোটেলেও তো এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন কখনও হইনি!

মার্থা
দেখুন, এটা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ।

জাঁ
নিঃসন্দেহে অদ্ভুত। হ্যাঁ, আমি বিবাহিত। এইতো বিয়ের আংটি, দেখেননি?

মার্থা
লক্ষ করিনি। আপনার স্ত্রীর ঠিকানা কি জানতে পারি?

জাঁ
সে তার বাড়িতে আছে, আফ্রিকায়।

মার্থা
চমৎকার! (বই বন্ধ করবে) কিছু পান করবেন? রুমটি স¤পূর্ণ গোছানো হয়নি।

জাঁ
তার প্রয়োজন নেই। আপনার সমস্যা না হলে আমি এখানেই অপেক্ষা করি। কোনো অসুবিধা নেই তো?

মার্থা
তা কেনো হবে? ঘরটা অতিথিদের জন্যই।

জাঁ
তারপরও একজন ব্যক্তিই অনেক সময় শত মানুষের চেয়েও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মার্থা
(ঘর পরিষ্কার করতে করতে) আমি জানি না কিভাবে? যদি না আপনি স্ফূর্তির পেছনে ছোটেন। যদি আপনি সে কারণে আসেন তাহলে ভুল জায়গায় এসেছেন। আমরা এখন আর স্ফূর্তির পেছনে ছুটি না। সে জায়গাই নয় এটা। অচিরেই তা বুঝতে পারবেন। খুবই নির্জন এবং শান্ত জায়গায় আপনি এসেছেন। খুব কম মানুষই এখানে আসে।

জাঁ
তাহলে তো এটা ব্যবসার জন্য মোটেও সুবিধার নয়।

মার্থা
ঠিক তা নয়, হয়তো আয়ের পরিমাণ খুব বেশি নয়, কিন্তু আমরা অন্য কিছু পেয়ে থাকি। আমাদের শান্তি ও নির্জনতা বজায় থাকে। আর অনেক টাকা দিয়েও এসব পাওয়া যায় না। তাছাড়া বেশি হইচই ও ঝক্কি ঝামেলা পোহানোর চাইতে পছন্দসই একজন খদ্দেরই আমাদের কাম্য। মা-ও তাই পছন্দ করেন।

জাঁ
কিন্তু (দ্বিধান্বিত) আপনার কি জীবনটাকে উপভোগ করতে ইচ্ছে করে না, এটা তো ভীষণ নীরস লাগার কথা। একাকীত্ব বোধ করেন না?

মার্থা
(ঝটকা মেরে ঘুরে তাকায়) দেখুন যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে সোজাসুজি কয়েকটা কথা বলতে চাই। এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করার মানে হলো আপনি এখন আমাদের অতিথি। অতিথি হিসেবে সমস্ত অধিকার আপনি ভোগ করবেন। আমার মনে হয় না আপনি কোনোদিক থেকে বঞ্চিত হবেন। সমস্ত সেবা পাবেন এবং দিন শেষে অভিযোগ করার মতো কোনো খুঁতও আপনি পাবেন না। কিন্তু এর বাইরে আমাদের একাকীত্ব লাগে কিনা বা আমাদের কাছে বিড়ম্বনার পাত্র হয়ে যাচ্ছেন কিনা জাতীয় চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। ওগুলো আমাদের বিষয়, আমারাই সেগুলো দেখব। মনে রাখবেন, আপনি অতিথি। উপভোগ করুন। কিন্তু দয়া করে এর বাইরে কোনো কিছুতে নাক গলাবেন না।

জাঁ
ক্ষমা করবেন, আমি এভাবে বলতে চাইনি। আপনি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবেন তা ভাবিনি। কেবল একটুখানি কৌতূহল ছিল মাত্র। আপনাকে বিরক্ত করতেও চাইনি। কেনো যেন মনে হয়েছিল, আমাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে মিল রয়েছে।

মার্থা
দুঃখিত, আবার বলতে হচ্ছে, কিভাবে যে আমি আপনাকে বোঝাব...। আক্রমণাত্মক, বিরক্তি- এসব আপনি কোথায় পেলেন? আপনি যেভাবে কথা বলেছেন তা অস্বাভাবিক, আমি কেবল তাই বলছি। এটি উভয়ক্ষেত্রেই বিভক্তি টানবে। যেভাবে আমি দোষী হলে যতটা কুৎসিত দেখাবে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। দুঃখিত আমাকে এভাবে বলতে হচ্ছে। আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি এ জন্য আমি মোটেও বিরক্ত হচ্ছি না। তাছাড়া পরস্পর দূরত্ব বজায় রাখা উভয়ের জন্যই মঙ্গল হবে বলে আমার বিশ্বাস। আর আপনি যদি অতিথির মতো আচরণ করতে না পারেন, আমার ভয় হচ্ছে হয়তো আপনাকে ‘চলে যান’ বলতে বাধ্য হবো। এটা পানির মতো সহজ, দু’জন মহিলা আপনাকে ঘর ও বিছানা ভাড়া দিয়েছে বলেই আপনার প্রতি বাহু প্রসারিত কিংবা ঘরের একজন বলে ভাববে না। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। তাহলেই হলো।

জাঁ
আমি এখন স্পষ্ট। আসলে স¤পূর্ণ আমার ভুলের ফলেই আপনার ধারণা হয়েছে আমি নিয়মনীতির ব্যাপারে অজ্ঞ। অবশ্যই আমি সে ভুল আর করব না।

মার্থা
শঙ্কার কিছুই নেই। এরকম ঘটনা এটিই প্রথম নয়। আগেও অনেকেই অযৌক্তিক কৌতূহল দেখিয়েছে।

জাঁ
ঠিক আছে। আমি আসলে এখন আর কিছু বলতে চাই না। মানে অন্তত এখন না।

মার্থা
এ ব্যাপারে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তবে একজন অতিথির আত্মবিশ্বাস সহকারে কথা বলার মতো উপাদানের কিন্তু অভাব নেই।

জাঁ
যেমন?

মার্থা
অতিথিরা সাধারণত নানা বিষয়ে কথা বলে, তাদের ভ্রমণ কিংবা রাজনীতি বিষয়ে। কেবল আমাদের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য সবকিছু সম্বন্ধে। আমরা তাই চাই, দুয়েক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে অতিথিরা তাদের জীবন সম্বন্ধে, নিজেদের সম্বন্ধেও কথা বলেছেন। আমি তাতে আপত্তি দেখাইনি। এমনটি হতেই পারে। কিন্তু এরকম কোনো সুযোগ নেই যেখানে ঘর ভাড়ার বদৌলতে কর্ত্রীকে ব্যক্তিগত প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হবে। মা মাঝে মাঝে তা করে ফেলেন কেননা অনেকক্ষেত্রে তিনি সতর্ক থাকেন না। আমি এর বিরুদ্ধে, যদি আপনি আমার কথা বুঝে থাকেন সেক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির অভাব হবে না। ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনি অনেক কথা বলারই সুযোগ পাবেন। বেশিরভাগ লোকই নিজেদের সম্বন্ধে কথা বলার মতো শ্রোতা পেলে তুষ্ট হন।

জাঁ
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি এক্ষেত্রে দক্ষ নই। তাছাড়া মনে হচ্ছে এক্ষেত্রে সুযোগও সীমিত যদি আমি এখানে বেশিদিন না থাকি তাহলে আমার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানতে পারবেন না। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে থাকলে আমি কিছু না বললেও ঠিকই আমার নাড়িনক্ষত্র আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়বে।

মার্থা
কেবল এটুকু আশা করব, আমার কথা আপনাকে সন্ত্রস্ত করবে না। সেটা নিরর্থক হবে কিন্তু কোনো ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে তা দূর করা করাই শ্রেয়। যদি আমি আপনার ওরকমভাবে কথা বলাকে প্রশ্রয় দিতাম শেষে কুৎসিত কোনো দৃশ্যের অবতারণা হতো। এভাবে দেখলে আমার কথাগুলো ন্যায়সঙ্গত মনে হবে। মোদ্দা কথা, আজকের পূর্বে আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত, হঠাৎ করে সম্প্রীতি খোঁজার চেষ্টা নিঃসন্দেহে আরও বোকামীর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

জাঁ
আর দুঃখিত হতে হবে না, আপনি যথার্থ বলেছেন সম্প্রীতি যেখানে সেখানে উৎপন্ন হয় না। এটি তৈরি হতে সময় লাগে। কিন্তু যদি আপনার কথা অনুসারে আমাদের মধ্যে সবকিছু সোজাসাপ্টা হয়, তাতেই আমি কৃতজ্ঞ।

(মায়ের আগমন)

ষষ্ঠ দৃশ্য

মা
শুভ সন্ধ্যা, আপনার ঘর প্রস্তুত।

জাঁ
অনেক ধন্যবাদ।

(মা বসে)

মা
(মার্থার প্রতি) ফর্মটা কি পূরণ করেছ?

মার্থা
হ্যাঁ করেছি।

মা
আমি একটু দেখি? আপনি কিছু মনে করবেন না তো। পুলিশ ইদানিং বেশ কঠোর হয়েছে। হায়, যা বললাম! আপনার আগমনের উদ্দেশ্য কি স্বাস্থ্যগত, ব্যবসায়, নাকি স্রেফ ভ্রমণ তা লিখতে আমার মেয়ে ভুলে গেছে।

জাঁ
আমার মনে হয় ভ্রমণ লেখাই উচিত।

মা
তার মানে নিশ্চয়ই মঠ দেখতে এসেছেন, খুবই ভালো করেছেন।

জাঁ
হ্যাঁ মঠটির কথা আমি শুনেছি। তবে আমি পুরো অঞ্চলটাই ঘুরে দেখতে এসেছি। সবই আমার ভীষণ পরিচিত, বেশ অনেকদিনের কথা। মধুর স্মৃতি।

মা
আপনি এখানে থাকতেন?

জাঁ
না, অনেক দিন আগে এদিক দিয়ে যাবার সুযোগ হয়েছিলো। কিছুই ভুলিনি।

মা
এখনও এটি একটি ছোট গ্রামই মাত্র।

জাঁ
হয়তো। কিন্তু আমার সময়টা ভালো কেটেছিল। আর এখানে ফিরে আসার পর মনে হচ্ছে নিজের ঘরে ফিরেছি।

মা
অনেকদিন থাকবেন?

জাঁ
জানি না। যদিও ব্যাপারটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে, কিন্তু একথা ভেবে আমি শঙ্কিত। কোথাও থাকতে হলে নির্দিষ্ট কিছু কারণের প্রয়োজন হয়। কিছু বন্ধু, ব্যক্তিগত বন্ধন ইত্যাদি। অন্যথায় সেখানে থাকা আর অন্য কোথাও থাকা একই কথা। যতক্ষণ না আপনি জানতে পাবেন কিরকম অভ্যর্থনা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, ততক্ষণ কিছুই বলতে পারবেন না। এটাই স্বাভাবিক।

মার্থা
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

জাঁ
হয়তো। তবে চাইলেও এর চাইতে ভালোভাবে আমি বলতে পারি না।

মা
মনে হচ্ছে আপনি অল্পদিনেই হাঁপিয়ে উঠবেন।

জাঁ    
তা জানি না। আমি উষ্ণ-অনুভূতির মানুষ। আর সুযোগ পেলে মনে রাখার মতো কিছু খুঁজে নিতে বিলম্ব করি না।

মার্থা
(অধৈর্য) এটা উষ্ণ অনুভূতির জায়গা নয়।

জাঁ
(না শোনার ভান করে মায়ের দিয়ে তাকায়) আপনি দেখছি এই এলাকা সম্বন্ধে স¤পূর্ণ অবগত। এই সরাইখানায় অনেকদিন ধরে আছেন।

মা
কালে কালে কত দিন গেল। কবে যে শুরু করেছিলাম, তাও ভুলে গেছি। এর আগে কী ছিলাম তাও মনে নেই। এই আমার মেয়ে...

মার্থা
এবার নিশ্চয়ই আমাদের পরিবারের ইতিহাস বলা শুরু করবে না তুমি।

মা
তা করবো না, মার্থা।

জাঁ
(দ্রুত) থাক। আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। পরিশ্রমী জীবনের শেষ প্রান্তে এমন ভাবাই স্বাভাবিক। তবে একজন পুরুষ থাকলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিত। একজোড় শক্তিশালী বাহু প্রত্যেক নারীরই প্রয়োজন হয়।

মা
তা ছিল, যখন সময় ভালো ছিল। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে হতো। আমি এবং আমার স্বামী হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতাম। অথচ পরস্পরের অনুভূতি প্রকাশের সময়টুকু পর্যন্ত পাওয়া যেত না। ফলে উনি কবরে যাওয়ার পূর্বেই তাকে ভুলে বসেছিলাম।

জাঁ
বুঝতে পেরেছি। কিন্তু (ইতস্তত) যদি একটি ছেলে থাকত। তাকে কি আপনি ভুলে যেতে পারতেন?

মার্থা
আমাদের অনেক কাজ পড়ে আছে।

মা
একটি ছেলে? হায়, কত বছর হয়ে গেল। এ বয়সে আমার মতো বয়স্করা এমনকি নিজের ছেলেকে ভালোবাসতেও ভুলে যায়। হৃদয় ততোদিনে ক্ষয়ে যায়।

জাঁ
সত্যি। কিন্তু পুরোপুরি ভোলা যায় না।

মার্থা
(দু’জনের মাঝে দিয়ে দাঁড়ালো) ছেলে এলেও অন্যান্য অতিথির চাইতে ভিন্ন আচরণ পেত না। পেত গতানুগতিক শুভেচ্ছা। অতিথিরা এখানে এসে মূল্য পরিশোধ করার বিনিময়ে ঘরের চাবি বুঝে নেয়। কেউই কখনও ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করেনি। এতে সবারই কাজের সুবিধা হয়েছে।

মা
মার্থা!

জাঁ
(চিন্তামগ্ন) তারা এভাবে কতদিন থাকত, এরকম নিয়ম মেনে?

মার্থা
কেউ কেউ বহুদিন। তাদের থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছিলাম। যাদের টাকার সমস্যা থাকত তারা পরদিনই চলে যেত। তাদের জন্য অবশ্য আমরা তেমন কিছু করিনি।

জাঁ    
বটে। আমার প্রচুর টাকা আছে। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি এখানে কিছুদিন থাকতে চাই। চাইলে অগ্রিম টাকাও দিতে পারি।

মা    
আপনাকে এ নিয়ে কিছু বলেছি? দরকার নেই।

মার্থা
টাকার অভাব না থাকলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দয়া করে কোনো অনুভূতির কথা বলতে যাবেন না। এসব ব্যাপারে আমরা কিছু করতে পারব না। আপনার প্রতি ধারণা এতই বাজে হয়েছিল, আরেকটু হলেই বলতাম, পথ দেখুন। এই আপনার রুমের চাবি, মনে রাখবেন, এই বাড়িতে অনুভূতির কোনো জায়গা নেই। বহু বছরের ধূসরতা এই বাড়ির উপর বয়ে গেছে, ফলে এক ধরনের শীতলতা ছড়িয়ে পড়েছে বাড়ির প্রতিটি কোণে। অনুভূতিহীনতার জন্য নিন্দা জানাতে পারেন কিন্তু সম্প্রীতির সন্ধান মিলবে না। এখানে আসা স্বল্পসংখ্যক অতিথিরা যা পেয়ে থাকেন তার সবই পাবেন তবে সহানুভূতি এর অন্তর্ভুক্ত নয়। চাবিটা নিন (চাবিটা তুলে দেয়) আর ভুলবেন না আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি, ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়াই। আমরা চাই সম্পর্কটা এভাবেই বজায় থাকুক। এতে উভয়েরই মঙ্গল।

(জাঁ চাবি নিলো, মার্থার চলে যাওয়া দেখলো)

মা
ওর কথায় শঙ্কিত হবার কিছু নেই মঁসিয়ে। প্রায় সবসময়ই কোনো না কোনো বিষয় ওর অপছন্দ হয়েই থাকে। (উনি উঠতে চেষ্টা করলেন, জাঁ গিয়ে তাকে সাহায্য করল) ঠিক আছে বাবা। এখনও ভেঙ্গে পড়িনি। এই হাত দুটো দেখেছ- এখনও সমর্থ, নয় কি? স্বচ্ছন্দেই একজন পুরুষকে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।

(নিরবতা, জাঁ নিজের চাবির দিকে তাকালো)

মা
কী চিন্তা করছেন? আমার কোনো কথা?

জাঁ
দুঃখিত, আমি ঠিক ভালোভাবে শুনতে পাইনি, কিন্তু আপনি হঠাৎ করে যে ‘বাবা’ বলে ডাকলেন।

মা
ও...এটা এমনিতেই বলেছি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। এটা কোনো সম্প্রীতি না। ভয়ের কিছু নেই। স্রেফ বলার ধরন।

জাঁ
হতে পারে। আমার রুমটা কোথায়?

মা
অবশ্যই, উপরের উঠে যান, বুড়ো লোকটি আপনাকে দেখিয়ে দেবে।

(জাঁ ওনার দিকে তাকাল, যেন কিছু বলতে চায়)

জাঁ
(ইতস্তত) না...কিছু না, আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে থাকতে দেয়ার জন্য।

সপ্তম দৃশ্য

(মা একা। তিনি আবার বসলেন। টেবিলের উপর হাত রেখে বিস্ময় নিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন)

মা
কী করছি, হাতের কথা কেনো এভাবে বলতে গেলাম? হাত দুটোর দিকে ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারতো মার্থা ওকে কী ইঙ্গিত করেছে। কিন্তু তাকায়নি। তার মানে হলো ও মারা যাচ্ছে। ওর ইচ্ছে। কিন্তু আমি চাই ও চলে যাক। ও থাকলে রাতে ঘুম আসবে না। এটা খুব সহজ ব্যাপার। বয়স হয়েছে। জানি আমার সামনে কী রয়েছে। ওর পায়ের গোড়ালি ধরে পুরো শরীরের ভারসাম্য রেখে রাস্তা ধরে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তারপর নদীতে পৌঁছে পানিতে ছুঁড়ে ফেলা। কেবল বাহুর বন্ধন শিথিল করা তারপর সব শেষ। শরীরের ভারে ছলকে ওঠা পানি এবং নিঃশ্বাসের জন্য খাবি খাওয়া। একজন ক্লান্ত, বৃদ্ধা মহিলা যার মুখে সেই ছলকে আসা পানি মোছারও সামর্থ নেই, তার পক্ষে একাজ আর সম্ভব নয়। আর ও...ও ধীরে ধীরে ডুবে যাবে, শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়বে। হায়, আমি কতো বুড়িয়ে গেছি। কেনো যে ও বলির পাঠা হয়ে হাজির হল? নিজের জন্য যে ঘুমটুকু রেখেছিলাম তার সবটুকু ওকেই দিয়ে দিতে হবে আমি জানি না...

(মার্থা প্রবেশ করল ঝড়ের বেগে)

মার্থা
এখনও বসে ভাবছ? অনেক কাজ পড়ে আছে।

মা
আমি লোকটার কথা ভাবছি কিংবা নিজের কথাই।

মার্থা
তারচেয়ে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্বাভাবিক থাকো। বাস্তবতা কাজে দিবে।

মা
তোর বাবাও এই কথাই বলতো। পরিষ্কার মনে পড়ছে। যাই হোক স্বাভাবিক, না...? কিন্তু এটাই শেষ, আর না। স্বাভাবিক! অদ্ভুত! মন থেকে পুলিশের ভয় তাড়ানোর জন্য সে এভাবে বলত। আর তুই? ঠিক সেইমুহূর্তে বললি যখন আমি আরেকটি পাপের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাচ্ছিলাম।

মার্থা
কিন্তু তুমি এটা এড়াতে চাইতে না। যদি না তুমি ঘুমাতে চাইতে। ঘুমকে পিছিয়ে দাও, আগামীকাল এলেই তুমি যা ইচ্ছা তা করতে পারবে।

মা
ঠিকই বলেছিস। অবশ্যই। কিন্তু তোকে স্বীকার করতে হবে, লোকটি অন্যদের মতো না।

মার্থা
না। সেও আত্মসচেতন। নিষ্পাপতা জাহির করে। জগতের সমস্ত ফাঁসির আসামী যদি জল্লাদের কাছে এসে হৃদয়ের সমস্ত কষ্টের কথা বলত, তাহলে কি ভালো হতো? ওর আদিখ্যেতা আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। যথেষ্ট হয়েছে। আমি এ পর্বের সমাপ্তি চাই।

মা
এইতো ভুল বললি। এরকমটি আগে কখনও হয়নি। রাগ কিংবা দয়া কখনই আমাদের কাজকে প্রভাবিত করেনি। আমরা এগুলো পাত্তাই দেইনি। এটা সবসময়ই নৈর্ব্যক্তিক থেকেছে। কিন্তু আজ আমি ক্লান্ত আর তুই বিরক্ত। এতোখানি যে স্পষ্ট। কোনো কিছুই খাপে খাপে মিলছে না। এতো কিছুর পর এই বন্ধুর পথ পাড়ি দেবো, কেবল আর কিছু বাড়তি টাকার জন্য?

মার্থা
আমরা টাকার জন্য করছি না। বরং এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাই বলেই করছি। জীবনের প্রতি তোমার বিতৃষ্ণা হতে পারে, কিন্তু এখানে থাকতে থাকতে প্রতিপদে পীড়িত হয়ে ক্রমেই আমি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। আর একটি মাসও আমি এখানে থাকতে পারব না। আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, এই সরাইখানায় যথেষ্ট হয়েছে। তোমার বয়স হয়েছে, এখন চোখ বন্ধ করে সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করেই তুমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচো কিন্তু আমি এখনও তরুণী। আমি জানি আমার চাওয়া-পাওয়ার সম্বন্ধে। আমার জীবনের এক বিশাল অধ্যায় এখনও বাকি যা আমাকে এই স্থান ত্যাগ করতে প্ররোচিত করছে। এখনও কাজ শেষ হয়নি, আর সামান্য কয়েকটা ধাপ, তারপরই মুক্তি। এজন্যই তোমাকে আমার দরকার। তুমি আমাকে এই জগতে এনেছ এখন তুমিই আমায় সাহায্য করবে। তোমার সন্তানকে দিয়েছ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। এখন সে চাইছে রৌদ্রদীপ্ত ঝলমলে আকাশ।

মা
জানি না, মার্থা। আমার মনে হচ্ছে তোর ভাইয়ের মতো তুইও যদি আমাকে ভুলে যেতে পারতি, তবে আমাকে এতো হ্যাপা সহ্য করতে হতো না।

মার্থা
আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি মা, দুঃখিত। (নিরবতা, রাগ ও বিব্রতকর কণ্ঠের মিশ্র সুর) তুমি না থাকলে কী করতাম আমি। আমি কোনদিনই তোমাকে ভুলতে পারব না। আমি তার মতো নই। এখানে বাস করার যন্ত্রণা মাঝেমাঝে আমাকে উন্মাদ করে দেয়। কিন্তু তোমাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি। হয়তো সবসময় তা প্রকাশ করি না।

মা
তুই আমার লক্ষ্মী মেয়ে। বয়স্কদের চিন্তা-ভাবনা তো তরুণদের কাছে দুর্বোধ্যই লাগবে। এই সুযোগে তোকে বলি। অনেকক্ষণ ধরেই বলার চেষ্টা করছি। এবার না হয় কাজটা না করলাম, অন্তত আজকের রাতটা।

মার্থা
আজ রাতে নয়? কাল পর্যন্ত অপেক্ষা? না, মা সেটা সম্ভব নয়। আমার মতো তুমিও ভালো করেই জানো এখানকার কারো সাথে দেখা হবার মতো সময় তাকে দিতে পারি না। আমাদের অবশ্যই এগিয়ে যাওয়া উচিত। যেহেতু সে হাতের মুঠোতেই আছে।

মা
তা জানি। কিন্তু আজকের রাতটা থাকুক। আমাকে একটু শ্বাস নিতে দে আর ওকে দে আরেকটা দিন বাঁচার সুযোগ। এমনও হতে পারে ওই হবে আমাদের মুক্তির পাথেয়।

মার্থা
তোমার পক্ষে এরকম কথা বলা কিভাবে সম্ভব? মুক্তি নির্ভর করছে কাজ করার উপর এবং এটাই একমাত্র আশা। কাজ শেষ করে বিশ্রাম নিশ্চিত করো। হ্যাঁ, আজকে রাতের কাজ।

মা
মুক্তির পাথেয় বলতে ঘুমকেই বুঝিয়েছি।

মার্থা
মা, তোমাকে কথা দিচ্ছি, সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় পৌঁছতে দেরি নেই। আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। হয় আজ রাতেই নয়তো কখনই নয়।

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

(শোবার ঘর। জাঁ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। সবে সন্ধ্যার শুরু। ধীরে ধীরে ঘর অন্ধকার হচ্ছে)

জাঁ
মারিয়াই ঠিক, সময়টা আসলেই কঠিন। (নীরবতা) জানি না ও এখন কী করছে? ওর রুমে বসে আছে? চেয়ারে দোল খাচ্ছে? কাঁদছে? না কাঁদছে না? ভাবছে। তারপর? উপলব্ধি? অন্যকিছু? ওহ এই সন্ধ্যাটা! কোথায় সুখের বার্তা, যা এই সন্ধ্যা নিয়ে আসবে? কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া...(সে ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো) উফ্ কী হচ্ছে এখানে? যে কাজে এসেছি তা আগে শেষ করতে হবে। এই ঘরেই রয়েছে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। (দরজায় টোকা, মার্থা প্রবেশ করল)

মার্থা
আমি আপনাকে বিরক্ত করলাম নাতো? আপনার জন্য পরিষ্কার তোয়ালে ও তাজা পানি নিয়ে এলাম।

জাঁ
আমি ভেবেছি আগেই এগুলো দেয়া হয়েছে।

মার্থা
না, সাধারণত বুড়োটাই কাজগুলো করে। তবে মাঝে মাঝে তাকে অন্য কাজও করতে হয়।

জাঁ
এটা অতখানি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর তাছাড়া আমার আপনাকে বলা উচিত নয় যে আপনার দ্বারা আমি বিরক্ত হইনি।

মার্থা
কেনো নয়?

জাঁ
আমি আসলে নিশ্চিত নই, এটা আমাদের চুক্তির আওতাভুক্ত কী না?

মার্থা
সেই আপনার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা।

জাঁ
(হেসে) অভ্যেস করে ফেলব। তবে কিছুদিন সময় লাগবে।

মার্থা
(ব্যস্তভাবেই) সেই সময় কি আর আপনার হবে? ততদিনতো আর এখানে থাকছেন না।

(জাঁ ঘুরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। জাঁ মার্থার উল্টো দিকে ঘুরলেও মার্থা তার দিকে কথা বলতে বলতে কাজ করতে লাগল)

মার্থা
আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না, ঘরটা সম্ভবত আপনার উপযোগী করে প্রস্তুত করতে পারিনি।

জাঁ
কই, এটাতো যথেষ্ট ছিমছাম, যা সবচাইতে বেশি দরকার। ঘরটা কি কিছুদিন পূর্বেই নতুন করে গোছানো হয়েছে?

মার্থা
কিভাবে জানলেন?

জাঁ
এইতো দুয়েকটা চিহ্ন দেখে।

মার্থা
হ্যাঁ, আসলেই হয়তো এটি সকলের সন্তুষ্টি অর্জনে সমর্থ নয়। যেমন- পানির সমস্যা। অনেকেই এ নিয়ে অভিযোগ করেছে। তাদের অবশ্য দোষও দেয়া যায় না। বিছানার উপর বাতি লাগানোও তেমনি দরকার। অনেকদিন ধরেই কাজটা করব ভাবছি কিন্তু হয়ে ওঠে না। রাতে যাদের বই পড়ার অভ্যাস আছে, ঘুমানোর সময় বাতি নেভানোর জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে আসা নিঃসন্দেহে বিরক্তিকর।

জাঁ
(ঘুরে তাকাল) আমি এটা লক্ষ্যই করিনি। এটা তেমন কোনো সমস্যা না।

মার্থা
এটা আপনার সহৃদয়তা। আপনার মনোভাব আমি উৎসাহ হিসেবে গ্রহণ করলাম। আমাদের সরাইখানা নানা সমস্যায় জর্জরিত। এগুলো আপনাকে উদ্বিগ্ন না করায় আমি আনন্দিত। অনেকেই এগুলো দেখে পালানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

জাঁ
আমাদের চুক্তি থেকে একটুখানি চ্যুত হয়ে বলছি, আপনার আচরণ বেশ অদ্ভুত। আমি ভাবতেই পারি না একজন মালিক তার প্রতিষ্ঠানের খুঁতগুলো খদ্দেরের সামনে তুলে ধরবে। কেনো যেন মনে হচ্ছে আপনি আমাকে তাড়াতে চাচ্ছেন।

মার্থা
ঠিক তা নয়। (তারপর যেন হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল) তবে এটা ঠিক, আপনার থাকার ব্যাপারে আমি এবং মা দ্বিতীয়বার চিন্তা করেছি।

জাঁ    
আপনারা আমার থাকবার বিষয়ে যে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি তা আমিও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কেনো? আমার টাকা-পয়সার সমস্যা নেই কিংবা আমি মনে করি না আমার ভাবভঙ্গীতে কোনো দাগী আসামীর প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। তাহলে কোন বিষয়টি আপনাদের উদ্বিগ্ন করেছে?

মার্থা
তা নয়, চেহারা দেখে আপনাকে খারাপ লোক মনে হয় না। অন্য একটি কারণ আছে। খুব দ্রুতই আমরা এখান থেকে চলে যাব। গত কয়েকমাস ধরে প্রতিদিনই ভাবি সবকিছু গুছিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করব। আমাদেরকে থামাবার কেউ ছিল না। কেননা অতিথি এখানে কমই আসে। কিন্তু আপনার আগমনের পর ভালো করে বুঝতে পেরেছি পুরোনো ব্যবসার প্রতি আমাদের মন কতটুকু উঠে গেছে।

জাঁ
তাহলে, আপনি চান আমি চলে যাই?

মার্থা
মাত্রই বললাম না, অন্যচিন্তার কথা। যেহেতু আমার উপর সবকিছু নির্ভর করছে, সেহেতু বলতে পারি যে এখনও নিশ্চিত নই আসলে কী ভাবছি?

জাঁ
আপনি যা চাইবেন তাই হবে। আপনার পথের কাঁটা হবার কোনো ইচ্ছে নেই। তবু বলি, এখানে আরো অন্তত দুয়েক দিন থাকা আমার জন্য ভীষণ জরুরি। সুতরাং এখানকার শান্তিপূর্ণ নির্জন জায়গায় থাকতে পারলে খুশি হতাম।

মার্থা
বুঝতে পেরেছি, বিশ্বাস করুন, এ নিয়ে আমি আবার চিন্তা করব। (নীরবতা, দরজার দিকে এগিয়ে আবার থামল) আপনি কি আবার ফেরত যাবেন? আফ্রিকায়?

জাঁ
হয়তো যাব।

মার্থা
খুবই চমৎকার দেশ, তাই না?

জাঁ    
(জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে) ভারী সুন্দর।

মার্থা
অনেকে বলে ওসব অঞ্চলে সমুদ্র উপকূল নাকি মরুময়।

জাঁ
আসলেই তাই। সেখানকার মানুষের কোনো নিশানা পাওয়া যায় না। কেবল ভোরের দিকে গাংচিলের পায়ের ছাপ দেখা যায়। জীবনের একমাত্র চিহ্ন। আর সন্ধ্যার সময়... (থেমে গেল)

মার্থা    
(শান্ত, মৃদুস্বরে) বলুন, সন্ধ্যাবেলায়?

জাঁ
আপনাকে তন্ময় করে ফেলবে। সত্যিই ভীষণ সুন্দর দেশ।

মার্থা
(নতুন স্বরে) প্রায়ই আমি ওই স্বপ্ন দেখি। ভ্রমণকারীদের গল্প আর যখনই সুযোগ পেয়েছি পড়েছি। কিন্তু আমি কেবল স্বপ্নই দেখতে পারি। এখানে শীত আর বসন্তে কোনো পার্থক্য নেই। যখন আমি খোলা সমুদ্র আর ফুলের ভাবনায় বিভোর হই (নীরবতা অনুভব করে) আমার কল্পনা আমাকে অন্ধ করে দেয়।

(জাঁ একদৃষ্টিতে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে, তারপর মার্থার সামনে বসে পড়ে)

জাঁ
বুঝতে পারছি আপনার কল্পনার বিস্তার। আপনার কণ্ঠ আমাকে বসন্তের কথা মনে করিয়ে দিল। বসন্ত আপনার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিবে। সাদা দেয়ালগুলো হাজারো ফুলে ছেঁয়ে যায়। শহরের আশপাশের পাহাড়গুলোয় এক ঘণ্টা ঘুরে এলেই দেখবেন আপনার কাপড়-চোপড় হলুদ গোলাপের মধুর সুবাসে ভারী হয়ে গেছে।

(মার্থা ঘুরে বসল)

মার্থা
আমার বিশ্বাস হতে চায় না। এখানে বসন্ত মানে মঠের বাগানে একটি ছোট্ট গোলাপ আর দুটি কুঁড়ি গজানো। এটাই যেন এখানকার লোকদের জন্য যথেষ্ট। (অবজ্ঞার দৃষ্টি) তাদের হৃদয়ও এরকমই প্রাচুর্যহীন। এর চাইতে অধিক সুবাসে ওদের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। ওদের জন্য এরকম বসন্তই উপযুক্ত।

জাঁ
তাই নাকি? আপনি শরৎ এর কথা বলতে ভুলে গেছেন।

মার্থা
শরৎ?

জাঁ
হ্যাঁ এটা হলো দ্বিতীয় বসন্ত। প্রতিটি পাতাই যেন ফুল। (জাঁ মার্থার প্রতি দৃষ্টি রেখে) তেমনি মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন আসে, যদি ধৈর্য ধরেন। একটুখানি যতœ কেবল।

মার্থা
আমি যত্ন নিবো কেনো? ইউরোপের এই অংশের শরৎ এখানকার বসন্তের মতোই বিষাদে ভরপুর, আমার সকল ধৈর্য কেড়ে নিয়েছে। আমার কল্পনা ভিন্ন কিছুর প্রার্থনা করে, যেখানে প্রখর সূর্য সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। (নীরবতা, জাঁ মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে। এটা লক্ষ্য করে মার্থা ঝট করে উঠে দাঁড়ালো) এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?

জাঁ
দুঃখিত। আমি চুক্তি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবেন না, কেননা এই প্রথম আপনি আমার সাথে যথার্থই মানুষের মতো কথা বললেন।

মার্থা
(ক্ষিপ্তস্বরে) এখানেই আপনি ভুল করছেন। মনুষত্বের দিকটিই আমার সবচেয়ে ভালো গুণ নয়। তা দেখলে আপনি মোটেও আনন্দিত হবেন না। আমি মানুষকে কেবল একটি বিষয়ই দেখাই তা হলো কাম্যবস্তু পেতে মানসিক দৃঢ়তা। তা পেতে সবকিছু ভেঙ্গে-গুঁড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করি না।

জাঁ
(হেসে) এরকম তীব্র মনোভাব আমাকে অবাক করে না, এটি আমাকে শঙ্কিতও করে না। তাছাড়া আমি আপনার পথের কাঁটাও নই। আপনার পথে আমি কেনইবা বিঘ্ন সৃষ্টি করব।

মার্থা
আপনার কোনো কারণ নেই। তবে এ বিষয়ে মাথা ঘামানোরও দরকার নেই। কখনও কখনও তা বিপদের কারণ হতে পারে।

জাঁ
কে বলল আপনাকে? আপনাকে সাহায্য করার কোনো কারণ আমার নেই।

মার্থা
কা-জ্ঞান, আমার পরিকল্পনা একান্তই আমার থাকুক। এটাই আমার চাওয়া।

জাঁ
চক্রপূর্ণ হয়ে কিন্তু আবার চুক্তিতে ফিরে এলাম।

মার্থা
হ্যাঁ, এ থেকে চ্যুত হওয়াই ভুল হয়েছে। যাই হোক, এত তথ্যের জন্য ধন্যবাদ। অযথা সময় নষ্ট করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। (দরজা পর্যন্ত গিয়ে) তবে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সময়ের অপচয় নয়। কোনোভাবেই না। এই কথোপকথন আমার ভেতরে যে বোধ তৈরি করেছে তার ফলে আপনাকে বাঁধা দেবার প্রবৃত্তি আর নেই। ইচ্ছেমতো থাকতে পারবেন। আমি নিজেও তা চাই। সমুদ্র, রৌদ্রোজ্জ্বল দেশের প্রতি আমার আকাক্সক্ষাও খানিকটা মিটবে।

(কয়েক মুহূর্ত জাঁ মার্থার দিকে তাকিয়ে থাকল)

জাঁ
আপনার শব্দ বাছাইয়ের ক্ষমতা অদ্ভুত। আমি থাকব এখানে, অবশ্য আপনার মায়েরও যদি কোনো আপত্তি না থাকে।

মার্থা
মাযের অনুভূতি আমার মতো অতো শক্ত নয়। আপনার থাকাটা আমার জন্য যতোটা জরুরি তার জন্য অতোটা নয়। সমুদ্র, মরুময় সৈকত এসব নিয়ে ভাবেন না। তাই বলে আমার বিরুদ্ধে তিনি যাবেন না।

জাঁ
তারমানে, আপনাদের একজন আত্মস্বার্থে চান আমি থাকি, অন্যজনের এ নিয়ে কিছু যায় আসে না।

মার্থা
এর চাইতে বেশি আর কে চায়, বিশেষত সরাইখানায়? (সে দরজা খুলল)

জাঁ
ভালো, খুশি হলাম। কিন্তু ক্ষমা করবেন, এখানকার সবকিছু কেমন অদ্ভুত। অদ্ভুত মানুষ, অদ্ভুত নিয়ম এবং অদ্ভুত কথা বলার কায়দা। ঠিক স্বস্তি পাওয়া যায় না।

মার্থা
তা নয়, যেখানে আপনার নিজের আচরণই অদ্ভুত সেখানে কিভাবে স্বস্তি প্রত্যাশা করেন, মঁসিয়ে? (বেরিয়ে যায়)

দ্বিতীয় দৃশ্য

জাঁ
(বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে) হয়তো তাই (ঘুরে এসে বিছানায় বসল) ওর আচরণ আমাকে এখানে থেকে চলে যেতে প্ররোচিত করছে। কী করছি এখানে? বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। মারিয়ার সাথে থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু...মার্থাও তো আমার বোন, আর মা, ওদের প্রতি কর্তব্য ভুললেও তো চলবে না। বহুদিন তাদের ভুলেছিলাম। (উঠে দাঁড়ালো) এই ঘরেই রয়েছে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু ঘরটা কী ভীষণ শীতল? সবকিছু নতুন করে সাজানো। অন্য কোনো শহরের অন্য কোনো সরাইখানার চাইতে কোনো পার্থক্য নেই। কত ভ্রমণকারীই এরকম জায়গায় রাত কাটিয়ে যায়। সব একই রকম। কিন্তু এই ছোট ঘরে আমি কী করছি? সমাধানের প্রতীক্ষা! হয়তো এখানেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে। (জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো) আকাশ ক্রমেই অন্ধকার হচ্ছে। অসহ্য লাগছে। ধীরে ধীরে চেপে বসা এই আতঙ্কের মাত্রা বাড়ছে তো বাড়ছেই, কমার কোনো লক্ষণ নেই। ভয়কে লুকিয়ে রাখা যায় না। একাকীত্বের ভয় তো আরো প্রবল। জন্ম থেকেই আমাদের ভেতরে তা বাসা বাঁধে। তখন কী হবে যদি আমরা আবিষ্কার করি। কোনো উত্তর নেই। এটা পরিণত হয় আতঙ্কে। কিন্তু কে উত্তর দিবে, এরকম একটি সরাইখানার ছোট্ট এই ঘরে?

(জাঁ ঘণ্টার দিকে এগিয়ে গেল, থামল এবং বাজিয়ে দিল। কোনো শব্দ নেই, নীরবতা। তারপর পদশব্দ এবং টোকা। দরজা খুলে গেল। প্রবেশমুখে বৃদ্ধ লোকটিকে দেখা গেল, নির্বিকার এবং অনড়)

জাঁ
কিছু না, দুঃখিত। দেখলাম ঘণ্টা কাজ করে কী না।

(বুড়ো ওর দিকে তাকাল, তারপর দরজা বন্ধ করল। পায়ের শব্দ ক্রমেই মিলিয়ে গেল)

তৃতীয় দৃশ্য

জাঁ
ঘন্টা বাজে তাহলে। কিন্তু বুড়োলোকটি কোনো কথা বলে না। এমনকি উত্তরও দেয় না।

(দরজায় দুটো টোকা পড়ল। মার্থা ট্রে নিয়ে প্রবেশ করল)

চতুর্থ দৃশ্য

জাঁ
কী হলো?

মার্থা
আপনার চা এনেছি।

জাঁ
আমিতো কিছু চাইনি।

মার্থা
ওহো, দুঃখিত! বুড়োটা নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে। মাঝে মাঝে এরকম হয়।

(টেবিলে চা রেখে জাঁর দিকে তাকায়)

মার্থা
আমি কি চা নিয়ে যাব?

জাঁ
না না। বরং ভালোই হল।

(মার্থা জাঁর দিকে তাকিয়ে চলে গেল)

পঞ্চম দৃশ্য

জাঁ
এক গ্লাস বিয়ার, তাও টাকা দিয়ে, এক কাপ চা সেও ভুল করে। (সে চায়ের কাপ তুলে নিল, ধরে রাখল, নীরবতা, তারপর হঠাৎ জোরে) ওহ্ ঈশ্বর! আমাকে কথা বলতে সাহায্য করো! অথবা সবকিছু বাদ দিয়ে মারিয়ার কাছে চলে যেতে দাও। আমাকে শক্তি দাও ঈশ্বর, আমার মনকে স্থির করো, আসলে আমি কী চাই? যা চাই তা যেন করতে পারি। (সে হাসল) বাহ্, এইতো খরুচে ছেলে। দীর্ঘ জীবন এবং সুখ! (চা খেল, দরজায় জোরে টোকা পড়ল) আসুন।

(দরজা খুলে গেল, মা প্রবেশ করে)

ষষ্ঠ দৃশ্য

মা
ক্ষমা করবেন, আমার মেয়ে বরলো, ও নাকি চা দিয়ে গেছে।

জাঁ
দেখতেই পাচ্ছেন।

মা
আপনি খেয়েছেন?

জাঁ
হ্যাঁ খেয়েছি, কেনো?

মা
না, কিছু না! ট্রেটা নিয়ে যাই।

জাঁ
(হেসে) দুঃখিত, এর জন্য আপনাকে আসতে হলো।

মা
ব্যাপার না, আসলে চা-টা আপনার জন্য বানানো হয়নি।

জাঁ
ও, তাই বলুন, অবশ্য আমি চাইনি। আপনার মেয়েই নিয়ে এসেছে।

মা    
(হতাশ স্বরে) হ্যাঁ, জানি, তবে ভালো হতো যদি আপনি...

জাঁ
আমি সত্যিই দুঃখিত, বিশ্বাস করুন, আপনার মেয়েই এসে রেখে গেল। আমি ভাবতেই পারিনি...

মা
আমি নিজেই দুঃখ প্রকাশ করছি। আপনি বিব্রত হবেন না। এটা সেরকমই একটা ভুল।

(ট্রে গুছিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেন)

জাঁ
মাফ করবেন।

মা
বলুন।

জাঁ
আমি একটু আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সন্ধ্যার খাবার খেয়েই আমি চলে যাচ্ছি। আমি অবশ্য ভাড়া পরিশোধ করেই যাব। (জাঁ এর প্রতি মা নীরবে তাকিয়ে রইলো) আপনি অবাক হলেন, অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। তবে এতে আপনাদের কোনো হাত নেই, সেটা ভুল করা হবে। আমি আপনাদের আচরণে সন্তুষ্ট। তবে এখানে বেশ অস্বস্তি লাগছে। তাছাড়া থাকার প্রয়োজনও আর নেই।

মা
(ধীরে) সমস্যা নেই, মঁসিয়ে। আপনার যা ইচ্ছা। আপনি স¤পূর্ণ স্বাধীন। তবে খাওয়ার পূর্বেই আমাদের সম্পর্কে আপনার ধারণা পাল্টাতে পারে। প্রথম ধারণায় অনেকেরই অবিশ্বাস থাকে, তবে তা ভুলও হতে পারে। অনেক কিছু অদ্ভুত লাগতে পারে, পরে হয়তো ভুল ভেঙ্গেও যায়।

জাঁ
আমার তা মনে হয় না। অন্তত এক্ষেত্রে না। আমি অসন্তুষ্ট নই। বরং এর বিপরীত। আমি আপনাদের ব্যবহারে কৃতজ্ঞ। (সে দ্বিধা করল) আসলে এখানে এসে আমার মূল উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছি।

মা
খুশি হলাম মঁসিয়ে, এটা অস্বাভাবিক নয়। এখানে কারও ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। আপনার সাথে বাজে ব্যবহার করব কোন দুঃখে?

জাঁ
(আবেগ ধরে) হয়তো তাই। মনে হচ্ছে ভালোভাবেই বিদায় নিচ্ছি। সম্ভবত আবার আসব। অবশ্যই আসব। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি কোনো ভুল করেছি। এখানে আমার কেউ নেই, করারও কিছু নেই। আমি এখানে স্বস্তি পাচ্ছি না। এমন অনুভূতি আমাকে ভীত করছে।

(মা, জাঁর প্রতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন)

মা
এটা অস্বাভাবিক না, নতুন জায়গায় এলে শুরুতে এরকম হতেই পারে।

জাঁ
জানি। দেখছেনইতো, আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আপনি হয়তো জানেন, বহুদিন আগে ফেলে আসা দেশে ফেরত যাওয়া সহজ কাজ নয়।

মা
অবশ্যই, আশা করি সমস্যা কেটে যাবে। এর চেয়ে বেশি আর কী করব।

জাঁ
না না, আমি তা বলছি না, এখানে এসে আপনার সাথেই প্রথম দেখা হলো। তারপরই সমস্যার শুরু। তবে সমস্যাটা আমার, আপনার না। আমি স্থির হতে পারিনি, এইতো।

মা
এরকম বাজে মুহূর্তে, কারোরই কিছু করার থাকে না। তবে আপনার সিদ্ধান্তে একটু অবাক হয়েছি। আবারো বলছি, এক্ষেত্রে তেমন কিছু করার নেই।

জাঁ
আপনি অনেক করেছেন আর কিছু করতে হবে না। কিন্তু আপনার এই কথাটি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আমি খুশি প্রকাশ করতে পারছি না। (সে অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করছে।) যদি পারতাম...

মা
অতিথিদের তুষ্ট করাই আমাদের কাজ।

জাঁ
(অনুৎসাহিত) অবশ্যই তা (একটু নীরবতা) যাই হোক, আমি ক্ষমা চাইছি। চাইলে ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি... (কপালে হাত দিল। ক্লান্ত দেখাচ্ছে) অহেতুক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, খরচও হয়েছে, এটা তখনই যৌক্তিক হবে...

মা
তার দরকার নেই। আমরাতো চাইনি। আপনি থাকবেন কী থাকবেন না তাই নিয়ে অনিশ্চিত ছিলাম। আমি ভয় পাচ্ছি। আপনার না কোনো ক্ষতি হয়।

জাঁ
(টেবিলে ঝুঁকে) আমার জন্য চিন্তা করবেন না। এখন আর কোনো দ্বিধা নেই, এইতো বেশ। আশা করব, আমাকে মনে রাখবেন। আমি আপনাদের ভুলব না। কথা দিচ্ছি, পরেরবার আমি ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই আসব।

(মা কোনো কথা না বলে দরজার দিকে হঁটে গেলেন)

জাঁ
একটি কথা (মা ঘুরলো, জাঁ-এর কথা বলতে কষ্ট হতে লাগল) তবে শেষে সামলে নিয়ে, আমি বলছিলাম যে আমার... (থামল) মাফ করবেন। আমি দুঃখিত। এতোখানি ঘুরে বেশ ক্লান্ত (বিছানায় বসল) কমপক্ষে, আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আর একটি কথা, এই সরাইখানায় অন্য যেকোনো অতিথির চাইতে আমার অনুভূতি আলাদা। তারা আমার মতো অস্তিত্বহীন নয়।

মা
এটা আপনার বিনয়।

(বেরিয়ে চলে গেলেন)

সপ্তম দৃশ্য

(জাঁ তাকিয়ে রইল। নড়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। ক্লান্তিতে নুইয়ে বালিশের উপর কনুই রেখে বসে পড়ল)

জাঁ
কালই ফিরে আসব। মারিয়াকে নিয়ে এসে বলব, ‘এই তো আমি’। আমি উভয়কে সুখি করব। মারিয়াই ঠিক, আসলেই খুব সহজ। (হাঁপিয়ে উঠে বিছানায় পা তুলে দিল) কী হলো আজ সন্ধ্যায়। সবকিছু কীরকম দূরে সরে যাচ্ছে। (প্রায় পুরো শুয়ে পড়ল। অষ্ফূট স্বরে কিছু বলল, তারপর) হ্যাঁ নাকি না (সে উল্টে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। দীর্ঘ নীরবতা। দরজা খুলে দু’জন মহিলা বাতি নিয়ে প্রবেশ করলো, বুড়ো লোকটি তাদের অনুসরণ করছে)

অষ্টম দৃশ্য

মার্থা
(ফিসফিস করে, বাতির আলোয়) সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মা
(একই কণ্ঠে, তবে উচ্চস্বরে) না মার্থা, না। আমার পছন্দ হচ্ছে না। তুই আমাকে জোর করছিস। তুই শুরু করে আমাকে দিয়ে শেষ করাচ্ছিস। আমার মনকে দ্বিধায় ফেলা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।

মার্থা
তোমার জন্য সব সহজ করে দিচ্ছি। তোমার ভাব বুঝেই কাজ শুরু করেছি। অন্য উপায় ছিল না।

মা
ঠিক আছে, কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু কাজটা ভালো হচ্ছে না। আমার এখনও পছন্দ হচ্ছে না।

মার্থা
বাদ দাও তো। কালকের কথা চিন্তা করে কাজ শেষ করো।

(সে তার পকেট হাতড়ালো এবং মানিব্যাগ বের করলে। সবগুলো পকেট হাতড়ে নিলো। এসময় পাসপোর্টটি বিছানার পেছনে মেঝেতে পড়ে গেল। বুড়ো লোকটি বাকি দু’জনের অগোচরে তা কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেল)

মার্থা
সব তৈরি। এখনই নদীতে জোয়ার আসবে। তীরের উপর দিয়ে পানি আছড়ে পড়ার শব্দ শোনামাত্রই আমরা ওর জন্য ফিরে আসবো। চলো।

মা
(শান্ত স্বরে) না, এখানেই ভালো আছি।

মার্থা
কিন্তু (মায়ের দিকে তাকালো উদ্ধতভঙ্গিতে) তুমি দেখছো না আমি ভয় পাচ্ছি? এখানে অপেক্ষা করব?

মা    
হ্যাঁ, আমার সমস্যা নেই। বিশ্রাম নেওয়াটা খারাপ না। শরীরটাকে বয়ে রাস্তা বেয়ে নদীতে ফেলবার জন্য দীর্ঘ রাত পড়ে আছে। ক্লান্ত না হলেও সময়টা বাজে কাটবে। এরকম শেষ কবে হয়েছিল বলতে পারছি না। এই বুড়ো হাড়ে আর কিছু দেবার নেই। এটাই দুশ্চিন্তার কারণ। (দুলতে দুলতে চেয়ারের পেছনের অংশে চলে এলেন, যেন অর্ধশোয়া) ওতো সুখি। সমস্ত ভাবনা-চিন্তার উর্ধে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিচ্ছে। ও অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়বে এমন এক ঘুম থেকে যা কিনা আরেক স্বপ্নহীন ঘুমহীন ছায়ায় পরিপূর্ণ। কোনো কষ্ট নেই। ওতো আমাদের মতো নয়। কোনো যন্ত্রণা হবে না। কোনো বাঁধা ছাড়াই ও ঘুমাবে। ঘুম এবং মৃত্যু। ও কোনো পার্থক্য বুঝবে না।

মার্থা
(উদ্ধত) যাক, শান্তি পাওয়া গেল! ওর কোনো যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না জেনে আনন্দিত। ওকে ঘৃণা করার কোনো কারণ নেই। (সে কান পাতল এবং হাসল) মা, বোধহয় পানির উচ্চতা বাড়ছে। দেরি করা যাবে না, চলো। এখনই পানি ছাপিয়ে যাবে।

মা
(আগের স্বরে) হ্যাঁ, পানির উচ্চতা এখনই অতিক্রম করবে। ও কিছুই জানবে না। গাঢ় ঘুমে ও মগ্ন। আত্মা এখন বিশ্রামে, সব মতামতের উর্ধে, সকল যত্ন থেকে মুক্ত, দেরি হবার পূর্বেই অর্থহীন কাজের শেষ আঁচড়ও আর দিতে হবে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর কোনো কষ্ট নেই। সমস্ত ধাক্কার সমাপ্তি। কাণ্ডজ্ঞানহীন চাহিদার পুনরাবৃত্তি করা লাগবে না। ও জীবনের গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছে। সমস্ত বিশ্রাম রেখে, সমস্ত দুর্বলতা ভুলে এবং সময়ের অপচয় করে ধর্মীয় রুঢ় কাজগুলা আর করতে হবে না। ঘুমাচ্ছে ও, নির্ভিক চিত্তে। আর কোনো কর্তব্য নেই। হায়, কিভাবে ওকে ঈর্ষা করলাম। আমি এক ক্লান্ত বুড়ি, ওর মতো ঘুমিয়ে পড়ার চাইতে আর কিইবা ভালো হতে পারে আমার? আর তারপর মৃত্যু। (নীরবতা) তুই তো একেবারে চুপ।

মার্থা
শুনছি। আর পানির শব্দের অপেক্ষা।

মা
এটা দ্রুতই আসবে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। আর ওই মুহূর্ত এলেই আমরা সুখি।

মার্থা
এরপরে সুখি হবো, আগে না।

মা
জানিস, ও চলে যেতে চাচ্ছিল।

মার্থা
তা জানতাম না, জানলেও কোনো লাভ হতো না। ঠিকই কাজটা সারতাম। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

মা
একটু আগেই জানিয়েছিল। কিছু বলতে পারিনি।

মার্থা
তুমি দেখা করেছ, না?

মা
চা খেতে না করতে ছুটে এলাম, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

মার্থা
হ্যাঁ, অনেক দেরি হয়েছে। শোনো, তোমাকে বলি, ওই আমাকে উস্কে দিয়েছে। ও আমার স্বপ্নের দেশের কথা বললো, আমাকে অস্ত্র যোগাল। আমিও বসে থাকিনি। ভালোমানুষীর উচিত শিক্ষা ও পেয়েছে।

মা
কিন্তু শেষ দিকে ও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। ও বলছিল, এ বাড়িতে ও নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।

মার্থা
(অস্থির কিন্তু শক্তিশালী কণ্ঠে) ঠিকই বলেছে ও। এটা ওর বাড়ি না। এখানে কেউ কোনদিন খুশি হয়নি, আপ্যায়িতও হয়নি। একটু আগে বুঝলেই ও রেহাই পেত, আমাদেরও কষ্ট করতে হতো না। তাহলে ও জানতো এ ঘরে মানুষ ঘুমাতেই আসে, যেমনি দুনিয়াতে আসে মরতে। (দূরে নদীর গর্জন শোনা যায়) পানি তীরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঈশ্বরের দোহাই, দ্রুত চলো।

(মা বিছানার দিকে গেলেন)

মা
ঠিক আছে, চল। দ্রুত যেতে হবে। সারাটা রাত বাকি। মনে হচ্ছে আর কোনোদিনই সকাল হবে না।

[দ্বিতীয় অঙ্কের সমাপ্তি]

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

(মা, মার্থা ও বৃদ্ধ, সবাই মঞ্চে। বৃদ্ধ পরিষ্কার করছে। মার্থা ডেস্কের পেছনে চুল বাঁধছে। মা মঞ্চের উপর হেঁটে দরজার দিকে যাচ্ছেন)

মার্থা
দেখলে, শেষ পর্যন্ত সকাল হলো।

মা
হ্যাঁ, আগামীকাল বুঝতে পারব, সবকিছু পেছনে ফেলতে পেরেছি।

মার্থা
এতগুলো বছর কিভাবে যে ছিলাম। আজ সকালে মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। মনে হচ্ছে এখনই সমুদ্রের গর্জন শুনছি। আনন্দে চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে।

মা
তোকে দেখে ভাল্লাগছে। বুড়ি হয়ে গেছি বলে যোগ দিতে পারছি না। কালকে নিশ্চয়ই ভালো বোধ করব।

মার্থা
নিশ্চয়ই। কিন্তু এখন আবার দুর্দশার কিচ্ছা শুরু করো না। আমি নিজেকে লাই দিতে চাই। কেনো আমি অসুখি থাকব? নিজেকে ফিরে পেয়েছি। আমার শরীর উষ্ণ হচ্ছে। কিছু একটা করা উচিত। দৌঁড়াবো...বলো না মা...

(থেমে গেল)

মা
কিরে মার্থা? তোর কা-কারখানা বুঝতে পারছি না।

মার্থা
কিছু বলো (ইতস্তত তারপর গর্বিত ভঙ্গী) মা আমি কি এখনও যথেষ্ট সুন্দরী নই?

মা
হ্যাঁ, আজকে তো আরও বেশি লাগছে। অপরাধের নিজস্ব সৌন্দর্য আছে।

মার্থা
কিসের অপরাধ, মা? সব অতীত। এখন নতুন জীবনের সকাল হয়েছে। সুখ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি যাব সেখানে।

মা
ভালো, আমার বিশ্রাম দরকার। তাও ভালো নতুন জীবনের সূচনা, যদি কেবল তোর জন্য, তবু। (বুড়ো লোকটি সিঁড়ি বেয়ে মার্থার দিকে নেমে এলো। পাসপোর্টটি দিয়ে বেরিয়ে গেল, একটি কথাও বলল না, মার্থা পাসপোর্ট খুলে নির্বিকারভাবে পড়ল)

মা
কী, এটা?

মার্থা
(শান্ত স্বরে) ওর পাসপোর্ট, পড়।

মা
আমার চোখ দুর্বল, ক্লান্ত।

মার্থা
পড়, এটি তোমার পরিচিত।

(মা পাসপোর্ট নিয়ে টেবিলের সামনে বসলেন, খুলে পড়া শুরু করলেন। দীর্ঘক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে)

মা
(আবেগশূন্য কণ্ঠে) তাহলে এই। জানতাম এটা হবে। জানতাম আমাদের থামতে হবে।

মার্থা
(স্ট্যান্ডের পাম্প ঘুরে ডেস্কের সামনে এসে) মা!

মা    
(আগের কণ্ঠে) মার্থা, এটা ঠিক হয়নি। বহু বছর বেঁচেছি, আমার ছেলের চাইতেও বেশি। জানতাম না ও কে তারপর মেরে ফেললাম। এখন একটা কাজই করতে পারি, ওর সাথে যোগ দেয়া, নদীর তলদেশে যেখানে শ্যাওলা আর কাঁদা ওকে ঘিরে রেখেছে।

মার্থা
মা! আমাকে একা ফেলে তুমি যেতে পারো না!

মা
তুই আমাকে সারাজীবন সাহায্য করেছিস। তোকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। এ সম্পর্কে আরো বলতে গেলে,বলতে হয় তোর জায়গায় তুই ছিলি একটা মেয়ে। ওর বেশি কিছু আমি চাইনি। কিন্তু আমাকে যেতে হবে। দুঃখের ভার বইবার বয়স আমার নেই। আমি ছিলাম ওর মা। আর যখন একজন মা সন্তানকে চিনতে ব্যর্থ হয় তখন জীবনে তার ভূমিকাও শেষ হয়ে যায়।

মার্থা
না, কখনোই না। তখনও মেয়ের জন্য তার অনেক কিছুই করার বাকি থাকে। কী বলবে তুমি? আমি বুঝতে পারছি না! তোমরা সবাই কোনো কিছু পরোয়া না করতে শিখিয়েছ অথচ তোমার মুখে এই কথা...

মা
(পূর্বের স্বরে, নির্বিকার) হ্যাঁ করেছিলাম, কিন্তু বুঝলাম, আমি ছিলাম ভুল এবং এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই চিরসত্য নয়। কিন্তু কিছু বিষয় নিশ্চিত, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা এরকম একটি নিশ্চিত, ধ্রুব বিষয়।

মার্থা
আর কিছু নয়? তবে মেয়ের প্রতি মায়ের ভালোবাসা কী?

মা    
আমি তোর মনে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না, কিন্তু দুটো আলাদা। এর শক্তি অনেক কম। কিভাবে আমি ছেলের ভালোবাসা থেকে এত দূরে ছিলাম?

মার্থা    
(উচ্চস্বরে) একে ভালোবাসা বলছ। সে ভালোবাসা গত বিশ বছরে এক মুহূর্তের জন্য ভাবায়নি!

মা
হ্যাঁ, এটা ভালোবাসা। বিশ বছর যাবৎ বয়ে চলা এই মৌনতাকে ভালোবাসা বলাই উচিত। এসবে কিছু যায় আসে না। ভালোবাসা কী না তার চেয়ে বড় কথা নিজ হাতে ওকে হত্যার পর বাঁচার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি আমি।

(উঠে দাঁড়ালেন)

মার্থা
এটা সম্ভব না, আমি বিশ্বাস করি না। তোমার আর কোনো লড়াই নেই? মেয়ের কথা এক মুহূর্ত না ভেবে বিনা দ্বিধায় কিভাবে এসব বলছ তুমি?

মা
কোনো কিছু নিয়ে ভাবনা নেই, লড়াই করারও ইচ্ছা নেই। এটা শাস্তি। মার্থা, এটা আমাদের শাস্তি। আমার মতো প্রত্যেক খুনির জীবনেই এই মুহূর্ত আসে, যখন তাদের আত্মা হয় নিঃস্ব, অনুর্বর, ভবিষ্যৎহীন। সেজন্যই খুনিকে চটজলদি শেষ করে দেয়া হয়। তাদের কাছ থেকে আর ভালো কিছু পাওয়া অসম্ভব।

মার্থা
তোমার এই সুরতো কোনোদিন শুনিনি। আমার ঘেন্না লাগছে। শাস্তি আর অপরাধের কথা শোনাতো আরো অসহ্য।

মা
যা অনুভব করছি তাই বলছি। এটা খুবই সহজ। মুক্তজীবন শেষ এবার দোজখের হবে শুরু।

মার্থা
(কাছে এসে প্রাণপনে) মা, কখনোই তুমি এসব কথা বলোনি। বছরের পর বছর আমাকে নিয়ে ঘুমন্ত অতিথিদের কাঁধে নিয়ে ফেলে দিয়েছ, কই, মুক্তি বা দোজখ কোনোটাই তো ভাবোনি! কিভাবে তোমার ছেলে সব পাল্টে দিল?

মা
এটা সত্যি, ভালোই চলছিলাম। কেবল অভ্যাসের ফলে জিন্দালাশের মতো দিন কাটিয়েছি। একটু দুঃখই এই জীবনটাকে পাল্টানোর জন্য ছিল যথেষ্ট। শেষ পর্যন্ত আমার প্রাণের ধনই এই পরিবর্তন করল।

(মার্থা বাঁধা দিতে গেল)

মা
জানি, আমি জানি মার্থা, কথাটা পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত হয়নি। অপরাধীর কাছে দুঃখ আবার কী? কিন্তু দেখ, এটা ঠিক মায়ের দুঃখ না। কান্না কোথায়? এটা পুনরায় ভালোবাসার যন্ত্রণা, যা ধরা দিল অধরার প্রান্ত পেরিয়ে। এই যন্ত্রণাও ঠিক যুক্তি দিয়ে উপলব্ধি করা যাবে না। যদি কেউ বলতে পারে তো সে আমি, কারণ সৃষ্টি আর ধ্বংস দুটোর স্বাদই আমি পেয়েছি।

(সে দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার দিকে এগুচ্ছিলো, মার্থা গিয়ে ধরে ফেলে)

মার্থা    
না মা, তুমি যেতে পারবে না। আমাকে ফেলে যেতে পারো না। ভুলে যেয়ো না, আমিই তোমার সাথে ছিলাম। সে তোমাকে ফেলে গিয়েছিল। সারাজীবন তুমি আমাকেই পেয়েছো, যেখানে সে ভেগেছে নীরবে। এই ঋণ তোমাকে শোধ করতে হবে। আমাকে নিয়েই তোমার চলতে হবে।

মা
(মৃদুস্বরে) কিছুই অস্বীকার করছি না, কিন্তু আমি ওকে খুন করেছি।

(মার্থা একটু ঘুরল, মাথা নিচু করে দাঁড়াল, মাথা দরজার দিকে ফেরানো)

মার্থা    
(দীর্ঘ নীরবতা, উত্তেজনা বাড়তে থাকে) সারাটা জীবন ও নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। এই দেশ ছেড়েছে। মুক্ত আকাশ, সমুদ্র সবই ও দেখেছে, মুক্ত মানুষের সাথে থেকেছে। আর আমি থেকেছি এখানে। একটি ছোট্ট শিশু এই মহাদেশের ক্ষুদ্র কোণে বড় হয়েছে, শ্বাস নেবার আনন্দ না জেনেই। আমাকে কেউ কখনও চুমু খায়নি, দেখেনি শরীরের সবটুকু সৌন্দর্য। এখানেও তুমি আমার কাছে দেনা। আমাকে রেখে তুমি যেতে পারো না। এখন পর্যন্ত সব বাকি। কারো মৃত্যুই তোমার অজুহাত হতে পারে না। যে পুরুষ জীবনকে উপভোগ করেছে তার কাছে মৃত্যু তুচ্ছ। তুমি দেখতে পাচ্ছো আমার ভাইকে ভুলে যাওয়া সম্ভব। খুব দরকারি কিছু হয়নি, ও জীবনের সবটাই দেখেছে এবং পরিণতি বরণ করেছে। ওর বেঁচে থাকবার কিছু বাকি ছিল না। কিন্তু আমি, আমিতো জীবনে কিছুই পাইনি। এখন আমার সুখের স্বাদ লাভের সুযোগ হয়েছে, যা ও পেয়েছে। তুমি তা কেড়ে নিতে পার না। পার কি? তুমি ওকে জয়ী করে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে চাও? ও তোমাকে নদীর ঠা-া তলদেশে নিয়ে যেতে চায়। তুমি তা হতে দিবে না।

(পরস্পরের দিকে নিঃশব্দে তাকালেন। মার্থা মুখ নিচু করল)

মার্থা
(ফিসফিস করে) আমি খুব কমই চেয়েছি মা। সারাজীবন অনেক কথাই বলতে গিয়ে মুখে আটকে যেত। আমাকে এতটুকু দাও। আমার বিশ্বাস তোমার এই দয়া আমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসবে।

(মা তার কাছে এলেন)

মা
তুই কি চিনতে পেরেছিলি?

মার্থা
(ঝট করে মাথা তুলে) না! কিভাবে চিনবো? ওর কিছুই আমার মনে নেই। ওকে চেনার কোনো উপায়ও আমার নেই। এটা ওর কপালে লেখা ছিল। তুমিইতো বলেছো, এই দুনিয়ায় সবকিছুর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য তুমি জিজ্ঞেস করতেই পারো। এটা তোমার অন্যায় নয়। কারণ, যদি আমি ওকে চিনতেও পারতাম, আমি একই কাজ করতাম, আমি নিশ্চিত।

মা
না, তুই পারতি না। সবারই নির্দিষ্ট সীমা থাকে, এমনকি খুনিরও।

মার্থা
আমি নিজেকে চিনি, তবে স¤পূর্ণ অজানা, উড়ে আসা এক ভাইয়ের কাছে কখনোই হাঁটু গেঁড়ে বসতাম না।

মা
কার কাছে বসতি?

মার্থা
(মাথা নামিয়ে) তোমার কাছে, মা, শুধুই তোমার কাছে।

(নীরবতা)

মা    
(ধীরে) অনেক দেরি হয়ে গেছে, মার্থা। আমার এখন কিছুই করার নেই। (ঘুরে মেয়ের দিকে তাকাল) তুই কাঁদছিস না, কাঁদছিস কি? না, অবশ্যই না। তুই জানিস না, কিভাবে কাঁদতে হয়। মনে আছে তোর, তোকে ধরে আমি আদর করতাম।

মার্থা
না, মা।

মা
এটাই স্বাভাবিক। অনেক আগের কথা, তারপর তো আদর-সোহাগ করতে ভুলেই গেলাম। কিন্তু ভালবাসতে ভুলিনি। (মার্থা একপাশে সরিয়ে ধীরে ধীরে এগুতে লাগল) এখন একথা বলছি, কারণ বহুবছর পর আমার হৃদয় আকূল হচ্ছে আদর-স্নেহের পাগল করা গন্ধে। কিন্তু আমি পারছি না, তাই চলেছি জীবনকে বরণ করতে।

(যাবার রাস্তা উন্মুক্ত)

মার্থা
(নিজের হাতে মুখে ঢেকে) মেয়ের দুঃখের চেয়েও বড় কিছু আছে?

মা
অবসাদ...আর বিশ্রামের আকুতি।

(মা চলে গেলেন, মার্থা বাঁধা দিল না)

দ্বিতীয় দৃশ্য

(মার্থা দৌঁড়ে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করল। তারপর পশুর মতো আর্তচিৎকার করে উঠল)

মার্থা
আমি কেনো? কিভাবে আমি জানব? আমায় দেখবে কে? ও আমার ভবিষ্যত চুরি করে মায়ের স্নেহ কেড়ে, একা করে দিয়েছে। বিনা অপরাধে কেনো এই শাস্তি? ও সবকিছু পেয়েছে আর আমি কিছুই পাইনি। ঢেউয়ের আশায় সারাজীবন কাটল, যে ঢেউ আমায় ভাসিয়ে নিবে। আর আসবে না। কোনোদিন পাবো না। অনন্তকাল এখানেই থাকতে হবে। সমুদ্র গর্জন করছে। কিন্তু আটকে দিচ্ছে পাহাড়। আমার চারপাশে অসংখ্য মানুষ, জাতি, রাজ্যের অবিচল কোলাহল, ফিসফিসানি রুদ্ধ করে দিচ্ছে সমুুদ্রের উদাত্ম আহ্বান। (নিচু গলায়) অন্যরা সুখি, সামুদ্রিক সান্ধ্য প্রবাহের মিষ্টি সুবাসিত সুখ ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে, বহুদূরে। চিকচিক করা ভেজা বালি আর গাঙচিলের চিৎকারের সাথে গোধূলীর আলোছায়ার তটভূমি তাদের স্বপ্নাবিষ্ট করে। আমার পাওনা কেউ শোধ করবে না। দুঃখ ছাড়া সেই বিপুল জলরাশির সংঘাত শুনতে পাবো না। যা ভালোবাসি তার থেকে বহুদূরে আমি, এ দূরত্ব অফুরন্ত। কী করব আমি? মাটিতে কান পাতবো? সে কি এতে দূরত্ব ঘুঁচিয়ে আমার সাথে কথা বলবে? কিভাবে তাকে ঘৃণা করবো? যা চেয়েছিল তার জন্য ঘৃণা করবো। এই আবদ্ধ জায়গাটিকেই বাড়ি বলে জেনেছি। আমার খিদে মেটাবে ওই বিস্বাদ ফল, আর তৃষ্ণার জন্য কিছু নেই। যে রক্তপান করলাম তাইতো যথেষ্ট। সব আমার মায়ের জন্য, যে ছেলের ভালোবাসার কাঙাল। আমাকে ভালো না বাসলে সে গিয়ে মরুক। চারপাশের দরজা বন্ধ হউক, এখানে আমার ক্রোধ, আমার গর্বিত অবস্থান নিয়ে বসে থাকব। প্রার্থনা করব না। মৃত্যুচিন্তা আমাকে স্বর্গ দেখায় না। স্বাধীন ও মুক্ত ভূমির চাইতে ভালো আর কী আছে। যেখানে ঢেউয়ের সাথে জলরাশির সখ্য, দেহের সাথে দেহ মগ্ন, সেখানে ঈশ্বরকে ডাকতে হয় না। আর এখানে বদ্ধ জায়গায় চোখ ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, বাধ্য হয়ে তাকাতে হয় আকাশে। কিভাবে এই দেশকে ঘৃণা করব, প্রতিনিয়ত যা ক্ষত-বিক্ষত করে চলে যতক্ষণ না মুক্তির জন্য আর্তচিৎকার করি। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসব না। দুনিয়ার সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েও মায়ের স্নেহ থেকে চ্যুত হয়েও, সকল স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলেও অপরাধের বোঝা বহন করে একাই পড়ে থাকব, এমনি করেই ছেড়ে দিব জগৎ, তবু আত্মসমর্পণ করব না কোনোমতেই। (দরজায় টোকা পড়ল)

তৃতীয় দৃশ্য

মার্থা
কে?

মারিয়া
ভ্রমণকারী।

মার্থা
ব্যবসা বন্ধ।

মারিয়া    
আমি স্বামীর কাছে এসেছি।

(প্রবেশ করল)

মার্থা
(তাকাল) কে আপনার স্বামী?

মারিয়া
গতকাল এখানে এসেছে। কথা ছিল সকালে আমার সাথে দেখা করবে।

মার্থা
ওতো বলল, ওর বউ এখানে নেই।

মারিয়া
তার কারণ ছিল। কিন্তু আমাদের দেখা করার কথা।

মার্থা
(এখনও তাকিয়ে) এটা সম্ভব না, আপনার স্বামী এখানে নেই।

মারিয়া
মানে, সে এখানে থাকেনি?

মার্থা    
উঠেছিল কিন্তু রাতেই চলে গেছে।

মারিয়া    
বিশ্বাস করি না। ওর এখানে থাকার যৌক্তিক কারণ ছিল। আপনার কথার স্বর ভালো লাগছে না। যা জানেন স্পষ্ট করে বলুন।

মার্থা
কিছুই জানি না, কেবল ও নেই এটুকু ছাড়া।

মারিয়া
আমাকে ছাড়া ও কোথায় যাবে। বুঝতে পারছি না। ওকি একেবারে চলে গেছে, না ফিরে আসবে?

মার্থা
একেবারে।

মারিয়া
দেখুন, গতকাল থেকে এই দেশে ধৈর্য ধরে আছি। সহ্যের সীমা পার করে ফেলেছি, আমি শঙ্কিত। ওকে ফিরিয়ে দিন। ও ছাড়া এক পা-ও নড়ছি না।

মার্থা
এটা আমার দেখার বিষয় না।

মারিয়া
অবশ্যই দেখার বিষয়। আর রহস্য সহ্য করব না। আমার স্বামী হয়তো রাগ করবে, তবু বলছি, গতকালের ওই লোকটি আপনার ভাই। আপনি তাকে দীর্ঘদিন দেখেননি, কিন্তু সেই আপনার হারিয়ে যাওয়া ভাই।

মার্থা
আমি জানি।

মারিয়া
(ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে) তাহলে আর কি? যদি সে আপনার ভাই হয় আর এটা আপনার বাড়ি তাহলে সে কোথায়? ওকে দেখে, ওর ফিরে আসায় আপনারা মা-মেয়ে খুশি হননি?

মার্থা
আপনার স্বামী এখানে নেই কারণ সে মারা গেছে। (মারিয়া চমকে ওঠে দাঁড়ালো, নির্বাক। মার্থার মুখে দৃৃষ্টি একচুল না সরে, মার্থার দিকে এগিয়ে হেসে ফেলল)

মারিয়া
আপনি নিশ্চয়ই মজা করছেন। জাঁ বলত ছোট বেলায় আপনি এরকম করতেন। এখন যা করতে পারেন বোন...

মার্থা
ছোঁবেন না। দূরে থাকেন। আমাদের কোনো মিল নেই। (বিরতি) আপনার স্বামী গতরাতে মারা গেছে। টিটকারী করছি না। এখানে থেকে কোনো লাভ নেই।

মারিয়া
নিশ্চয়ই, পাগল হয়েছেন, বদ্ধ পাগল। এতো সহজ নাকি! কই লাশ দেখান, তারপর বিশ্বাস করব। নইলে নয়।

মার্থা
এটা সম্ভব না, শুধু আপনি না, কেউই দেখতে পারবে না। (মারিয়া তার দিকে আবার এগুতে গেল) বলেছি আমায় ছোঁবার চেষ্টা করবেন না, যেখানে আছেন থাকেন... সে এখন নদীর তলদেশে আছে। ওকে আমরা ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলাম। তারপর বয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়ে এসেছি, মা এবং আমি উভয়ে মিলে। আমরা ওকে খুন করেছি, ও এখন মৃত। তবে ও যন্ত্রণা ভোগ করেনি।

মারিয়া
(এক পা পিছিয়ে) না, না...আমিই বোধ হয় পাগল হয়ে গেছি। কেউ এভাবে বলেনি। কেউ কোনোদিনও এভাবে বলেনি। আর কেউ কোনোদিন, কোনোদিন এরকম কথা শোনেও নি। জানতাম এখানে আমার জন্য ভালো কিছু নেই, তাই বলে এই পাগলা বাড়ির পাগলদের কাণ্ডে জড়িয়ে চরম মূল্য দিতে হবে, একথা ভাবিনি। আমি বুঝতে পারছি না। এমন ঘটনা আমার বোধের বাইরে।

মার্থা
যা ঘটেছে আমি তাই বলতে পারি। বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। সেখানে প্রমাণ রয়েছে, যথাসময়ে তা দেখবেন।

মারিয়া
(হতাশার শেষপ্রান্তে) কিন্তু কেনো, কেনো এ কাজ করলেন আপনারা?

মার্থা
কোন অধিকারে এ প্রশ্ন করছেন?

মারিয়া
কোন অধিকারে? আর কিছু না হলেও অন্তত প্রেমের অধিকারে।

মার্থা
মানে?

মারিয়া
মানে, কিছু একটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে আর কিছু পাগলামী, খুনির গলা চেপে ধরার জন্য আমার হাত দু’টোয় কিলবিল করছে। কেবল ছোট্ট একটি  ব্যাপার, আপনার কথা বিশ্বাস করতে আমার একগুঁয়ে প্রত্যাখ্যান, যা কিনা ভাবছে এক মুহূর্তে নখ দিয়ে আপনার মুখ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে। আপনি একটা পাগলী। যদি তা না হন, তবে নিশ্চয়ই জানেন ভালোবাসার মানে কী?

মার্থা
আমি কিছুই বুঝিনি। আনন্দ, প্রেম, দুঃখ। মনে হচ্ছে অন্য ভাষা। এসবের অর্থ আমার কাছে দুর্বোধ্য।

মারিয়া
(প্রচণ্ড চেষ্টা করে) দেখুন, এসব বন্ধ করুন। যদি এটা খেলা হয় তো বলি, শব্দ নিয়ে খেলে কোনো লাভ নেই। যা জানতে চাই তা বলুন। ফের অসহ্য হবার আগেই সব স্পষ্ট করে বলুন।

মার্থা
আগেই স্পষ্ট করে বলেছি। আপনার স্বামীকে গত রাতে হত্যা করেছি। ওর টাকা দেখে দাঁও মারতে চেয়েছিলাম। আগেও অনেকবার একাজ করেছি।

মারিয়া
তোমরা তাহলে খুনি। ওর মা এবং বোন দু’জনেই খুনি।

মার্থা
হ্যাঁ আমরা খুনি।

মারিয়া    
(আগের মতো প্রাণান্ত স্বর) খুন করার আগে কি জানতেন, ও আপনার ভাই?

মার্থা
যদি জানতেই চান,... আসলে ভুল করেই খুন করেছি। সাধারণ ব্যাপার। এরকম ঘটনা হয়েই যায়, আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

মারিয়া
(টেবিলের কাছে গিয়ে, দু’হাতের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে, নিস্তেজ কণ্ঠে) ঈশ্বর, আমি জানতাম, রক্তারক্তি না হয়ে শেষ হবে না। এই পাগলা সঙে এটা আমাদের পুরস্কার, এতে অংশগ্রহণের শাস্তি। আমার জানা উচিত ছিল, এখানকার আকাশটাই অশুভ। (টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মার্থার দিকে না তাকিয়ে) ও চেয়েছিলো ঘরে ফিরতে, আপনার সান্নিধ্য পেতে, আপনাদের সুখি করতে। ও উপযুক্ত কথা খুঁজছিল। কিন্তু তা পাওয়ার আগেই সে খুন হলো। (কান্না শুরু করল) আপনারা, আপনারা দু’জন অমানুষ। আপনারা কিছু বলেননি? আপনারা দেখেননি কীরকম সোনার ছেলে ছিল সে? একটি ছেলে, সে ফিরে এলো, এমন গর্বের ধন, এমন তাজা ছেলেটাকে চোখে পড়ল না। সে হতে পারত আপনাদের অহংকার আর সুখের কারণ, যেমনটি ছিল আমার। অথচ আপনারা ছিলেন ওর শত্রু। এখনও তাই আপনি। আপনি এখনও বরফের মতো শীতল। অথচ এমন ঘটনার পর রাস্তায় গিয়ে পশুর মতো আর্তচিৎকার, যন্ত্রণা পাওয়ার কথা।

মার্থা
সব না জেনেই রায় দিলেন! এতোক্ষণে মাও হয়তো ছেলের কাছে পৌঁছে গেছেন। হিমশীতল পানির মধ্যে তারা ঘুরপাঁক খাচ্ছে। ক’দিন পর দেহাবশেষ পাওয়া গেলে পাশাপাশি সমাহিত করা হবে। এটা জেনেও আমি পশুর মতো আর্তচিৎকার করবো কেনো? মনুষ্যহৃদয় সম্পর্কে আমার ধারণা ভিন্ন। বরং আপনার কান্না দেখে আমার ঘেন্না লাগছে।

মারিয়া
(প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে ঘুরে মুখোমুখি হয়ে) সমস্ত আনন্দ চিরতরে হারাবার কান্না যা আপনি ধ্বংস করেছেন। কান্না দেখে আপনার খুশি হওয়া উচিত। কারণ এটা যখন থামবে, কোনোকিছু চিন্তা না করেই আপনাকে খুন করে ফেলতে পারি।

মার্থা
হয়তো পারেন। এ নিয়ে ভাবছি না। আমার সিদ্ধান্ত তৈরি। এতোকিছু দেখে আর শুনে ঠিক করেছি আমিও মরব।  তবে ওদের থেকে দূরে গিয়ে। ওদের গাঢ়, নিরানন্দ আকাঙ্ক্ষায় আমার কোনো জায়গা হবে না। দেখছেন না, নতুন গজানো মমতা কেমন অবিশ্বস্ত হলো। ভাগ্যিস আমার ঘরটা আছে। আমার সুখের শেষ স্বাদ। সেখানে মরব, নিজের মতো করে।

মারিয়া
আমাকে বলছেন কেনো? আমার কি? মরতে ইচ্ছা হলে মরবেন গিয়ে, দুনিয়াশুদ্ধ মরেন! আমার ভালোবাসার মানুষ আমাকে রেখে হারিয়ে গেছে। যা হারিয়েছি সেই স্মৃতির মুখোমুখি হওয়া নির্মম।

(মার্থা পেছনে এসে দাঁড়ালো, কাঁধের পাশে মুখ রেখে বলল)

মার্থা
অহেতুক আর কী বলবেন। আপনি হারিয়েছেন স্বামী, আর আমি মা। দু’জনেই শোকাতুর। কিন্তু ও একেবারেই চলে গেছে। ওর সাথে কাটানো মুহূর্ত চিন্তা করুন, ও আপনাকে কখনই ত্যাগ করেনি। কিন্তু আমার মা প্রথমে আমাকে ত্যাগ করেছে, তারপর মরেছে। আমার ক্ষেত্রে হয়েছে দু’বার।

মারিয়া
জাঁ, ওর সুখগুলো আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চেয়েছিল। এই ঘরে বসে তাই ভাবছিল, যখন আপনি নিচে বসে ওর মৃত্যুর কথা ভাবছিলেন।

মার্থা
(হঠাৎ বেপরোয়া) আমিও আপনার স্বামীর সাথে ছিলাম। ওর নিরাশার কথা শুনেছি। তার মতোই ভাবতাম আমারও একটা ঘর আছে। বিশ্বাস করতাম সেই অপরাধই এর ভিত্তি, যে অপরাধ আমি আর মা একসাথে করেছি। ভাবতাম এই বন্ধন কোনোদিন টুঁটবে না। মা-ই ছিল একমাত্র সঙ্গী। সে নিজেকে হত্যা করল, আমিও করব। অপরাধ এক ধরনের নিঃসঙ্গতা, এমনকি হাজার জনে মিলে করলেও। এখন দেখছি একাই বেঁচেছি, একাই খুন করেছি, এখন একাই মরব।

(মারিয়া তার দিকে ঘুরল। এখনও কাঁদছে)

মার্থা
(একপা পিছিয়ে, কঠোর গলায়) আবারও বলছি আমাকে স্পর্শ করবেন না। সমস্ত তীব্রতা রক্তে বান ডেকে মস্তিষ্কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যখন ভাবি কোনো মানুষের উত্তাপ, মৃত্যুর আগে আমাকে স্পর্শ করবে। মানুষের দয়ামায়া আমাকে আঁকড়ে ধরবে, এটা আমি ভাবতেই পারি না।

(মুখোমুখি এবং কাছাকাছি)

মারিয়া
ভয় পাবেন না, আপনার ইচ্ছা হলে মরবেন। আমার কিছু যায় আসে না। আপনি আর আপনার মা আমার কাছে ছায়ার চাইতে বেশি হবেন না। আপনাদের ঘেন্নাও করব না। কাউকে পছন্দ কিংবা হেয় কিছুই করার ইচ্ছা আর আমার নেই। (দুই হাতে মুখ ঢেকে) সত্যি কথা হল, ব্যথা সহ্য বা মোকাবেলা কোনোটি করবারই সময় আমার নেই। দুর্ভাগ্যের বিভীষিকা আমাকে পিষ্ট করে দিয়েছে।

মার্থা
এতো কিছুর পরও কিন্তু আপনার কান্না করার শক্তি আছে। সুতরাং এখনও আপনার অনেক কিছুই করার আছে। আমার কাজ শেষ হয়নি। মরার আগে আপনাকে সর্বনাশা আশা থেকে মুক্ত করতে চাই।

মারিয়া
(ভীত চোখে তাকিয়ে) না না তার দরকার নেই, দয়া করে আমাকে একা রেখেই চলে যান।

মার্থা
ভয় পাবেন না, এখনই চলে যাব। আপনার প্রেম আর নাকি কান্না আমার অসহ্য লাগছে। কিন্তু আপনি ঠিক আর আমি ভুল এই ধারণা নিয়েই আমি চলে যাচ্ছি না, কারণ প্রেম শাশ্বত আর এই পরিণতি একটা দুর্ঘটনা, এটাও আমি মানতে রাজি নই। সাধারণত যেভাবে ঘটনা ঘটে এটা তারই সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ এবং আপনাকে এটাই মানতে হবে।

মারিয়া
কী মানতে হবে?

মার্থা    
বাস্তবতা, এমন এক নিশ্চিত ব্যবস্থা যেখানে কেউ কাউকে চেনে না।

মারিয়া
(উন্মত্ত) তো কী হলো? এতে কী হল? আমার কিছু আসে-যায় না। হৃদয় ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়েছে। আর কী চান? আর কী আশা করেন আপনি? এখানকার কোনো কিছুর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, শুনলেন, বিন্দুমাত্র নেই। যাকে ভালোবাসতাম তাকে আপনারা খুন করেছেন।

মার্থা
(দৃঢ়তা নিয়ে) ওর কথা যথেষ্ট হয়েছে, আমি আর শুনতে চাই না। ওকে আমি ঘেন্না করি। এখন আপনার জীবনেও ওর কোনো গুরুত্ব নেই। সে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং দরজা চিরতরে বন্ধ। সে বাড়িতে এসেছিল, ভালো কিছুর অপেক্ষায়। বোকা! সে যা খুঁজছিল তাই পেয়েছে। বাস্তবতা সবাইকে শক্ত করে চেপে ধরেছিল। আপনার বোঝার সময় হয়েছে, এটা সবার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা কেউই জীবনে কিংবা মরণে কোথাও শান্তি খুঁজে পাব না। স্বদেশ বলে কিছু নেই। (উপেক্ষার হাসি) চারপাশে তাকান! এটা কারও নিজের দেশ হতে পারে? এই গাঢ় অন্ধকার, আমাদের গিলে কর্দমাক্ত ভূমির সাথে মিশিয়ে দিতে চায় অন্ধ কৃমি খাবার হবার জন্য।

মারিয়া
(কান্নারত) ঈশ্বরের শপথ! আপনি এভাবে কথা বলছেন কেনো? আমি সহ্য করতে পারছি না। ও থাকলেও পারত না। যে দেশের খোঁজে ও এলো, ওর স্বদেশ... এরকম হতেই পারে না।

মার্থা
(দরজা পর্যন্ত গিয়ে এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়ালো) সে ছিল একটা বোকা এবং তার যোগ্য পুরস্কার পেয়েছে। আপনিও পাবেন। (একইভাবে হেসে) আমরা সবাই বোকা। আমরা আত্মার আহ্বান শুনে সাড়া দেই, প্রেম কিংবা সমুদ্রের জন্য, কিন্তু কেনো? আমাদের জন্য এটা কি ভালো ফল বয়ে আনে? এসবই উদ্ভট, ভীষণ হাস্যকর। আপনার স্বামী তা জানে। সে তার উত্তর পেয়েছে। আমাদের সবার জন্য শেষ পর্যন্ত রয়েছে একটি ঘর, তা বলা যাবে না। কিন্তু প্রত্যেকের সমাপ্তি যেখানে, একসাথে মিলিত হবে। (ঘৃণার স্বরে) একই উত্তর আপনার জন্যও অপেক্ষা করছে এবং সেদিন যদি আপনার শক্তি থাকে আপনিও এই দিনটির কথা মনে করবেন, যখন আপনি ভেবেছিলেন চরম বঞ্চনার কথা, যাকে আমরা বলি একাকীত্ব। দেখতে পাচ্ছেন না? আমাদের সবার উপর অবিচারের আছর পড়েছে, যার পাশে আপনার দুঃখ কিছুই না। আমার কথা শুনুন, আপনাকে কিছু পরামর্শ দিচ্ছি। গ্রহণ করুন, আপনার স্বামীর পরিবর্তে আমি বলতেই পারি, যেহেতু তাকে আমি হত্যা করেছি। আপনার একজন ঈশ্বর আছে তার কাছে প্রার্থনা করুন যেন সে আপনাকে পাথর বানিয়ে দেয়, এতেই সত্যিকার সুখ। সে তা জানে, তাইতো সে নিজেও ওরকম। দ্রুত নিজেকে গড়ে তুলুন বয়রা হয়ে, পাথর হয়ে, আর যদি তা বেশি কঠিন হয়ে যায়, তবে চলুন আমাদের সাথে, আমাদের একই বাড়িতে, জানেন আপনি। বিদায় বোন। আপনার ঈশ্বরের কাছে আপনাকে রেখে গেলাম। এটা খুবই সহজ। আপনারতো বেছে নেবার উপায় আছে। সৈকতের নুড়ির মতো অনাবিল আনন্দে বেঁচে থাকা কিংবা আমাদের স্যাঁতস্যাঁতে, আঠাল বিছানাকে আলিঙ্গন করা, যা সবাইকে আমন্ত্রণ জানায়। আমরা সেখানে থাকব এবং আপনার জন্য অপেক্ষা করব।

(সে বেরিয়ে গেল, মারিয়া ভীত হয়ে তার কথা শুনছিল, এদিক ওদিক দুলে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল)

মারিয়া
(চিৎকার দিয়ে কেঁদে) হে ঈশ্বর! আমি এই মরুভূমিতে বাঁচতে পারব না। আমার ত্রাণকর্তা আমার প্রার্থনা শোনো। (হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে) আমি নিজেকে সমর্পণ করছি। তোমার করুণা বর্ষণ করো। আমার দিকে হাত বাড়াও। আমাদের রক্ষা করো। যারা একে অপরকে ভালোবাসে আর যারা বিচ্ছিন্ন তাদের রক্ষা করো।

(দরজা খুলে বৃদ্ধ প্রবেশ করল)

চতুর্থ দৃশ্য

বৃদ্ধ
(দৃপ্ত এবং স্পষ্ট গলায়) আমায় ডেকেছেন?

মারিয়া
(ঘুরে তাকায়) না, বোধ হয়, আমি জানি না। কিন্তু আমাকে সাহায্য করুন। দয়া করে করুণা করুন। আপনার সাহায্য আমার ভীষণ দরকার।

বৃদ্ধ
(পূর্বের স্বরে) না।

তানভীর নাহিদ খান: ফ্রিল্যান্স নাট্যকর্মী