Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

২০১৫ সালের বহরমপুরের নাট্য-আঙ্গিনা

Written by বিদ্যুৎ মৈত্র.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

২০১৩ সালের জুন মাস নাগাদ সংস্কারের জন্য প্রশাসনের নির্দেশে বন্ধ হয় বহরমপুরের রবীন্দ্রসদন। ফলে মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহরের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের কাছে নাট্যসহ সংস্কৃতিচর্চা এক প্রকার ব্যহত হয়। শহরের এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে দৌঁড়ে দৌঁড়ে কোথাও মঞ্চ বেঁধে, কোথাও মুক্তমঞ্চে, যে যার মতো করে নাট্য প্রদর্শন করেছেন। এই আঘাত সেই সময় নাটকের দলগুলোর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। কারণ কাজের শুরু-শেষ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না।

ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের এই জেলা অন্যদিক দিয়ে কিছুটা পশ্চাৎপদ হলেও নাট্যচর্চায় এর একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে যা আজও বহমান। সেদিক থেকে প্রায় দীর্ঘ দু’বছর রবীন্দ্রসদন বন্ধ থাকা (যদিও এর সংস্কার প্রয়োজন ছিল) এবং বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় ২০১৫ সালে নাট্যমঞ্চায়নের প্রাণকেন্দ্রে নাটকের খরা দেখা দেয়। এমনিতেই নাট্যসংস্থায় প্রয়োজন লোকবল। সেই লোকের যোগান অপেশাদার ক্ষেত্রে একেবারেই কম। তবুও যারা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে’ পছন্দ করেন তারাই এই উঠোনে ভিড় জমান। কিন্তু সেই ভিড়ও ফিকে হয়ে যায় যদি না সেখানে মনের খোরাক থাকে। এক বছরেরও বেশি সময় রবীন্দ্রসদন বন্ধ থাকায় শহরের প্রতিষ্ঠিত দলগুলো কখনো মহড়াকক্ষে আলোচনা সভা করে, কখনো বা দূরে কোথাও পাড়ি দিয়েছেন নাটক মঞ্চস্থ করতে। অনেকে আবার পুরোপুরি বন্ধ রেখেছিলেন নাট্যচর্চা। ছোট ছোট দলগুলো তাদের কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল। তবে সকল নাট্যপ্রিয় মানুষজন কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাদের মনের খিদে চেপে রেখে অপেক্ষা করছিলেন নতুন রূপের রবীন্দ্রসদন দ্বারোদ্ঘাটনের। সেটা বোঝা গেলো ২০১৫ সালের মে মাস নাগাদ।

২০০১ সাল থেকে বহরমপুরের ‘ঋত্বিক’ প্রতি ডিসেম্বর মাসেই আয়োজন করে ‘দেশ-বিদেশের নাট্যমেলা’। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে ঐ দর্শকপ্রিয় নাট্যমেলা অন্যত্র মঞ্চ বেঁধে করবার পরিকল্পনা নিয়েও শেষ পর্যন্ত বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে ঐ ভগ্নপ্রায় প্রেক্ষাগৃহে নাট্যমেলা করতে পেরেছিল, যা কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল বহরমপুরের নাট্যমোদি দর্শককে। তবে প্রেক্ষাগৃহের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়ার কারণে দর্শকাসন ছিল পুরোনই আর তারই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় নাট্যমেলা। অন্য একটি দল ‘রঙ্গাশ্রম’ও একইভাবে নাট্যমেলা করেছিল।

২০১৫ সালের বহরমপুরের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষজন প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিষ্ঠিত নাট্যদলের নাটক দেখবার সুযোগ পান আবার নবরূপে সজ্জিত নাট্যমঞ্চে। তবে এই প্রসঙ্গে একটি কথা জানিয়ে রাখা ভালো, সব নাট্যদলই যে মঞ্চনাট্য চর্চা করে থাকে তা কিন্তু নয়। বহরমপুরের ‘যুগাগ্নি’ কিংবা ‘ব্রীহি’র মতো নাট্যদলগুলো মূলত পথনাটক বা মুক্তাঙ্গন নাটকের জন্যই গড়ে উঠেছিল। তবে ‘যুগাগ্নি’ শুরু থেকেই মঞ্চনাটক ও পথনাটক উভয়ই মঞ্চস্থ করে আসছিল। বহরমপুর তথা পশ্চিমবঙ্গে এই দলটি ‘হত্যারে’, ‘মা-অভয়া’, ‘খোদার মর্জি মজদুর সাথী’-র মতো নাটক মঞ্চস্থ করে আলোড়ন ফেললেও ইদানিংকালে সেই কাজ আর দেখা যায় না। যদিও ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা মঞ্চস্থ করে নতুন নাটক ‘বিধাতা পুরুষ’। এর বাইরেও ‘যুগাগ্নি’র একটি অন্যতম আয়োজন হলো ‘লোকনাট্য নগরনাট্যের মিলনমেলা’।

অন্যদিকে বাদল সরকারের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ‘ব্রীহি’ মুক্তাঙ্গন নাটকেই অভ্যস্থ। তবে এই সংস্থাটি নাটক ছাড়াও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে বলে নিজেদেরকে সাংস্কৃতিক সংস্থা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ‘আমার ভারতবর্ষ’ নাটকটি ২০১৫ সালে একাধিক প্রদর্শনী করেন তারা। অমর মিত্র’র গল্প অবলম্বনে তৈরি এই নাটক দর্শকের কাছে পুরনো ভারতবর্ষের একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করে দলের নাট্যকর্মীরা। ১৪ বছরের এই সংস্থাটি গত ১০ বছর ধরে শহরের একপ্রান্তে  মুক্তাঙ্গন নাট্যোৎসবের আয়োজন করে। এবং সমমনস্ক নাট্যদলগুলোকে (অবশ্যই রাজ্যের ভিতর) নিয়ে নাটক প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে একেবারে খোলা মাঠে। তবে বিনোদনের জন্যই কেবল নাটক দেখা বলে যারা মনে করেন, তারা এই ধরনের নাটক বা পথনাটক দেখে মুখ ঘোরাতেই পারেন। তাই বলে নাটক যে কেবল বিনোদনের জন্য নয়, সমাজের দর্পণও যারা ভাবেন তারা এই ধরনের উৎসবে অংশগ্রহণ করেন ও নাটক উপভোগ করেন।

এটা ঠিক যে বহরমপুরের বেশি সংখ্যক মানুষকে নাট্যমুখি করবার জন্য ‘ঋত্বিক’-এর নাট্য-বিষয়ক কাজকর্ম অগ্রগণ্য। এই সংস্থাটি শহরের মানুষকে সুযোগ করে দিয়েছে দেশ-বিদেশের নাটক দেখবার। বাংলাদেশের নাটক প্রায় প্রতি বছরই তাদের নাট্যমেলায় মঞ্চস্থ হয়। আর শহরের মানুষও যেনো ঐ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। তাই বলে কি অন্যদিনগুলোয় ভিড় হয় না? অবশ্যই হয়। কিন্তু ভাষা বোঝার একটা ব্যাপার থাকায় অনেক নাটকের বেলায় কমিউনিকেশনে অসুবিধা হয়। তাই বাংলাদেশের নাটক দেখবার একটা স্বাভাবিক চাহিদা থাকে। শুধু তাই নয় অনেক সময় বা বলা ভালো বেশিরভাগ সময় তাদের নাটকের গুণগত মান বেশ ভালো হয়।

‘ঋত্বিক’ ২০১৫ সালে দুটি নাটক মঞ্চে এনছে। তার মধ্যে ‘আঁধারে সূর্য’ প্রথম মঞ্চস্থ হয় নাট্যমেলায়। কিন্তু মোহিত চট্টপাধ্যায়ের ‘জুতো’ নাটকটি নদিয়া জেলার করিমপুরে প্রথম মঞ্চস্থ হলেও বহরমপুরে এখন পর্যন্ত কোনো প্রদর্শনী হয়নি। ‘ঋত্বিক’-এ বেশ কিছু উঁচু মানের কলাকুশলী আছেন। যারা নিয়মিত নাট্যচর্চা করে তাদের গুণগত মান বাড়িয়েই চলেছেন প্রতিনিয়ত। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় অমন জোরালো নাটক, যা কিনা মানুষের চিন্তায় খোরাক জোগাবে, তেমন নাটক দেখতে পাচ্ছি কই? গৌতম রায়চৌধুরী-উত্তর পর্বে এটা পিছনের দিকে এগুবার পদক্ষেপ হয়তো নয়। তবে আকাক্সক্ষা তো আমাদের থাকবেই কতটা এগিয়ে যাচ্ছে তারা। অবশ্য জেলার নাটকের কট্টরপন্থীরা এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেন যে বহরমপুর তথা জেলাবাসিকে সারাবছর জুড়ে নাটকের সাথে আটকে রাখতে সক্ষম একমাত্র ‘ঋত্বিক’ই। সে সেমিনারের মাধ্যমেই হোক কিংবা নতুনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মশালাভিত্তিক নাটক মঞ্চস্থ করেই হোক। কিংবা প্রতি মাসে নিয়মিত নাট্য-মঞ্চায়নের মধ্য দিয়েই হোক। তাদের নাট্যমেলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সাহায্য হয়তো পৃষ্ঠপোষকের কাজ করে।

কেন্দ্রীয় সাহায্য পান এই ধরনের আরও একটি নাট্যসংস্থা ‘রঙ্গাশ্রম’, বয়সে ‘ঋত্বিক’-এর চেয়ে অনেকটাই ছোট। প্রথমজন ৩৬ আর দ্বিতীয়জন ২১। ২০০৬ সাল থেকে ‘রঙ্গাশ্রম’ নিয়মিত নাট্যোৎসবের আয়োজন করে চলেছে। যার ফলে বহরমপুরের মানুষ তাদের দৌলতেও ভালো নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তাছাড়া ‘রঙ্গাশ্রম’এর প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ ভট্টাচর্য্যরে প্রতি জেলার মানুষ নাটকের ক্ষেত্রে কোথায় যেনো একটু ভরসাও করেন। এন.এস.ডি ফেরৎ একজন নির্দেশকের কাছে সে আশা করা মোটেও বাড়াবাড়ি নয়। ‘রঙ্গাশ্রম’-এর আগে যখন ‘থিয়েটার বহরমপুর’-এ উনি নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন, সেই সময় তাঁর নির্দেশিত নাটক ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘মোবারক’, ‘শেকড়ের সন্ধানে’ দর্শকের মনে যে আশার আলো জ্বালিয়েছিল তা এখনো দীপ্যমান। কিন্তু মুশকিল বাঁধলো অন্যত্র। ভাঙাভাঙির খেলা থেকে বাদ পড়লো না থিয়েটারও। অবশেষে নানান প্রতিকূলতা পেরিয়ে নাট্যকর্মীদের বালির বাধ আগলে সন্দীপ ভট্টাচার্য্য দেয়াল তুললেন ‘রঙ্গাশ্রম’-এর মহড়া কক্ষের। পিছিয়ে পড়েও আবার উদ্যম ফিরে পেল বহরমপুরের থিয়েটার। মঞ্চস্থ হলো ‘সন্তাপ’, ‘মনিদীপা’, ‘প্রতারক’-এর মতো মঞ্চসফল দর্শকধন্য নাটক। কখনো দিল্লিতে, কখনো কলকাতায় মঞ্চস্থ হলো নাটকগুলো। ২০১৫ সালে নতুনভাবে করলেন ‘এক কুমারী মেয়ের কাহিনী’ অবলম্বনে ‘মনিদীপা’। বহরমপুরসহ রাজ্যের বিভিন্ন মঞ্চে ২০১৫ সাল জুড়ে মঞ্চস্থ হয় এ নাটক। তবুও ‘রঙ্গাশ্রম’ সংগঠন হিসেবে বড্ড নড়বড়ে। কবেই-বা কোন নাট্যসংস্থা খুব ভালো সংগঠনের নজির রেখেছে দু’একটি ছাড়া!

‘ঋত্বিক’ আর ‘রঙ্গাশ্রম’ ভারত সরকার প্রদত্ত অনুদান দিয়ে যে বিপুলায়তন মেলা অথবা প্রযোজনা করছে, তা ঐ অনুদান ছাড়া সম্ভব হতো কিনা সে প্রশ্নও ঘোরাফেরা করে নাট্য-বোদ্ধাদের ভেতর। কিন্তু ঋত্বিক নাট্যমেলা করে আসছে ২০০১ সাল থেকে। ২০১০ সাল থেকে তারা সাহায্য পাচ্ছে। তবে কি ধরে নেয়া যায় ২০০১ থেকে ২০০৯, এই নয় বছর তাদের নাট্যমেলা ছিল গুণগত মানে উৎকর্ষহীন? তা কখনোই নয়। ‘রঙ্গাশ্রম’-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

২০১৫ সালে আরও একটি বয়োজ্যেষ্ঠ নাট্যদল ‘প্রান্তিক’, প্রিয়াংকু শেখর দাসের সৌজন্যে বহুবছর পর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বলেই মনে হয়। একই বছর তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করে তারা। ‘জীবন সাথী’, ‘বালুকা বেলায়’, ‘সরল অঙ্ক’ এবং ‘ÔMy name is গওরজান’। প্রথমটি মোহিত চট্টপাধ্যায়ের, বাকি দুটি সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক। কিন্তু তিনটি নাটকেরই নির্দেশনা প্রিয়াংকু শেখর দাসের। নাটক নির্মাণে বা নির্দেশনায় কিংবা অভিনয়ে আরও শৈল্পীক সূক্ষ্মতার প্রয়োজন থাকলেও বারবার ‘নানাহে’-র গন্ধ শোঁকার হাত এবার বদলাবে মনে হয়। অনেক আনকোরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে ২০১৫-র একেবারে শেষে এসে নিজেদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যে নতুন করে শুরু হলো ৪৮ বছরের ‘প্রান্তিক’-এর ‘হাজার দুয়ারী উৎসব’। এ-ও এক বড় প্রাপ্তি ২০১৫ সালে। অন্যদিকে প্রায় ‘প্রান্তিক’-এর সমবয়সী ‘ছান্দিক’-ও বহুদিন পর নতুন নাটক নির্মাণ করলো ২০১৫ সালে। ‘চালচিত্র’। কিশলয় সেনগুপ্ত নেই, আছেন তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিক শক্তিনাথ ভট্টাচার্য্য। কিন্তু কই নতুন মুখ? এখানে ‘ছান্দিক’-এর কথা প্রসঙ্গে একটা কথা মনে আসছে। তা হলো জনসংযোগ। বহরমপুরের অনেক সংস্কৃতি সংস্থাকে দেখেছি একমাত্র পিঠ চুলকানির মানুষগুলোর পরিধির বাইরে কিছুতেই পরিধিটাকে বাড়ায় না। তার ফলে ক্ষতি হয় শিল্পের, সেই মাধ্যমের। প্রকাশ পায় অসহিষ্ণুতা। পাছে লোকে দোষ-ত্রুটি ধরে ফেলে। তবে ‘ছান্দিক’ এই দোষে দুষ্ট কিনা আমার তা জানা নেই।

২০১৫-এর বহরমপুরের নাটকের কথা লিখতে গিয়ে প্রত্যেক দলেই কিছু না কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে। মনে হয় ওগুলো তাদের স্বভাবও। বেশ কয়েকটি দলের কথা বলে ফেললাম। বহরমপুর নাটকের শহর। বহরমপুর দিব্যেশ লাহিড়ীর শহর। তবে নাটকের মক্কা না মদিনা তা বলতে পারবো না। পশ্চিমবঙ্গের যে কয়েকটি জেলার নাটক, পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে দর্শক সমাদর পেয়েছে তার মধ্যে বহরমপুর অন্যতম। এ জেলার নাট্যদলগুলোর মধ্যে মতানৈক্যের পাশাপাশি মনান্তরও ঘটেছে প্রতিনিয়ত। তবে সেই সঙ্গে প্রতিভার বিকাশও ঘটেছে অনবরত। নাটককারের সংখ্যা কম এই শহরে। জীবন সংগ্রাম থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়া কৌশিক রায়চৌধুরীর অকাল প্রয়াণ মনটাকে বড় বিষণ্ন করে রাখে। তার সম্বন্ধে জানি খুবই সামান্য। তবুও মনে হয় বেঁচে থাকলে আমরা আরও কিছু হয়তো দেখতাম এবং শিখতাম। আমাদের কথা ভাবে কে!

চলুন দেখি ‘উজান’ কী করলো ২০১৫ সালে। প্রায় সাতবছর পর গত সালে তারা মঞ্চস্থ করলো ‘পথ’ নাটকটি। শেষ মঞ্চসফল নাটক ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায়’। নয় বছর পর তারা নাট্যোৎসবের আয়োজন করলো সম্পূর্ণ নিজের খরচায়। তবে ‘উজান’-এর নির্দেশক-অভিনেতা গৌতম মজুমদারের ‘পথ’ প্রযোজনায় বহুদিন পর মঞ্চে এলেন ‘যুগাগ্নি’র প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ সরকার। কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে নাটক থেকে হঠাৎ সরে যাওয়ার নিরবতা ভাঙলেন স্ব-মহিমায়। ‘ÔMy name is গওহরজান’-এ-ও পরে তিনি অভিনয় করেন। আগামী দিনে তাঁর নির্দেশিত ও অভিনীত নাটক দেখবার প্রতীক্ষায় শহরবাসি। এছাড়াও অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে বহরমপুর রেপার্টরি থিয়েটারের প্রদীপ ভট্টাচার্য্য সিরিয়াল সিনেমার পাশাপাশি ২০১৫ সালে শহর বিদ্যালয়গুলোতে কর্মশালাভিত্তিক নাটক ও নতুনভাবে করলেন ‘সক্রেটিসের বিচার’। নতুন সংস্থা ‘গাঙচিল’ও শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের নিয়ে নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছে গত বছর। ‘ঋত্বিক’-এর বিপ্লব দে-ও বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নাটক তৈরি ও মঞ্চস্থ করেছেন। এছাড়া সুহৃদ, নবীন নাট্যসংস্থাগুলো কোনো নতুন নাটক নির্মাণ করেছেন বলে মনে পড়ে না। তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সবার মনে আলোড়ন তৈরি করেছিল যে তরুণ নাট্যদল ‘রণ’ তা আজ সকলের অগোচরে বিরাজমান। হয়ত-বা কৌশিক করের অনুপস্থিতিই তার জন্য দায়ী। বহরমপুর ছেড়ে নিজের প্রতিভার জোরেই কৌশিক আজ দাপিয়ে অভিনয় করছে, নির্দেশনা দিচ্ছে নাটক লিখছে, তাবড় তাবড় মঞ্চশিল্পীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজ্য তথা দিল্লি বম্বে সর্বত্র। সঙ্গে পলাশও। যার ফল ভোগ করতে হলো বহরমপুরকে। যথাযথ উত্তরসূরীর অভাবে থমকে গেল ‘রণ’। হয়তো আবার দেখা যাবে তাদের নাটকের প্রাঙ্গণে কোনো দায়িত্ববানের হাত ধরে।

যাই হোক লেখার অন্তিম পর্বে এসে বহরমপুরের নাট্যদল তথা নির্দেশকদের কাছে শহরের নাটকপ্রেমী মানুষজনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবদারের কথা বলে শেষ করবো। ‘ঋত্বিক’ যেমন তার ৩৫ বছরের ইতিহাস-সহ নাট্যকার ও পরিচালক গৌতম রায়চৌধুরীর লেখা নাট্যরূপ দেয়া নাটকগুলোর সংরক্ষণ শুরু করেছেন, তেমনভাবেই সংরক্ষিত হোক প্রত্যেক নাট্যদলের নিজস্ব অথবা জোটবদ্ধ সংরক্ষণ। খুবই প্রয়োজন দিব্যেশ লাহিড়ীর নাট্য সংকলন তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে ‘প্রান্তিক’-কেই উদ্যোগী হতে হবে। প্রয়োজন লাইব্রেরির। প্রয়োজন শহরের নামজাদা নাট্যপরিচালকমণ্ডলীর জোট বেঁধে কাজ করা। মতানৈক্য থাকতে পারে তবে মনান্তর শিল্পেরই ক্ষতি। তৈরি করতে হবে সমস্ত শৈল্পীক দক্ষতা ও সূক্ষ্মতা বজায় রেখে নাটকের মধ্যদিয়ে যুগযন্ত্রণার কথা বলতে পারার নাটক। ইদানিং নাটকের গান খুব একটা শোনা যায় না। চাই নাটকের গানের সংকলন। আর চাই একটি নাট্যপত্র। কারণ ‘... বাল্যে বা কৈশোরে যদি ভালো বই পড়ি, বা ভালো অভিনয় দেখি, বা ভালো গান শুনি, তখন শুধু যে একটা গভীর উপলব্ধি হয় শুধু যে সারা মনটা ভরে গিয়ে যেনো টলটল করে তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক কত কিছুর পরিবর্তনও যেনো ঘটে। মনে হয় মাথাটা যেনো আরো একটু উঁচু হয়ে গেছে, দাঁড়ানোটা তেঁতুল চারার মতো আরো সোজা হয়ে গেছে, আরো যেনো বুক পুরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি আমি। আর শরীরের মধ্যে একটা তীব্র, প্রখর, অনুভব যেনো বিদ্যুতের মতো তখন আপাদমস্তক ছুটে বেড়াচ্ছে। শিল্পকলা বোধকরি এই টুকুই করতে পারে। এই ‘প্রচণ্ড’টুক্ইু...।’ (ভূমিকা : রক্তকরবী, সংক্ষেপিত, শম্ভু মিত্র জানুয়ারি, ১৯৯২)

বিদ্যুৎ মৈত্র- সাংবাদিক ও শিক্ষক। বহরমপুর, ভারত