Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

রেখ মা দাসেরে মনে

Written by আব্দুল্লাহেল মাহমুদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

ভূমিকা
মানুষ কেনা-বেচা নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মানুষের মুখ’ নামে একটা নাটক লিখেছিলাম ১৯৯০ সালে। নাটকটি বেশ দর্শকনন্দিত ও আলোচিত হয়েছিল। তখন থেকেই মানুষ কেনা-বেচা নিয়ে একটা মঞ্চনাটক লেখার ভাবনা মাথায় কাজ করছিল। ২০০৭ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গসন্তানের হৃদয়স্পর্শী কাহিনী একটি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হলে সেই ভাবনা আরো গভীরতা পায়। পরবর্তীকালে নাট্যকার গোলাম শফিকের লেখা ‘ভূমধ্যসাগর’ নাটকটি আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। তার কিছুদিন পর নাটকটি লিখতে শুরু করি। মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে নাটকটি লেখা শেষ করি। গোলাম শফিককে ধন্যবাদ। নাটকটি এখনো মঞ্চে আসেনি। মঞ্চে এলে হয়তো কিছু পরিবর্তন হতে পারে।- নাট্যকার

কুশীলব
১. হাবিব ২. এন্ড্রু ৩. ফিলিপস ৪. উইলিয়াম ৫. কাপ্তেন ৬. জিতু সরকার ৭. মকবুল ৮. রশীদ ৯. মোকসেদ ১০. খয়বর ১১. কাশেম ১২. মাসুদ ১৩. সালেহু বাপ্পা ১৪. তাগুবা ১৫. খালাসি ১ ১৬. খালাসি ২ ১৭. মঞ্জিলা ১৮. আঙ্গুরী ১৯. অজুফা ২০. আকলিমা ২১. বর্ডার গার্ড ১ ২২. বর্ডার গার্ড ২ ২৩. কানাই ২৪. সুফিয়া ২৫. রেজিনা ২৬. সাত্তার ২৭. শুভ ২৮. আবদাল হামাদি ২৯. সেলিম ৩০. ড্রাইভার ৩১. সালাম ৩২. মাকেমবা ৩৩. আবু আব্বাস ৩৪. সুশান্ত সাহা ৩৫. আবেনা ৩৬. ড্রাইভার ৩৭. সৈনিক ১ ৩৮. সৈনিক ২ ৩৯. সৈনিক ৩ ৪০. পুলিশ ৪১. দাউদী ৪২. বেকেলে ৪৩. গামিনি ৪৪. গাব্বা ৪৫. শান্তাল  ৪৬. ইদরিসা  ৪৭. জোমো ৪৮. কিমাথী ৪৯. গণিকালয়ের বাসিন্দা (নারীপুরুষ) ৫০. ট্রলারের যাত্রী (১৫-২০ জন)

দৃশ্য- এক

(মঞ্চের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ত্রিশোর্ধ্বযুবক আহসান হাবিব)

হাবিব
প্রিয় দর্শক-আমি আহসান হাবিব, ভূমধ্যসাগরের নোনা জলে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া এক বঙ্গসন্তান। আজ আমার নানা পরিচয়- দেশত্যাগী, অভিবাসী, উদ্বাস্তু, পাচার হওয়া মানুষ, হালের জনপ্রিয় নাম আদম- আজ আমি শোনাবো আমার দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার গল্প- আমার গল্পের শুরু কিংবা শেষ নেই। এ এক অন্তহীন যাত্রা। জানি না কখন শুরু হয়েছিল এ যাত্রা, কত প্রাচীন এর ইতিহাস। আমি শুরু করছি মাঝপথ থেকে- অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো এক সময়-  ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে ছুটে চলেছে দাস ব্যবসায়ী জলদস্যুদের পালতোলা ক্লিপার শিপ। জাহাজের ভিতর আঠারো ইঞ্চি উচ্চতার পাটাতনে হাত পা বেঁধে গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হয়েছে আফ্রিকার উপকূল থেকে ধরে আনা কালো মানুষের চালান।

(দাঁড় টানতে টানতে গান করছে জাহাজের দু’দল খালাসি)

প্রথম দল    
বারমুদাতে ছিলাম ভালো
ধরলেন কাপ্তেন মুর
জাহাজের নাম ফ্লাইয়িং ক্লাউড
বন্দর বাল্টিমুর।

দ্বিতীয় দল
The Flying Cloud was aYankee ship
Five hundred tons or more
She could outsail any chipper ship
Hailing out of Baltimore.

প্রথম দল
পাল্লায় পড়ে আল্লা বলে ঝুলে পড়লাম পালে
আখের দেশ ঐ আফ্রিকাতে দাস ব্যবসার জালে।

দ্বিতীয় দল
It will went until the day
We reached old African shore
And five hundred of poor slaves me boys
From their native land, we bore.

(ডেকের উপর চিৎকার করতে করতে উঠে আসে খালাসি এন্ড্রু)

এন্ড্রু
অসহ্য এরকম আর কদিন চললে পাগল হয়ে যাবো- (চিৎকার শুনে ছুটে আসে ফিলিপস) মনে হয় সাগরের নোনাজলে ঝাপ দিয়ে জীবন বাঁচাই। এবার নিউ ইংল্যান্ডে জাহাজ ভিড়লেই কেটে পড়বো।

ফিলিপস
তোর আবার কী হলো?

এন্ড্রু
কী আর হবে মিস্টার ফিলিপস- সেলারের চাবিটা কোথায় রেখেছো?

ফিলিপস
সকাল হতে না হতেই?

এন্ড্রু
ওসব উপদেশ আর নীতিবাক্য রেখে চাবিটা কোথায় সোজা বলে ফেলো। খোলের ভিতর পায়খানা প্রশ্রাব, রক্তবমি সব মিলিয়ে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে নরকও লজ্জা পাবে। এ রকম জায়গায় শয়তানের বাবারও সাধ্য নেই লির্জলা হুইস্কি ছাড়া এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে।

ফিলিপস
এ আর নতুন কী? তবে একটা কথা ঠিক আমরা যারা এসব জাহাজে খালাসির চাকরি করি তারা শয়তানের পিতা না হলেও সাক্ষাৎ বড়ভাই।

এন্ড্রু
ধ্যৎ শুধু বকবক করেই চলেছো চাবিটা দিয়ে দাও।

ফিলিপস    
আমার বিছানার নিচে।

এন্ড্রু
গড ব্লেস ইউ!

ফিলিপস
দাঁড়াও! আমার জন্য দু’পেগ নিয়ে এসো কিন্তু।

প্রথম দল    
পালে যখন ধরতো বাতাস
চলতো যেন ঘোড়া
ষোল পালের জাহাজ চলে
অন্য জাহাজ খোঁড়া।

দ্বিতীয় দল
Eachman was loaded down with chain
As we made, made them walk blow
Just eighteen inches of space
Was all that eachman had to show?

প্রথম দল    
ভরলো জাহাজ চললো ফিরে
ক্রীতদাসে ঠাসা
মরে গেলেই বাঁচতো ওরা
ভাবতো এটাই খাসা।

(এন্ড্রু ফিরে আসে।)

ফিলিপস
দু’পেগ ঢেলে আনতেই এতক্ষণ তার মানে আধা বোতল শেষ করে এসেছো।

এন্ড্রু
শোনো মাইডিয়ার ফ্রেন্ড কথাবার্তা কম কাজ বেশি, এসো শুরু করা যাক- হার হাইনেস প্রিন্সেস অব দ্যা ইয়াঙ্কি
শিপস দ্যা ফ্লাইং ক্লাউডের সুস্বাস্থ্য কামনা করে।

ফিলিপস
এবার সত্যি করে বলো দেখি কতটুকু ঢেলেছো? এভাবে ঢালতে থাকলে নিউ ইংল্যান্ড ফিরে যাওয়া পর্যন্ত চলবে?

এন্ড্রু
চলবে- আলবৎ চলবে। দাস ব্যবসার জাহাজে যেদিন থেকে চাকরি নিয়েছি সেদিন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি জাহাজে থাকা অবস্থায় বিশুদ্ধ জল স্পর্শ করবো না।

ফিলিপস
কেন? কেন করবে না?

এন্ড্রু
সহজ হিসাব Water water every where not a drop to drink. সমুদ্রে খাবার জল অতি মহার্ঘ বস্তু নেহায়েত বাধ্য না হলে খরচ করা যাবে না। তাই আমি জল পান করি না। আর করলেও হুইস্কির সাথে মিশিয়ে নেই।

ফিলিপস
তা বেশ বলেছো এই বস্তুর সত্যিকারের সমঝদার আফ্রিকার ছোট ছোট রাজাগুলো। মাত্র দু’শ বোতল হুইস্কিতে কুড়িটা তাগড়া নিগ্রোকে বেঁচে দিলো!

এন্ড্রু
হ্যাঁ কোম্পানির মালিকরা যদি দামি কাপড়, ক্যালিকো, মুল্যবান ধাতু এসব দিয়ে জাহাজ না ভরে আরো বেশি গুড় আর মদের পিপে দিয়ে জাহাজ ভরে দিতো তাহলে আমাদের কাজটা আরো সহজ হতো। কোম্পানিরও লাভ হতো অনেক বেশি।

(আসে ডাক্তার উইলিয়াম)

ফিলিপস
ঠিক বলেছো- ডাক্তার উইলিয়াম মুখটা দেখছি সাহারা মরুভূমির মতো।

উইলিয়াম
খবর ভালো না, আরো তিনটা শেষ।

ফিলিপস
তিনজন? তা ডাক্তার উইলিয়াম আপনার দায়িত্ব তো এদের রক্ষা করা? কী করেন আপনি?

এন্ড্রু
ওনার সময় কোথায়? যেটুকু সময় উনি পান তাতো ঐ কৃষ্ণবালাদের সাথে প্রণয়লীলাতেই শেষ হয়ে যায়। অসুস্থদের দেখবার সময় কোথায়?

উইলিয়াম
সবসময় বোতলের তলায় পড়ে থেকো না। আর একটা কথা বলবে তো এমন রগড় দেব না বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবে। (ফিলিপসকে) কাপ্তেন কোথায়?

এন্ড্রু
ডেকের ওপাশে। আরে দাঁড়াও খবর দিতে এত তাড়া কিসের? কাপ্তেনের কাছে খবর দিলেই বুঝি ওরা নরক থেকে সপ্রাণ উঠে এসে সালাম ঠুকে বলবে- বান্দা হাজির। যে যায় সে বেঁচে যায় জনমের মতো। Death is a necessary end, will come when it will come.

ফিলিপস
শেক্সপীয়র আওড়াচ্ছিস?

এন্ড্রু
কে বলেছে শেক্সপীয়র আওড়াচ্ছি? তুমি কি জানো অ্রামি স্বয়ং শেক্সপীয়র!

ফিলিপস
সেতো দেখতেই পাচ্ছি, আর খাসনে শেষে না আবার চ্যাংদোলা করে জাহাজের খোলে ঢুকাতে হয়।

এন্ড্রু
It provokes the desire but takes away the performance therefore much drink may be said to be an equivocator with lechery.

এন্ড্রু
একদম খাঁটি কথা! It takes you, it sets you on and it takes you off.

এন্ড্রু
ফলাফল মূত্রের গতিবৃদ্ধি। হা করে থেকো না অ্রামার গ্লাসেই দু’চুমুক দাও।

(উইলিয়ামের মুখে ঢেলে দেয়)

ফিলিপস
এ পর্যন্ত কতজন গেল?

উইলিয়াম
সাঁইত্রিশ, আটত্রিশ, ঊনচল্লিশ- ঊনচল্লিশ জন।

ফিলিপস
নিউ ইংল্যান্ড পৌঁছানো পর্যন্ত বাকিগুলো টিকবে তো?

এন্ড্রু
আধাআধি টিকবে, যে যাই বলো কালো আফ্রিকানগুলোর জান বড় কঠিন। ওদের অবস্থায় থাকলে এতদিনে আমরা শেষ হয়ে যেতাম।

উইলিয়াম    
এ ব্যবসা আর বেশিদিন চলবে না।

এন্ড্রু
মানে?

উইলিয়াম
সারা ইংল্যান্ড জুড়েই স্লেভ ট্রেডের বিরুদ্ধে কথা হচ্ছে, পর্লামেন্ট আইন পাশ হলো বলে।

ফিলিপস
সব লোক দেখানো। কারা এর বিরুদ্ধে কথা বলছে? যারা এ ব্যবসায় লস খেয়েছে তারা। আঙ্গুর ফল টক আর কী! বড় বড় রথী-মহারথী কার পুঁজি খাটছে না? চার্লস ডিকেন্স- এতবড় লেখক, আইজ্যাক নিউটন- এত বড় বিজ্ঞানী, তারা দু’জনেই সাউথ সি কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার।

এন্ড্রু
আলেকজান্ডার পোপ, জন লক এদের পুঁজিও খাটছে রয়াল আফ্রিকান কোম্পানিতে। সব দেখা আছে কে কত বড় নীতিবান! ধ্যৎ আজে বাজে কথা বলে নেশাটাই পাতলা করে দিলে। যাই দু’পেগ মেরে আসি।

(এন্ড্রু চলে যায়)

উইলিয়াম
আজ মনে হয় আরো দু’চারটা যাবে, অবস্থা খুবই খারাপ।

ফিলিপিস
যেভাবেই হোক মরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।

উইলিয়াম
কয়েকটার যা অবস্থা তাতে ঈশ্বর কেন স্বয়ং শয়তানও বাঁচাতে পারবে না।

ফিলিপস
একটু সেবা যত্ন করো, নাহলে দোষটা তোমারই হবে। খালি জাহাজ নিয়ে তো নিউ ইংল্যান্ড ফেরা যাবে না। তোমার আমার মুখ দেখে কোম্পানি বেতন দিবে না। জাহাজ বন্দরে ভিড়লে তোমাকে কত দিতে হবে?

উইলিয়াম
ছ’মাসের বেতন দু’শ পাউন্ড।

ফিলিপস
আর এই নিগ্রো শয়তানের বাচ্চাগুলো কত করে বিক্রি হবে?

উইলিয়াম
পঁচিশ থেকে ত্রিশ পাউন্ডে।

ফিলিপস
তাহলে তুমিই বলো কোম্পানির কত লোকসান হবে? তোমার বেতন তো পুরোটাই জলে।

উইলিয়াম
কিন্তু কার্গো আইন অনুযায়ী ক্রীতদাসরা অবস্থার সম্পত্তি, পানিতে ডুবে গেলে ক্ষতিপুরণ দাবি করা যায়।

ফিলিপস
তা যায়। কিন্তু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোকে তুমি কী করে বুঝাবে যে এরা পানিতে ডুবেই মারা গেছে?

উইলিয়াম
নিউ ইংল্যান্ডের তুলা আর ক্যারিবিয়ানের চিনির জন্য আর কত কালো মানুষের রক্ত লাগবে?

ফিলিপস
(এন্ড্রু ফিরে আসে) তুমি দেখছি মেরি উলফস্টোন ক্রাফটের মতো কথা বলেছো।

এন্ড্রু
মেরি উলফস্টোন ক্রাফট? নামটাতো বেশ! তা সেই সুন্দরী নারী কি তোমার নতুন প্রণয়িনী?

ফিলিপস
আজ্ঞে না, উনি যত্রতত্র প্রণয়ের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন। নারী আর দাসদের পক্ষে লড়ছেন।

এন্ড্রু
বাব্বা!

ফিলিপস
তার কথা চিনি তৈরিতে আর কত রক্ত লাগবে?

এন্ড্রু
ওই যে কাপ্তেন আসছে।

কাপ্তেন
এ্যানিথিং রং?

উইলিয়াম
স্যার আরো তিনজন শেষ।

কাপ্তেন
পানিতে ফেলে দাও ডেডম্যান টেল নো টেইলস, লোকসানটা আরো বাড়লো।

(সবাই চলে যায়। খালাসিরা এক এক করে মৃত দেহগুলো পানিতে ফেলে দেয়)

প্রথমদল
লাগলে মড়ক এবং জরক
আধা আধিই সাফ
ঠ্যাং ধরি আর জলে ফেলি
চেচাক বাপরে বাপ।

দ্বিতীয়দল
The plague it come and fever too end
Killed them like flies
We dumped their bodies on the deck
And have them outside.

দুইদল
জাহাজের নাম ফ্লাইয়িং ক্লাউড বন্দর বাল্টিমুর।

প্রথম দল
পাঁচশ টনের ফ্লাইয়িং ক্লাউড পালের ক্লিপার জবর।

দ্বিতীয় দল
বাল্টিমুরের সব জাহাজের পারতো নিতে খবর।

প্রথম দল    
পালে যখন ধরতো বাতাস
চলতো যেন ঘোড়া।

দ্বিতীয় দল
ষোল পালের জাহাজ চলে
অন্য জাহাজ খোঁড়া।

(জাহাজের ডেকে ছুটে আসে কৃঞ্চাঙ্গী তাগুবা পেছনে মাতাল এন্ড্রু)

এন্ড্রু
ওফেলিয়া না না জুলিয়েট দাঁড়াও। I love you more than words can weild the matter, dearer than eyesight, space and liberty. ওফেলিয়া প্রিয়তমা আমার দাঁড়াও।

তাগুবা
কে তোর ওফেলিয়া? আমি তাগুবা, আফ্রিকা থেকে যাকে ধরে এনেছিস মাতাল শয়তান। (ওদের চেচামেচি শুনে এগিয়ে আসে ক’জন খালাসি) আর এক পা-ও এগুবি না, কামড়ে খামচে দিব।

খালাসি ১
হুররে!

খালাসি ২
রোমিও জুলিয়েট দ্বিতীয় অঙ্ক চতুর্থ দৃশ্য!

খালাসি ১
চালিয়ে যাও!

এন্ড্রু
বুঝেছি আমার উপর অভিমান হচ্ছে Speak low if you speak love. ভালোবাসার কথা বলতে হয় কানে কানে ফিস ফিস করে।

(এন্ড্রু এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরতে চাইলে তাগুবা তার মুখে ঘুষি মারে। অন্যরা তা দেখে হাততালি দেয়)

খালাসিত্রয়
হুররে!

এন্ড্রু
ব্ল্যাক নিগার তোর দেমাগ আমি এক্ষুণিই শেষ করছি।

(তাগুবাকে ঘুষি মারলে সে ডেকের উপর পড়ে যায়। অন্যরা এসে দাঁড়ায় দু’জনের মাঝে)

খালাসি ১
মিস্টার উইলিয়াম শেক্সপীয়র শেষ পর্যন্ত মেয়েদের উপর বাহাদুরি? হুইস্কির ডোজটা মনে হয়ে বেশি হয়ে গেছে।

খালাসি২
শোনো! ও হচ্ছে খোদ কাপ্তেনের পেয়ারের মানুষ, ওর পাত্তা তুমি পাবে না। আর যদি কাপ্তেন জানতে পারে তাহলে
কী হবে বুঝতেই পরছো।

এন্ড্রু
আমি কোনো শালাকেই পরোয়া করি না। ঘর সংসার ফেলে এই নরকে কাজ করতে কেন এসেছি? লবণ দেয়া শুকরের মাংস, দু’মাসের শুকনো পোকায় খাওয়া সব্জী এসব খেয়ে মানুষ বাঁচে না। আরো কিছু লাগে। বত্রিশজন খালাসির মাঝে দশজন আমাশয় আর জ্বরে চিৎপটাং। সাড়ে তিনশ নিগারের দেখভাল করা এত সহজ না। তার উপর প্রতিদিন দু’একটা করে মরছে।

খালাসি ২
ঠিক বলেছো যত হুজ্জত সব আমাদের। কাপ্তেন সব দেখেও দেখে না। আর এ ব্যাটা ডাক্তার উইলিয়াম, একটা অপদার্থ।

এন্ড্রু
ও ব্যাটা কোনো ডাক্তার না। ওর চিকিৎসা না পেলেই লোকজন বরং দু’চার দিন বেশি বাঁচে।

খালাসি ১
একদম ঠিক, কাপ্তেন ভগ্নিপতি বলে করে খাচ্ছে।

তাগুবা
আসমানটা কত বড়! এই ডেকের উপর এলেই যা একটু বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি। তখন একটু একটু করে বাঁচতে ইচ্ছে করে। তোরা মানুষ না, মানুষ মানুষকে এভাবে ধরে নিয়ে যেতে পারে না, তোরা সাক্ষাৎ শয়তান।

এন্ড্রু
ঠিক বলেছো। আমরা শয়তানের বড়ভাই। এই জাহাজে যারা কাজ করি তারা সবাই। তোমার হাত দু’টি দাও সুন্দরী ওফেলিয়া, আফ্রিকার কালো কুসুম তোমার ঘ্রাণ নেই।

তাগুবা
কী মনে করিস আমাদের? তোদের জনে জনে প্রেম বিলাবো? খবরদার আর কাছে আসবি না।

এন্ড্রু
এরকম করে বলে না। এত নিষ্ঠুর বাক্য তোমার কণ্ঠে মানায় না। একটু আগের আচরণের জন্য আমি দুঃখিত, ক্ষমাপ্রার্থী।

তাগুবা
খবরদার কাছে আসবি না। তোদের নরকে আর আমাকে রাখতে পারবি না।

এন্ড্রু
কোথায় যাবে?

তাগুবা
সাগরে ঝাঁপ দেব।

(জাহাজের কিনারার দিকে যেতে থাকে)

এন্ড্রু
ঝাঁপ দিলে মরে যাবে।

তাগুবা
মরবো না মুক্তি পাবো। প্রতিদিন তোদের জনে-জনে ভালোবাসার হাত থেকে মুক্তি পাবো।

(হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে সাগরে। চারদিক থেকে শুধু একটি বাক্য শোনা যায়। ঝাঁপ দিয়েছে, ঝাঁপ দিয়েছে। ডেকের উপর ছুটে আসে কাপ্তেন, উইলিয়াম ও ফিলিপসসহ কযেকজন)

কাপ্তেন
কী করে হলো? কী করছিলে তোমরা?

(হাঁটু গেড়ে বসে এন্ড্রুু। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে)

এন্ড্রু
Life is but a walking shadows a poor player that struts and frets his hour upon the stage and then is heard no more, it is a tale told by an ediot full of sound and fury signifying nothing.

কাপ্তেন    
শেক্সপীয়র আওড়াচ্ছে, বেহেড মাতাল, মাথায় পানি ঢালতে হবে। কী তোমরা কথা বলছো না কেন?

খালাসি ২
এন্ড্রুর তাড়া খেয়ে ও জাহাজের উপর উঠে আসে।

কাপ্তেন
তারপর তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলে? কতবড় একটা লস হয়ে গেল। অর্ধেক পথ আসতেই পঞ্চাশজনের মতো নেই। আমার এই জাহাজটা হয়ে গেছে অর্ধেক পাগলাগারদ আর শুড়িখানা, বাকি অর্ধেকটা বেশ্যাবাড়ি।

এন্ড্রু
আর আপনি সেই পাগলাগারদ আর বেশ্যাবাড়ির পরিচালক।

কাপ্তেন
স্টপ স্কাউন্ড্রেল।

এন্ড্রু
খবরদার গালাগালি করবেন না।

কাপ্তেন
(বাঁশিতে ফুঁ দিলে ছুটে আসে দু’জন মাস্কেটিয়ার) ওকে নিয়ে যাও।

খালাসি ২
না এন্ড্র কিছু অন্যায় কথা বলেনি। আমরা এই নরকে গাধার মতো খেটে মরবো, তারপরও কিছু হলেই আমাদের দোষ। বত্রিশজন খালাসির মধ্যে দশজন মৃত্যুপথযাত্রী। কই তাদের নিয়েতো কখনো কথা শুনি না।

কাপ্তেন
নিউ ইংল্যান্ডের স্লেভ মার্কেটে ওদের দাম আছে, তোমাদের নেই। তোমাদের জন্য কেউ এক পেনিও দেবে না।

খালাসি ২    
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, আমাদের মতো দু’চারটা খালাসি ভেদবমি আর রক্ত আমাশয়ে মারা গেলে কী আসে যায়?

খালাসি ১
আফ্রিকার জঙ্গল থেকে দাসদের কুকুর বেড়ালের মতো হাত পা বেঁধে জাহাজে তোলা, মাঝে মধ্যে জীবন দিয়ে বিদ্রোহ দমন, এসবের বিনিময়ে আমরা কী পাই? কথায় কথায় শাস্তি গালাগালি এসব বন্ধ করতে হবে।

কয়েকজন     
হ্যাঁ বন্ধ করতে হবে।

কাপ্তেন
হোয়াট?

খালাসি ১
একটা কথা মনে রাখবেন আমরা খালাসিরা যদি শেকলে বাঁধা ব্ল্যাক নিগারদের সাথে যোগ দেই তাহলে অবস্থাটা অন্যরকম হয়ে যেতে পারে।

কাপ্তেন
হুমকি দিচ্ছো?
    
কাপ্তেন
মিউটিনি? বিদ্রোহ?

(কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে। গুলি খেয়ে এন্ড্রু পড়ে যায়। মাস্কেটিয়ারা অন্যদের ঠেলতে ঠেলতে নামিয়ে দেয় জাহাজের খোলের ভিতর)

দৃশ্য- দুই

(আল আরাবিয়া ট্রাভেলস। বিদেশ যেতে আগ্রহীদের সাথে কথা বলছেন জিতু সরকার)

জিতু
কত আনছো?

মকবুল
পঁচিশ হাজার।

জিতু
বাকি পঞ্চাশ হাজার?

মকবুল
জিতুভাই আর দিবার পারুম না। বাড়ি ভিটার দুই কাঠা বন্ধক দিছি। বউয়ের একটা নাকফুল আছিলো দুই আনি সোনার, তাও বেইচা দিছি। নতুন বউ এক বছরও পুরা হয় নাই।

জিতু
শ্বশুর বাড়ি থেইকা যৌতুক লও। বউরে বাপের বাড়ি পাঠায়া দেও, ট্যাকা নিয়া আসুক। শোনো! শ্বশুর বাড়ি হইলো বেকার ছেলেদের সোনালী ব্যাংক, লোন নিলে ফেরৎ দিতে হয় না।

মকবুল
জিতুভাই!

জিতু
শোনো মকবুল, তোমারে আর কী কমু, বন্ধুর আত্মীয়, নাইলে কবেই না কইরা দিতাম।

মকবুল
শ্যাষ সম্বল যা আছিলো তাও বিক্রি কইরা দিছি। এহন শরীল থেইকা হাত পাও খুইলা দেওন ছাড়া দিবার মতো আর কিছু নাই।

জিতু
জিতু সরকারের জমিদারি নাই যে জমিদারির ট্যাকা দিয়া বিদ্যাশ পাঠামু। পারুম না। ঘাটে ঘাটে কতজনরে পয়সা দিতে হয়, সেই খবরতো আর তুমরা জানো না। হেরপর পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানের টিকেট, ট্যাক্স, ইমিগ্রেশন কত কী! আমার কয় পয়সা ব্যবসা হয়? দ্যাশের মানুষের উপকার হয় হের লাইগাই করি। বাকি পঞ্চাশ হাজার নিয়া দেখা করবা, দেরি করলে এই লটে পাঠাইতে পারুম না।

রশীদ
আমাগো কী করলেন জিতুভাই?

জিতু
আগে ঠিক করো কই যাইবা? কুয়েত-কাতার-বাহরাইন দেড় লাখ, আবুধাবি-দুবাই-আমিরাত দুই লাখ, সৌদি আরব আড়াই লাখ।

মোকসেদ
সৌদি আরবেতো আকামা বন্ধ।

জিতু
সবার লাইগা না। আমার কাছে এক্ষণ এই মুহূর্তে দশজন কফিল রেডি। মোবাইলে খালি কমুকাইফা হালুকা সঙ্গে সঙ্গে মামলা ডিশমিশ। তুমরাতো আবার খাদ্দামার চাকরি করবার পারবা না।

মোকছেদ    
খাদ্দামা?

জিতু
খাদ্দামা হইলো কাজের বুয়া। থাকা-খাওয়া, কাপড়চোপর ওষুধপত্র ফ্রি। মাসে বেতন চল্লিশ হাজার মানে বছরে পাঁচলাখ। ঢাকা শহরে কাজের বুয়ারা কত পায়? খুব বেশি হইলে তিন হাজার। তুমি না গিয়া বউডারে পাঠায়া দ্যাও। ট্যাকা পয়সাও কম লাগবো। পরশুদিন ফ্লাইট।

মোকছেদ    
আমিই যামু। কিন্তু এত ট্যাকা দিবার পারুম না।

জিতু
যাইবা না। তুমারে যাইতে কইছে কেডা? শোনো মন খারাপের কিছু নাই। কম পয়সার বেবস্থাও আছে আমার কাছে। তবে যাইতে হইবো কষ্ট কইরা। পাসপোর্ট-ভিসা, ট্যাক্স-ইমিগ্রেশন কিছুই লাগবো না। মাত্র পঞ্চাশ হাজারে সব কইরা দিমু।

রশীদ
কুনহানে?

জিতু
মালেশিয়া! ছবির মতন দ্যাশ। আরব দ্যাশের মতন মরুভূমি না। মনে হইবো য্যান দ্যাশেই আছো। জাহাজে উঠবা আর পাড়ে গিয়া নামবা। গাঙ পার হওয়ার মতো সাগর পার হইবা। হেরপর আর কিছু করতে হইবো না। আমার লোকজন আছে সব ঠিক কইরা দিব। তবে যাইতে হইবো গোপনে, কাউরে জানান যাইবো না।

মকবুল
আমারে পাঠায়া দ্যান।

জিতু
দিলাম।

রশীদ
আমিও যামু।

মোকছেদ    
আমিও! দ্যাশেতো ভিক্ষা করবারও উপায় নাই।

জিতু
বেশ! তাইলে আগামী সপ্তাহে ট্যাকা পয়সা নিয়া যোগাযোগ করো। সব কিন্তু নগদে দিতে হইবো। টেকনাফ থেইকা পনের তারিখে ট্রলার ছাড়াবো।

রশীদ
আমরা তাইলে যাই?

জিতু
বলো আসি।

(সবাই চলে যায়, আসে খয়বর)

খয়বর
স্যার!

জিতু
ঝটপট কও।

খয়বর
খবর ভালো। এক নম্বর গিরিসের পাট্টি বসায়া রাখছি। দুই নম্বর ট্রলার পাট্টি থাইল্যান্ড বর্ডারে ধরা খাইছে। আর ইন্ডিয়ার পাট্টি এইবার আমি নিজেই হ্যান্ডেল করুম।

জিতু
নিজেই হ্যান্ডেল করবা, সেয়ানা হইয়া গ্যাছো?

খয়বর
কী করুম? আপনের বেতনেতো পোষায় না।

জিতু
বেশ!

খয়বর
গিরিসের পাট্টি নিয়া আসুম?

জিতু
পরে। আগে থাইল্যান্ডের খবর কও।

খয়বর
বার্গেনিং চলতাছে।

জিতু
গুড! আদম সন্তানরা কী কয়?

খয়বর
কয় জিতু সাহেবরে কন ছাড়ায়া নিতে। কান্দাকাটি শুরু হইয়া গ্যাছে।

জিতু
ভেরিগুড! ফোন লাগাও।

খয়বর
স্যার ধরেন।

জিতু
(ফোন চেপে ধরে) কে?

খয়বর
ট্রলার মাঝি কাশেমালী।

জিতু
হ্যালো! কাশেম খবর কী?

কাশেম
স্যার! খবর ভালো। বর্ডার পুলিশের সাথে পঞ্চাশ হাজারে সিস্টেম কইরা ফালাইছি। আর আদমগুলারে কইছি যারা একলাখ পঁচিশ হাজার কইরা দিতে পারবো তাগো মটরসাইকেল দিয়া বর্ডারে নিয়া যাইবো। যারা পারবো না, তাগো থাইল্যান্ডের জঙ্গলে তিনবছর বেগার খাটতে অইবো।

জিতু
লোকজনে কী কয়?

কাশেম
কয়, জিতু সাবরে দিয়া ব্যবস্থা করো।

জিতু
ভেরিগুড! তুমি ফোনে লোকজনের দ্যাশে কথা কওয়ার বেবস্থা করো। আমি সিনাওয়াত্রারে ফোন দিতেছি। ও আইসা ছুটায়া নিয়া যাইবো। যারা ট্যাকা দিবার পারবো না তারা সিনাওয়াত্রার ফার্মে বেগার খাটবো। তুমি মালেশিয়া পৌঁছায়া মাহাথির লগে দেখা করবা। তার কাছে তোমার টিকেট রেডি। কুনো অসুবিধা হইলে ফোন দিও। (খয়বরকে) যা গ্রিসের পার্টি নিয়া আয়। (খয়বর বেরিয়ে যায়। জিতু সরকার গুন গুন করে গান গায়। আসে হাবিব ও মাসুদ) আসেন হাবিব সাহেব, মাসুদ সাহেব কেমন আছেন?

মাসুদ
ভালো।

জিতু
সরি! আপনাদের অনেকক্ষণ বসায়া রাখতে হইলো। কী করবো বলেন, পাবলিক ফাংশনতো, সময়মতো কিছু শ্যাষ হয় না। কী খাইবেন? ঠাণ্ডা না গরম?

হাবিব
না কিছু না।

জিতু
তাইলে চা খান। খয়বর এইখানে চা বিস্কিট দ্যাও। এইবার কন আপনেরা কী ডিসাইড করছেন?

হাবিব
আমরা গ্রিসে যাবো।

জিতু
সবাই গ্রিসে যাইবার চায়। কিন্তু গ্রিসের অবস্থা আর আগের মতো নাই। ইকোনোমি খুব খারাপ। দেওয়ালে দেওয়ালে
গ্রাফিতি কইরা লেখা- ওয়েলকাম টু দ্যা সিভিলাইজেন অব ফিয়ার।

হাবিব
মানে ভয়ের রাজত্বে স্বাগতম?

জিতু
আপনেরা শিক্ষিত ইয়্যাংম্যান। বুঝতে অসুবিধা হওনের কথা না। গত চার-পাঁচ মাসে বেশ কিছু দুর্ঘটনাও ঘটছে। জাইনা শুইনা তো আর আগুনে ঝাপ দিতে বলতে পারি না। তারপরও যদি যাইতে চান পাঠাইতে পারি। তবে অন্যবিকল্পও আছে ভাইবা দেখতে পারেন।

মাসুদ
মিডলইস্টে যাবো না।

হাবিব
আমাদের টার্গেট ইউরোপ।

জিতু
তাই যাবেন। আপনেরা খুব ভালো টাইমেই আসছেন আমাদের কোম্পানির ইউরোপের লিয়াজো অফিসার সালেহু বাপ্পা এখন ঢাকায়। নাইজেরিয়ান ভদ্রলোক। এখানে আসতেছে। একটু অপেক্ষা করলে কথা বলতে পারবেন। বুঝলেন আমরা কোনো ভায়া মিডিয়া কাম করি না। সব ডাইরেক্ট কানেকশন। (দেয়ালে ঝোলানো ম্যাপ দেখিয়ে) এই হইলো মরক্কো। ডাইন দিকে তিউনেশিয়া, আলজেরিয়া। আর সবার ডাইনে লিবিয়া। এই হইলো গ্রিস। এইখানে ইতালি আর এইটা হইলো স্পেন। মাঝখানে ভূমধ্যসাগর। আপনেরা গ্রিস, স্পেন, ইতালি, যেখানে খুশি যাইতে পারেন। আমি কই কি আপনেরা স্পেনেই যান। স্পেন যাইতে হইলে মরক্কো সবচে ভালো রুট, আর ইতালি যাইতে হইলে লিবিয়া।

মাসুদ
আপনি যা ভালো বুঝেন।

জিতু
বেশ! যেখানে খুশি যাইতে পারেন। গ্রিসে ছয় লাখ, স্পেন সাত আর ইতালি সাড়ে সাত লাখ।

হাবিব
এত টাকা?

জিতু
আরে যাইতে পারলে তো টাকা উসুল হইতে এক বছরও লাগবো না।

মাসুদ
পারবো না। এত টাকা দিতে পারলে তো দ্যাশেই কিছু করতে পারতাম।

জিতু
এক সাথে না পারেন কিস্তিতে দিবেন।

হাবিব
যদি কিস্তি ঠিকমতো দিতে না পারি?

জিতু
না পারলে সাহারা মরুভূমির মধ্যে ঘুরপাক খাইবেন, নয়তো ভূমধ্যসাগরের কিনারায় বইসা গান ধরবেন, ঢেউ উঠে
সাগরেরে ক্যামনে পাড়ি ধরিরে।

মাসুদ
ঠাট্টা করছেন?

জিতু
ঠাট্টা না। কঠিন বাস্তবটাই তুইলা ধরলাম। পুরা টাকা না পাইলে তো আমার এজেন্টরা সাগর পার করবো না। একটু ভাবনা চিন্তা করেন। ঠিক করেন যাইবেন কি যাইবেন না। আর গেলে কই যাইবেন। আগামী মাসের ফাস্ট উইকেই ফ্লাইট।

(প্রবেশ করে সালেহু বাপ্পা)

সালেহু
আসসালামো-আলাইকুম, গুদমর্নিং এভরিবদি, (সবার সাথে হাত মিলায়) নাইস তু মিত ইউ, নাইস তু মিত ইউ।

জিতু    
প্লিজ! (ইশারায় বসতে বলে) যার কথা বলছিলাম, আমাদের প্রজেক্টের লিয়াজো অফিসার। মিস্টার সালেহু, আই টোল্ডদেম এ্যাভরিথিং রিগার্ডিং আওয়ার প্রজেক্ট। নাও ইট ইজ ইয়োর ডিউটি টু মেক দেম আন্ডারস্ট্যান্ড।

সালেহু
নো প্রোবলেম। লিসেন মাই দিয়ার ফ্রেন্দস। উই উইল অর্গানাইজ এ্যাবরিথিং। ফুদ, ত্রান্সপোর্ত, একোমোদেসন এন্দ শিপ তু ইউরোপ।

জিতু    
এইবার নিশ্চই বুঝতে পারছেন। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, সাগর পাড়ি দেওয়া সব বেবস্থাই উনি করবেন। আপনাদের যদি আরো কিছু জানবার থাকে, যেমন ধরেন কুনপথে খরচ কম সুবিধা বেশি।

হাবিব
মিস্টার সালেহু, ক্যান ইউ টেল আস হুইচ রুট এন্ড কান্ট্রি ইজ ইনএক্সপেনসিভ?

সালেহু
ইয়েস! রাইত নাও উই হ্যাব থ্রি প্যাকেজেস। নাম্বার ওয়ান ফ্রম মরক্কো তু স্পেন, নাম্বার তু আলজেরিয়া তু সিসিলি গ্রীস এন্দ নাম্বার থ্রি লিবিয়া তু লাম্পেদুসা ইতালি। ফর মি ইত ইজ দিফিকালত তু সে হুইচ কানত্রি ইজ বেতার বিকজ ইত ইজ ইয়োর চয়েজ, ইয়োর দিসিশন। মিস্টার জিতু, হাও মেনি পিপল ইন দিস গ্রুপ?

জিতু
সিক্সটিন।

সালেহু
নো প্রোবলেম।

হাবিব
আমরা তাইলে যাই। সিদ্ধান্ত যা হয় কাল পরশুর মধ্যে ফাইনাল করবো।

সালেহু
গুদলাক ইয়াংম্যান।

দৃশ্য- তিন

(অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে তিনটি তরুণী- মঞ্জিলা, আকলিমা আর আঙ্গুরী। তাদের দেখে এগিয়ে আসে দালাল খয়বর)

খয়বর
মঞ্জিলা, তরা এত দেরি করলি ক্যান? ম্যালা পথ হাইটা বাসস্ট্যানে যাইতে হইবো।

মঞ্জিলা
কই যামু আমরা?

খয়বর
পয়লা বাসস্ট্যান, হেরপর নাইট কোচে বর্ডার। বর্ডার পার হইয়া ইন্ডিয়া।

আঙ্গুরী
কিন্তু আমগোতো পাসপোর্ট নাই।

খয়বর
পাসপোর্ট ভিসা কইরা যাইতে হইলে তো লাগবো লাখ ট্যাকা। তরাতো যাইবি বিনা পয়সায়। হের লাইগাতো যাইতে হইবো গোপনে। যাতে পুলিশ বর্ডারগার্ড কেউ জানতে না পারে। (খয়বরের মোবাইল বেজে ওঠে) হ্যালো কেডা? অজুফা?

অজুফা
খয়বর ভাই আপনে কই? আমরাতো বাসস্ট্যানে আইসা পড়ছি।

খয়বর
আমি পথেই আছি। এক ঘন্টার মধ্যেই আইসা পরুম। এক কাম কর তরা বিসমিল্লাহ হোটেলে গিয়া চা বিস্কুট খা। আমি আইসা ট্যাকা দিমু। মালিকরে আমার কথা কইলেই হইবো। খিদা লাগলে ভাত খায়া ল, বিরানিও খাইবার পারস। কুনো অসুবিধা নাই।

আকলিমা
আমার কেমুন জানি ভয় করতাছে।

খয়বর
তগো সাথে আরো তিনজন যাইবো।

মঞ্জিলা
শেষে যদি আমাগো চাকরি না হয়?

খয়বর
না হয় মানে? যাওনের লগে লগে চাকরি, মাসে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা। ওভার টাইম করলে তো আরো বেশি। গার্মেন্টসে কাম করলে তো পাইতি বড়জোর পাঁচ ছয় হাজার।

আকলিমা    
কিন্তু আমাগো এত ট্যাকা দিব ক্যান?

খয়বর
আরে বেক্কলের বেক্কল, যারা চাকরি দিব তাগো ট্যাকা পয়সার শেষ নাই। কইতে পারস ট্যাকার উপর ঘুমায়। অভাব শুধু কাজের লোকের।

আকলিমা
আমাগো কামডা কী?

খয়বর
বাড়ি ঘরের কাম, হোম সার্ভিস। বিদেশিরা বাড়ি ঘরের কাম করে না।

মঞ্জিলা
আমার ক্যান জানি বিশ্বাস হয় না।

খয়বর
বিশ্বাস না হইলে ফিইরা যা। তরে জোর করতাছে কেডা?

মঞ্জিলা
রাগ করেন ক্যা?

খয়বর
না রাগ করবো না। যহন বিদ্যাশ থেইকা ব্যাগ ভর্তি ট্যাকা আর গতরভর্তি সোনাদানা লইয়া দ্যাশে ফিরবি তহনতো এই খয়বরের কথা মনেই থাকবো না। আমারেতো চিনবিই না। কথা না কইয়া হাট।

হাবিব
(রাতের অন্ধকার ভেঙ্গে ছুটে চলে দূরপাল্লার নাইটকোচ। ভেতরে ক’জন স্বপ্নতাড়িত তরুণী। তারা ছুটে চলেছে দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। শীতের কুয়াশা ভেদ করে, তারা যেখানে থামে, সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে, সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। সন্তর্পনে হাঁটতে থাকে তারা)

খয়বর
একটু জোরে পাও চালা। বেলা উঠবার আগেই বর্ডার পার হইতে হইবো। শোন যদি বর্ডারগার্ডে ধইরা ফালায়-

আঙ্গুরী
তাইলে?

খয়বর
ডরের কিছু নাই। খালি কইবি নিয়ামতপুর যাইতেছি। খালাতো বইনের বিয়া। আর যদি এ্যারেস্ট কইরাও ফালায় একদম ডরাইবি না। আমি তগো ছুটায়া নিমু।

গার্ড ১
হল্ট! থামো! কই যাও তোমরা?

আঙ্গুরী
নিয়ামতপুর, খালাতো বইনের বিয়া।

গার্ড ২
কেইস সন্দেহজনক, ক্যাম্পে চলো।

খয়বর
ওস্তাদ এইদিকে আসেন।

গার্ড ১
তুমি আবার কী কইবার চাও। তুমারে দেইখাতো সুবিধার মানুষ মনে হইতাছে না।

গার্ড ২
হু দেখতেই দুই নম্বর।এগো নিয়া বর্ডার পার হইবার তালে আছে।

খয়বর
সবইতো বুঝেন।

গার্ড ২
তাইলে আর কথার কাম কী? চলো ক্যাম্পে। আইজই চালান দিয়া দিমু।

খয়বর
এই নেন ধরেন।

গার্ড ২
কী?

খয়বর
চা সিগারেট খরচ।

 গার্ড ২
ঐ কাম করি না, কত?

খয়বর
তিন হাজার, জনপ্রতি পাঁচশ।

গার্ড ১
এত কমে কাম হইবো না। তাছাড়া আমরা মানুষ দুইজন।

খয়বর
ঠিক আছে আরো তিন, দুইজনেই সমান সমান।

গার্ড ২
দশ মিনিটের মধ্যে সীমানা পার হইবি, আর জানি কেউ না দেখে।

খয়বর
চল। তগো লাইগা আমার কতগুলা ট্যাকা দণ্ডি গেল। সামনের এই পথটুক পার হইলেই কানাইদার বাড়ি।

মঞ্জিলা
কানাইদা? কানাইদা আবার কেডা?

খয়বর
আরে কানাইদাইতো সব। তগো চাকরিতো কানাইদার হাতে। কানাইদা ও কানাইদা।

কানাই
কে? খয়বরদা তুমি। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। পথে অসুবিধা হয়নিতো?

খয়বর
ডাবল জরিমানা দিয়া পার হইছি।

কানাই
এই তোমরা ভিতরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঝটপট রেডি হয়ে নাও। একটু পরেই রওনা দিব।

(মেয়েরা ভেতরে চলে যায়)

খয়বর
আমার পেমেন্টটা দিয়া দ্যাও, দেরি করবার চাই না। (কানাই টাকা দেয়) কত?

কানাই
ছয় দশে ষাট।

খয়বর
এত কমে আর পোষায় না, ঘাটে ঘাটে কত খরচ।

কানাই
না পোষালে আমার কিছু করার নেই। আমারওতো দু’পয়সা প্রোফিট চাই। এখন আর আগের মতো ব্যবসা চালানো সহজ না। যা দিয়েছি কেটে পড়ো। সময় ভালো না, শেষে আম ছালা দুটোই যাবে।

খয়বর
এমুন করলেতো মাল ডেলিভারি দিবার পারুম না।

কানাই
বাজার ভালো থাকলে তোমাকে দু;পয়সা বেশি দিতে আপত্তি ছিল না।

খয়বর
(যেতে যেতে) শালা নাটকীর পুত তুমারে আর সাপ্লাই দিমু না।

কানাই
আমাকে কিছু বললে?

খয়বর
না।

(চলে যায়)

কানাই
চাই না মাগো রাজা হতে, রাজা হওয়ার সাধ নাই মা, পাই যেন দু’বেলা খেতে। হরি হরিহে, তুমিই কাণ্ডারি। (সবাই আসে) ও তোমরা এসেছো? আমরা কথাগুলো একটু মন দিয়ে শুনবে। এটা হলো বর্ডার এরিয়া, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে। এখন থেকে তোমরা সবাই নতুন নামে পরিচিত হবে। তুমি বাসন্তী, তুমি মালতী, তুমি কল্পনা, তুমি সীতা, তুমি স্বরস্বতী আর তুমি সবিতা।

মঞ্জিলা
আমরা নাম পাল্টামু ক্যান? এইগুলাতো হিন্দু নাম।

কানাই
রাগ করো না আমার কথাটা একটু বুঝতে চেষ্টা করো। তোমরা এখন ইন্ডিয়ায়। বর্ডার পুলিশে যদি ধরে তাহলে সোজা বহরমপুর জেলখানা। কিন্তু ওরা যখন তোমাদের হিন্দু নাম শুনবে, তখন কোনো সন্দেহই করবে না। কার কী নাম একবার বলোতো।

মঞ্জিলা
বাসন্তী।

আকলিমা    
মালতী।

অজুফা
সীতা।

রোজিনা
স্বরস্বতী।

সুফিয়া
সবিতা।
    
আঙ্গুরী
কল্পনা।

কানাই
চমৎকার আমরা আর এখানে দেরি করবো না চলো।

আকলিমা    
আমরা কি এহন চাকরিতে জয়েন দিতে যাইতেছি?

কানাই
চাকরি?

মঞ্জিলা
ক্যান খয়বর ভাই তো কইলো আপনেই আমাগো চাকরির বেবস্থা করবেন।

কানাই
ও বুঝেছি, তা তোমরা চাকরি করবে কেন? তোমরা করবে ব্যবসা, স্বাধীন ব্যবসা, চাকরিতো গোলামি।

রোজিনা
বেবসা করুম? আপনের কথাতো কিছুই বুজতেছি না।

সুফিয়া
বেবসা করতে গেলে ট্যাকা-পয়সা, পুঁজি-পাটা লাগে, আমাগো কি আছে?

রোজিনা
বুজছি আপনে আমাগো লগে ঠাট্টা করতেছেন।

কানাই
না, ঠাট্টা করছিনে তোমাদের যে কি পুঁজি আছে তা তোমরা নিজেরাই জানো না। তোমাদের পুঁজিতো ভালোবাসা, তোমরা করবে ভালোবাসার ব্যবসা। দুনিয়া কি মজা লেলো দুনিয়া তুমারি হ্যায়, দুনিয়া তুমারি হ্যায়।

মঞ্জিলা
আপনের কথাতো সুবিধার মনে হইতেছে না।

আঙ্গুরী
আমরা আপনের সাথে যামু না।

রোজিনা
যামু না, চিক্কার দিমু।

কানাই
কাজ হবে না, উল্টো বিপদে পড়বে। তখন তোমাদের ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে শিয়াল শকুন, নয়তো পঁচে মরবে জেলখানায়। মাথা ঠাণ্ডা রেখে আমার কথা শোনো। তোমাদের ছয়জনকে ছয় বিশে একশ বিশ, মানে এক লাখ বিশ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি।

সুফিয়া
কী কইলেন?

কানাই
খয়বর তোমাদের বিক্রি করে গেছে। তোমরা যদি আমার সাথে যেতে না চাও তাহলে জনপ্রতি বিশ হাজার টাকা ফেরৎ দিয়ে চলে যেতে পারো। আমার লাভের দরকার নেই। আসল পেলেই ছেড়ে দেব। পালাবার চেষ্টা করো না, ধরা পড়ে যাবে। তারচে কথা না বাড়িয়ে চলো আমার সাথে।

দৃশ্য- চার

হাবিব
ষোলজন বঙ্গসন্তান, কর্ম প্রত্যাশী বেকার যুবক, স্কুল-কলেজ পাশ, আছে মাঠের কৃষক, শ্যালো মেশিনের ড্রাইভার, কারো আছে ঘরসংসার, স্ত্রী পুত্র কন্যা, কারো বুকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। ওরা এসেছে কুড়িগ্রাম, ভুরুঙ্গামারী, চাটখিল, চণ্ডীপাশা মেহেরপুর, নকলা, বেলকুচি, চাটমোহর, শরিষাবাড়ি থেকে। ভাঙাচোরা প্রাগৈতিহাসিক জিপে ছুেেট চলেছে ধূধূ মরুভূমির উপর দিয়ে।

শুভ
উহ মাগো।

হাবিব
কী হইলো?

শুভ
পিঠের ব্যথা, ঝাঁকির চোটে শরীরের সব জয়েন্ট ঢিলা হইয়া গ্যাছে। মনে হয় নাটবল্টু সব খুইলা খুইলা পড়বো।

মাসুদ
শুভ এক কাজ করো, গ্রিজ লাগায়া টাইট দিয়া লও।

শুভ
ঠাট্টা করো? এই রকম মুরগির বাক্সের মধ্যে কতক্ষণ বইসা থাকা যায়?

হাবিব
ঠিকই বলছো এই মরুভূমির উপর দিয়া দুইদিন পার হইয়া গেল। যদি একটু কাইত হইতে পারতাম।

সাত্তার
মামা এইটা হইলো রাঙামাটির চান্দের গাড়ি।

হাবিব
চান্দের গাড়িতো যায় রাস্তা দিয়া কিন্তু এই ব্যাটাতো চলছে মরুভূমির উপর দিয়া, কোনো রাস্তাঘাট নাই। ড্রাইভার ঠিক পথে চলছেতো? পথ হারায়া যদি মরুভূমির মধ্যে আটকা পড়ে?

সাত্তার
তুমার যত আজে বাজে ভাবনা।

হাবিব
আজে বাজে ভাবনা? শোনেন সাত্তার সাহেব, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত্রি হয়।

মাসুদ
আমি ভাবতেছি অন্য কথা।

হাবিব
কী?

মাসুদ
গাড়ির যা কন্ডিশন কতদূর যাওয়ার পর গাড়ি নিলডাউন হইয়া পড়লো। আর ড্রাইভার গাড়ি থেইকা কয় সবাই নামো, গাড়ি ঠেলতে হইবো।

সেলিম
ভাই এতকিছু ভাবতেছি না, ম্যালা ট্যাকা পয়সা খরচা কইরা আসছি। যত কষ্টই হোক, জায়গা মতো পৌঁছাইতে পারলে আর কিছু চাই না। গলাটা শুকায়া আসতেছে, মাসুদ বোতলটা দ্যাও, এক ঢোক পানি খাই।

হামাদি
এত বেশি পানি খেও না শেষে খালি বোতল চুষতে হবে।

সাত্তার
এই মিয়া তুমার নামডা জানি কী?

হামাদি
আবদাল হামাদি।

সাত্তার
বুঝছি আব্দুল হামিদ। তুমি মিয়া বেশি বেশি কথা কও।

হামাদি
আমার কথা শুনলে আখেরে তোমাদেরই লাভ। সবার পাসপোর্টগুলো দিয়ে দাও।

শুভ
কেন পাসপোর্ট দিতে হবে কেন?

হামাদি
আমি ট্যুর ম্যানেজার, তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বটাও আমার।

শুভ
খুব ভালো কথা পাসপোর্টগলো দেই আর তুমি সেগুলো নিয়ে কেটে পড়।

হামাদি
শুধু শুধু কথা বাড়িও না।

হাবিব
এ্যাই হামিদ পানি দাও।

হামাদি
তোমাদের এত পানি পিপাসা লাগে কেন? দিনে দুই গ্লাসের বেশি পানি পাবে না। আমাদের আরো দু’দিন মরুভূমির উপর দিয়ে যেতে হবে, কথাটা মনে রেখো। নাও আজকের মতো এই শেষ।

মাসুদ
এখনই যা অবস্থা আর দুইদিন গেলেতো শুকায়া লইট্যা শুঁটকি হইয়া যামুরে ভাই।

সাত্তার
ঠিক। আমরা হইলাম পানির দেশের মানুষ।

হামাদি
আর আমি হলাম বেদুইন মরুভূমির রাখাল। দুম্বা ভেড়া কিভাবে চড়াতে হয় তা আমি ভালো জানি।

মাসুদ
ঐ ব্যাটা আমরা দুম্বা ভেড়া? কি মনে করছস আমাগো? তগো ট্যাকা পয়সা দিয়াই কামে লাগাইছি। বেশি কথা কবিতো
চাপা খুইলা হাতে ধরাইয়া দিমু।

হামাদি
সরি, ভুল হয়ে গেছে।

সাত্তার
(হঠাৎ গান ধরে) ওকি গাড়িয়াল ভাই হাকাও গাড়ি তুমি চিলমারীর বন্দরে...

শুভ
সাত্তার মিয়া, এইডা চিলমারী না মরুভূমি।

হাবিব
শুভ তুই একটা বেরসিক। হাকাও গাড়ি!

সাত্তার
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মোর জুইড়া রয়রে বে...

(গানের মাঝে বিকট আওয়াজ তুলে গাড়ি থেমে যায়। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে সামনের ডালা খোলে। হামাদিসহ
আরো দু-তিনজন নামে)

ড্রাইভার
ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে, কার্বুরেটরে পানি ঢালতে হবে।

(হামাদি গাড়ি থেকে পানির কনটেইনার নামায়)

মাসুদ
খাওনের পানি নামাইতেছো ক্যান?

ড্রাইভার
ইঞ্জিনে পানি খাবে।

মাসুদ
আমাগো গলা শুকায়া মারবার চাও?

হামাদি
তোমাদের চাইতে গাড়ির পিপাসা বেশি।

শুভ
একটা ভালো গাড়ি জোগাড় করবার পারো নাই?

মাসুদ
ঢাকায় জিতু সরকারে কইছিলো এসি গাড়িতে কইরা নিয়া যাইবো। ঢাকা ফিইরা গেলে তুমারে দেইখা লমু জিতু সরকার।

হামাদি
পানি না দিলে গাড়ি চলবো না। আর যদি গাড়ি না চলে তাহলে-

হাবিব
না চলে মানে? লাখ লাখ টাকা দিছি। জান খারাপ কইরা ফালামু শালা।

হামাদি
জ্বী দুলাভাই। এখনই এই অবস্থা? মরুভূমির উপর দিয়ে আরো দশ বারো হাজার কিলোমিটার যেতে হবে।

হাবিব
ভয় দেখাও?

হামাদি
না। বাস্তব অবস্থাটা কি তাই বললাম।

(ড্রাইভার আবার গাড়ি স্টার্ট দেয়)

ড্রাইভার
সবাই উঠে পড়।

মাসুদ
আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

হামাদি
শ্বশুর বাড়ি। জানি তোমাদের কষ্ট হচ্ছে। কথা দিচ্ছি সামনে যেখানে থামবো, সেখানে তোমাদের শ্বশুর বাড়ির আদর যত্নেই রাখবো।

সাত্তার
ইয়ার্কি করো?

হামাদি
ইয়ার্কি না। আল্লার কসম শ্বশুর বাড়িতেই রাখবো।

হাবিব
রসের আলাপ রাখো। আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

হামাদি
লিবিয়া। মুয়াম্মার গাদ্দাফির দেশ।

হাবিব
শরীরেতো ফোস্কা পড়ে গেল। এরকম আর কতদিন মরুভূমির উপর দিয়ে চলতে হবে?

হামাদি
দশ-বারো দিনতো লাগবেই।

শুভ
রাতেও কি গাড়ি চলবে?

হামাদি
পরবর্তী শেল্টারে না পৌঁছা পর্যন্ত চলবে।

হাবিব
সাত্তার, ভিটামিন এনার্জি কিছু একটা দেও। একটা কিছু ধরো।

সাত্তার
দূর্গম গিরি কান্তার মরু
দুস্তর পারাবার হে
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে
যাত্রীরা হুঁশিয়ার....

(গানের তুঙ্গমুহূর্তে গাড়ি থেমে যায়)

হাবিব
আবার কী হইলো?

ড্রাইভার
গাড়ি যাবে না। ঠেলতে হবে।

শুভ
মাসুদ তুমি একটা কুফা। গাড়ি ঠেলার কথা তোমার মুখ দিয়াই বাইর হইছিলো। এইবার ঠেলো।

হামাদি
সবাই একটু হাত লাগাওরে ভাই।

হাবিব
লাগাও সবাই হাত লাগাও।

ঠেলার গাড়ি ঠেলতে ভালো
খাস্তা লুচি বেলতে ভালো
কিন্তু সবার চাইতে ভালো
পাউরুটি আর ঝোলাগুড়।

শুভ
দাদাগো স্পেন এখনো বহুদূর।
মারো ঠেলা।

সবাই
হেইয়ো।

শুভ
জোরের কাম।

সবাই
হেইয়ো।

হামাদি
সবাই উঠে পড়। গাড়ি চলছে।

সাত্তার
খালি পেটে ব্যায়াম হইয়া গেল। এইবার একটু পানি দেও।

(হামাদি পানি দিলে সবাই একটু একটু করে গলা ভিজায়)

সালাম
আছে! আছে! এহনো আছে!

শুভ
কী?

সালাম
চার্জ এহনো আছে।

(দু-একজন তাদের মোবাইল বের করে)

হামাদি
কোনো কাজ হবে না, সিম পাল্টাতে হবে। তাছাড়া নেটওয়ার্কও নাই।

সাত্তার
নাই টেলিফোন
নাইরে পিওন
নাইরে টেলিগ্রাম
বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম।

(হঠাৎ ব্রেক কষে গাড়ি থেমে যায়)

শুভ
আবার কী?

ড্রাইভার
গাড়ি আর যাবে না।

মাসুদ
(ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে যায়) গাড়ি যাইবো না মানে? ইয়ার্কি পাইছো?

হামাদি
এসে পড়েছি। আপাতত কয়দিন যাত্রা বিরতি।

হাবিব
এই মরুভূমির মধ্যে একটা কাঁটাগাছওতো নাই। এইটা কোন ধরনের ঠাট্টা?

হামাদি
ঠাট্টা না। সামান্য এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে। সবাই আসো আমার সাথে।

(সবাই হামাদিকে অনুসরণ করে।)

দৃশ্য- পাঁচ

(একটি পুরাতন বাড়ি। বাড়ির কিছু অংশ ব্যবহৃত হয় গণিকালয় হিসেবে, বাকি অংশে ভবঘুরেদের বসবাস। বাড়ির সামনে কয়েকজন গণিকা হাসি-ঠাট্টা আর গান বাজনায় মত্ত। অপেক্ষা করছে খদ্দেরের জন্য। হামাদির পিছনে পিছনে সবাই প্রবেশ করে)

সাত্তার
এইডা কুন জায়গায় নিয়া আসছো?

হামাদি
এটাই তোমাদের শেল্টার, শ্বশুরবাড়ি।

মাসুদ
জায়গাটা কেমন জানি সন্দেহজনক।

(গণিকালয়ের মেয়েরাও ওদের দিকে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে, শিষ দেয়)

সাত্তার
মাইয়াগুলার রকম সকমতো ভালো ঠেকতাছে না।

হাবিব
আল্লাহ জানে কোন দোজখে আইসা পড়লাম।

হামাদি
তোমাদের জন্য এটাই সবচেয়ে নিরাপদ আর আরামের জায়গা। কম পয়সায় এর চেয়ে ভালো জায়গা পাবে না।   আবার যাত্রা শুরু না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এখানেই থাকবে। থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থাই করা আছে।

(হামাদি বেরিয়ে যায়।)

শুভ
এই শালা আবার কই গেল?

সাত্তার
জাহান্নামে যাউক- আমি কাইত হইলাম।

মাসুদ
জায়গাটা মনে হয় চোর বদমাসের আস্তানা।

শুভ
যা খুশি হউক আমি ঘুম দিলাম- কেউ ডিস্টার্ব করবা না।

মাসুদ
আমি একটু ঘুইরা আসি।

(বেরিয়ে যায়।)

সেলিম
দ্যাশ ছাড়ছি দশ-পনের দিন- কারো কুনো খবর জানি না- বউডারে রাইখা আসছিলাম যখন তখন অবস্থায়- মনডা কেমন জানি ফাত ফাত কইরা উড়ে।

হাবিব
সেলিম মিয়াা- এত নরম মন নিয়া বিদেশ আসা ঠিক হয় নাই- বউয়ের আঁচলে মুখ লুকায়া থাকলেই পারতা।

সেলিম
হাবিব- তুমি সব সময় খোঁচা দিয়া কথা কও- তোমার কি? ঝাড়া হাত পাও- ঘর সংসার থাকলে বুঝতা।

(হামাদি দুজন আফ্রিকান নারী ও পুরুষকে নিয়ে আসে)

হামাদি
এর নাম আবু আব্বাস আর ’ও হচ্ছে মাকেমবা। এখন ওরাই তোমাদের দেখভাল করবে।

(উত্তেজিত অবস্থায় আসে মাসুদ)

মাসুদ
আমার সন্দেহই ঠিক- এইটা হইলো বেশ্যাবাড়ি। দুনিয়ার চোর বদমাইসের আস্তানা।

(হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে হামাদির শার্টেরকলার চেপে ধরে) শালা তরে-আমি খুন করুম। (অন্যরা তাকে থামায়) এইডা বুঝি তোর শ্বশুরবাড়ি? শালা কাউলা।

হামাদি
মাথা ঠাণ্ডা করো। এটাই তোমাদের জন্য নিরাপদ- পুলিশ ইমিগ্রেশনের লোকজন কেউ ডিস্টার্ব করবে না। সব ম্যানেজ
করা আছে। শোনো, সবার পাসপোর্ট আমার কাছে- বেশি দূরে যাবে না। আমি দু-এক দিনের জন্য যাচ্ছি- সব ব্যবস্থা করেই ফিরবো।

(চলে যায়)

মাসুদ
শালা যদি ফিইরা না আসে তাইলে কিন্তু মহা বিপদ- বিদেশে পাসপোর্ট ছাড়া তোমার কোনো অস্তিত্বই নাই।

হাবিব
মাথা আর কাজ করতেছে না- খিদায় পাকস্থলী পর্যন্ত শুকায়া গেছে।

সাত্তার
আবু আব্বাস, খাবার দাবার কিছু হইবো?

মাকেমবা    
একটু অপেক্ষা করো- আমি দেখছি।

মাসুদ
যাও তাড়াতাড়ি নিয়া আসো- একটু কাইত হই।

সাত্তার
যা হোক কিছু একটা খাইতে দে মা- অন্নদে অন্নদে গো অন্নদা অন্নদে।

(ক্লান্তিতে সবাই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। গানের রেশও থেমে যায়)

দৃশ্য- ছয়

(নেপথ্যে চ্যানেল সেভেন টুয়েন্টিফোর। এখন দেখবেন আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি সুশান্ত সাহার পাঠানো একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট)

সুশান্ত
২৩ অগাষ্ট, বিকেল পাঁচটা থেকে আমরা অপেক্ষা করছি কলকাতার খিদিরপুর নৌবন্দরে। আজই ফিরে আসছে ১৭৫ জন হতভাগ্য বাংলাদেশী। ভারতীয় যাত্রীবাহী জাহাজ এম.ভি. আকবর যখন বন্দরে ভিড়লো তখন রাত আটটা। জাহাজ থেকে একে একে নেমে আসছে এসব হতভাগা মানুষ। পরনে কারো লুঙ্গি কারো প্যান্ট কারো বা হাফ প্যান্ট। হাতে ছোট্ট একটা পলিথিনের পুঁটলি, ভেতরে দু-একটা জামাকাপড়। অধিকাংশের পরনে লাল নীল হলুদ রঙের গেঞ্জি। তাঁরা এসেছেন কালাপানির দেশ আন্দামান থেকে। তাঁদের ভাঙাচোরা মলিন বিদ্ধস্ত চেহারা বলে দিচ্ছিল কী দুঃসহ কষ্টে কেটেছে তাঁদের দিনগুলো। বহু দৌঁড়-ঝাঁপ করে উল্লাপাড়ার মকবুল, চকোরিয়ার মোকসেদ আর রশীদের সাথে কথা বলার সুযোগ হলো। আকস্মিক ঘোর কাটিয়ে তাঁরা বলতে শুরু করেন তাদের দুঃসহ বেদনার গল্প।

মকবুল
আমরা চাষাভূষা গরীব মানুষ। মনে করছিলাম মালেশিয়া গিয়া কপাল ফিরামু- জনপ্রতি চল্লিশ হাজার ট্যাকা দিয়া উঠলাম টেকনাফের ছদর মুন্সীর নৌকায়।

মোকসেদ
আমাগো নৌকায় আছিলো একশপনের জন। সাথে আছিলো আরো তিন নৌকা। চাইর নৌকায় প্রায় পাঁচশ মানুষ। এর মইধ্যে আছিলো রোহিঙ্গা শরণার্থী। রাইতের অন্ধকারে আল্লার নাম নিয়া রওনা দিলাম কতগুলা আদমসন্তান। দিন যায়- রাইত যায়- সাগরের মধ্য দিয়া চলছে আমাগো নৌকা। সাতদিন পর আমরা ধরা পড়লাম থাইল্যান্ডের কোর্স্ট গার্ডের হাতে।

রশীদ
মাঝির সাথে কী কথা হইলো জানি না- আমাগো নৌকা থেইকা নামায়া নিয়া গেল- বন্দী কইরা রাখলো দশদিন। দিনে একবেলা খাওন দিতো- প্যাট ভরতো না। পানি দিতো মাইপা মাইপা। দশদিন পর সবাইরে কইলো- তুমগো মালেশিয়া যাওয়ার বেবস্থা কইরা দিতেছি- নৌকায় উঠো- উঠলাম নৌকায়। উইঠা দেহি সব কয়টা নৌকার ইঞ্জিন খুইলা নিছে। আমাগো নৌকা চাইরটা রশি দিয়া বানলো একটা বড় জাহাজের সাথে।

মকবুল
চাইর পাঁচ ঘণ্টা টাইনা নিয়া গেল সাগরের মইধ্যে। তারপর একসময় রশি কাইটা দিয়া কয় সোজা যাইতে থাকো-দুইদিন গেলেই মালেশিয়া পৌঁছায়া যাইবা। দুই দিন- তিন দিন- চাইর দিন- ভাসতেছি মাইঝ দরিয়ায়। সাগরের কুনো কূলকিনারা নাই। নৌকার উপরে উইঠা চাইর দিকে দেহি পানি আর পানি। জাহাজ নৌকা কিচ্ছু দেহি না। বড় বড় ঢেউ আইসা যহন বাড়ি দেয় তহন মনে হয় এই বুঝি ডুবলো। নৌকার ইঞ্জিন নাই- দড়ি বৈঠা পাল কিচ্ছু নাই- হাত দিয়া কি সাগর পাড়ি দেওয়া যায়? মনে হইতেছিল য্যান নুহু নবীর নৌকার খোলে ভাসতেছি কয়েকশ আদমসন্তান। পায়খানা, পেশাব আর বমির গন্ধে দম বন্ধ হইয়া আসে।

মোকসেদ
অল্পস্বল্প খাবার পানি যা আছিলো সব শ্যাষ। খিদার চোটে একটা বিস্কুট দুইজনে ভাগ কইরা খাইছি- পিপাসায় সাগরের নোনা পানি খাইছি। সেই পানি খায়া রক্তবমি। দশদিন বারোদিন যায়- খানা পানির অভাবে একজন দুইজন কইরা মরতে শুরু করলো- সবাই তহন কয়, আল্লা তুই উঠায়ানে- আর কষ্ট সহ্য হয় না।

রশীদ
একজন দুইজন কইরা উনিশজন মানুষ মইরা গেল চোখের সামনে। আমার হাতের মইধ্যে পানির অভাবে ছটফট করতে করতে মইরা গেল ছোট ভাইডা- ভাইজান আমারে এক চামচ পানি দেও- মায়েরে আমি কী জবাব দিমু?

মকবুল
কাউরে দাফন কাফনও করবার পারি নাই- খালি জানাজা পইড়া ভাসায়া দিছি সাগরে। আল্লা আল্লা করতেছি কুন সময় আমারেও তুইলা নিব। খালি মনে হইতেছিল দুনিয়াতে একটা কথাই সত্য- মিত্যু!

রশীদ
এমুন সময় রাইতের আন্ধাইরে একজন চিক্কার দিয়া কয়- বাতি দেহা যায়, বাতিঘর। লাফ দিয়া পড়লাম সাগরে-হেরপর কিছু মনে নাই- হুশ হইলে দেখলাম মাছধরা নৌকায় শুইয়া আছি।

মোকছেদ    
ক্যামনে খবর পাইলো জানি না- দুই তিন ঘণ্টার মইধ্যেই ইন্ডিয়ার নেভি আর কোস্টগার্ড আইসা আমাগো উদ্ধার কইরা
নিয়া গেল আন্দামান। এহন দ্যাশে ফিরতেছি।

দৃশ্য- সাত

(গণিকালয়ের একাংশ। কথা বলছে গণিকা আবেনা। সবাই শুনছে আগ্রহভরে)

আবেনা
কেমন করে এই নরকে আসলাম? শোনো- সোমালিয়া, ইথিউপিয়া আর নাইজার থেকে ট্রাকে করে আসছিলাম আমরা একশ মানুষ। মরুভূমির উপর দিয়ে চলছে আমাদের ট্রাক। পাঁচদিন পর ট্রাক গেল নষ্ট হয়ে। দুদিনেও সারাতে পারলো না। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। মরুভূমির উপর দিয়ে     হাঁটছিতো হাঁটছি। দিন যায় রাত যায়। পথ আর শেষ হয় না-খাবার দাবার যা ছিল সব শেষ। হাত পা চলে না। দশ পনেরটা শিশু আর কোলের বাচ্চা ছিল। দু-তিন দিনের মধ্যেই তারা শেষ। মায়ের শুকনা বুক চুষতে চুষতে বুকেই মরে রইলো। চোখের সামনে একটুখানি পানির জন্যে মরতে দেখেও কিছুই করতে পারিনি। বড়রাও পানির অভাবে মারা যেতে শুরু করলো। আমিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম-কিভাবে উদ্ধার পেলাম জানি না। তারপর বহু ঘাটের পানি খেয়ে আশ্রয় মিলেছে এখানে।

(আসে ম্যাকেমবি)

ম্যাকেমবি
রসের আলাপ রেখে খাবারগুলো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো- আবেনা তুই এখন যা।

সাত্তার
এগুলা নিয়া যাও- এই অখাদ্য আর খাইতে পারুম না।

ম্যাকেমবি
এ খাবারই খেতে হবে।

সেলিম
আমাগো দ্যাশের গরুও এর চায়া ভালো খায়। কুনদিন যে এই দোজখ থেইক্যা মুক্তি পামু।

হাবিব
ম্যাকেমবি, আজ আঠারো দিন- হামাদি ফিরবেতো?

সেলিম
মনে হয় না- শালা টাউট। ট্যাকা পয়সা মাইরা দিয়া ভাগছে- পাসপোর্টগুলাও নিয়া গেছে।

শুভ
আসবে না- আসবে না।

ম্যাকেমবি
আসবে।

সেলিম
আসবে না।

ম্যাকেমবি
আমি বলছি ও আসবে- আসতে বাধ্য। শোনো তোমাদের মতো কিছু বাঙালি, তামিল আর রোহিঙ্গা নিয়ে আমাদের ব্যবসা না।

হাবিব
ঠিক বুঝলাম না।

ম্যাকেমবি
পুরো আফ্রিকায় আমাদের ব্যবসা। প্রতিমাসে শত শত মানুষ এই পথ দিয়ে ইউরোপ যায়। হামাদি যদি ফিরে না আসে আর তা যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে যে বদনাম হবে তাতে এই ব্যবসার অনেক ক্ষতি হবে।

(আসে আবেনা)

আবেনা
এসে গেছে!

ম্যাকেমবি
বলছিলাম না? দেখো বলতে না বলতেই এসে গেছে।

শুভ
আবেনা তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক!

হাবিব
ডাকো- তার চান মুখটা একটু দেখি। হামাদি-হামাদি- ঐ মিয়া আব্দুল হামিদ- এইদিকে একটু আসো।

আবেনা
হামাদিকে ডাকছো কেন? ওতো আসেনি।

হাবিব
তাহলে কে এসেছে?

আবেনা
সোমালিয়া আর ঘানার পার্টি- পঁচিশজন।

ম্যাকেমবি
দক্ষিণের ঘরটাতে ব্যবস্থা করো।

শুভ
আসবে না।

হাবিব
বিকল্প কিছু একটা করা দরকার। পাসপোর্টগুলাও নিয়া গেছে- এইখান থেইকা বাইর হইলেও ধরবো পুলিশে-দেশের সাথে যোগাযোগেরও কোনো উপায় নাই।

সেলিম
আমার আর কিছু ভালো লাগতাছে না আব্বাস, আবু আব্বাস-আবু মিয়া-

আব্বাস
এরকম ভেড়ার মতো ভ্যা ভ্যা করছো কেন?

সেলিম
তাইলে কী গান করুম? তোমার হামাদি কই গ্যাছে? খবর দাও- নাইলে কিন্তু সব উল্টাপাল্টা কইরা দিমু। আর কতদিন বইসা বইসা মাছি মারুম?

আব্বাস
শুধু শুধু মাথা গরম করে কোনো লাভ নেই- তোমাদের আগেও শতশত মানুষ এই পথ দিয়ে গেছে।

সেলিম
তাতে কী?

আব্বাস
শুয়ে পড়লে?

সাত্তার
কী আর করা? যতদিন রেজেক আছে ততদিন থাকতেই হইবো- ন্যাও শুইয়া পড়ো।

(এক এক করে শুয়ে পড়ে)

হাবিব
শেষ পর্যন্ত কি বিদেশের মাটিতে পঁচে মরতে হবে?

রেখ মা দাসেরে মনে এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ
ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন করো নাগো তব মনঃকোক নদে
প্রবাসে দৈবের বশে
জীবতারা যদি খসে
এ দেহ আকাশ হতে নাহি খেদ তাহে
জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে
চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন নদে

(শুয়ে পড়ে)

দৃশ্য- আট

(সবাই ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় হৈচৈ করতে করতে প্রবেশ করে হামাদি)

হামাদি
এই তোমরা সবাই ওঠো ওঠো-

মাসুদ
ডাকাত পড়লো নাকি?

হামাদি
ওঠো ওঠো- দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হও, আমরা এক্ষুণি রওনা দিব।

হাবিব
পাগল নাকি- এই মাঝরাতে- এতদিন কোথায় ছিলে বাপধন?

হামাদি
সে কথা পরে হবে। রাতে রাতে রওনা দিলে একটু আরামে যেতে পারবে।

সাত্তার
এতদিনে আসছো তাইলে- এইবার কুন শ্বশুরবাড়ি নিয়া তুলবা?

হামাদি
শ্বশুর বাড়ি না, এই বার নিয়ে যাবো হাবিয়া দোজখের মাঝখান দিয়ে।

সাত্তার
এতদিন কি তাইলে বেহেশতের মাঝখান দিয়া নিয়া আসছো?

হামাদি
হ্যাঁ! একদম জান্নাতুল ফেরদৌসের মাঝ দিয়ে, কথা না বাড়িয়ে চলো।

(ছুটে চলেছে মরুভুমির যোগ্য বাহন খোলা ল্যান্ডক্রুজার। নয়জনের আসনে ষোলজন। জায়গার সঙ্কুলান করতে কমানো হয়েছে পোটলা-পুুঁটলি। ব্যাগ থেকে কাপড় চোপড় খুলে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে প্যান্টের উপর প্যান্ট, শার্টের উপর শার্ট, জ্যাকেট তিন চারটা করে। একজনের কোলের উপর আরেকজন)

শুভ
মামা আগেরটাতো ছিল চান্দের গাড়ি, এই বারেরটা কি? কোলের উপর বইসাও জায়গা হয় না।

হামাদি
এর নাম ল্যান্ডক্রুজার, ব্রিটিশের তৈরি। মরুভূমিতে এর চেয়ে ভালো গাড়ি হয় না। একেবারে উটের মতো। দিনের পর
দিন পানি ছাড়াই চলতে পারে।

সাত্তার
পানি দ্যাও মগজতো গইলা যাইতেছে।

সেলিম
আমার মনে হয় এই জন্যই আফ্রিকানগুলার মাথা মোটা, যাতে মগজ না গলে। হামাদি পানি দ্যাও।

হামাদি
পানি হবে না।

শুভ
হবে না মানে! ইয়ার্কি পাইছো?

সাত্তার
এ্যাই তুমি এমুন সিমার ক্যান- এই যে মানুষগুলা পিপাসায় কাতরাইতেছে তাগো লাইগা তুমার দিলে একটু রহম হয় না?

হামাদি
আমার কথা না শুনলে পিপাসায় আরো কষ্ট পাবে।

সেলিম
পানি দিবা না, হুমকি দ্যাও, ঐ শালা ড্রাইভার গাড়ি থামা।

সাত্তার
গাড়ি থামা শালা!

শুভ
স্টপ স্টপ গাড়ি থামা।

সেলিম
গাড়ি থামা নাইলে কিন্তু এসপার ওসপার কিছু একটা হইয়া যাইবো।

হাবিব
গাড়ি থামাও হামাদি।

(হামাদির নির্দেশে গাড়ি থামে। হামাদি বোতলের মুখ দিয়ে মেপে মেপে সবাইকে পানি দেয়)

হামাদি
এর বেশি পাবে না।

সাত্তার
খাবারতো চাই নাই- চাইছি একটুখানি পানি।

হামাদি
এখনই যদি সব পানি শেষ করে ফেল সারাদিন কী খাবে? আরো পাঁচ ছয়শ কিলোমিটার গেলে পানি পাবে। একটু একটু  করে খাও শুধু গলাটা ভিজিয়ে রাখো।

সাত্তার
এইটুকু পানি দিয়া আঙ্গুলও ভিজে না।

সালাম
পানির অভাবে হিসু পর্যন্ত বন্ধ হইয়া গ্যাছে- হিসু কি জিনিস ভুইলা গেছি।

হামাদি
রাতে আমরা যেখানে থামবো, সেখানে পানি পাবে তখন যত খুশি খেও।

হাবিব
পানির দরকার এখন আর তুমি শোনাও রাইতের কিসসা। তুমি সত্যিই একটা অদ্ভুত মানুষ! এই যে আমরা এত রাগারাগি গালিগালাজ করি তোমার কি একটুও রাগ হয় না?

হামাদি
রাগ হলে চলবে না। একটু কষ্ট করে চলো- গাড়ি স্টার্ট দেও।

(গাড়ি চলতে শুরু করে)

শুভ
এখন আমরা কোথায়?

হামাদি
মৌরিতানিয়া। সামনে আল মামলাখ আল মাগরিবিয়াহ, মানে মরক্কো।

সেলিম
মানুষজন বাড়িঘর গাছপালা পশুপাখি কিছু নাই, ক্যামনে জানলা এইটা মৌরিতানিয়া?

হামাদি
সময়ের আন্দাজে। শোনো আমরা মরক্কোর বর্ডার পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে ভিতরে ঢুকবো। যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে তোমরা কোনো কথা বলবে না। একদম বোবা হয়ে থাকবে যেন ওদের কথা বুঝতে পারছো না। যদি ইংরেজিতেও কথা বলে তবুও না।

সাত্তার
যদি ধইরা নিয়া যায়?

হামাদি
তবুও না। যা বলতে হয় আমি বলবো। খালাস করার দায়িত্ব আমার।

(হঠাৎ শব্দ করে গাড়ি থেমে যায়)

মাসুদ
আবার শুরু হইলো?

(ড্রাইভার নেমে ইঞ্জিন চেক করে)

সাত্তার
গাড়ি চালু হইবো তো? নাকি আবেনার দলের মতো পথ হারায়া পানির অভাবে-

সেলিম
এইসব  আকথা কুকথা কইবা না।

হাবিব
সমস্যাটা কী?

ড্রাইভার
বুঝতে পারছি না।

সাত্তার
ক্যান যে এই পথে নামলাম- দ্যাশে থাকলে এর চাইতে ভালো থাকতাম।

শুভ
কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলে না।

সাত্তার
আমার খালি আবেনার দলের কথা মনে হইতেছে, যদি গাড়ি আর না চলে আর পথ হারায়া পানির অভাবে মইরা পইড়া থাকি, তাইলে তো গোর জানাজাও পামু না। শকুনে খাইবো লাশ।

মাসুদ
চুপ করতো, দিমু এক থাপ্পর!

ড্রাইভার
সবাই একটু হাত লাগাও।

সেলিম
গাড়ি ঠেলার কপাল নিয়া বাইর হইছি- ঠেলো। ঠেলার গাড়ি ঠেলতে ভালো-

সবাই
আরো জোরে-

সবাই
হেইও-

সাত্তার
গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে গাড়ি চলে না
চড়িয়া গাড়ি যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্যপথে ঠেকলো গাড়ি উপায় বুদ্ধি মিলে না

(হঠাৎ গাড়ি স্টার্ট নেয়। সবাই গাড়িতে উঠে পড়ে)

সবাই
গাড়ি চলছে!

মাসুদ
ধরো- আবার গানটা ধরো।

সাত্তার
মহাজন যত্ন করে পেট্রোল দিলো ট্যাংকি ভরে
গাড়ি চালায় মন ড্রাইভারে
ভালো মন্দ বুঝে না।
গাড়িতে প্যাসেঞ্জারে
অযথা গণ্ডগোল করে
হেন্ডিম্যান কন্ডাক্টরে
কেউর কথা কেউ শোনে না।
পার্সগুলা সব ক্ষয় হয়েছে
ডায়নামা  বিকল হয়েছে
লাইটগুলা ঠিক জ্বলে না।
ইঞ্জিনে ব্যতিক্রম করে
কন্ডিশন ভালো নয় রে
কখন জানি ব্রেক ফেইল করে
ঘটায় কোন দুর্ঘটনা।
আব্দুল করিম ভাবছে এবার
কন্ডেম গাড়ি কি করবো আর
সামনে বিষম অন্ধকার।

(হঠাৎ ব্রেক কষে থেমে যায় গাড়ি)

সাত্তার
আবার কী গণ্ডগোল!

হামাদি
সবাই নামো।

শুভ
ক্যান?

হামাদি
গাড়ি আর যাবে না।

শুভ
কী কও?

হামাদি
গাড়ি এখান থেকে ফেরৎ যাবে।

সেলিম
শালা তরে আমি খুন করুম-

(হঠাৎ ঘুষি মারে হামাদিকে, সবাই মিলে সেলিমকে সরিয়ে নেয়)

হামাদি
আমি আর পাল্টা ঘুষিটা দিলাম না, সহ্য করতে পারবে না। যা বলি মন দিয়ে শোনো- আমরা এখানে দুই একদিন
থেকে খোঁজ খবর নিয়ে বর্ডার পার হবো হেঁটে।

মাসুদ
এই বিরান মরুভূমির মধ্যে থাকতে হইবো?

(গাড়ি ফিরে যায়)

হামাদি
এইখানে পানি আছে, খেজুর গাছের ছায়া আছে, আর কী চাই? পায়খানা প্রস্রাব যা যা দরকার ইচ্ছে মতো সেরে নাও।

সাত্তার
ইয়ার্কি মারো পায়খানা প্রস্রাব হওয়ার মতো খাবার, পানি কোনোটাই দ্যাও নাই।

হামাদি
ঠিক আছে শুয়ে বসে থাকো।

সেলিম
উফ হাত পাও ছড়ায়া বসতে পারতেছি- এতক্ষণে মনে হইতেছে এই হাত পাওগুলা আমার নিজের।

মাসুদ
ঠিক- গাড়িতে বইসা থাকতে থাকতে হাড় মাংস সব ভর্তা হইয়া গ্যাছে।


শুভ
আমি শুইলাম-

মাসুদ
আমার একটা সিনেমার কথা মনে পড়তেছে।

হাবিব
সিনেমা এই মরুভূমির মধ্যে!

মাসুদ
হ্যাঁ, মরুতীর্থ হিঙলাজ।

শুভ
আমিও দেখছি, মরুভূমির ছবি।

মাসুদ
ছবিতে মরুভূমির কষ্ট, বিপদ আপদ দেখতে ভালোই লাগে। এহন বুঝতেছি মরুভূমি কী জিনিস! একটা দারুণ গান ছিল, এখন ক্যান জানি গানটার কথাই সত্য মনে হইতেছে। কত দূর আর কত দূর-

(মাসুদের গলা থেকে গানটা কেড়ে নেয় সাত্তার। সবাই কণ্ঠ মিলায়)

সাত্তার
কত দূর আর কত দূর।
পথের ক্লান্তি ভুলে
স্নেহভরা কোলে তব মাগো
বলো কবে শীতল হবো।
কত দূর আর কত দূর।

(গান চলতে থাকে। হঠাৎ মাথার উপর হেলিকাপ্টারের শব্দ শোনা যায়। সাথে সাথে অনেকগুলো গাড়ির আওয়াজ)

হামাদি
আমরা ধরা পড়ে গেছি।

হাবিব
ধরা পড়ে গেছি!

হামাদি
হ্যাঁ, কেউ কোনো কথা বলবে না।

নেপথ্য
(লাউড স্পিকারে) হল্ট। যে যে অবস্থায় আছো সেভাবেই থাকো, কেউ নড়বে না।

(মরক্কোর সৈনিকরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে)

সৈনিক ১    
কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কী কথা বলছো না কেন?

সৈনিক  ২
সবাইকে সার্চ করো।

সৈনিক  ৩
(সার্চ করে) না কিছু নাই।

সৈনিক  ২
পুলিশ স্টেশনে নিয়ে চলো।

(সবাইকে বন্দুক দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায়)

দৃশ্য- নয়

(হাজতখানার ভেতরে সবাই বন্দি। দু’জন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে)

সেলিম
শেষ পর্যন্ত বিদেশের হাজতে পইচা মরতে হইবো?

সাত্তার
আমি বন্দি কারাগারে- আমার কিন্তু ভালোই লাগতেছে। মাথার উপর ছাদ- খাবার পানি- মরুভূমির চাইতে ভালো। কইতে পারো বেহেশতেই আছি।

সেলিম
তোমার সবকিছুতেই ঠাট্টা ইয়ার্কি- মনে এত ফূর্তি আসে ক্যামনে?

সাত্তার
আসে না- আনতে হয়, বিপদের সময়ই মনটা তাজা রাখতে হয়, আমি বন্দি কারাগারে-

(গান ধরে)

পুলিশ ১
খামোশ হৈচৈ করবে না।

হাবিব
চুপ থাকতে কয়- কিন্তু ঐ ব্যাটা আব্দুল হামিদ কী করতেছে?

মাসুদ
মনে হয় কিছু একটা বার্গেনিং চলতেছে। পুলিশতো- দুনিয়ার সব পুলিশই এক। কতটাকা পর্যন্ত ঘুষ খায় না সেইটা হইলো জানবার বিষয়। আমি একটু ট্রাই কইরা দেখি!

(মাসুদ গার্ড দু’জনের কাছে এগিয়ে যায়। গার্ডরাও এগিয়ে আসে। মাসুদ কোনো কথা না বলেই পকেট হতে একটা ইউরোর নোট বের করে দেয় একজনের হাতে। তারপর ইশারায় হাতের মোবাইলটা চায়। দু’জনের মাঝে দর কষাকষি চলে। মাসুদ আরো কিছু ইউরো দেয়। এক পর্যায়ে মোবাইলটি তার হস্তগত হয়। সে দৌঁড়ে চলে আসে অন্যদের কাছে)

শুভ
এইটা একটা কাজের কাজ হইছে।

হাবিব
এক কাজ করো, সবার বাড়িতে এসএমএস কইরা দ্যাও, এই নাম্বারে ফোন করতে। আর জিতু সরকাররে ধরো।

সাত্তার
প্রায় দুই মাস বাড়ির কোনো খবর জানি না।

সেলিম
বউডারে রাইখা আসছিলাম যখন তখন অবস্থায়- এহন কী অবস্থা আল্লাই জানে।

সালাম
ছোট বইনডার বিয়ার কথাবার্তা চলতেছিল-

হাবিব
সবারই খবর নেওয়া দরকার।

মাসুদ
জিতুভাই হ্যালো হ্যালো-

জিতু
জিতু সরকার বলছি।

মাসুদ
জিতুভাই আমি মাসুদ আমরা মরক্কোর বর্ডারে ধরা পড়ছি- এহন মরক্কোর জেল হাজতে আছি- বড় বিপদে আছি-
আপনে আমগো বাঁচান।

জিতু
এমন কান্দাকাটি করতেছেন ক্যান? একট ধৈর্য ধরেন- সবুরে মেওয়া ফলে- চিন্তার কিছু নাই, আমি সব বেবস্থা করতেছি। চিনুয়ারে ফোন দিতেছি, সে আইসা ছাড়ায়া নিয়া যাইবো।

(ফোন কেটে দেয়)

মাসুদ
হ্যালো- লাইন কাইটা দিছে। শুয়রের বাচ্চা তরে একবার পাইয়া লই। (রিং বাজে) হ্যালো-

নেপথ্যে
সালাম কইতেছো?

মাসুদ
জ্বিনা আমি সালামের বন্ধু, সালামরে দিতেছি।

সালাম
হ্যালো-

নেপথ্যে
ক্যামন আছো বাবা?

সালাম
ভালো না। আমরা এহন মরক্কোর জেল হাজতে।

নেপথ্যে
কী কও!

সালাম
বাবা আপনে এক্ষুণি জিতু সরকাররে ধরেন।

নেপথ্যে
আচ্ছা- আমরা সবাই ভালো। আছিয়ারে তুইলা দিছি- যাওনের সময় তোমার লাইগা খুব কান্দাকাটি করতেছিল। আমি আজই জিতু সরকারের সাথে যোগাযোগ করতেছি। সাহস হারাইওনা দেখি কী হয়।

সালাম
খুব আদরের বইন, বিয়ার সময় থাকতেও পারলাম না খোঁজ খবরও নিতে পারলাম না।

(আবার ফোন বাজে)

মাসুদ
হ্যালো-

নেপথ্যে
সেলিম কেমন আছো?

মাসুদ
সেলিম ধরো।

সেলিম
বাবা আমি সেলিম- আগে শাহানার কী খবর কন।

নেপথ্যে
গত মাসের পনের তারিখ তোমার একটা মেয়ে হইছে।

সেলিম
আলহামদুলিল্লাহ!

নেপথ্যে
তোমার খবর কী?

সেলিম
ভালো না। মরক্কোর বর্ডারে ধরা পড়ছি। এহন কী হইবো জানি না। চিন্তা কইরেনা না। আপনে আল আরাবিয়ার সাথে
যোগাযোগ করেন, রাখি।

শুভ
যাক বহু দিন পর দুইটা ভালো খবর পাওয়া গেল।

হাবিব
সেলিম স্পেনে পৌঁছায়া পার্টি দিবা।

সেলিম
দিমু- গ্র্যান্ড পার্টি!

(হামাদিসহ একজন পুলিশ অফিসার আসে)

পুলিশ
সবাই ওঠো। যেখান থেকে এসেছিলে সেখানেই আবার পুশব্যাক করে দিচ্ছি। চলো-

(সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যায়)

দৃশ্য- দশ

(পাহাড়ি পথে হাঁটছে সবাই)

হামাদি
আমরা এসে গেছি।

শুভ
ঢেউয়ের গজর্নটাতো সাংঘাতিক!

হামাদি
একদল আমাদের আগেই এসে গেছে, ওরাও সেখানে যাবে।

সাত্তার
তাহলে শেষ পর্যন্ত স্পেনে যাইতেছি!

মাসুদ
তাইতো মনে হয়।

দাউদী
তোমরা কোত্থেকে?

হাবিব
বাংলাদেশ।

দাউদী
সবাই?

হাবিব
হ্যাঁ সবাই- তোমরা?

দাউদী
আমার নাম দাউদী, ঘানা থেকে এসেছি।

বেকেলে
আমি বেকেলে, ইথিউপিয়া থেকে।

গাব্বা
গাব্বা, সোমালিয়া।

শান্তাল
আমি শান্তাল, কঙ্গো থেকে।

গামিনি
গামিনি,  শ্রীলঙ্কা।

মাসুদ
পুরা এশিয়া আর আফ্রিকা!

হামাদি
জাহাজের কী অবস্থা হলো দেখে আসি।

সেলিম
বাপরে কী ঢেউ- এই সাগরের নাম কী?

দাউদী
আলবাহর আল আবিয়াদ আল মুতওয়াসসিদ।

সাত্তার
এত বড় নাম- এমুন নাম তো শুনি নাই।

বেকেলে
আরবি নাম, আসল নাম মার মেদিতারিয়ান।

হাবিব
মেডিটারিয়ান সি- ভূমধ্যসাগর। এই পাড়ে আফ্রিকা আর ঐ পাড়ে ইউরোপ।

সেলিম
বড় জাহাজ ছাড়াতো এই সাগর পাড়ি দেওন যাইবো না। আর যে ঠাণ্ডা, এই ঠাণ্ডাতেইতো রবফ হইয়া যামু!

(তীরে এসে ভিড়ে একটা মাছধরা নৌকা। নেমে আসে হামাদি ও একজন চালক)

হামাদি
সবাই উঠে পড়।

হাবিব
এই বুঝি তোমার জাহাজ- মিথ্যুক কোথাকার- এটাতো মাছধরার নৌকা।

হামাদি
সাগরে চলাচল করে- ইঞ্জিনে চলে। এর নাম ইদরিসা, নৌকার চালক। এখন থেকে তোমাদের সব দায়িত্ব ওর। আমার
ডিউটি এখানেই শেষ।

হাবিব
এত ছোট নৌকায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন? অসম্ভব যেতে পারবো না। তুমি বড় নৌকার ব্যবস্থা করো।

ইদরিসা
এর চেয়ে ভালো নৌকা হবে না।

হাবিব
তাহলে আমার যাবো না।

হামাদি
এখান থেকে ফেরা যায় না- হয় স্পেন না হয় মৃত্যু। আমার কথা শুনে লক্ষ¥ী ছেলের মতো উঠে পড়। ছয় থেকে আট
ঘণ্টার পথ- দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাবে। আল বিদা!

ইদরিসা
ভয়ের কিছু নাই আজকে সমুদ্র অনেক শান্ত, এখন বেলা তিনটা, দেরি না করে রওনা দিলে রাত বারটা নাগাদ স্পেনে পৌঁছে যাবো। রাতের বেলা যাওয়াটাই নিরাপদ।

সেলিম
আমি দ্যাশে ফিইরা যামু।

হাবিব
তা আর সম্ভব না, এত দূর যখন আসতে পারছি তখন শেষ না দেইখা ছাড়ছি না। চলো যা আছে কপালে!

(সবাই নৌকায় ওঠে আফ্রিকান দলে দু-তিনজন নারীও আছে)

জোমো
সবাই ভালো করে বসো। ভয় পেও না- আমি জোমো। এখন থেকে আমি আর ইদরিসা আছি তোমাদের দায়িত্বে। আশা করি রাত দশটায় ডিনার খাবো স্পেনে।

(জোমো দড়ি ধরে টান দিলে চালু হয় ইঞ্জিন। ভটভট শব্দে চলতে থাকে নৌকা)

সাত্তার
শেষ পর্যন্ত স্পেনে যাইতেছি- আমার বিশ্বাসই হইতেছে না!

সেলিম
ভালোয় ভালোয় পৌঁছাইলে স্পেন গিয়াই পার্টি দিমু।

বেকেলে
শালারা এমন একটা নৌকা জোগাড় করেছে যে, ঠিক মতো পা ছড়িয়ে বসতেও পারি না।

দাউদী
নৌকায় শুয়ে আরাম করতে এসেছো?

বেকেলে
তা আসিনি, কিন্তু ঠিক মতো বসতে তো দিবে না কি?

দাউদী
যা পেয়েছো তাই কপাল! এখন ভালোয় ভালোয় পৌঁছতে পারলে হয়।

শুভ
বাপরে কী ঠাণ্ডা বাতাস- সাত্তার, শরীর গরম করা দরকার- কিছু একটা ধরো।

সাত্তার
মাঝি বাইয়া যাওরে
অকূল দরিয়ার মাঝে
আমার ভাঙা নাও ও রে মাঝি-

শুভ
ধুর- এই গানেতো শরীর আরো তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হইয়া যাইবো, গরম কিছু একটা ধরো।

সাত্তার
তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
পাড়ি দিবরে            
আমরা ক’জন নবীন মাঝি
হাল ধরেছি শক্ত করে রে।
(সবাই কণ্ঠ মিলায়)
জীবন কাটে যুদ্ধ করি
প্রাণের মায়া সঙ্গে করি
জীবনের সাধ নাহি পাই
জানি শুধু চলতে হবে
এ তরী বাইতে হবে
আমি যে সাগর মাঝিরে-

(গানের মাঝে হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় গাব্বা চিৎকার করে উঠে)

গাব্বা
কী হলো?

সেলিম
থামলো ক্যান?

জোমো
ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে।

কয়েকজন
ইঞ্জিন বন্ধ!

গামিনি
এখন তাহলে কী হবে?

ইদরিসা
ঘাবড়ে যাচ্ছো কেনো? মাঝে মধ্যে এরকম একটু আধটু হয়ই- দেখছি।

দাউদী
বাতিটাও নিভে গেল- ঢেউয়ে নৌকা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝবে কী করে?

গাব্বা
আমার কাছে টর্চ আছে।

ইদরিসা
টর্চের আলোয় সাগরের কিছুই বোঝা যাবে না- ওটা বরং ইঞ্জিনে ধরো।

(সবাই ইঞ্জিনের উপর ঝুকে পড়ে)

সেলিম
ঘুটঘুটা আন্ধাইর!

গাব্বা
নিজের চেহারাটাও দেখ যায় না।

সালাম
মরুভূমিইতো ভালো আছিল।

সেলিম
হ- হাইটা চলফেরা করা যায়।

হাবিব
কোন দিকে যাইতেছি, কিছুই বোঝার উপায় নাই।

ইদরিসা
একটু ধৈর্য ধরো।

সাত্তার
ঢেউ বাড়তাছে- নৌকা ডুইবা যাইবো না তো?

সেলিম
লা ইলাহা ইল্লাা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নিকুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন- আল্লা তুই রহম কর।

গাব্বা
ও মাগো-

শান্তাল
যা হওয়ার তাই হবে- চিৎকার করে কোনো লাভ নাই। এই যে আমারে দেখছো একবার নৌকা ডুবির পরও বেঁচে আছি।

সেলিম
কী কও?

শান্তাল
হ্যাঁ সত্যি বলছি।

সেলিম
তোমরতো বেশ সাহস!

দাউদী
ঘটনাটা কী?

শান্তাল
আমরা ছিলাম ছয়জন- চারজন ছেলে, দু;জন মেয়ে। আমাদের দালাল যে নৌকাটা জোগাড় করে, তা খুব শক্ত-পোক্ত ছিল না। মিনিট বিশেক চলার পর ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা উল্টে যায়। আমি সাঁতার জানি না। কিন্তু কিছু একটা ধরেছিলাম বলে বেঁচে যাই। ছেলেরাও বেঁচে যায়। কিন্তু আমার সঙ্গী মেয়েটি মারা যায়। নৌকায় কোনো রেসকিউ ওয়েস্ট ছিল না। আমার সব কাগজপত্র সার্টিফিকেট ভেসে যায় সাগরে।

হাবিব
তারপর?

শান্তাল
তারপর? তারপর অনেক কষ্টে একটা মরোক্কান ফ্যামিলিতে কাজ পেলাম। ঘরবাড়ি ধোয়া মোছার কাজ। এখানে আমার কাজ করার কোনো অনুমতি ছিল না। কিনশাশায় আমি সেক্রেটারির কাজ করতাম। আমি একজন হাইস্কুল গ্রাজুয়েট- ধোয়া মোছার কাজ করে সপ্তাহে বেতন পেতাম পঁয়তাল্লিশ ইউরো। খুব কষ্টে চলতাম। সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে তোমাদের সাথে চলেছি।

সেলিম
দেশ ছাড়লে কেন?

শান্তাল
না ছেড়ে উপায় ছিল না- আমরা ছিলাম প্রেসিডেন্ট মবুতুর সমর্থক। বর্তমান প্রেসিডেন্ট কাবিলা ক্ষমতায় আসার পরপরই শুরু হয় আমাদের উপর নির্যাতন। কাবিলার লোকজন প্রকাশ্য রাজপথে মানুষ খুন করতে দ্বিধা করতো না। অবস্থাটা এমন হয়ে গেল যে, কঙ্গোতে বাস করাটাই কঠিন হয়ে গেল। একদিন দুপুরবেলা তারা বাড়ি থেকে আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল, সে আর ফিরে এলো না। অবস্থাটা এতই খারাপ হয়ে গেল যে, একটা এ্যাসপিরিন কেনার মতো পয়সাও ছিল না। বাধ্য হয়েই ঘর ছাড়ি।

গাব্বা
কঙ্গো থেকে মরক্কোতো অনেক দূর!

শান্তাল
হ্যাঁ- অনেক দূর- দু’বছরের বেশি সময় আমি পথে পথে! কঙ্গো থেকে সেন্ট্রাল আফ্রিকা, চাদ, নাইজার, আলজেরিয়া হয়ে মরক্কো পৌঁছেছি। পথে ধর্ষণের শিকারও হয়েছি একবার।

হাবিব
থাক আর শুনতে চাই না- আমাদের অবশ্য সে রকম অবস্থা হয়নি।

দাউদী
ইঞ্জিন কি ঠিক হবে?

জোমো
সকালের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।

বেকেলে
ও মাগো!

শান্তাল
কী হলো?

বেকেলে
পেট গোলাচ্ছে- মনে হয় বমি হবে।

শান্তাল
নাও- একটু পানি খাও- ঠিক হয়ে যাবে। ঐ যে শেষ রাতের চাঁদটা কুয়াশার ফাঁক দিয়ে একটু একটু দেখা যাচ্ছে।
(গাব্বা গান ধরে। অন্যরা কণ্ঠ মিলায়)

গাব্বা
হে ছোকড়া চাঁদ ও জোয়ান চাঁদ            
হে হে
খবর শোনাও একটা খবর শোনাও
একটা ছোট্ট খবরতো শোনাও ভাই
শোনাও ভাই।
যখন সূর্য উঠবে ভোরের আলো ফুটবে
তোমার সেই খবরটা বলতে হবে
হে হে
সূর্য উঠবে ভোরের আলো ফুটবে
তোমার সেই খবরটা বলতে হবে
কী জানতে চাই? আহা ব্যাস্ত কেন?
এখনই তা বলছি শোনো
সূর্য উঠবে যবে কানে কানে বলে যাবে
কেমন করে কিছু খেতে পাই
কিছু খেতে পাই হে.....
ছোকড়া চাঁদ জোয়ান চাঁদ।

(গান গাইতে গাইতে সবাই নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার একজন দু’জন করে জাগতে শুরু করে)

দাউদী
ইদরিসা?

ইদরিসা
কী?

দাউদী
সকাল তো হয়ে গেছে- এখনো জাহাজ, কোস্টগার্ডের পেট্রোল বোট, মাছ ধরার নৌকা কিছুইতো দেখলাম না-শুয়রের বাচ্চা- ছয় ঘণ্টার পথ ষোল ঘণ্টায়ও শেষ হয় না- নিশ্চয়ই দিক ভুল করেছিস- শালা তোকে আজ খুন করে ফেলবো।

(রেগে গিয়ে ঘুষি মারে। অন্যরা তাকে সামাল দেয়)

ইদরিসা
ভুলতো মানুষেরই হয়, আমি কি ইচ্ছে করে ভুল করেছি?

জোমো
একটা কথা বুঝতে চেষ্টা করো, তোমরা মারা গেলে কি আমরা বেঁচে থাকবো?

গাব্বা
খাবার পানি সব শেষ- শেষ পর্যন্ত কি না খেয়ে মরতে হবে?

দাউদী
পয়সাতো কম দেই নাই, একটা ভালো ইঞ্জিনওয়ালা নৌকা ঠিক করতে পারিস নাই? যদি কিছু হয় তাহলে বাপ দাদার নাম ভুলিয়ে দেব, শালা!

সেলিম
লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন।

শুভ
ভয় পাইছো?

সেলিম
ভয় না পাইয়া উপায় আছে? মনে হয় এই বুঝি ডুবলো।

গামিনি
দাঁড় বৈঠাওতো নাই, থাকলে দাঁড় টেনেই সাগর পাড়ি দিতাম।

বেকেলে
পাগলে কী কয়?

গামিনি
শ্রীলংকান নেভির তাড়া খেয়ে একবার এরকম অবস্থায় পড়েছিলাম- তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল রাইফেল দিয়ে দাঁড় বানিয়ে টেনেছি সারারাত।

গাব্বা
বলো কী!

গামিনি
মিথ্যে বলিনি- আমরা চৌদ্দজন রাইফেল দিয়ে দাঁড়ের মতো পানি কেটেছি। এই নৌকাতেও আমরা প্রায় পঞ্চাশজন, সবাই দাঁড় টানতে পারলে ঠিকই কিনারায় ভিড়তে পারতাম। একটা পাল খাটাবার ব্যবস্থা করতে পারলেও হতো- শ্রীলংকার জেলেরাতো এখনো পালের নৌকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়।

হাবিব
যুদ্ধ ফেলে ইউরোপ যাচ্ছো, পালাচ্ছো নাকি?

গামিনি
একজন মুক্তিযোদ্ধা বাঁচা অনিশ্চিত জেনেই যুদ্ধে আসে। ইউরোপ যাচ্ছি টাকা-পয়সা আর গোলা-বারুদের ব্যবস্থা করতে। বৈধ পথে পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, তাই-

সেলিম
ঐ যে দূরে কী যেন দেখা যায়।

বেকেলে
মনে হয় জাহাজ

(সবাই দেখার চেষ্টা করে)

দাউদী
জাহাজ,জাহাজ!

গাব্বা
সিগন্যাল দাও।

(সবাই যার যার গায়ের জামা জ্যাকেট খুলে সিগন্যাল দিতে থাকে। অনেকক্ষণ পর)

বেকেলে
নাহ- মনে হয় দেখে নাই।


দাউদী
এখনতো ওটাকেও দেখতে পাচ্ছি না- পানি আছে কারো কাছে? বুকটা শুকিয়ে গেছে।

হাবিব
যার কাছে যা ছিল সব শেষ।

সাত্তার
ঐ ব্যাটা জোমোর কাছে থাকতে পারে।

দাউদী
পানি বের কর শালা! নৌকা ছাড়বার আগে বেশি করে পানি নিতে পারিসনি?

জোমো
এখন পানি যা আছে, তাতে অর্ধেকেরও ঠোঁট ভিজবে না।

বেকেলে
বের কর।

শান্তাল
আমাকে একটু দিও।

জোমো
ইমার্জেন্সির জন্য রেখেছিলাম-

মাসুদ
ইমার্জেন্সির আর কী বাকি আছে- বের কর, নাইলে, দিলাম কিন্তু!

জোমো
দিচ্ছি।

(জোমো লুকানো বোতল বের করলে সবাই কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। এক সময় বোতলটা ছিটকে পড়ে। পানি গড়িয়ে পড়ে যায়)

জোমো
কী লাভ হলো!

(সবাই হতাশ হয়ে বসে পড়ে। কয়েকজন গড়িয়ে পড়া পানি চেটে খায়)

বেকেলে
পানির উপর ভাসছি- অথচ মুখে দেয়ার মতো এক ফোঁটা পানি নাই- প্রভু তুমি রক্ষা করো।

শান্তাল
রাতেরবেলা তবু ভালো ছিল, দিনের তাপে সব শুকিয়ে যাচ্ছে, কলজেটাও ফেটে যাচ্ছে।

গাব্বা
এখন কী হবে! পানি ছাড়া মরবো?

দাউদী
নিজ নিজ হিসু খাওয়া ছাড়াতো উপায় নেই!

গাব্বা
প্রয়োজনে তাই করতে হবে- তবে যাই করো সাগরের পানি খেও না, রক্তবমি হয়ে মারা যাবে।

(সবাই চুপ করে যায়। নেমে আসে অন্ধকার)

গাব্বা
টর্চটাও জ্বলছে না, ব্যাটারি শেষ।

সেলিম
আমার কাছে লাইটার আছে।

দাউদী
রেখে দাও, জরুরি না হলে জ্বালাবে না।

শুভ
ভাইজান ও ভাইজান গাড়ি ছাড়তে আর কত দেরি? শেষে সময় মতো পৌঁছতে পারবো না।

হাবিব
শুভ এই শুভ কী হলো?

শুভ
দেরি হলে মা রাগ করবে- তোমরা তাড়াতাড়ি করো।

সাত্তার
প্রলাপ বকতেছে।

হাবিব
সেলিম লাইটার জ্বালাও- কারো কাছে একটু পানি হবে পানি?

(কারো কোনো সাড়া পাওয়া যায় না)

মাসুদ
লক্ষণ খারাপ- হার্টবিট পাইতেছি না- মনে হয় সময় শেষ- যদি একটু পানি দিতে পারতাম-

হাবিব
শুভ- এই শুভ!

(হাবিবের কোলে ঢলে পড়ে)

সেলিম
ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজেউন- শ্যাষ, সব শ্যাষ।

(হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে)

মাসুদ
(দাউদীর উপর চড়াও হয়) হারামীর বাচ্চা, তোর জন্যে পানিটা পইড়া গেল- নাহলে শুভরে বাঁচাইতে পারতাম-

শান্তাল
এই তোমরা কী শুরু করেছো?

(সবাই দুজনকে সরিয়ে দেয়)

বেকেলে
সবাই মরবে- কেউ বাঁচবে না- কেউ না- শুরু হলো মৃত্যুর মিছিল- লাশটা ফেলে দাও।

হাবিব
না।

বেকেলে
পঁচে গেলে গন্ধ ছড়াবে।

দাউদী
লাশ পাশে নিয়ে ঘুমাতে পারবো না।

মাসুদ
তুমি আর কোনো কথা বলবে না।

সেলিম
তীরে পৌঁছায়া কবর দিব মাটিতে। যতক্ষণ বাঁইচা আছি লাশ এইখানেই থাকবো।

বেকেলে
না থাকবে না।

(লাশ ধরে টান দিতেই মাসুদ, সেলিম, সাত্তার সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাবিব, শান্তাল দু’জনে মিলে অনেক কষ্টে সবাইকে থামায়)

সাত্তার
সাবধান কইরা দিলাম- লাশের গায়ে হাত দিবি না।

হাবিব
একজন একজন করে সবাই যাবে, আগামী দু-একদিনের মধ্যেই সবাই যাবে।

গামিনি
ততক্ষণ সম্পূর্ণ বেঁচে থাকতে চাই। বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করে যেতে চাই। জানি মৃত্যু কাউকে ক্ষমা করে না।

হাবিব
হ্যাঁ- মৃত্যুর কাছে সাদাকালো সবাই সমান। আমরা সবাই একই নৌকার যাত্রী- উই আর ইন দ্যা সেম বোট ব্রাদার।

গাব্বা
We are in the same boat brother
We are in the same boat brother

সাত্তার
মোরা যাত্রী একই তরণীর
সহযাত্রী একই তরণীর।

গাব্বা
And if you shake one end
You gonna rock the other
In the same boat brother
We are in the same boat brother

সাত্তার
মোরা যাত্রী একই তরণীর
সহযাত্রী একই তরণীর
যদি সংঘাত হয় তবে ধ্বংস হবে
গর্ব মোদের প্রগতির।

(ক্লান্তিতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হয়ে আসে কিমাথী রাতে মারা যাওয়া দু-তিনজনের লাশ উল্টে পাল্টে দেখে)

কিমাথী
আরো তিনজন গেল- ঈশ্বর আজ পাঁচদিন, খাদ্য নেই, পানি নেই। লাশের পাশে শুয়ে আছি, নড়বার শক্তিটুকু নেই-আমি মরতে চাইনা- বাঁচতে চাই- বাঁচার জন্য যা করতে হয় তাই করবো। শুনেছি আমার পূর্বপুরুষরা নরমাংসভুক ছিলেন- প্রয়োজনে আমিও তাই হবো।

(কিমাথী তার পকেট থেকে একটা চাকু বের করে একটা মৃতদেহ থেকে খানিকটা মাংস কেটে নেয়। তারপর মুখের সামনে তুলে ধরে)

কিমাথী
ঈশ্বর তুই ক্ষমা করে দিস! লোপ পেয়েছে আমাদের সব মানবিক মূল্যবোধ- আমারা এখন বমি খাই, থুথু খাই, নিজ নিজ পেশাব খাই, মৃত বন্ধুর গায়ের মাংস কেটে খাই।

দাউদী
কী খাচ্ছো কিমাথী?

কিমাথী
কিচ্ছু না। (মাংসের টুকরাটা ফেলে দেয় পানিতে) পারলাম না- ঈশ্বর ক্ষমা করে দিস!

(গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে একজন আফ্রিকান ঢলে পড়ে। দাউদী পরীক্ষা করে দেখে)

দাউদী
আরেকজন- ঈশ্বর তুমি শান্তি দাও।

(জেগে ওঠে সেলিম)

সেলিম
(শান্তালকে জড়িয়ে ধরে) বুবুগো, আমার মেয়েডা বাপের মুখ না দেইখাই এতিম হইয়া গেল- মাগো তর মুখটা বুঝি আর দেখবার পারলাম না!

শান্তাল
আশা রাখো ভাই- তুমি এখনো বেঁচে আছো।

দাউদী
(একটা লাশের মুখ দেখে) বন্ধু তুইও চলে গেলি- আরো পাঁচজন চলে গেলো! সবাই একটু ধরো। (কয়েকজনে ধরাধরি করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়) ঈশ্বর শান্তি দাও- যারা চলে গেল তাদের ক্ষমা করে দিও। শান্তি দাও তাদের- যারা এখনো মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছি।

জোমো
আমার হাত পা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। (দু’জনে তার গা হাত পা ডলতে শুরু করে) এবার তীরে ভিড়তে পারলে আর ফিরবো না। তোমাদের সাথে স্পেন চলে যাবো। শেষ পর্যন্ত সাদাদের দেশেই মরতে হবে।

দাউদী
চুপ করে থাকো- কথা বলো না।

জোমো
কী অদ্ভুত! এখন থেকে দুশ বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়েছিলো মানুষ ধরার দল- এই ভূমধ্যসাগর দিয়ে। আর আজ আমি নিজেই মানুষ পাচার করছি- নিজেও পাচার হয়ে যাচ্ছি শ্রম বিক্রি করতে।

মাসুদ
(গোঁ গোঁ শব্দ শুনে এগিয়ে যায়) কবির- এই কবির!

কবির
একটু পানি-

হাবিব
পানি কই পাই- হায় আল্লাহ!

সেলিম
(গায়ে হাত দিয়ে) ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজেউন।

গামিনি
মৃত্যু এসে এভাবে একজন একজন করে নিয়ে যাবে, আমরা কিছুই করতে পারবো না? আমরা বাঁচবো- আমাদের বাঁচতে হবে।

শান্তাল
বাঁচার জন্য শক্তি চাই।

হাবিব
শক্তি- কোথায় পাবো?
শক্তি সিন্ধু মাঝে রহি শক্তি পেল না যে
মরিবার বহু পূর্বে জানিও মরিয়া গিয়াছে সে
মৃত্যুর আগে মরতে চাই না- হে ভূমধ্যসাগর তুমি আমাদের শক্তি দাও- আমাদের শক্তি দাও যেন আগুন পাখির মতো, ভস্মস্তুপের ভেতর থেকে জেগে উঠতে পারি।

দাউদী
বাঁচবো না হয় মরবো- এসো বৈঠার জোগাড় করি।

(লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনের উপরের কাঠের ছাউনী ভেঙ্গে বৈঠার মতো বানিয়ে নেয় কয়েকজন। অন্যরা পায়ের জুতা স্যান্ডেল খুলে বৈঠার মতো পানি কাটতে থাকে)

গাব্বা
We are in the same boat brother.

সাত্তার
মোরা যাত্রী একই তরণীর।

গাব্বা
The lord looked down from his holy place
Said lawd duh me what a sea of space.

সাত্তার
প্রভু চোখ মেলে চাও
দেখ স্বর্গ হতে-
হে মহাপ্রভু, কী শূন্য সাগর।

গাব্বা
What a spot to launch the human race!

সাত্তার
এই তরী পৃথিবীর
সারা মানবজাতির।

গাব্বা
So he built him a boat for a mixed up crews
With eyes of black and brown and blue
S that’s how’s come that you and I
Got just one world and just one Sky.

সাত্তার
তাই ঈশ্বর গড়ে দিল মিলনের নৌকো
চোখ কারো কালো কারো নীল কারো পিঙ্গল
তাইতো দেখি তোমার আমার একই আকাশ একই ধরণীর।

সবাই
We are in the same boat brother.

শান্তাল
লাইট! লাইট! ঐ যে লাইট দেখা যায়।

গাব্বা
হ্যাঁ- মনে হয় এদিকেই আসছে।

সাত্তার
হ্যাঁ- এই দিকেই-

(দূরে সার্চলাইটের ঝলকানি দেখা যায়। সবাই দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকে। দু-তিন জন মৃতদের কাপড় দিয়ে মশাল বানিয়ে জ্বালায়। কিছুক্ষণ পর আলো আর দেখা যায় না। সবাই আবার হতাশায় নিমজ্জিত হয়)

দাউদী
আর আশা নাই!

গামিনি
হাল ছেড়ে দিলে চলবে না- শেষ পর্যন্ত আশা বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

হাবিব
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সানমশশান্ত¦না
সহিতে পারি এমন যেন হয়।

(আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে ভোর হয়)

শান্তাল
আরো একদিন গেল- কী আশ্চর্য এখনো বেঁচে আছি!

দাউদী
হ্যাঁ-কিন্তু লাশগুলো পঁচতে শুরু করেছে, গন্ধ ছড়াচ্ছে-এগুলো ভাসিয়ে না দিলে জীবিতরাও দ্রুত মরবে।

মাসুদ
হ্যাঁ- এখন আর সহ্য করা যাইতেছে না।

হাবিব
তীরের দেখা কখন পাবো তাও জানি না। লাশ আর রাখা সম্ভব না। তার চাইতে আল্লার নাম নিয়া সাগরে ভাসিয়ে দেই। (সবাই মিলে দোয়া দরূদ পড়ে এক এক করে লাশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেয়) মরে গেলে লাশ, জীবিত থাকলে মানুষ! শুভ, কবির, নুরুল ইসলাম, সিদ্দিক, ইরাসতো, ইনিকো, সর্বশেষে হাঙ্গরের খাদ্য- খাদ্য শৃক্সক্ষলের কী অদ্ভুত চিত্র!

গামিনি
আসো আবার বৈঠা ধরি।

(সবাই এসে আগের মতো বৈঠা চালাতে থাকে)

গাব্বা
ঐ যে দূরে আলো দেখা যায়।

দাউদী
মনে হয় কোনো বন্দর। ইদরিসা-

ইদরিসা
কী?

দাউদী
ঐ আলো কোন জায়গার?

ইদরিসা
আমি দিক ভুলে গেছি- আলজেরিয়া না মরক্কো বলতে পারছি না।

গাব্বা
স্পেন না ইতালি?

ইদরিসা
তাও বলতে পারবো না।

হাবিব
যে জায়গাই হোক তুমি ঐ দিকে হাল ধরে থাকো।

ইদরিসা
আচ্ছা- জোমো আলোটা কোনদিক থেকে আসছে রে? জোমো- জোমো- কথা বলছিস না কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিস হারামজাদা?

শান্তাল
জোমো কী ব্যাপার? (চিৎকার করে ওঠে) জোমো মরে গেছে-

দাউদী
তোমাকে আর সাদাদের দেশে মরতে হলো না জোমো- ভূমধ্যসাগর তোমাকে গ্রহণ করেছে।

(জোমোকে ভাসিয়ে দেয় সাগরে)

গামিনি
বৈঠা ধরো- মাঝি একজন কমে গেল।

গাব্বা
(গান ধরে)
We are in the same boat brother.

(আস্তে আস্তে কণ্ঠগুলো নিস্তেজ হয়ে এলে হঠাৎ শুরু হয় বৃষ্টি। বহুদিন পরে সবাই যেন প্রাণ ফিরে পায়)

সাত্তার
আয়- আরো জোরে আয়।

হাবিব
যে যেভাবে পারো পানি খাও আর জমা করো।

(রাতের অন্ধকার কেটে ভোর হয়ে এলে, দেখা যায় নিঃসাড় হয়ে সবাই শুয়ে আছে নানা জায়গায়। একজন দুজন করে নড়াচড়া করে উঠে বসে)

গাব্বা
ইদরিসা-এই ইদরিসা- কি হলো ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি? ইদরিসা-মরে গেল নাতো? ইদরিসা-

ইদরিসা
শরীর আর চলছে না- রাতের বৃষ্টির পানিতে জানটা এখনো টিকে আছে।

হাবিব
আমরা ঠিক পথে আছিতো?

ইদারিসা
বলতে পারবো না ভাই, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

দাউদী
তোর এত ঘুম আসে কোত্থেকে?

ইদরিসা
ঠিকই বলেছো, আমার ঘুম আসে কী করে? এতগুলো মানুষ মারা গেল শুধু আমার ভুলে। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। এখনো কেনো বেঁচে আছি? আমি আর বাঁচতে চাই না-

(হাল ছেড়ে দিয়ে সাগরে ঝাঁপ দিতে গেলে তাকে ধরে ফেলে গামিনি)

গামিনি
মরবার অধিকারও তোমার নাই। শেষ মানুষটি জীবিত থাকা পর্যন্ত তুমি হাল ছাড়তে পারবে না।

(সবাই লাশগুলো পাশাপাশি এনে রাখে। মৃত সেলিমের পাশে বসে হাবিব)

হাবিব
সেলিম- ভাইরে, তোর জন্য আমার বেশি কষ্ট। মেয়ের মুখটা আর দেখা হইলো না- যদি বাঁইচা থাকি আর দেশে ফিইরা যাই- তাহলে তোর মেয়ের সাথে দেখা কইরা তোর কথা বলবো।

গাব্বা
লাশগুলো আর রেখে কী লাভ! চলো সাগরে ভাসিয়ে দেই।

(লাশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেয়)

হাবিব
কী অদ্ভুত মিল! অনেক আগে একটা ছবি দেখেছিলাম- দাস ব্যবসায়ী জলদস্যুরা মাদাগাস্কার থেকে দাস বোঝাই করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে চলেছে আমেরিকায়। জাহাজে দেখা দিলে গুটি বসন্ত- শুরু হলো মড়ক- প্রতিদিন মারা যেতে লাগলো চার পাঁচজন করে- খালাসিরা তাদের ঠ্যাং ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিতো সাগরে।

গামিনি
পার্থক্য শুধু ওদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আর আমরা যাচ্ছি নিজেদের উদ্যোগে।

দাউদী
মূল উদ্দেশ্য একটাই- শ্রম বিক্রি! দাসত্ব! বাদ দাও ওসব- তারচে চলো আবার হাত লাগাই- রাতের বৃষ্টিটা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

ইদরিসা
(হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে) সব দোষ আমার, আমি পাপী এতগুলো মানুষ মারা গেল শুধু আমার দোষে। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই।

(কেউ কিছু বোঝবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সাগরে)

শান্তাল
সবশেষ!

দাউদী
আর কোনো আশা রইলো না- মাঝি নেই, এই বিশাল সাগরে কে ধরবে হাল?

গামিনি
এবার সত্যি সত্যিই সব আশা শেষ।

হাবিব
না- আশা শেষ হয় না- নদীর দেশের মানুষ, হাল ধরতে জানি।

(হাবিব হাল ধরে বসে। গামিনি ও দাউদী অন্যদের নিয়ে আবার বৈঠা ধরে। গান গেয়ে ওঠে সাত্তার)

সাত্তার
আমরা ক’জন নবীন মাঝি
হাল ধরেছি শক্ত করেরে
তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
পাড়ি দিবরে...

(দূরে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনা যায়। আওয়াজ কাছে আসতে থাকে। সবাই উৎকর্ণ হয়ে চারদিকে তাকায়)

মাসুদ
ঐ যে হেলিকপ্টার- সিগন্যাল দেও।

(সবাই সিগন্যাল দিতে থাকে। কিছুক্ষণ উড়াউড়ি করে হেলিকপ্টারটি চলে যায়। এবার সবাই ভেঙ্গে পড়ে)

সাত্তার
এতগুলা মানুষের সিগন্যাল চোখে পড়লো না- আর আশা নাই।

হাবিব
যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণই আশা আছে- আমার খালি ইদরিসার কথা মনে পড়ছে।

মাসুদ
ক্যান?

হাবিব
একজন সাধারণ মাঝি সবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে সাগরে ঝাঁপ দিলো।

মাসুদ
কিন্তু জিতু সরকারদের এজন্য একটুও অনুশোচনা হবে না।

হাবিব
না হবে না।

গামিনি
আসো সবাই আরেকবার বৈঠা ধরি।

দাউদী
কোনো লাভ নাই- ঝিনুক দিয়ে সাগর সেঁচা যায় না।

গামিনি
তবু চেষ্টা করতে দোষ কী?

গাব্বা
শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নাই- এখন যদি কোনো যাদুমন্ত্রে রক্ষা পাই- আজ কয়দিন তাও বলতে পারবো না-অবাক লাগছে এখনো বেঁচে আছি!

বেকেলে
একটা কথা দু’দিন ধরে মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে, বলতে সাহস পাচ্ছি না।

দাউদী
কী এমন কথা?

বেকেলে
সমুদ্র দেবতা-

শান্তাল
সমুদ্র দেবতা? কী বলতে চাচ্ছো?

বেকেলে
এটা নিশ্চই সমুদ্র দেবতার অভিশাপ।

শান্তাল
কী করে বুঝলে?

বেকেলে
তা না হলে এরকম হবে কেন? এরকম অথৈ সাগরে ভাসবো কেন?

শান্তাল
এখন তাহলে কী করতে হবে?

বেকেলে
পূজো দিয়ে কোনো প্রাণ উৎসর্গ করে তাকে খুশি করতে হবে।

শান্তাল
তোমার কথা বুঝলাম না।

বেকেলে
প্রাণের বদলে প্রাণ!

গাব্বা
কী বলতে চাও তুমি?

বেকেলে
জীবিত কোনো প্রাণ সমুদ্রে বিসর্জন দিতে হবে।

হাবিব
তুমি এসব কী বলছো? এখানে তো মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী নেই। তাহলে-

বেকেলে
হ্যাঁ তাই! লটারি হবে। লটারিতে যার নাম উঠবে তাকেই-

দাউদী
আর একটা কথাও না- লটারিতে তোমার নামই উঠেছে।

(দাউদী আর গাব্বা বেকেলেকে চ্যাং দোলা করে তুলে ধরে)

গামিনি    
কী করছো? থামো থামো!

দাউদী    
চুপ করে বসে থাকো, আরেকবার বলেছো কী তোমাকেই বিসর্জন দেব।

শান্তাল    
উহ্ মাগো- আরতো পারি না, হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

(হাবিব একটা বোতল থেকে একটু বৃষ্টির পানি তার মুখে ঢালে। শান্তাল পানি গিলতে পারে না। একটা ঝাঁকুিন দিয়ে নিস্তেজ হয়ে যায় সে)

গাব্বা
দিদি মনি, তুমিও চলে গেলে।

(সবাই ধরাধরি করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়)

হাবিব
এখন আমাদের শুধু একটাই কাজ।

দাউদী
কী?

হাবিব
শক্তি খরচ না করে মৃত্যু কিম্বা উদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করা। নৌকার হাল ধরতে শিখেছি বাবার কাছে- আমার হাতে হাল তুলে দিয়ে বলেছিলেন- যত ঢেউ আর ঝড় তুফানই হোক না কেনো শক্ত করে হাল ধরতে পারলে নৌকা তীরে ভিড়বেই।

গামিনি
ঐ যে দূরে কী যেন দেখা যায়!

(সবাই নড়ে চড়ে দেখার চেষ্টা করে)

মাসুদ
মনে হয় পেট্রোল বোট-

সাত্তার
ঐ দিকেই তীর হতে পারে-

গাব্বা
কালো কালো কী যেন দেখা যায়-

গামিনি
মনে হচ্ছে কোনো বন্দর¬-

বেকেলে
পেট্রোল বোটটা মনে হয় এইদিকে আসছে-

দাউদী
অন্যদিকে চলে যাচ্ছে মনে হয়-

হাবিব
চিন্তা নাই- এদিকে আসুক না আসুক তীরের দেখা পেয়ে গেছি- বেঁচে থাকলে একসময় তীরে পৌঁছবই।

গামিনি
এদিকেই মনে হয় আসছে- সিগন্যাল দাও।

(সবাই জামা কাপড় খুলে সিগন্যাল দিতে থাকে)

দাউদী
শুধু প্রার্থনা করো সমুদ্র যেন আর উত্তাল না হয়।

সবাই
প্রার্থনা করি-

হাবিব
পথ হারা যাত্রীরা খুঁজে পাক পথের দিশা।

সবাই
প্রার্থনা করি-

হাবিব
যাযাবর পাখিরা খুঁজে পাক তাদের অভয়াশ্রম।

সবাই
প্রার্থনা করি-

দাউদী
পৃথিবীর দেশে দেশে উদ্ধাস্তু মানুষেরা খুঁজে পাক নিরাপদ আবাস।

সবাই
প্রার্থনা করি-

দাউদী
আফ্রিকার যুদ্ধ আর খরাগ্রস্তরা খুঁজে পাক বাঁচার আশ্বাস।

সবাই
প্রার্থনা করি-

গামিনি
পৃথিবীর তাবৎ সংগ্রামী মানুষ খুঁজে পাক সংগ্রামে শক্তি ও সাহস।
    
সবাই
প্রার্থনা করি-

গামিনি
ভাগ্য বিড়ম্বিত অন্যায় যুদ্ধে পর্যদুস্ত মানুষ জয়ী হোক তার যুদ্ধে।

সবাই
প্রার্থনা করি-

হাবিব
সকল নারী ও শিশুরা পাক দুঃশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন।

সবাই
প্রার্থনা করি-

হাবিব
সুখি হোক জগতের সকল প্রাণী।

সবাই
প্রার্থনা করি-

(মন্ত্রের মত উচ্চারিত হতে থাকে তাদের প্রার্থনা)

আব্দুল্লাহেল মাহমুদ: নাট্যকার। সদস্য- আরণ্যক নাট্যদল